Moumita Ghosh

Drama Action

4.2  

Moumita Ghosh

Drama Action

শুশ্রূষা// মৌমিতা ঘোষ

শুশ্রূষা// মৌমিতা ঘোষ

6 mins
1.4K


সকাল বেলায় জগিং করতে বেরিয়েছে রুমেলা। এই পাড়ায় দশদিন হলো ভাড়া এসেছে ওরা। রুমেলা একটা বেসরকারি ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চে ব্যাঙ্কিং ম্যানেজার। ওর পরনে খুবই সাদামাটা ঢিলেঢালা একটা ব্লু টপ আর ব্ল্যাক একটা প্যারালেল প্যান্ট।হাতে একটা জিঅরডিনো ঘড়ি। গয়নাগাটি কিছুই পড়েনা ও‌। তাই রোজকার পড়ার কোন কানের দুল, লোহা বা চুড়ি কিছুই নেই কানে হাতে।

বাড়ি শিফট করার পর গোছাতে লেগেছে তিনদিন। এখনো অবধি অফিস, বাজার, জিনিসপত্র গোছানো, রান্না বান্নার বাইরে মুখ তুলতে পারেনি। কাউকেই চেনেনা প্রায়। আলাপ করার সময় পায়নি । ফেব্রুয়ারির শেষ।অফিসে মারাত্মক চাপ চলছে‌।

রুমেলা প্রথমে কুড়ি মিনিট খুব জোরে হাঁটে, তারপর বাড়ি ফিরে এক্সারসাইজ, প্রাণায়াম। রাহুলের টিফিন বানিয়ে, ও যা খেয়ে যাবে সেটাও চাপা দিয়ে আসে ডাইনিং টেবিলে। যদিও সেই ফিরে গিয়ে আবার তাড়া লাগাতে হয় ওকে।

এই গলিটা বেছে নেওয়ার কারণ আছে। এই গলিটা রুমেলার বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিট দূরে। বেশ কিছু মাধবীলতার গাছ, কাঞ্চন গাছ,টগর গাছ আছে। একজনের বাড়িতে বারান্দায় বনসাই করা আছে অনেক গাছের। রুমেলা হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়ে মন দিয়ে গাছগুলো দেখে। মনে মনে রবীন্দ্রসঙ্গীত ভাঁজে, আবার হাঁটে। গলিটা শান্ত থাকে বেশ সকাল বেলায়। 

আজ ও-ও হাঁ করে দেখছিল মাধবীলতার গাছটাকে, হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে পাঁচ হাত জন ঘিরে ধরলো ওকে। একজন মহিলা বললেন," দেখেচ, আমি বলেছিলাম, এ নজর রাখে।দেকাচ্চি নজর রাখার মজা।এই , তোরা সব আয়।..."রুমেলা কিছু বোঝার আগেই আরো দশ বারো জন ওকে ঘিরে ফেলল।


 রুমেলা একটু গলা চড়িয়েই বললো, "কী চাই?"

যদিও ভিতরে ভিতরে ভীষণ নার্ভাস লাগছিল ওর‌।

"কী দেখছিলেন?"

" মাধবীলতা। আর ওই বনসাইগুলো।'

"আহা।কী সুন্দর কথা! আমাকে দেখে কি চুতিয়া মনে হয়?"

"ভাষা সংযত করে কথা বলুন।"

"ওরে,হেব্বি ভদ্দরলোকের রে।"

রুমেলা বুঝতে পারছে কোথাও একটা মস্ত গন্ডগোল হয়ে গেছে, কিন্তু তার জট খোলা এখন প্রায় অসম্ভব।

ওকে ঘিরে যারা দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে দুজন সামনের দোতলা বাড়িটায় থাকেন, অন্যদিন হাঁটতে হাঁটতে দেখেছে।চারজন ভদ্রলোক আশেপাশের ফ্ল্যাটের, আর চার পাঁচটা ছেলে মনে হচ্ছে এই পাড়াটার লাগোয়া বস্তির। ওদেরকে এখানে কোন কারণে ডেকে আনা হয়েছে। 

ইতিমধ্যে ওদেরই বোন বা বান্ধবী হবে , তিনটে মেয়ে এসে জুটেছে। রুমেলা হঠাৎ বিপদের গন্ধ পায়। কথা বলায় খুব লাভ হবেনা ভেবে ছুটতে শুরু করে । 

"ওই ধর, ধর, ধর! পালাচ্ছে মালটা।"

সবাই মিলে ধরে ফেলে। প্রথমেই এক ধাক্কায় ফেলে দেয় ওকে একটা ছেলে।তারপর মেয়েগুলো ওকে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে আগের জায়গায় নিয়ে যায়।

বল, কেন তাকিয়েছিলি ওই বাড়ির দিকে

ঘটনার আকস্মিকতায় রুমেলা যেন বোবা হয়ে গেছে। কোন শব্দ নেই ওর কাছে। ঠোঁটের কষ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। কনুই থেঁতলে গেছে। হাঁটুর উপরে প্যান্ট গেছে ছিঁড়ে।

 "বল, চুপ করে আছিস কেন মাগী?"

"গাছ দেখছিলাম। "রুমেলা কাঁদতে কাঁদতে বলে।

আবার মিথ্যা কথা?

"না। সত্যি।"

"তুই আসলে চর। সকালে দেখে গিয়ে খবর দিস, রাতে এখানে চুরি হয়।*

"হাউ কুড ইউ টেল দিস টু মি? ডু ইউ নো হু অ্যাম আই?"

সামনের বাড়ির মহিলা এগিয়ে এলেন।" খুব ভালো জানি। মেইনটেইন করা চোর। সেজেগুজে ভালোমানুষির ভান করে অপকর্ম করিস। এক চড়ে দাঁত ফেলে দেব আর একটাও কথা বললে।"

"আপনি একটা ফোন দিন আমাকে, লেট মিঃ প্রুভ মাই আইডেন্টিটি।"

এক চড় মারলেন মহিলা রুমেলাকে কষিয়ে।

বলেছি না, কোন কথা নয়।

সামনের একটি ফ্ল্যাটে একজন মহিলা ডাক্তার থাকেন। রুমেলা যখন ভোরবেলা হাঁটে, তখন রোজ ক্রশ চিহ্ন দেওয়া গাড়ি করে উনি ড্রাইভ করে বেরোন। ভদ্রমহিলা এসে বললেন, " ওকে কিন্তু ভালো ঘরেরই মনে হচ্ছে। হাতে ইমপোর্টেড ওয়াচ, কী করে ও চোর হবে?"

"ম্যাডাম, আজকাল চোরেরা মাঞ্জা দিয়ে ই ঘোরে। ধূম ,রেস এসব দেখেননি না? 

নাম বলছে রুমেলা চ্যাটার্জি। কোন হিন্দু ঘরের বৌকে দেখেছেন হাতের নোয়াটাও খুলে ফেলতে? 

এটা কোন লজিক হল?

আপনার বাড়িতে চুরি হয়েছে? হয়নি তো? ফুটুন তো, পাতলা হন। ওদের মধ্যে সবচেয়ে উগ্র ছেলেটা এগিয়ে যেতেই ডাক্তার ম্যাডাম গাড়িতে গিয়ে বসলেন।যেতে যেতে বললেন, then call police।

"ডাকব। আগে হাতের সুখ করে নিই। "বলেই চুলের মুঠি টা ধরে ঠুকে দেয় পোস্টে।


 রুমেলা আহ্ করে ব্যথায় চিৎকার করে ওঠে। হাত জোর করে বলে ওঠে,

"প্লিজ আপনাদের ভুল হচ্ছে, আমি ভালো চাকরি করি, গাছ, ফুল এসব ভালোবাসি, তাই আসি এই গলিতে হাঁটতে ,আপনারা কেন বুঝছেননা?"

"বহুত সেয়ানা মাল তো, এত মার খেয়ে ও এক ই কথা বলে যাচ্ছে।বলি, কোত্থেকে এলে গো?আগে তো দেখিনি। "

একজন ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন, বললেন,"পুলিশ ডাকি? হঠাৎ কিছু হয়ে গেলে? তোমরা এভাবে মারছ!"

"প্লিজ, কাকু , পুলিশ ডাকুন। পায়ে পড়ি আপনার, আমাকে বাঁচান।"রুমেলা বলে ওঠে।

একজন মহিলা বলে ওঠেন," এই, তুমি ঘরে যাও, এসে গেলেন জনতার বিবেক, এতজন মানুষ যখন বলছে চোর, কিছু তো যুক্তি আছে।" ভরা বাজারে স্ত্রীর কাছে অপমানিত হয়ে চলে গেলেন ভদ্রলোক। 

রোদ বাড়ছে।।রগড় দেখতে ভিড়টা বেড়েছে। রোদে আরো জ্বলছে থেঁতলে যাওয়া জায়গাগুলো। আশেপাশের ফ্ল্যাটের জানালাগুলোয় অসংখ্য মুখ।

রুমেলা ওর দূরতম ভাবনায় কোনদিন ভাবতে পারেনি চোর সন্দেহে মার খাবে। স্কুল-কলেজে ডিবেট করা রুমেলার কোন কথা জোগাচ্ছে না মুখে। কোন একটা এক্সটেম্পোরে "জনতার কোন চরিত্র হয় না" বলে বলে ফার্স্ট হয়েছিল।ঘটনা তুলে তুলে দেখিয়েছিল যে উন্মত্ত জনতার শরীর থাকে, মস্তিষ্ক বলে কিছু থাকেনা। নিজেদের মধ্যে লুকিয়ে রাখা জন্তুর সুযোগের বহিঃপ্রকাশের নাম জনতা।

আজ ও সেই জনতার খিস্তি,মার, উন্মত্ত , রাক্ষুসে রূপের সামনে। মনে মনে বিবেকানন্দ আর সারদা মাকে স্মরণ করে ও। একজন মহিলা ওকে মা তুলে খারাপ কথা বলতে সর্বশক্তি দিয়ে একটা চড় মারে ও। ভদ্রমহিলা চার হাত পিছিয়ে যায়। 

এনাফ হয়েছে। আমি কিন্তু মিডিয়া ডাকব। পাঁচ মিনিট দূরে আমার বাড়ি। গিয়ে দেখে আসুন। আর এক পা এগোবেন না।

"শালি , মিডিয়া দেখাচ্ছিস,তোর ছবি ভাইরাল হয়ে মিডিয়া য় দেখাবে।"

তিনজন মহিলা ঝাঁপিয়ে পড়ে টপটা ছিঁড়ে দেয় রুমেলার। রুমেলা বুকটা ঢেকে রাস্তায় শুয়ে পড়ে। মারের পর মার পড়তে থাকে। রুমেলা জানে সবচেয়ে সস্তা আর কার্যকর অস্ত্র এটা। ভিডিও করছে অনেকে। ওর কান দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। ওর ঘড়িটা কেউ খুলে নিল। রুমেলা বুঝতে পারছে ও জ্ঞান হারাচ্ছে, পড়াশোনায় ঝকঝকে রুমেলা, ছোট থেকে স্যোশাল সার্ভিস করা রুমেলা,ডিবেটে ফার্স্ট প্রাইজ পাওয়া রুমেলা, রবীন্দ্রসঙ্গীতের খাতার রুমেলা।

"আরে, বৌদি, এই সরুন তো, সরুন তো, আপনারা ওনাকে মারছেন? উনি তো ব্যাঙ্কে চাকরি করেন।কাছেই থাকেন।" বলে হারু। হারু সব্জি বিক্রি করে। হারুর সঙ্গে এসে প্রথম দিনই ঠিক করে নেয় রুমেলা ,ও ফোনে বলে দেবে, হারু বাড়িতে পৌঁছে দেবে সব্জি। 

"এই তোরা কি পাগল হয়ে গেছিস? বৌদির বর চ্যানেলে কাজ করে, দেবে সব হুড়কো করে, পুলিশ এসে কিন্তু এইসব ভদ্রলোকেদের তুলবে না। তোদের তুলে নিয়ে যাবে। এরা সব তখন চিনবেনা।ঈশশ। এত ভালো মানুষ টা... বাড়িতে সব্জি নিয়ে গেলে কেউ জিজ্ঞেস করে না , বৌদি জল দেয়, সরবত দেয়,ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে টাকার ব্যাগ আনতে যায়। আরে গাধারা, একটা ওড়না টোড়না কিছু ছুটে নিয়ে আয়।"

ওখানে মজা দেখা একজন মহিলা নিজের ওড়না টা দেন।

একজন জিজ্ঞেস করে "কোন চ্যানেলে কাজ করে রে ওনার হাজবেন্ড?"

চ্যানেলে র নাম টা বলার পরে ভিড় অনেক পাতলা হয়ে আসে।বস্তি থেকে আসা নাইটি পরা মেয়েটি রুমেলার চোখে মুখে জল দেয়।হারু একজনকে বাড়িটা বুঝিয়ে দেয়,বলে বাড়ির লোককে ডেকে আনতে‌।

একজন ভদ্রলোক বলেন" হুঁ হ্যাজ কলড দিস হুলিগানস্? " আমি আগেই জানতাম, উনি ভদ্র ঘরের। দেখেই মনে হচ্ছিল।

" এই মালটা কে? এই আপনি দিমাগ চাটবেন না তো। এতক্ষণ মজা নিয়ে , বৌদির বুকের খাঁজ মেপে এখন বাতেলা মারছে।" বলল একটি ছেলে। ছুটতে ছুটতে এসে পৌঁছেছে সুজয়, ছেলে কে সঙ্গে নিয়ে। ছেলে আদর্শ ক্লাস সিক্সে পড়ে। ছেলে কাঁদতে থাকে।" মামান,চোখ খোল।"

সুজয় দেখছে রুমেলা পড়ে আছে। মুখ ফেটে গেছে। চুল চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে। বুকের উপর ওড়না চাপা দেওয়া। উফ্। কেঁদে ফেলে সুজয় ও।

"কেন মেরেছেন ওকে? উত্তর দিন।সবাই চুপ। লেট মি কল দ্য পোলিস ফার্স্ট।" ফোন করে লোকাল থানায়। নিজের পরিচয় দেয় ,ওসি খুব ই চেনা। তক্ষনি আসবেন বলে কথা দেন।

ফোন টা রেখে অ্যাম্বুলেন্সকে কল করে। তারপর স্থানীয় বিধায়ককে, ফোন করে। বিখ্যাত সাংবাদিক হওয়ার কারণে সবাই চেনে সুজয় কে। 

ভিড় কমে আসছে।

এখন দশ জন মতো আছে। 

"আই ওয়ান্ট মাই আনসার।কেন?"

"দাদা, এই গলিতে পরপর দুদিন চুরি হয়েছে। বৌদি রোজ সকালে হাঁটতে আসে‌। কেউ আগে দেখেনি।তার মধ্যে বৌদি ওই গাছওলা বারান্দাটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, এই বাগান শুদ্ধ বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে, ওই জন্য এই বাড়ির চুগলিখোর মহিলা প্রথম সবার মাথায় ঢুকিয়েছে যে বৌদি খবর দেয় চোরেদের সব দেখেশুনে। " বলল হারু। 

ঐ মহিলাকে আমি দেখছি। বাড়ির কেচ্ছা যদি খুঁড়ে না বের করে চারদিন ধরে চ্যানেলে দেখাই তো আমার নাম সুজয় চ্যাটার্জি না। পুলিশ এসে গেছে। আদর্শ একটানা কেঁদে চলেছে। অ্যাম্বুলেন্স এর অপেক্ষায় সবাই। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। আবার কিছু ভিড় জমেছে। বারবার জলের ছিটে দিচ্ছে আদর্শ, মায়ের মুখে।

জ্ঞান ফিরেছে রুমেলা র ।‌কিছুতেই চোখ খুলবেনা রুমেলা। চোখ খুললেই ও জানে কিছু মুখ ঝুঁকে আছে ওর উপরে; হতাশার নিষ্ঠুর মুখ, হুজুগে মুখ, নির্বোধ মুখ, সুবিধাবাদী মুখ, হিংস্র মুখ, নির্লজ্জ একটা ভাইরাল হয়ে যাওয়া ভারতবর্ষের মুখ। 

একটা অ্যাম্বুলেন্সের অপেক্ষা...সবার।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama