প্রাপ্তির হাসি
প্রাপ্তির হাসি


দূর্গা পূজার কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। নতুন মাসের শুরু হল। এখনও অবশ্য মাইনে পায়নি সুকেশ মাইতি। কোম্পানির কাজ। মাইনের সময় হয়ে গেছে। এখনও অ্যাকাউন্টে টাকা ঢোকার মেসেজ মোবাইলে আসে নি। মাইনে ঢুকলে পূজোর কেনাকাটা করতে হবে। বউ ছেলে মেয়ের আবদার সারাবছরে একবার বড় উৎসবে কেনাকাটা করতে হয়। এই সময়টা কৃপণতা করতে পারেনা সুকেশ মাইতি।
অফিস শেষে বাড়ি ফিরতেই তার স্ত্রী চেপে ধরে পূজোর কেনাকাটা কবে হবে জানতে চেয়ে। সুখের জন্য এখনো মাইনে ঢোকেনি। যেদিন পাবে সেদিনই পূজোর কেনাকাটা করতে যাবে। শুনে যেন মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল তার স্ত্রীর। সেটা দেখে সুকেশেরও মন খারাপ হলো। কিন্তু কিছু করার নেই। হাতে টাকা না আসা পর্যন্ত কেনাকাটা করা যাবে না।
সুকেশ মাইতি জানে গত পূজোতেও অনেক কিছু কেনাকাটা হয়েছে। তার অর্ধেক হয়তো একবারই সবাই পরেছে, কি তার স্ত্রী কি তার ছেলে মেয়ে। তারপর থেকে সেগুলো আলমারিতেই তোলা রয়েছে যত্ন করে। এবার নিশ্চয়ই তাই হবে। সুকেশ নিজের জন্য অতিরিক্ত কিছু কেনে না। কিন্তু স্ত্রী ছেলে-মেয়ে জ্বালায় সম্ভব নয় সেটা। পূজোর সময় যা প্রয়োজন তার অতিরিক্ত কেনাকাটা করে। এটা তার পছন্দ নয়। কিন্তু তাদের মন রক্ষা করার জন্য সহ্য করতে হয়।
পরদিন কাজ করতে করতে মোবাইলে ম্যাসেজ ঢুকলো সুকেশের। বাড়িতে জানিয়ে দিলে সেটা। সবাই সন্ধ্যাবেলায় রেডি থাকবে আর সুকেশ বাড়িতে গিয়ে তাদের সঙ্গে করে মার্কেটে যাবে। এভাবেই ছক কষে রাখল।
বিকালে অফিসের কাজ গোছানো হয়ে গেলে বাড়িতে ফোন করলো সুকেশ। সকলের সঙ্গে সেও অফিস থেকে বেরোতে প্রস্তুত হলো। এখান থেকে রোজ বাসে যাতায়াত করে। অফিস থেকে বেরিয়েই সামনে বাস রাস্তা। অন্ধকার হতে শুরু করেছে। স্ট্রীট লাইট গুলো জ্বলছে। বাসের জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল সুকেশ।
হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে এলো কয়েকটা বাচ্চা ছেলে মেয়ের দল। কারো গায়ে নোংরা ছেঁড়া জামা কাপড় কারো গায়ে তাও নেই। হয়তো অফিসের পাশের বস্তিতে এরা থাকে। অফিস ছুটির টাইমে এসেছে যদি সবার কাছ থেকে কিছু টাকা পয়সা নেওয়া যায়।
সুকেশ মাইতির আজ পুজোর কেনাকাটা করার জন্য মনে একটু আনন্দ বোধ হচ্ছিল। কিন্তু এদের দেখার পর সেটা যেন একটু মিইয়ে গেল। সে ভাবলো তাদের যেমন পুজো আছে এই ছোট ছেলেমেয়েদেরও তো পূজো আছে। এরা কি কিছু কেনাকাটা করেছে? মনে মনে নিজেকে জিজ্ঞাসা করলো সুকেশ।
দুটো ছেলে মেয়ে সামনে আসতেই ওদের জিজ্ঞাসা করল,' কিরে কি চাই?'
ছেলেটার চেয়ে মেয়েটা বয়সে মনে হল একটু বড়। সেই উত্তর দিল,' স্যার কয়টা টাকা দেবেন। পূজোর জামা কিনবো।'
অন্য যেসব ছোট ছেলে মেয়ে রাস্তায় ভিক্ষা করে তাদের সঙ্গে এদের একটু পার্থক্য ধরা পরল সুকেশের চোখে। কেন জানি সে জিজ্ঞেস করল,' থাকিস কোথায়?'
দুজনেই একসঙ্গে হাত তুলে আঙ্গুল দিয়ে বস্তির দিকটা দেখায়। সুকেশ যেটা আন্দাজ করেছিল তাই। সে বলল,' এখন তো পয়সা নেই। কালকে এখানে আসিস এই সময়। আসবি তো?'
দুজনেই মাথা নেড়ে প্রস্তাবে সম্মতি জানায়। তারপর ছুটে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে। সেই মুহূর্তে বাসটাও চলে এলো। সুকেশ বাসে উঠে পড়ল বাড়ি ফেরার জন্য।
বাড়ি ফেরার পর তার স্ত্রীকে বলল,' গতবার পূজোয় যেসব কেনাকাটা করা হয়েছিল তার বেশিরভাগ তো একবারের বেশি ব্যবহার করা হয়নি-'
সুকেশের কথা শেষ হয়ে পারল না তাই স্ত্রী রাগে ফেটে পড়ল। চিৎকার করে বলে উঠলো,' তুমি কি বলতে চাইছো? গতবারের পুরোনো জামা কাপড় আমি এবার পুজোয় পরবো। সবাই কি বলবে?'
সুকেশ অবাক হয়ে গেল একথা শুনে। সে বলল,' আমি ও কথা বলিনি। কেনাকাটা তো করতেই যাচ্ছি। ছেলে মেয়েদের যে জামা কাপড়গুলো পড়ে আছে ওগুলো তো এবার আর ওরা পরবে না। সব বাক্স বন্দী হয়ে পড়ে থাকবে। সেগুলোর কথা বলছি। ওগুলো বের করে রেখো তো। কাজে লাগিয়ে দেবো।'
'তাই বলো। আমি ভাবলাম অন্য কিছু। তা কি কাজে লাগাবে?' তার স্ত্রী জিজ্ঞাসা করল। সুকেশ সব ঘটনা খুলে বলল।
সব শোনার পর তার স্ত্রী বলল,' ঠিক আছে আগে মার্কেটে চলো বাড়ি এসে দেখব।'
সুকেশ দেখল এখন স্ত্রীকে রাগানো যাবে না দক্ষ যজ্ঞ কান্ড বাঁধিয়ে দেবে। তাই তার কথামতো বাড়ি ফিরে এসে দেখার সিদ্ধান্ত নিল। তারপর সবাই মিলে বেরিয়ে পড়ল মার্কেটের উদ্দেশ্যে।
লোকজনের ভিড়ে মার্কেটের দোকানগুলোয় পা ফেলা দায়। সকলেই কেনাকাটার জন্য এসেছে। জিনিসপত্র দেখে কেনাকাটার জন্য সময় তো লাগবে। সুকেশ তার স্ত্রী ছেলেমেয়েদের নিয়ে সারা মার্কেট চষে বেড়াচ্ছে। সবার পছন্দ বলে কথা। আর এক দোকান থেকে তো নেওয়া যাচ্ছে না। একটা পছন্দ হয় তো আর একটা হয় না। এভাবেই কেনাকাটা শেষ করতে অনেক রাত হয়ে গেলো। এত ঘুরেফিরে শরীরটা ক্লান্ত হয়ে গেছে সবার। কিন্তু মনের আনন্দে সেই ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে।
পরদিন অফিস থেকে বেরিয়ে অফিসের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে সুকেশ। হাতে অফিস ব্যাগ ছাড়াও আরেকটা ব্যাগ রয়েছে। গতকালের সেই ছেলে মেয়ে দুটোর অপেক্ষা করছে। যে বাসটায় বাড়ি ফেরে সেটা সামনে দিয়ে চলে গেল। কিন্তু সুখেশ বাসটা ধরল না। স্ট্রীট লাইটগুলো জ্বলছে অন্ধকার হয়ে এসেছে। এতক্ষণে তো চলে আসার কথা ওদের। একটু পরেই দেখল ওরা তার দিকেই আসছে। সুকেশকে দেখতে পেয়েই বোধহয় দৌড়ে ছুটে এলো।
'কিরে এত দেরী করলি কেন?' সুকেশ জিজ্ঞাসা করল। তারপর হাতের ব্যাগ থেকে কয়েকটা প্যাকেট বের করল। নতুন জামা কাপড়ের প্যাকেট। গতকাল তার স্ত্রী এই বাচ্চাদের কথা শোনার পর নিজেদের কেনাকাটার সঙ্গে এদের জন্যেও জামা কাপড় কিনেছে। অবশ্য নিজেদের জন্য যা কেনার কথা তার থেকে কম কিনেছে। সেই পয়সাটা বাঁচিয়ে বাচ্চা দুটোর জন্য কিনেছে। স্ত্রীর এই কাজে অবশ্যই খুশি হয়েছিল সুকেশ মাইতি।
প্যাকেটগুলো হাতে নিয়ে মুখটা ফাঁকা করে দেখল বাচ্চা দুটো। একে অপরের দিকে চাইলে ওরা। পুজোতে নতুন জামা পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। এতদিনের বাক্সবন্দী হাসিগুলো বেরিয়ে এসে ধরা দিল ওদের মুখে। সেটা দেখে নিজেকে খুশি করার চেয়ে অপরকে খুশি করার পরম তৃপ্তি পেল সুকেশ মাইতি।