Moumita Ghosh

Romance

3  

Moumita Ghosh

Romance

আয়নার বিয়ে// মৌমিতা ঘোষ

আয়নার বিয়ে// মৌমিতা ঘোষ

5 mins
1.0K


দরজাটা বন্ধ করতেই একটু এগিয়ে এসে সুজাতকে সোফায় বসায় ঈলিনা।সুজাত একটু দেরিতেই পৌঁছেছে হোটেলে। কথামতো ঠিক দশটায় পৌঁছে গেছে ঈলিনা। হোটেল ঠিক নয়। গেস্ট হাউস। কলকাতা শহরের বুকে ওদের মতো মানুষদের আশ্রয় এই গেস্ট হাউসগুলো। অনেকবার এসেছে। তাই চেনা । ঈলিনার আগে পৌঁছাতে অস্বস্তি হয়না। প্রথম তিনবার একসাথে এসেছিল। তারপর ঘটনাচক্রে প্রতিবার ই আলাদা আলাদা পৌঁছেছে।আদালত পরকীয়া সিদ্ধ করলেও লোকের চোখ তো আর বদলায়না। সেটা আগে পৌঁছে গেলে বেশ টের পায় ঈলিনা। যদিও ও খুব স্বাভাবিক থাকে। রায় তো বেরোল হালে। তার আগেও এক ই রকম ডেসপারেট ছিল। খুব সপ্রতিভভাবে আইডি প্রুফ দিয়ে চেক ইন করে যায়। আজ একাদশী। কলকাতা শহরের ছুটির আমেজ কাটেনি। পুজোর আমেজ ও না। ওরা এই দিনটিকে বেছেছে শনিবার বলে। আর ছুটি পরে পাবে না বলে। সত্যি বলতে কী , ঈলিনা মাসে একদিন পায় সুজাতকে। আর সেটা না পেলে ওর মাথায় পাগলা ঘন্টা বেজে যায়। 


সুজাত বসে হোয়াটস্অ্যাপ ঘাঁটতে থাকে। ঈলিনা চুপ করে বসে থাকে ওর দিকে তাকিয়ে।হোয়াটস্অ্যাপ থেকে চোখ তুললে আলতো করে চুমু খায় ঈলিনা। 

"বাবা , এত সেজে এসেছ? লাল জরির সিল্ক, লাল বড় টিপ, কী কেস?"

ঈলিনা ওর আঙুলটা তুলে নিজের কপালে রাখে। বলে," একটু ছুঁয়ে থাকো। আমাদের বিয়ে হচ্ছে। সিঁদুর টিঁদুরে আমি বিশ্বাস করি না। যদিও কাল রাতে বরণের সময় এই সোয়েটের টিপটার উপরেই সবাই সিঁদুর দিয়েছে। তাই বাই ডিফল্ট সিঁদুর আছে কপালে। " ব'লে চোখ বুজে ফেলে ঈলিনা। এর আগে আদর করার মতো করে এক দুবার কী সুন্দর ভাবে কপালে আঙুল ছুঁইয়েছে সুজাত। মিথ্যে টিপ আঁকার মতো, আদরের মতো। আজ বলল," এই নাটক আমার ভালো লাগছে না। কী বাংলা সিনেমার মতো করছ?" বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলেও মুখে কিছু বলে না ঈলিনা। বলে" আজ আমাদের বিয়ে বুঝলে।এই মাত্তর হল বিয়ে।" হেসে ফেলে সুজাত, " কী ছেলেমানুষি যাত্রাপালা এটা?"

" এই যে তোমার জন্য বিয়ের মতো সেজে এলাম।"

" দিনের বেলায় এরকম লাল টকটকে বিয়েবাড়ির সাজে বেরোলে কী করে? বাড়িতে সন্দেহ করল না?"

আরো গভীরভাবে ওকে চুমু খায় ঈলিনা। এত গভীরভাবে যাতে ও বুঝতে পারে আজ মনে মনে বিয়ে করছে ঈলিনা। সুজাত বিহ্বল হয়ে যায়। ওরা বিছানার দিকে এগোয়।ইলিনা একটা প্রণাম করে জড়িয়ে ধরে বলে শুভ বিজয়া।

" তুমি খুশি হওনি এত সেজে এলাম, লাল শাড়িতে তোমার জন্য?"

" হ্যাঁ। হয়েছি তো। বেশ পুজো পুজো দেখাচ্ছে।"

সচেতনভাবে বিয়ে কথাটা বাদ দিল সুজাত।

তারপর বলল, " আমাকে তুমি বিয়ে করতে চাও? "

" চাই তো।"

" বিয়ে করলে এই ভালোবাসা, ভালো সময় কাটানো সব চলে যাবে।"

" আবার কাটা রেকর্ড বাজাচ্ছো কেন? এই কথাই তো বারবার বল। আর কথাগুলো অজানা নয়।নইলে আজ তুমি আর আমি এখানে কেন?"

" আমি আজকের জন্য তোমার বউ হতে চাই। কুমকুম চর্চিত, রঞ্জিত ওষ্ঠ, কঙ্কন সমভিব্যাহারে।" 

" আচ্ছা হও।কী আর বলব? নিজে নিজে হও তবে।"

ঈলিনা বুকের কাছটায় ঘেঁষে গিয়ে বলে " এই যে, আজ বিয়ে হয়েছে। প্রচুর আদর চাই ফুলশয্যার মতো। রাণী র মতো রাখতে হবে। "

তা সুজাত যথাসম্ভব ওর সব ফ্যান্টাসি মেটানোর চেষ্টা করে।রাণীকে তুষ্ট করতে রাণীর ব্যাগে বয়ে আনা চাদর পাতার পর সেই ম্যাজিক ব্যাগ থেকে বেরিয়ে আসে অলিভ অয়েল। সারা শরীরে আগুন ছড়ায়। 

" উহু। আমাকে দেবে না ।বাড়িতে গন্ধ পাবে। বিশাল ঝামেলা হবে। "

" আমাকে তো কেউ ছোঁয় না , আর জামাকাপড়ও কেচে দেয়না; তাই আমার ধরা পড়ার ভয় নেই।"

" আরে তুমি তো এমনিতেই অলিভ অয়েল মাখো। আমি তো জীবনে গায়ে ছোঁয়াই নি। কোন গ্রাউন্ডেই বোঝাতে পারবনা।"

ঠিক আছে বাবা। তারপর আদরে আদরে কখন অলিভ অয়েল এক শরীর থেকে অন্য শরীরে ছড়িয়ে গেছে ওরা জানতেও পারেনি। 

" বলো, কেন কাল লিখলে যে আজ আমার আসাটা ভীষণ জরুরী।" 

" উহু। সব বলা যায়না। লজ্জা লাগে।" 

"লজ্জা? আমার কাছে? বল না।।"

"না।"

কী করে বলবে যে কাল এতো পাগল হয়ে গিয়েছিল সুজাত র জন্য ও, যে নিজেকে নিজের আদর করতে হয়েছে সারাদিনে ছবার।এর আগে কোন দিন এতবার এরকম অস্থির লাগেনি। ওকে প্রাণমন দিয়ে চাইছিল। বিয়ে কী সুজাত? বিয়ে মনে মনে স্বীকার করা আমার সমস্ত হৃদয়, আমার যা কিছু তোমাকে দিলাম।সবেতেই তোমার অধিকার ,আমি নিজে তোমাকে দিলাম। সমাজ নয়, ধর্ম নয়, আমি আমার হৃদয়টি দান করলাম তোমায়। আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে আমি তোমাকে বহন করব। তোমার ভালো থাকা আমার ভালো থাকা হবে। তোমার খারাপ থাকা , আমার খারাপ থাকা।


" কী গো , অন্যমনস্ক হয়ে কী ভাবছ?"

" কিছুনা। খিদে পেয়েছে।"

" অর্ডার কর অনলাইনে । তুমি পেমেন্ট কর। আমি দিয়ে দেব তোমাকে।"

ঈলিনা অর্ডার করে সুজাতর পছন্দমতো। যদিও সুজাত তিন-চারবার বলে "তোমার যেটা পছন্দ , নাও না। "  

 কিন্তু ওই যে তোমার ভালো থাকা...আমার ভালো থাকা। 

খাবার আসার গ্যাপে অনেক গুলো প্রিয় গান শোনায় সুজাত। অন্যদিন অনেক অনুরোধ করতে হয়। আজ একটা অনুষ্ঠান আছে ওর। তাই প্র্যাকটিস সেশন টা এখানেই হয়ে যায়, অনুরোধের প্রয়োজন পড়েনা।আর ঈলিনা ভাবতে থাকে ওর বাসরঘর ভরে উঠছে গানে। ও জানে পুরুষ এরকমই , বিহ্বলতা তাদের স্বভাববিরুদ্ধ, হঠাৎ করে কোন ইমোশন ওরা ধরতে পারে না, তাই রাগ না করতে শিখে গেছে। 

খাবার এল। প্রথম গ্রাস কিছু বলার আগেই মুখে পুরে দিল সুজাত। যদিও ওর টয়লেট থেকে ফিরে আসা অবধি ঈলিনা অপেক্ষা করছিল, প্রথম গ্রাসটা ওর মুখে তুলে দেবে বলে, আর উল্টোটা ও আশা করছিল। বৌভাতের পরিবেশনের ক্ষুদ্র সংস্করণ আর কী! হলনা। 

মুখে বলল " খাইয়ে দাও।" 

" এই সব নাটক আবার শুরু কর না । খেয়ে নাও। আমার ভালো লাগে না। "

একটুও না রেগে ওর হাতে একটু রুটির টুকরো ধরিয়ে দেয় ঈলিনা। সুজাত কথা না বাড়িয়ে খাইয়ে দেয়। ঈলিনাও খাইয়ে দেয় এক টুকরো। তারপর ওরা খেয়ে নেয়। খাওয়া শেষ হলে সুজাত র বাড়ি থেকে ফোন আসতে থাকে। " হ্যাঁ। হয়ে গেছে। আসছি।"

ফোন শেষ হলে ঈলিনা বলে আরেকবার, প্লিজ। 

নিরাশ করেনা সুজাত। সুজাত আদর করে, আর ঈলিনা ভাঙতে থাকে পাটভাঙা বেনারসিতে, উলুতে, অর্ধেক লেপ্টে যাওয়া ঘাম, সিঁদুর-চন্দনে। যে বিয়ে সতেরো বছর আগে শরীরে ধূপ -ধুনো - সুগন্ধি হয়ে জ্বলেছিল, কিন্তু সৌরভ ছড়াতে পারেনি; সেই বিয়ে চায় ও, হ্যাঁ সেই বিয়ে আজ ও মনে মনে সাজাচ্ছে এই হোটেলের বিছানায়।

সুজাত উঠে গেছে। ঈলিনা ওই ছেড়ে যাওয়া সুরভিটুকু নিয়ে শুয়ে আছে, উঠতে পারছেনা। 

সুজাত স্নান করে এলো। অলিভ অয়েল গন্ধ তাড়িয়ে এল। ঈলিনা র সারা শরীরে ফুলশয্যা। সে গন্ধ সে একটুও মুছতে চায়না। " এই যে , ম্যাডাম, বেরোতে হবে আমায়। পাঁচ মিনিট চেয়েছিলে। হয়ে গেছে।"

নিজের শরীরটাকে টেনে তোলে ঈলিনা বিছানা থেকে। "তোমার কপালে সিঁদুর ধ্যাবড়ালো কী করে? "

গতকাল বরণের সময় এই টিপটাই পরা ছিল, লোকে দিয়েছে সিঁদুর। "

" ও।"

ওয়াশরুমে যায় ঈলিনা। সারা কপাল জুড়ে সিঁদুর মাখামাখি হয়ে গেছে। ঠিক ফুলশয্যার পরের মতো দেখাচ্ছে ক্লান্ত অথচ সুখী একটা মুখ।একটু আগে সুজাত গাইছিল " হায় গো হৃদয়, তবুও তোমার আশা কেন যায় না....।"

আয়নার উপরে আঁজলা ভরে জল ছিটিয়ে দেয় ঈলিনা। তিন তিনবার । ধুয়ে যেতে থাকে একদিনের বিয়ে ওর চোখের সামনেই। 

দরজায় টোকা পড়ে। 'তাড়াতাড়ি করো। '


Rate this content
Log in