প্রান প্রিয়
প্রান প্রিয়
১০ই ডিসেম্বর
দারোগাবাবু এসে দাঁড়ালো রাজের জেলের সেলের ঠিক সামনে । এসে একবার কড়া নাড়লো রাজের সেলের ওই লোহার থাম্বা গুলোতে । রাজ কে ডেকে বলল, “গোস্বামী বাবু আজ রাত 12 টায় আপনার ফাঁসি, খেয়ে নিন খাবার দিলাম ।“ রাজ মুখ তুলে তাকাল দারোগা বাবুর দিকে, খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল লোহার ঐ থাম্বা গুলোর দিকেও । কিছুক্ষণ পর রাজের উকিল দিনেশবাবু এসে উপস্থিত হলেন । তিনি এসে রাজের সাথে কথা বলতে চাইলেন। কিন্তু রাজ রাজি হলোনা উকিলবাবুর সাথে কোন কথা বলতে। উকিল বাবু অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন রাজকে তার সাথে একবার কথা বলার জন্য কিন্তু রাজ কিছুতেই রাজি নয়। দারোগাবাবুর কাছ থেকে একটা চেয়ার চেয়ে নিয়ে উকিলবাবু বসলেন রাজের সেলের ঠিক সামনে আর রাজকে খাবারটা খেয়ে নিতে বললেন । উকিল বাবু – “আপনি এত সৎ মানুষ কিন্তু আজ দেখুন আপনার শাস্তি হচ্ছে - ফাঁসি। আপনার মত সৎ মানুষের যদি ফাঁসি হয় তাহলে আমাদের মতো উকিলদের আর কাজ করা চলে না। আমি হেরে গেলাম আপনাকেও হারিয়ে দিলাম নিজের কাছেও হেরে গেলাম । আমি আপনার পাশে দাঁড়াতে পারলাম না আপনাকে সাহায্য করতে পারলাম না । জানিনা কেন আপনি এই সিদ্ধান্ত নিলেন কিন্তু আপনার মত সৎ মানুষ যখন এভাবে নিজের ইচ্ছায় ফাঁসি বরণ করে নেয় তাহলে আমাদের মতো উকিলদের আর কিই বা করা চলে বলুন।“ রাজ উকিলবাবুর সমস্ত কথাই শুনলো তারপর উকিল বাবু কে বলল, “আপনি ব্যর্থ চেষ্টা করছেন উকিলবাবু আমি আপনাকে কিছুই বলব না আপনি বরং ফিরে যান, আমি তো আপনার সব টাকা মিটিয়ে দিয়েছি, কেন ব্যর্থ চেষ্টা করছেন বারবার কোন লাভ নেই আপনি ফিরে যান উকিল বাবু।“ উকিলবাবুর সেই একটাই কথা, “বড় জানতে ইচ্ছা করছে আপনার মতন সৎ মানুষ কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল, প্লিজ একটু বলুন না” ;
ছয় মাস আগে
রাজ খুব গরিব পরিবারের একটা ছেলে ছোটবেলায় মা বাবাকে হারিয়েছে, একমাত্র দিদিই হচ্ছে তার সম্বল । খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করে রাজ এম বি এ পাস করেছে তাই এখন বিজনেস রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে কাজ করছে, দু একটা কাস্টমারও পেয়েছে । রাজের দিদির অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্যই রাজ আজ এই জায়গায় এসে পৌঁছেছে । নিজের বলতে রাজের ওই দিদি ছাড়া আর কেউই নেই । কাজের সূত্রে রাজকে কলকাতায় আসতে হয়েছে । এখানে রাজ একটা ফ্ল্যাটে উঠেছে । ফ্ল্যাটে একদিন রাজ একটা মেয়েকে দেখতে পায় বিকেল বেলা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটা, আকাশের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা ঘুড়ি উড়ানো দেখে। ফর্সা, ছিপছিপে চেহারা, হালকা একটু লাল আভা রয়েছে, কালো রঙের কামিজ পরা চুলগুলো হালকা উড়ছে বাতাসে, মেয়েটা দেখতে বেশ সুন্দর। হ্যাঁ মেয়েটা রাজের মত অতটা লম্বা নয় তবে ঠিক আছে। রাজ ছাদে এসে মেয়েটার দিকে একদৃষ্টিতে হা করে তাকিয়ে থাকে কিন্তু কখন যে মেয়েটা চলে গেছে রাজ বুঝতেই পারেনি। পরেরদিন আবার ঠিক সেই সময়ে রাজ ছাদে উঠে মেয়েটাকে দেখতে । ছাদে উঠে দেখতে পাই মেয়েটা সেই একই জায়গায় আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘুড়ি উড়ানো দেখছে । রাজ আবার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে । মেয়েটা রাজকে লক্ষ্য করে কিন্তু কিছু বলেনা রাজও কিছু বলে না মেয়েটাকে। মেয়েটা ছাদ থেকে নেমে গেলে মেয়েটার পিছু পিছু রাজও নেমে যায় । পরের দিন আবার সেই একই ঘটনা কিন্তু এবার মেয়েটি রাজকে বলে, “ঐ মিস্টার কি ব্যাপার বলুন তো দেখছি ক'দিন ধরেই আপনি আমাকে ফলো করছেন আমি ছাদে আসলেই আপনি ছাদে আসছেন, আবার দেখলাম আপনি আমার ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ছিলেন আবার ডিলিট করে দিয়েছেন, আপনার ব্যালকনি থেকে আমার ব্যালকনিতে তাকিয়ে আছেন কি ব্যাপার কি বলুনতো ?” রাজ বলে, “আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তর না’তো, আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর কই না’তো আর আপনার তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর একদমই না আমি এসব কিছুই করিনি । আচ্ছা আপনার নামতো পল্লবী তাহলে আপনি একটা কথা বলুন তো আমি যে এত কিছু করেছি তা আপনি কি করে জানলেন তাহলে আপনিও নিশ্চয়ই আমাকে ফলো করেছেন, আপনিও নিশ্চয়ই আমাকে দেখেছেন, আমার ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে ছিলেন আপনিও, এবার আপনার কি ব্যাপার বলুন তো?” মেয়েটা কোন উত্তর না দিয়ে নিচে নেমে গেল। পরেরদিন বিকেল বেলায় পল্লবী ছাদে আসলে রাজ আর থাকতে না পেরে পল্লবীকে প্রশ্ন করেই ফেলে, “আচ্ছা তুমি এই ঘুড়ি উড়ানোর দিকে তাকিয়ে থাকো কেন বলতো ?” পল্লবী উত্তর দেয়,” আসলে আমার বাবা আমাকে ঘুড়ি উড়ানো শিখিয়েছিল। বাবা লাটাইটা ধরে থাকতো আর আমি ঘুড়ির সুতো ধরে টান দিতাম । পরে বাবা লাটাই চালানোটাও শিখিয়ে দিয়েছিল কিন্তু বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন তাই ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে থাকি বাবার কথা খুব মনে পড়ে । বাবাকে খুব মিস করি। তারপর আমাদের এক দুর সম্পর্কের আত্মীয় আমাদের দেখাশুনো করে আমার পড়ার খরচ দেয় তাই আমরা এই শহরে এসেছি ।“ কথাগুলো শুনে রাজের বুকটা কান্নায় ফেটে পড়ল কারন বাবা মা না থাকার যন্ত্রণাটা কি তা রাজ ভালই জানে । রাজও দিদি ছাড়া কিছুই হতে পারত না, আজ রাজ যা কিছু হয়েছে সবই দিদির জন্য । তাই আর কিছু কথা না বলে নিচে নেমে এল।
২৬শে নভেম্বর
রাজ পল্লবীকে দেখতে পেয়ে ছাদে ডাকল কিন্তু পল্লবী এল না । রাজ পল্লবীকে খোঁজ করছে, ডাকছে কিন্তু কোনো সাড়া পাচ্ছে না । রোজ রাত্রিবেলা ছাদে এসে অপেক্ষা করছে কিন্তু পল্লবী আসছে না ছাদে । কয়েকদিন পর পল্লবী নিজেই ডাকল রাজকে ছাদে আসার জন্য তখন রাত এগারোটা । পল্লবী রাজকে বলল, “কি ব্যাপার তুমি এভাবে ঠান্ডায় রাত্রিবেলা ছাদে দাঁড়িয়ে থাক কেন আর আমাকে ফলো করছ কেন এত ঠান্ডায় কেউ ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে ।“ রাজ বলল, “এই তো তার মানে আমার জন্য চিন্তা হচ্ছে তাহলে । আমার কথা ভাবছে। আমার ঠান্ডা লাগা আমার শরীর খারাপ নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে ।“ এভাবেই দুজনে কথা বলতে লাগল আর এইভাবেই রাজ আর পল্লবী বন্ধু হয়ে উঠল ।
১লা ডিসেম্বর
এদিন রাত্রিবেলা ওরা দুজনে ছাদে কথা বলছে এমন সময় প্রকাশবাবু, ঐ দুর সম্পর্কের আত্মীয় এসে পল্লবীর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল নিচে । ফ্ল্যাটে ঢুকে পল্লবীকে জিজ্ঞাসা করল, “পল্লবী, এত রাতে ঐ ছেলেটার সাথে তুমি কি করছিলে ছাদে ? কি সম্পর্ক তোমাদের ?” পল্লবী বলে, “আমাদের মধ্যে কিছুই সম্পর্ক নেই ও আমার বন্ধু ।“ প্রকাশ বাবু বলেন, “ওসব বন্ধু আমি জানি না তোমাকে এখানে থাকতে দেওয়া হয়েছে পড়াশুনার জন্য আর তোমার মায়ের সাথে আমার কথা হয়ে গেছে তোমার বিয়ে আমার সাথেই হবে তাই তোমায় আমি দেখাশুনো করি তোমার পড়াশুনার খরচ আমি এমনি এমনি চালায় না বুঝলে ।“ সব শুনে পল্লবী উত্তর দেয়, “ আমি যদি আগে জানতাম যে এই কারনে আপনি আমাদের দেখাশুনো করেন তাহলে আপনাকে বিয়ে করার আগে আমি সুইসাইড করব আর আমার মায়ের দোষ যে আমার মা বাবা মারা যাওয়ার পর ভিক্ষা না করে আপনার কথায় এইভাবে রাজী হয়েছে ।“ তারপর দরজাটা মুখের উপর দড়াম করে বন্ধ করে দিল পল্লবী । পরদিন আর রাজের সাথে পল্লবির দেখা হয়না । রাজ ইচ্ছে করেই কয়েকটা জামাকাপড় নিয়ে ছাদে গেছে কাচতে যে কোনোদিন একটা গামছাও ধুয়েনি আসলে ছাদে গেছে এই ভেবে যদি ওর সাথে পল্লবীর দেখা হয়ে যায় । কিন্তু না দেখা হল না । দিন দুই পেরিয়ে গেল রাজের সাথে পল্লবীর দেখা হয়নি । কয়েকদিন পর পল্লবী রাজের সাথে দেখা করবে বলে ইশারায় রাজকে ছাদে যেতে বলল। রাজ ছাদে এল কিছুক্ষণ পর পল্লবীও এল । পল্লবী রাজকে সব জানালো । তারপর থেকে রাজ আর পল্লবী এভাবেই রাত্রিবেলা দেখা করতে লাগল ছাদে ।
৭ই ডিসেম্বর
রাজ আর পল্লবী রাত্রিবেলা ছাদে কথা বলছে হটাত প্রকাশ বাবু ছাদে এলেন একটা চেলা কাঠ নিয়ে। পিছন থেকে রাজের মাথায় আঘাত করতে যাবেন রাজকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে পল্লবী রাজের সামনে এসে দাঁড়ালো, চেলা কাঠের বারি পরলো পল্লবীর মাথায় । মাথা ফেটে নাক দিয়ে মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে পল্লবীর । প্রকাশ বাবু ছুটে বেরিয়ে গেলেন । রক্তাত অবস্থায় পল্লবীকে কোলে তুলে যা হোক করে রাজ নিয়ে এল হসপিটালে । হসপিটালে এসে ডাক্তাররা বললেন পল্লবী আর বেঁচে নেই। ওদিকে প্রকাশ বাবু পুলিশ নিয়ে এসে হাজির হসপিটালে আর রাজের দিকে পুলিশদের দেখিয়ে দিয়ে বলেন, “এই ছেলেটা আমার হবু স্ত্রীকে মেরে ফেলেছে ।“ পুলিশ ধরে নিয়ে যায় রাজকে ।
বর্তমান অবস্থা
“কি ! শুনলেন উকিলবাবু । বুঝতে পারলেন এবার সব” – রাজ বলল । উকিলবাবুর চোখ তখন ছলছল করছে। “ সত্যি গোস্বামী বাবু আপনার কথা শুনে বুঝতে পারলাম ভালোবাসা কাকে বলে । আমি সত্যিই খুব দুঃখিত আপনার মতো একজন সৎ মানুষকে আমি বাঁচতে পারলাম না “– এই কথা বলে উকিলবাবু চলে গেলেন ।
রাত ১১ টা
জেলার সাহেব, পুলিশ সকলেই এসে উপস্থিত হলেন রাজের সামনে রাজকে নিয়ে যাওয়ার জন্য । জেলার সাহেব বললেন, “ আর একটু পরেই তোমায় ফাঁসি দেওয়া হবে তাই তার আগে তোমার কি ইচ্ছা আছে বলো আমরা করার চেষ্টা করব। “ রাজ বলল, “আমার দুটো ইচ্ছে আছে ।“ জেলার সাহেব বলেন , “হ্যাঁ নিশ্চয় বলো কি ইচ্ছা ।“ “ আমার প্রথম ইচ্ছা আমি ঐ উকিলের সাথে দেখা করতে চাই আর আমার দ্বিতীয় ইচ্ছা আমাকে একবার ঐ জায়গায় নিয়ে যেতে হবে যেখানে পল্লবীকে দাহ করা হয়েছে ।“ জেলার সাহেব বললেন, “ঠিক আছে ।“ তারপর ওরা রাজকে প্রথমে নিয়ে যায় উকিলবাবুর কাছে । রাজ বলে, “উকিলবাবু আপনি হেরে যাননি, আপনি তো আমাকে জিতিয়ে দিয়েছেন, হ্যাঁ আইনের কাছে আপনি হয়ত হেরে গেছেন কিন্তু আমার আর পল্লবীর ভালবাসাকে আপনি জিতিয়ে দিয়েছেন। আমাদের মিলন হতে চলেছে, এই পৃথিবীর মাটিতে হয়নি ঠিকই কিন্তু স্বর্গে নিশ্চয় হবে আর স্বয়ং ভগবানও এটাই চেয়েছিলেন । পল্লবী অপেক্ষা করছে আমার জন্য উকিলবাবু আপনি সত্যি জিতে গেছেন ।“ উকিলবাবু কান্না চোখে রাজকে বলল, “আপনি খুব ভালো মানুষ আপনি কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সব বুঝতে পেরেছি, কতটা ভালবাসলে এইভাবে নিজের জীবনকেও এভাবে স্যাক্রিফাইস করা যায় তা আপনার ভালোবাসার গল্প না শুনলে জানতে পারতাম না । আপনি আপনার সব টাকা ফেরত নিন গোস্বামী বাবু ।“ রাজ বলে, “না উকিলবাবু ও টাকা আমি নেব না আপনি রাখুন আর একান্তই যদি দিতে চান তবে আমার দিদিকে দেবেন আর বলে দেবেন যে আমি আর দিদিকে দেখতে চায়না কারন দিদি আমাকে দেখলে খুব কাঁদবে আর আমি দিদিকে কাঁদতে দেখতে পারবো না। আসি উকিলবাবু ।“ তারপর ওরা রাজকে নিয়ে যায় সেই শ্মশানে যেখানে পল্লবীকে দাহ করা হয়েছিল । তখনও ওখানে হাড়, কাঠ কয়লা, আংরা পরে আছে । রাজ ওগুলোর উপর শুয়ে পরলো । আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “ প্রাণপ্রিয়, তিনদিন হয়ে গেল তোমায় দেখিনি, তিনদিন পর আজ তোমায় দেখব আর মাত্র ত্রিশ মিনিট তারপরই আমি আসছি তোমার কাছে চিরকালের জন্য ।“

