মিস্টার পারফেকশনিস্ট
মিস্টার পারফেকশনিস্ট
পল্লবী খুব তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে গাড়ি নিয়ে বেরোলো কিন্তু বাঁকুড়ার কাটজুড়িডাঙার মোরে এসে ট্রাফিকে আটকে পড়ল । পল্লবী কেমিস্ট্রিতে পি. এইচ ডি . করা নেট পাশ করা একজন মেয়ে যে আর কয়েকদিন পরেই কোনো একটা কলেজ জয়েন করবে । পল্লবীর গাড়িটার পাশেই একটা সাদা রঙের Toyota গাড়ি এসে দাঁড়ালো । গাড়ির কাঁচ খুলে ভিতরে থাকা ছেলেটা তার গাড়ির আয়না দেখে চুল ঠিক করছে চশমা ঠিক করছে গাড়ির ভিতর বসেই । পল্লবী সব দেখছে হটাত বলে উঠল, “ হাই হ্যালো মিস্টার “ । ছেলেটা গাড়ির ভিতর থেকেই এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে লাগল যে মেয়েটা কি ওকেই কিছু বলছে নাকি অন্য কাউকে ডাকছে । ঠিক তখনই পল্লবী আরও বলে উঠল, “ এই যে আপনাকেই বলছি ।“ ছেলেটা আর কিছু না করে গাড়ির কাঁচগুলো তুলে দিল । আর সেটা দেখে পল্লবী খুব রেগে গেল । ভাবলো – আমি পল্লবী চ্যাটার্জি, আমার বাবা রাঘব চ্যাটার্জি যে কিনা এই বাঁকুড়ার একজন সম্মানীয় মন্ত্রী তার মেয়েকে এই ভাবে ইগনোর করল, কোন কথা বলল না অপমান করল । আমিও দেখছি ওকে ওর কত ক্ষমতা । তারপর ছেলেটার গাড়ির পিছনে ফলো করতে লাগল । দেখল ছেলেটা বাঁকুড়ার একটা শপিং মলে গিয়ে ঢুকে গেল। পল্লবীও গাড়িটা রাস্তার ওপর দাঁড় করিয়ে রেখে শপিং মলে ঢুকল কিন্তু ছেলেটাকে কোথাও আর দেখতে পেল না। বাইরে এসে গার্ডকে জিজ্ঞাসা করল,
-এই মাত্র এখানে একটা ছেলে ঢুকল কোনদিকে গেছে?
-এখানে তো অনেক ছেলেই আসছে কোন ছেলেটার কথা বলছেন আপনি ?
-আরে যে এই মাত্র ব্লেজার পরে ঐ গাড়ি থেকে নেমে ঢুকল সে ।
- উনি তো আমাদের মালিক
-ওনার সাথে দেখা করব আমি এখনি
-না ওনার সাথে দেখা করা যাবে না
-কেন যাবে না
এই নিয়ে ওদের মধ্যে একটা বচসা শুরু হল । খানিক পর অপূর্ব, ম্যানেজার এসে জিজ্ঞাসা করল কি ব্যাপার । পল্লবী বলে,
-আমি একবার আপনাদের মালিকের সাথে দেখা করতে চায়
-দেখুন ওনার সাথে তো দেখা করা যাবে না
-ঠিক আছে তাহলে ওনার নম্বর টা দিন
-সেটাও দেওয়া যাবে না
-কি নাম ওনার
-ওনার নাম রাজ গোস্বামী
-আচ্ছা দেখছি
এরপর পল্লবী রেগেমেগে অপূর্বর নম্বরটা নিয়ে ওখান থেকে বাড়ি চলে এল । পল্লবীর মা মারা গেছে অনেক আগেই তাই বাবার কাছে মেয়ে বড্ড আদুরে । বাড়ি ফিরে পল্লবী বাবাকে সব বলল,
-জানো বাবা আজ একটা ছেলে আমাকে ইগনোর করেছে ।
-কে ছেলেটা ? মার খাওয়াবো গুন্ডা দিয়ে?
-না বাবা ও আমাকে ইগনোর করেছে আমিই ওকে বোঝাবো কে আমি
অপূর্ব আর রাজ দুজনেই খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাই পরদিন সকালে যখন দুজনে একসাথে টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট করছে অপূর্বর ফোনটা বেজে উঠল ।
-হ্যালো
-আপনার মালিকের নম্বর টা দেওয়া যাবে?
-কে আপনি ?
-আমি সেই মেয়েটা যে কাল শপিং মলে গিয়ে রাজ গোস্বামীর খোঁজ করছিলাম ।
-আচ্ছা । হ্যাঁ নম্বর দেওয়া যাবে কিন্তু আপনি কি করবেন
কি বলবে কিছু বুঝতে না পেরে পল্লবী তাড়াহুড়োতে বলে ফেলল,
-আমি আপনাদের শপিং মলের মেইন ডিজাইনার হতে চাই
-ঠিক আছে তাহলে আপনি কাল চলে আসুন ইন্টারভিউ দিতে
-ওকে
পরদিন যথারীতি পল্লবী গেল দেখল অখনে আরও অনেকেই এসেছে ইন্টারভিউ দিতে । একে একে হচ্ছে এবার পল্লবীকে ডাকল ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য । পল্লবী কিন্তু নিজের নাম ছাড়া বাকি সব বায়োডাটা মিথ্যে দিয়েছে, মানে ওর বাবা যে একজন মন্ত্রী সেটা সম্পূর্ণ গোপন রেখেছে । ইন্টারভিউ টেবিলে রাজ আর পল্লবীর একদম সোজাসাপটা কথাবার্তা চলছে । রাজ পল্লবীকে প্রশ্ন করল,
-আপনি মেইন ডিজাইনার কেন হতে চেয়েছেন?
-ছোটবেলা থেকেই এমব্রয়ডারি ভালো পারি আর এই সূঁচ সুতোর কাজ বরাবরই মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য তাই জন্য।
-এত কোনো উত্তর হল ?
-আপনার মনের মধ্যে কি উত্তর আছে তা তো আমার জানা নেই তাহলে আমাকে আগে জানতে হবে তারপর তাহলে উত্তর দিতে হবে।
-আপনি কি করেন ?
-আমি ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়ছি
-ও পড়ছেন মানে এখনও কমপ্লিট হয়নি
-না, কেন কমপ্লিট হলেই বুঝি ডিজাইনিংয়ের সব বোঝা যায় নিজের মধ্যে থাকা প্রতিভা দিয়ে করা যায় না ?
শেষে অপূর্বর তত্পরতায় পল্লবীকে মেইন ডিজাইনার হিসেবে নেওয়া হল । 14ই নভেম্বর পল্লবীর জয়েনিং । অফিসে আসার পর পল্লবীর প্রথম কাজ পড়ল বসের জন্য কফি নিয়ে যাওয়া। পল্লবী কফি নিয়ে সোজা বসের রুমের ভিতরে ঢুকে গেল, তা দেখে রাজ বলল,
-কি ব্যাপার ? অফিসে বসের রুমে ঢোকার আগে নক করে বলতে হয় “ May I come in sir ? “ জানো না তুমি?
-এক হাতে কফি আর এক হাতে জলের গ্লাস পায়ে করে দরজা খুলছি দেখতে পেয়েও উঠে এসে দরজাটা খুলতে পারলেন না একবার?
এই নিয়ে রাজের সাথে পল্লবীর এক মুহুর্ত ঝগড়া হয়ে গেল । কয়েকদিন পর রাজের কোম্পানিতে লস হতে দেখা গেল । তাই সব স্টাফদের নিয়ে রাজ একটা মিটিং করবে ঠিক করল কিন্তু সেখনে পল্লবীকে থাকতে দেওয়া হবে না আর সেটা শুনে পল্লবী অফিসে ঢুকেই সোজা রাজের রুমে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
-কি ব্যাপার আমাকে মিটিংয়ে কেন থাকতে দেওয়া হবে না?
-তুমি একজন ফ্যাশন ডিজাইনার তোমার এই মিটিংয়ে থেকে কি হবে?
-আমি এই মিটিংয়ে থক্তে চাই আর দেখতে চাই ঠিক কি কারণের জন্য আমাদের প্রোডাক্ট রিজেক্ট করা হয়েছে
-ঠিক আছে থাকবেন
পরদিন মিটিংয়ে আলোচনার সময় সবকিছু দেখে পল্লবী বলল,
-এখানে মেয়েদের জামাকাপড়ের বয়ন সুতো টা খারাপ, ফেবরিক টাও ভালো নয় আর ছেলেদের জামার কলারের সেলাইটা উল্টো দিকে বোনা হয়েছে আর কলারের ভিতরে যে ফেবরিকটা দেওয়া হয় সেটা নেই তাই সব রিজেক্ট করা হয়েছে ।
-তুমি দুদিন এসে সব বুঝে গেছো দেখছি
-আমি সবকিছু দেখে যা বুঝলাম আর যা মনে হল তাই বললাম
তখন বাকিরা সবাই সবকিছু চেক করে দেখল হ্যাঁ সত্যিই তাই পল্লবী যা বলল সব কিছুই ঠিক । রাজও দেখল ঠিকই বলছে পল্লবী । আর এই কারণেই কোম্পানির সব মিলিয়ে প্রায় দু লাখ টাকার লস হয়েছে। রাজ আর কিছু না বলে অফিসের বাইরে বেরিয়ে এল । এসে টেনশনে পান খেতে লাগল । ওর পিছনেই পল্লবীও বেরিয়ে এল, রাজকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগল,
-জিনিসগুলো দেখছিলাম চোখ দিয়ে কান কিন্তু সবই শুনতে পাচ্ছিল তাই ঠিক কি কি কথা হচ্ছিল সবকিছুই কানে এসেছে । কি Mr. Perfectionist কি ভাবছেন আমাকে নিয়ে ?
-তোমাকে নিয়ে ভাববো তাও আবার আমি , কতো টাকা রোজগার করো তুমি, কি যোগ্যতা আছে তোমার যে তোমাকে নিয়ে ভাবতে হবে আমাকে ।
-মানুষকে মানুষ বলে ভাবতে পারেন না আপনি । তার যোগ্যতা নিয়ে ভাবেন । মানুষকে মানুষের কাজ দেখে ভাবতে শিখুন তার ধর্ম বা তার ধনী গরীব অবস্থা দেখে নয় ।
রাজ পল্লবীর কথায় আরও রেগে গিয়ে সপাটে একটা চর মারল পল্লবীর গালে । পল্লবী তখনই বাড়ি ফিরে এল । এসে বাবাকে সবকিছু বলল । বাবা বলল,
-তুই আমার মেয়ে হয়ে আড়াই হাজার টাকার জন্য এরকম একটা জায়গায় জয়েন করেছিস । আর ও কিনা তোর গায়ে হাত তুলেছে । আমি তোর জন্য অনেক ভালো একটা ছেলে এনে দেব ।
-আমি কিন্তু তাহলে সুইসাইড করবো বাবা, ও আমার গায়ে হাত তুলেছে তাই ও ছাড়া আমায় আর কেউ ছোঁবে না ।
-আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে মা কি করবো বল তুলে নিয়ে আসব গুন্ডা দিয়ে ছেলেটাকে আমার বন্দুক দিয়ে ছেলেটাকে গুলি করে দিবি । কি চাস তুই বল?
-না আমি ওকে বোঝাতে চাই ও কার গায়ে হাত তুলেছে । আমি ওকে বিয়ে করতে চাই । এনে দাও ওকে আমার কাছে। আমি যে ওকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি ।
-এখনি বিয়ে করবি?
-হ্যাঁ এখনি করব।
গুন্ডা দিয়ে অপূর্ব আর রাজকে তুলে নিয়ে আসা হল আর এদিকে মন্ত্রী হওয়ার কারনে তিন ঘন্টার মধ্যে বিয়ের মন্ডপ, পুরোহিত মশাই থেকে শুরু করে বিয়ের সমস্ত আয়োজন প্রস্তুত হয়ে গেল ।
-কি ব্যাপার আমাদের এইভাবে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে কেন?
-তোমায় আমার মেয়েকে এখনই বিয়ে করতে হবে তাই জন্য ।
-মানে টা কি?
রাজ আর অপূর্বকে বন্দুকধারী গুন্ডা গুলো ঘিরে রেখেছে । অপূর্ব আর রাজ সবকিছু বুঝতে পেরে অপূর্ব বলল,
-ঠিক আছে বিয়ে তো হবেই কিন্তু তার আগে ওদের দুজনকে একবার দশ মিনিটের জন্য অন্তত কথা বলতে দিন। চলুন আমরা সবাই একটু বাইরে যায় ওর একটু আলাদা করে কথা বলুক ।
-ঠিক আছে ।
রাজ আর পল্লবী বাদে বাকিরা সবাই বাইরে বেরিয়ে গেল । রাজ পল্লবীকে বলল,
-২৫ শে অক্টোবর যখন আমি ওড়িশা থেকে পশ্চিমবঙ্গ ফিরছিলাম তখন আমি একটা মেয়েকে দেখি আর তখনই ঠিক করি আমি এরকমই একটা মেয়েকে বিয়ে করব । কিন্তু মেয়েটার মধ্যে একটা অহংকার আর ইগোইস্টিক মনোভাব দেখতে পায় । তাই ঠিক করি প্রথমে ওর ঐ ইগো আর অহং বোধ টা আমি আমার পায়ের তলায় নিয়ে আসবো । আর সেই মেয়েটা কে জানো ? তুমি । সেদিন আমি দেখেছিলাম, তুমি গাড়ি থেকে নেমে একটা গরীব বাচ্চা ছেলের সাথে খুব বাজে ভাবে কথা বলছিলে । তাকে তুমি তোমার বড়লোকিপোনা দেখাচ্ছিলে । তাই আগে তোমার ঐ অহংকার ঘুঁচাতে চেয়েছিলাম । আর আজ দেখো তুমি আমায় বোঝাচ্ছিলে মানুষকে মানুষ বলে ভাবতে শিখতে । মানে আমি আজ স্বার্থক হয়েছি আমি তোমার সমস্ত অহংকার সমস্ত ইগো ঘুঁচিয়ে তোমায় একটা মানুষ করে দিতে পেরেছি । আমি তো তোমাকেই বিয়ে করতে চেয়েছিলাম তাই জন্যই তো এতো কিছু প্ল্যান করতে হয়েছে । আর তাতে অপূর্ব আমায় সাহায্য করেছে । আসলে তুমি আমায় সেদিন ফলো করোনি তোমাকে আমি ফলো করতে বাধ্য করেছিলাম কারন ওটা ছিল প্ল্যানের একটা পার্ট । তোমাকে আমার অফিস অবধি ডেকে আনা আমার নম্বর দেওয়া আমার অফিসে মেইন ডিজাইনারের কাজ দেওয়া তোমায় অপমান করা সবকিছুই আমার আর অপূর্বর প্ল্যান । এখানে তুমি কিছুই করোনি তোমাকে আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী সবকিছু করতে বাধ্য করা হয়েছে । আর আজ দেখো আমি সফল হয়েছি । আমার তোমাকে বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নেই ।
পল্লবী সবকিছু শুনার পর রাজকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ আমি তোমাকে সত্যি খুব ভালোবাসি “ । তারপর দুজনে একসাথে গান ধরল – মেঘ লিখেছে আমায় আমার হয়ে সে তাঁকে দেখতে চাই । আমি বলি যে মেঘ দেখাবো তোমায় যতদূর আকাশ দেখা যায়।

