উজ্জীবন// মৌমিতা ঘোষ
উজ্জীবন// মৌমিতা ঘোষ
মোহনবাগান মাঠ।একটু পরেই খেলা শুরু হবে।সময়টা ২০০২।সৈকত পৌঁছে গেছে মাঠে। মোহনবাগানের কোন খেলা মিস করেনা কখনো সৈকত।আজ সঙ্গে জামাইবাবু আর পাড়ার চার বন্ধু। প্রথম দশ মিনিটেই গোল। মোহনবাগানের। উল্লাসে ফেটে পড়ল গোটা গ্যালারি।'আজ তোর বৌদিকে বাড়ি গিয়ে মিষ্টির প্যাকেট দেবো', খুব খচে যাবে, আমার তো ঘরেই চিরশত্রু ইষ্টবেঙ্গল।'
"বৌদিকে রাগিও না, দুঃখ আছে কপালে।" সৈকতকে বলে ভোলা।
ওরা আবার মন দেয় খেলায়।
হাফ টাইম অবধি এক-শূন্য চলে। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই গোল, আনন্দে চিৎকার করে ওঠে সৈকত।তারপর ই পড়ে যায়। " আরে কী হল তোমার?" বলেন জামাইবাবু।
" ওঠো ওঠো সৈকতদা।" ভোলা,চন্দন আর সৌম্য ধরাধরি করে বসানোর চেষ্টা করে। 'আমার হাত-পা নড়ছে না। জামাইবাবু আমি কিছুতেই পারছিনা।"
চোখ খুলে কেবিনটা দেখতে পাচ্ছে সৈকত। মোমিনপুরের বিখ্যাত বেসরকারি হাসপাতালে ওকে ভর্তি করা হয়েছে। একটু ভর দিয়ে উঠতে চেষ্টা করল সৈকত। নাহ্ কোন সাড় নেই পায়ে,হাতে। অসহায় সৈকত কেঁদে ফেলল। এই মুহূর্তে মনিটরের শব্দ ছাড়া কোন শব্দ নেই কেবিনে। দূরে দুজন নার্স দেখা যাচ্ছে। কথা বলতে গিয়ে আওয়াজ বেরোলনা সৈকতের। ও কি বোবাও হয়ে গেল? খুব চেষ্টা করে , শক্তি সঞ্চয় করে ডাকল নার্সকে। নার্স এসে দাঁড়ালে জিজ্ঞেস করল" আমার কী হয়েছে?"আমি কি প্যারালাইজড?"
"বড় ডাক্তার এসে জানাবেন স্যার।আপাতত আপনার হাত পা নাড়াতে পারবেন না বলেই মনে হয়।কাল সকালে রিপোর্ট পাবেন। আমি খাইয়ে দিচ্ছি আপনাকে।"
" আমার বাড়ির লোক কেউ আছে?"
ওনারা ছিলেন।একটু আগে গেলেন।"
খেতে খেতে এক আশ্চর্য অসহায়তায় দুচোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল সৈকতের। সারারাত ঘুম এলোনা।অসাড় দেহে জেগে রইল। পরেরদিন জানতে পারল গিলেনবেরি বলে একটি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্যারালাইজড ওর শরীর।মাথার উপরে বাজ ভেঙে পড়ল। বৌ-মেয়ে ক্রমাগত কাঁদছে। ওদের সামনে বহু কষ্টে শক্ত হয়ে আছে সৈকত। ওরা চলে গেলে রোজ সিলিং এর দিকে তাকিয়ে ভাবে," আমি কী অন্যায় করেছি? আমিই কেন?" ঈশ্বরের সঙ্গে এক অক্ষম ঝগড়া করে ও।
অফিসের ছেলেরা দেখা করতে এসেছে। দুটি বেসরকারি ব্যাংকের সবচেয়ে বড় ডি এস এ হল সৈকতের স্পার্ক সলিউশন। প্রায় একশো তেরো জন স্টাফ। সৈকতের পরিশ্রম ও ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে ব্যবসার রমরমা।কেবিনটা টুইন শেয়ারিং। ওপাশের বেডে একটি বাচ্চা নয় বছরের মেয়ে। সৈকতের বেড থেকে বাইরে টা দেখা যায়। কে বেরিয়ে গিয়ে কী বলল,কে চোখের জল মুছলো,সবটা লক্ষ্য করে সৈকত। আর কাজ ই বা কী আছে?
এখন বিছানায় চোখ বুজে আছে।খুব ক্লান্ত লাগছে। দুটো ফিল্ডের ছেলে এসেছে। সৈকত আর চোখ খুললনা ক্লান্তিতে। শুয়েও লোকে যে ক্লান্ত বোধ করে ও আগে জানতনা।
"স্যার,ঘুমোচ্ছেন?"
দুতিনবার ডেকে উত্তর না পেয়ে তরুণ , সুরজিৎ কে বলল ," নির্ঘাত ঘুমিয়ে পড়েছে, কী হবে বলতো আমাদের? ওনার সুস্থ হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই তো নেই।।"
সুরজিৎ বলল "দেখি কিছুদিন। তারপর চাকরি খুঁজব।"
" তোর তো বৌ-বাচ্চা নেই, অপেক্ষা করতেই পারিস, আমাকে তো এক্ষুনি খুঁজতে হবে ভাই। "
ওরা চলে গেছে।সৈকত ঘুমিয়ে একটা খালি, মানুষ-শূন্য অফিস দে
খতে পাচ্ছে।ওর চেয়ারটা ফাঁকা পড়ে আছে।কেউ কোত্থাও নেই। বিশাল একটা তালা ঝুলছে।সুবিশাল।এর মধ্যে জলের মতো পয়সা খরচ হয়েছে। কাছের আত্মীয়রা আসা বন্ধ করেছে,পাছে কেউ সাহায্য চায়। পিসতুতো বোনের বিয়ে দিয়েছিল সৈকত নিজের খরচায়।সে আসেনি একবার ও।এই ক'দিন মোহরের দিকে আর তাকাতে পারছেনা সৈকত। কাছের লোকেদের নিষ্ঠুরতা ,আর ঘটনার আকস্মিকতায় ও শুকিয়ে গেছে।
আজ সকাল থেকে খুব শরীর খারাপ সৈকতের।আরো অনেক টেস্ট হয়েছে। ডাক্তার একরকম জবাব দিয়েছেন।মোহর বড্ড ভেঙে পড়েছে।সৈকতের কাছে আসতেই শিশুর মতো কেঁদে উঠে সৈকত বলে,"মোহর , আমাকে চিলি চিকেন খাওয়াবে?বড্ড ইচ্ছে করছে।"মোহর বিকেলে বেস্ট চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে নিয়ে এলো চিলি চিকেন।খাইয়ে দিতে দিতে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল স্বামীর দিকে, সৈকত খুব তৃপ্তি করে খেলো আর শেষ করে বলল, আমার শেষ ইচ্ছে পূরণের জন্য ধন্যবাদ মোহর।"
দিনের সূর্য নিবে গেল কেবিনে।মেয়ে কেয়ার রক্তশূন্য, ফ্যাকাশে মুখটা ভাবতে ভাবতে এক মনে নিজের মৃত্যু কামনা করতে লাগলো সৈকত।এই কদিন সামনের বাচ্চাটার সঙ্গে বিশেষ কথা হয়নি। সৈকত ট্রমাটাই কাটিয়ে উঠতে পারছিলনা। ওর এত অ্যাক্টিভ একটা জীবন হঠাৎ করে থেমে যাবে ভাবতে পারেনি কখনো।এই প্রথম হঠাৎ বাচ্চাটাকে ভালো করে লক্ষ্য করতে লাগলো।ছোট, হাসিখুশি রোগা চেহারা। রাতে নার্স ওকে যখন খাওয়াচ্ছিলো প্রচুর কলকল করে গল্প করছিলো। সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি সৈকত,ওর শরীর খুব খারাপ হতে থাকলো। স্পেশালিস্ট এলেন, অনেক ডাক্তারি পদ্ধতি চলতে লাগলো, সৈকত পড়ে থাকলো অসাড়,সময় গোনার সময় এসেছে ওর।
সকালের দিকে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল সৈকত। চোখ খুলতেই দেখলো বাচ্চা মেয়েটি ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
"নাম কী?"
" ঝুম্পা।"
"এদিকে আয় দেখি।"
" আমি তো হাত-পা নাড়াতে পারছি না।আমি ভালো হয়ে গেলেই তোমার কাছে যাবো গো।" হাসি হাসি মুখে বলল ঝুম্পা।
সত্যিই তো, এতদিন তো একবারও উঠতে দেখেনি ওকে। নার্স ইনজেকশন দিতে এলে জিজ্ঞেস করল সৈকত," ওর কী হয়েছে?"
" গিলেনবেরি।"
শুনে অবাক হয়ে গেল সৈকত । সারাদুপুর ওর কানে বাজলো " আমি ঠিক হয়ে গেলেই তোমার কাছে যাবো।" ওইটুকু মেয়ের কী আত্মবিশ্বাস!
আমিও সুস্থ হয়ে ওর বেডের কাছে যাব। যেতে হবেই।
হাতে পায়ে যেন জোর আসতে থাকলো সৈকতের। তবে,নাহ্, নাড়াতে পারলনা।
'মিরাক্যল ম্যাডাম, হি ইজ আউট অফ ডেঞ্জার নাও। তবে প্যারালাইজড অবস্থা থেকে বেরোতে সময় লাগবে। এক-দুদিনে আগামী অ্যাডভাইস দিয়ে আমরা ছেড়ে দেব। লেটস্ হোপ ফর দ্যা বেস্ট।" ডাক্তার মোহরকে বললেন।
আজ চারমাস পরে দাঁড়াতে পেরেছে সৈকত। এ'কদিন একদিনের জন্যও ভোলেনি ঝুম্পা কে । খেলনা নিয়ে পাঠিয়েছে মোহরকে ওর কাছে। আজ সত্যিই দাঁড়াতে পেরেছে ও। বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে আছে সৈকত।ওর ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। সব স্টাফ ছেড়ে গেছে। ওর কানে শুধু একটাই ধ্বনি, "আমি সুস্থ হয়ে গেলেই তোমার কাছে যাবো।' ওকে কাল ঝুম্পার বাড়ি যেতে হবে। কথা দেওয়া আছে যে! সারাজীবন ধরে দুটো বেডের মধ্যে বাঁধা থাকবে ওদের জীবন সূত্র।জিতে যাওয়ার উল্লাসে অনেকদিন পর একটা চুমু খায় মোহরকে ও।