Moumita Ghosh

Horror

4  

Moumita Ghosh

Horror

প্রায়শ্চিত্ত// মৌমিতা ঘোষ

প্রায়শ্চিত্ত// মৌমিতা ঘোষ

7 mins
2.0K


"ও আমার গায়ে তোমার গন্ধ পায়। "

"কী বলছো তুমি ?এ ও কি সম্ভব?"

"তুমি জানোনা অনিমেষ, আমার শরীরে তোমার একটা বুনো গন্ধ লেপ্টে থাকে। আমিও পাই সেটা। ও তো পাবেই।"

 "তোমার শরীরে কী করে পায় ও গন্ধ? ও কি তোমাকে ছোঁয় নাকি?"

 "না। আবার হ্যাঁ ও।"

 "আজও তুমি ওকে এড়াতে পারলে না। এত মাস হয়ে গেল।"

"ওকে অতিক্রম করার সাধ্য কোথায় আমার?"

"তুমি ভুল বুঝছো অনিমেষ । আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু সৌগত আমার স্বামী, আমার পনেরো বছরের অভ্যাস। তাকে কী করে পার করে ফেলব? এতটা সহজ নাকি? আজকাল ও যেন কী একটা খোঁজে আমার শরীরে। কী যেন বলতে চায়। ওর কথা না বলা চোখের কষ্টটা ছুঁয়ে যায়।"

"ধুর ,যত তোমার মনের কল্পনা। এতবছর কিছু বুঝলো না, হঠাৎ তুমি ওর চোখে কষ্ট দেখতে পেতে শুরু করলে। আর ও এত দেখতে পাচ্ছ কী করে বলতো? যত্তসব।"

অরুনিমা চুপ করে তাকিয়ে থাকে জানালার কাচের বাইরে। গাড়ির উইন্ড স্ক্রিনে বৃষ্টি ঝাঁপিয়ে পড়ে হঠাৎই। অরুনিমা দমকে দমকে কেঁদে ওঠে। অনিমেষ ওকে বাড়ি পৌঁছে গাড়ির মুখ ঘোরায়।

ঘরের মধ্যে বিছানার এক দিকের দেওয়ালে বেশকিছু আর্টিফিশিয়াল ফার্ণ লাগানো। বেডরুম থেকে ড্রয়িং রুম নানারকম পাতাবাহার ও অর্কিডে সাজানো। কিছু তারমধ্যে আসল ও কিছু আর্টিফিশিয়াল। এই ঘরটা বড় যত্ন করে সাজিয়ে ছিল সৌগত। ও আসলে বরাবরই সংসারী ঘরোয়া টাইপ। আর অরুণিমা খোলা হাওয়ার মত, মেলে দেওয়া পালের মত। তাই কি সৌগতর এত সন্দেহ? সন্দেহ ক'রে ক'রে সুস্থ সম্পর্কটাকেই হারিয়ে ফেলল? অরুনিমা রান্নাবান্না সারে। চিংড়ি মাছের মালাইকারি বসাতেই সৌগত যেন গন্ধ পেয়ে চলে এলো। পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ওকে। "উফ্" বলে ছাড়িয়ে নিলো অরুনিমা নিজেকে। "এখন আর এত ন্যাকামি করে কি হবে? যখন দরকার ছিল তখন তো আর করোনি! জ্বালিয়ো না।"

সৌগত মুখটা যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেলোো। "তুমি কী ভেবেছো এত সহজে ছেড়ে যাবো তোমাকে আমি? আর তোমার শরীরে ফুল ফোটাবে অন্য কেউ? একদিন এ বাড়িতে যদি সে আসে ,তার রক্ষা নেই। কেউ বাঁচাতে পারবে না তাকে, কেউ না" - সৌগত চলে গেল। কেমন একটা ভয় গ্রাস করতে লাগল অরুণিমাকে। সত্যিই কি ও অনিমেষের ক্ষতি করবে? কোনদিনই কি অনিমেষকে ও নিজের করে পাবে না? না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে অরুণিমা। ঘুমের ঘোরে হঠাৎ টের পায় কে কাঠি কাঠি আঙুলে ওর শরীরে হাত বুলাচ্ছে। গলা শুকিয়ে আসে অরুনিমার। মনে হয় ওই কাঠি কাঠি আঙ্গুল যে কোন সময় গলা টিপে ওর শ্বাসরুদ্ধ করে দেবে। সৌগত আবার এসেছে। দাঁতে দাঁত চিপে চোখ বুজে ঘুমের ভান করে ও। একটা হিমশীতল নাক ওর বুকে ঠেকিয়ে বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে ছায়ামূর্তিটা। অনিমেষের গন্ধটা পাচ্ছে বোধহয়। ফিসফিস করে শ্বাস ফেলছে সৌগতর ছায়া। ধীরে ধীরে গর্ গর্ করে একটা আওয়াজ আসছে এখন ওর গলা থেকে। কী ভীষণ, উফ। একটা হিম শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে অরুনিমার শিরদাঁড়া বেয়ে। সৌগত আলতো করে ওর ঠোঁটে চুমু খেয়ে ঘর জুড়ে বিশ্রী শব্দে খিল খিল করে হেসে উঠল। "মনে রেখো, যার গন্ধ তোমার গায়ে তার নিস্তার নেই।"

সৌগত চলে গেছে। প্রচন্ড ভয় পেয়ে বিছানায় উঠে বসেছে অরুনিমা। ফোন করে অনিমেষকে। 

"অনিমেষ ও তোমাকে ছাড়বে না। তুমি চলে যাও আমাকে ছেড়ে। প্লিজ। কোন বড় বিপদ হওয়ার আগে চলে যাও।"


"তোমার এই রাত-দিনের হ্যালুসিনেশনের থেকে তুমি বেরোও অরুনিমা। আমার অসহ্য লাগছে। সৌগত মরে ভূত হয়ে গেছে কবে। আর আর তুমি এখনো ওর সঙ্গে ঘর সংসার করছো!"

নিজের কানে একটু লাগলো কথাটা সৌগত মরে ভূত হয়ে গেছে কবে!

অরুনিমা বলল, "আর কোনদিন তোমার সাথে আমি দেখা করবো না অনিমেষ। আমাদের সম্পর্ক এখানেই শেষ। বাই।"

ফোন রাখল অরুনিমা।

বালিশ বুকে করে অনেকক্ষণ কাঁদলো। দেওয়ালে দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো সে কান্না। অরুনিমা হঠাৎ অনুভব করল আরো কে যেন কাঁদছে। দুজনেরই কান্না এ দেওয়াল থেকে ও দেওয়াল আছড়ে পড়তে লাগলো। জ্ঞান যখন ফিরল, দেখলো, সারাঘর ওলট-পালট। রান্না ঘরের থেকে রান্নার জল ধরে রাখা হয় যে ডেকচিতে সেটাকে কে যেন এনে আছড়ে ফেলেছে বেডরুমের মেঝেতে। সেই জল গড়িয়ে এসে অরুণিমার চুল ব্লাউজ সব ভিজে গেছে। বিছানার চাদর টাকে গড়িয়ে যাওয়া জলের উপরে ফেলেছে কেউ। অথচ দরজা বন্ধ ভিতর থেকেই। অরুনিমা বুঝলো কার কাজ। সৌগত মারা গেছে তিন বছর হল। কিন্তু আজও ফিরে ফিরে আসে বারবার। শুধু ওর ডেথ সার্টিফিকেটেই ও নেই। অরুণিমার সংসারে সৌগত একইরকমভাবে আছে। ওর ভালবাসায়, ওর হিংস্রতায়, ওর ঘর গোছানোতেও। এইজন্যেই জল গড়িয়ে আলমারির তলায় ঢুকে যাবে এটা সৌগত সহ্য হয়নি। চাদর ফেলে আটকেছে। সৌগত ঘরোয়া হলেও অসম্ভব মদ্যাসক্তি ছিল। আর মদ খেলে ওর মনের মধ্যে খেলা করা অজস্র সাপ ফণা তুলে উঠতো। প্রতিটি নিঃশ্বাসে তারা উগরে দিত সন্দেহের বিষ। অকারণ সন্দেহ দুটো মানুষকে কত ভয়ংকর জায়গায় নিয়ে যেতে পারে তা অরুনিমার দেখা। অথচ ভালোবাসতো মানুষটা ওকে। কী খেতে ভালোবাসে, কোন রঙের শাড়িতে ওকে মানাবে সব দিকে নজর রাখত। কিন্তু অন্য কেউ প্রশংসা করলে সহ্য করতে পারত না। অরুণিমার প্রমোশন হয়েছিল বলে একবার গরম ইস্ত্রি হাতের ওপরে চেপে ধরেছিল। বিশ্রী পোড়া দাগটা এখনো আছে । সৌগত অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলে অরুনিমা যেন এই অত্যাচার থেকে হাঁফ ছেড়ে বেচে ছিল। সুখের চেয়েও ওকে আচ্ছন্ন করেছিল এক স্বস্তি।

কিন্তু সৌগত মারা গিয়েও এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও গেল না। প্রথম প্রথম খুব ভয় লাগলেও এখন কিরকম গা সওয়া হয়ে গেছে অরুনিমার। তবে রাতে ওর শরীরের উপরে ঝুঁকে পড়াটাতে অরুণিমা কিছুতেই নির্লিপ্ত থাকতে পারেনা। ভয়ে দিনদিন ক্লিষ্ট হচ্ছে অরুণিমার শরীর। একমাত্র আশ্রয় অনিমেষের আদর টুকু। কিন্তু ওর শান্তি সইবে কেন সৌগতর? মরে গিয়েও সন্দেহ করেই চলেছে। পার্থক্য এটাই, এখন আর সন্দেহটা অমূলক নয়। আজ সারাদিন অরুনিমা বেরোয়নি কোথাও। খুব জ্বর গায়ে। ফোন বেজেছে বহুবার। কিন্তু অনিমেষের ফোন ও আর ধরবে না। সারাদিন ওঠার ক্ষমতা ছিলনা অরুনিমার। রান্নাবান্না কিছুই হয়নি, খাওয়াও হয়নি। জ্বরে অচৈতন্য অবস্থায় হঠাৎ অনুভব করল মাথায় একটা ঠান্ডা আরাম। কে যেন জলপট্টি দিচ্ছে ওকে। চোখ খুলে সৌগত কে দেখতে পেল না কোথাও। অথচ পাশে বাটিতে ফ্রিজের ঠান্ডা জল রাখা, আর কপালে জলপট্টি। মাথার পাশে বেডসাইড টেবিলে এক গ্লাস দুধ ও রাখা। অরুনিমার চোখে জল চলে আসে। দুধ খায়। গ্লাসটা রাখতেই দরজায় আওয়াজ পায় কে যেন ছিটকিনি খুলে বাইরে চলে গেল। খোলা দরজাটা দিয়ে বাইরের বাগানের দিকে তাকিয়ে শীত শীত করতে থাকে। অরুনিমা কোনোমতে উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বাথরুমে যায়, তারপর এসে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে দেখে বিছানায় রাখা ল্যাপটপটা স্ক্রিনে কে টাইপ করে রেখেছে..." আমি জানি আমি তোমার সঙ্গে খুব অন্যায় করেছি। তাইতো যে আদর; যে পরিতৃপ্তি দিতে পারিনি; আজ দেওয়ার জন্য ফিরে ফিরে আসি। যে সংসারটা অসম্পূর্ণ থেকে গেল সেটাকে ছেড়ে কিছুতেই যেতে পারি না। সেই সংসারটাকে পরিপূর্ণ করে দেখতে চাই বলে আসি। কিন্তু তোমার বুকে নাক গুজে আমি শুধু অন্য গন্ধ পাই অরুনিমা। আমি কষ্ট পাই। আমার শরীর নেই। কষ্ট আছে। একই রকম। তোমাদের মতই। তোমার তো অনেক কাজ আছে অরুণিমা। আমার এই বাড়ি আগলে পড়ে থাকা ছাড়া আর কোন নিষ্কৃতি নেই। "

বেশ কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে থাকে অরুণিমা। বাথরুমে ঢুকে একেবারে স্নান সেরে ফেরে । দুধ কর্নফ্লেক্স খেতে বসে। হঠাৎই কলিংবেল বাজে। উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখে অনিমেষ দাঁড়িয়ে। অরুনিমা দরজা বন্ধ করে দিতে চায়। অনিমেষ জোর করে ঢুকে পড়ে ঘরে। তুমি চলে যা..., অনিমেষ দেওয়ালে ঠেসে ধরে ঠোঁটের মধ্যে ঠোঁটে আটকে চুমু খেতে থাকে। অরুনিমার যাবতীয় প্রতিরোধকে ভেঙে দখল নেয় অনিমেষ। 

"হোক আমার ক্ষতি। মেরে ফেলুক আমাকে সৌগত। তোমার বুকের উপরে শেষ হয়ে যাক আমার জীবন। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না অরুনিমা। শেষ হলে তোমার কাছাকাছি থেকেই শেষ হোক।"

অরুনিমা বলে" তুমি কেন বুঝতে পারছ না অনিমেষ, ওর জীবদ্দশায় আমি কারো ঘনিষ্ঠ হয়নি, তাও ও আমাকে কত শারীরিক অত্যাচার করেছে, আর আজ যেখানে আমি তোমাকে সত্যিকারের ভালোবাসি, তোমার শরীরের মধ্যে আশ্রয় খুঁজে পাই, ও ছেড়ে দেবে? দেবে না।"

হঠাৎ করে ঘরের দরজা জানলা গুলো আপনাআপনি খোলা বন্ধ হতে লাগলো। ড্রয়িংরুমের ঝাড়লন্ঠন টা হাওয়ায় যেন দোল খেয়ে ছুটে আসে অনিমেষের মাথা লক্ষ্য করে। অনিমেষ কোনমতে বাঁচল। হঠাৎ অনিমেষ দেখলো ওর বাঁ কান থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। ও ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। দরজা খুলতে গেল। ছিটকিনিটার যেন একশো কেজি ওজন। নামাতে পারছে না কিছুতেই। এদিকে অনিমেষের নাক দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে সমানে। ও বসে পড়েছে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। ঘরময় একটা হিস হিস গরম নিঃশ্বাসের শব্দ। অরুনিমার শরীরে হঠাৎ একটা শক্তি এসে যায়। সোজাসুজি গিয়ে জড়িয়ে ধরে অনিমেষকে। জানলার কাঁচ ভেঙে ছিটকে আসে অনিমেষের দিকে।‌অরুণিমা হাত দিয়ে আটকাতে চায়।হাত কেটে গলগল করে রক্ত পড়তে থাকে।

"তুমি আর আমাকে কষ্ট দিতে পারবে না। এত বছর পরে আমি অনিমেষকে দেখে বুঝেছি সত্যি ভালোবাসা কাকে বলে। দেখো; ও আমার চোখের সামনে কষ্ট পেয়ে মরে যাচ্ছে। তবু ওর চোখে কোনো অনুতাপ নেই। আমার প্রতি রাগ নেই। নেই ছেড়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা। তুমি যেমন করে ভালোবাসা বোঝো, তেমনটা ভালোবাসা নয়, সৌগত, কিছুতেই নয়।"

ধীরে ধীরে জ্ঞান হারাছিল দুজনেই। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল দুজনের গা। অরুনিমা শুধু অনুভব করল একটা সাপ যেন ওর শরীরে জড়িয়ে পাক খেতে খেতে চলে গেল। চোখ খুলতে দেখে প্রতিবেশীরা ,রমাদি, অতনু দা ত্রিদিবদা দাঁড়িয়ে। নিজের খাটে শুয়ে আছে অরুণিমা। শশব্যস্ত হয়ে অনিমেষ কোথায় খুঁজতে চায়। রমাদি আশ্বস্ত করে , অনিমেষ ঠিক আছে। 

অতনু দা এগিয়ে এসে বলে, "কাঁচটা হালকা করে লেগেছিল ভাগ্যিস। ভেইন কাটেনি।" হাতের ব্যান্ডেজ টা খেয়াল করে এতক্ষণে অরুনিমা। খুব ক্লান্ত লাগে ওর। শরীরের সব বলটুকু কে যেন শুষে নিয়েছে। আবার চোখ বুজে ফেলে ও। একে একে সবাই চলে যায়। অনিমেষ পাশে এসে বসে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,"ও চলে গেছে অরুনিমা। আর ফিরবে না। যখন তুমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললে, আমি যেন দেখলাম একটা সাপ তোমাকে জড়িয়ে আস্তে আস্তে চলে গেল, আবার ফিরে এলো। তোমার পায়ে মুখ ঠেকিয়ে চলে গেল।আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমার কানের রক্ত পড়া থেমে গেল। আমি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললাম। ত্রিদিবদাদের ডাকলাম, ডাক্তার এলো। তখন থেকে এখনো বুঝিনি আর সৌগত উপস্থিতি। দুপুরে অনিমেষে খাইয়ে দিলো অরুনিমাকে। দেখো অরুনিমা কী লেখা! অরুনিমা দেখল দেওয়ালে একটা অস্পষ্ট লেখা ফুটে উঠেছে। "আমি চলে গেলাম। আর কোনদিন তোমায় দেখতে পাবো না এটাই আমার প্রায়শ্চিত্ত।" লেখাটা মিলিয়ে গেল। পাশের ঘরে সৌগতর শখ করে কেনা ল্যাম্পশেডটা বিকট শব্দে ভেঙে গেল হঠাৎ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror