💞 ফিরে দেখার ছবি 💞

শর্মিষ্ঠা মুখার্জী🔥 অগ্নিশিখা

বাড়ির সামনের গলির মুখে স্কুলের গাড়ি থেকে নামলো মেখলা । রোজকার মতো গলির মুখে দাঁড়িয়ে আছে মেখলার মনি মাসি । 

মনি মাসিকে মেখলার ঠাকুমা যখন বাড়িতে এনেছিল তখন মেখলার জন্ম হতে মাত্র মাস তিনেক বাকি । জন্মের পর থেকেই মেখলা এই মনি মাসির হাতেই বেড়ে ওঠে । মেখলার সমস্ত দেখাশোনার ভার ছিল মনি মাসির উপর । তাই মেখলা নিজের সব কথা, হাসি - কান্না - কষ্ট - আনন্দ সবকিছুই জানাতো মনি মাসিকে । আর মনি মাসির দায়িত্ব ছিল সব আবদার - দুষ্টুমির তালিকা মেখলার বাবা - মায়ের কাছে পেশ করা এবং অনুমতি আদায় করা । 

মেখলা গাড়ি থেকে নামলে মেখলার ব্যাগ হাত থেকে নিয়ে মনি মাসি একটু মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বললো , " মামনি আজকেও বুঝি কিছু খাওয়া হয় নি তাই না ? মুখটা একেবারে শুকিয়ে যাচ্ছে দিন দিন । এতো সুন্দর পরীর মতো মুখটার এটা কি হাল হচ্ছে শুনি ? " কোনো উওর দিলো না মেখলা শুধু একটু আলতো হাসলো । বাড়িতে ফিরে স্নান - খাওয়া সেরে ছাত্র - ছাত্রীদের ক্লাস টেস্টের খাতাগুলো যেই দেখতে বসেছে অমনি মা ঘরে এসে হাজির । শাড়ির আঁচলের ভাঁজে ধরে কিছু ছবি ভয়ে ভয়ে বের করে বললো , " মামনি এই পাত্রদের ছবিগুলো একটু দেখে বল কাউকে পছন্দ হোলো কিনা ? " মেখলা শুধু একবার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাত থেকে ছবিগুলো কেড়ে নিয়ে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে আবার খাতা দেখায় মন দিলো । এবার শুরু হোলো মেখলার মায়ের রাগের ভণিতা । " একি করলি তুই ? ছবিগুলো সব ছিঁড়ে দিলি । এভাবে কতোদিন চলবে শুনি ? আমাদের বয়স হচ্ছে, এরপর আমরা না থাকলে তুই একা কিভাবে থাকবি ভেবে দেখেছিস ? তোর কথা ভেবে ভেবে আমি, তোর বাবা, মনি মাসি আমরা কেউ রাতে ঘুমাতে পারিনা । তোকে তো একা ফেলে রেখে আমরা মরেও শান্তি পাবো না । " 

এবার মেখলা রাগে চীৎকার করে উঠে বলে , " আবার বিয়ে ? আমার আর ইভানের বিয়েটা তোমার কি ক্ষতি করেছিল ? আমাদের সমস্যা আমরা ঠিক মিটিয়ে নিতাম কিন্তু না তোমার সন্তান প্রীতির মাশুল দিতে হোলো আমাকে । আমাদের পাঁচ বছরের সম্পর্ক তোমার জন্য ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে আবার তুমি আমাকে বিয়ের কথা বলছো ? আমি তোমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছি আমি আর বিয়ে করবো না । এখন যাও আমার অনেক কাজ আছে । " মেখলার মা কি আর করে, অগত্যা মেখলার ঘর থেকে বেরিয়ে যায় । মেখলার মা আগাগোড়া খুব বদমেজাজি আর বাবা একেবারে মাটির মানুষ । মেখলার মায়ের উপর কোনোদিনই বাবা - মনি মাসি এমনকি মেখলা নিজেও কিছু বলার সাহস করতো না, এককথায় মেখলার মায়ের কথাই ছিল শেষ কথা । তাই মেখলার ভালোবাসার সংসার ভাঙতে দেখেও মেখলার বাবা একটি বারও মুখ খোলে নি আর মনি মাসি তো একজন আয়া মাত্র । 

মেখলা আর মায়ের মধ্যে দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে প্রায় প্রত্যেকদিন বাড়িতে বিশ্বযুদ্ধ চলে । তাই মেখলা বাড়িতে বিশেষ কারো সাথে কথা বলে না । বাবা আর মনি মাসির সাথে যদিও কথা হয় কিন্তু মায়ের সাথে একদমই না । স্কুলের বাচ্চাদের সাথেই মেখলার একটা আত্মিক টান, ওদের নিয়ে বেশ ভালোই আছে মেখলা । 

স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা অনুরাধা দির খুব কাছের মানুষ মেখলা । হবে নাই বা কেনো ! 

মেখলা একসময় ছিল অনুরাধা দির প্রিয় ছাত্রী । বিয়েতেও তিনি গিয়েছিলেন। 

মায়ের মতো স্নেহ করতেন মেখলাকে । 

মেখলা চতুর্থ শ্রেণীতে আঁকার ক্লাস নিচ্ছে তখন স্কুলের পিয়ন এসে বলে যায়, 

" মেখলা দিদিমনি আপনাকে বড় দিদিমনি একটু দেখা করতে বলেছেন । " মেখলা বলে , " অমল দা তুমি গিয়ে বলো আমি এই ক্লাসটা শেষ করেই যাচ্ছি "। পিয়ন অমল দা " আচ্ছা " বলে চলে যায় । 

ক্লাস শেষ করে মেখলা অনুরাধা দির সাথে ওনার কেবিনে দেখা করতে যায় ।

মেখলা : " বড়দি আসবো ? "

অনুরাধা দি : " আরে ! আয় আয় ভিতরে আয় । "

মেখলা : " কি হয়েছে গো বড়দি , এতো জরুরি তলব " । 

অনুরাধা দি : " বস্ , আজকে কতো তারিখ তোর মনে আছে ? আজকের দিনে কি হয়েছিল মনে আছে তোর ? "

মেখলা : " হ্যাঁ , আজকে ১৪ই মাঘ । আজকের দিনটা যে আমি কোনোদিনই ভুলতে পারবোনা বড়দি । "

অনুরাধা দি : " একটা কথা বলি, একবার ফোন করনা ইভানকে । অনেকতো হোলো, শুধু শুধু কষ্ট পেয়ে নিজেকে শেষ করছিস কেনো ? "

মেখলা : " কিন্তু বড়দি ফোন করাটা কি ঠিক হবে ? যদি ফোন না ধরে ? যদি, যদি অপমান করে ফোন disconnect করে দেয় ? না না, থাক বরং । "

অনুরাধা দি : " আহ্ ! আমি বলছিতো । একবার ফোন করেই দ্যাখ , যদি না ধরে তাহলে আর কোনোদিনও কোনো যোগাযোগ করবি না । তবে আমি বলছি, একবার ফোন কর । "

মেখলা অনুরাধা দির কথামতো ইভানের নাম্বার ডায়াল করতেই সাথে সাথে অপরদিক থেকে ইভানের কন্ঠস্বর ভেসে আসে " হ্যালো, মেখলা । কেমন আছো ? " মেখলা যেন আকাশ থেকে পড়ে , আসলে ওতো আশাই করে নি ওর ফোন ইভান ধরবে । 

ইভান : " মেখলা, মেখলা বলো কেমন আছো ? "

মেখলা ভারাক্রান্ত গলায় উওর দিলো " আমি ভালোই আছি । যতোটা ভালো থাকা সম্ভব ততোটুকুই ভালো আছি । তুমি কেমন আছো ? "

ইভান : " আমি ও যতোটুকু ভালো থাকা সম্ভব ততোটুকুই ভালো আছি । আচ্ছা মেখলা, একদিন দেখা করতে পারবে ? আমি তোমার বেশি সময় নষ্ট করবো না কথা দিচ্ছি । শুধু একটিবার দেখা করতে পারবে কি তুমি ? "

মেখলা : " হ্যাঁ, আজকে সন্ধ্যা ছ'টায় আমাদের সেই পুরানো ক্যাফেতে আমি অপেক্ষা করবো "। এই বলে ফোনটা কেটে দিয়েই অনুরাধা দিকে জরিয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে মেখলা । 

অনুরাধা দি : " কিরে, আমি বলেছিলাম বলেই তো ফোনটা করলি । দেখলি তো ইভান তোর ফোন সাথে সাথেই ধরেছে , যেন তোর ফোনের অপেক্ষাতেই ছিল । এবার ধীরে ধীরে তোদের মধ্যেকার সব ভুল বোঝাবুঝি, রাগ - অভিমান আস্তে আস্তে মিটিয়ে ফেল । "

রোজকার মতো স্কুলের গাড়ি থেকে নামতেই দ্যাখে মনি মাসি দাঁড়িয়ে আছে । রোজকার মতোই সুন্দর মুখখানা কি করছিস এই বকুনি শুনতে শুনতে বাড়িতে ফেরে মেখলা । বাড়িতে ফিরে স্নান - খাওয়া সেরে বিছানায় ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়ে কবিগুরুর গান শুনতে শুনতে চোখ বুজলো মেখলা । চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা । 

" আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে

  আছো তুমি হৃদয় জুড়ে

আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে

আছো তুমি হৃদয় জুড়ে

ভালো আছি, ভালো থেকো

আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখ

ভালো আছি, ভালো থেকো

আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখ

দিও তোমার মালা খানি

বাউল এর এই মন টা রে

আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে

আছো তুমি হৃদয় জুড়ে

আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে

আছো তুমি হৃদয় জুড়ে

আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে

আছো তুমি "

সন্ধ্যা ছ'টার মিনিট পনেরো আগেই সেই পুরানো ক্যাফেতে পৌঁছে যায় মেখলা । ইভান খুব punctual , একদম ছ'টায় এসে ঢুকলো । দূর থেকে ইভানকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মেখলা । ইভানের পড়নে মেখলার দেওয়া সেই ডেনিম ব্লু জিনস আর সাদা শার্ট । সামনে এসে দাঁড়ালো ইভান, গায়ে সেই পুরানো চেনা পারফিউমের গন্ধ । অনেক কথা হোলো সেদিন দুজনের মধ্যে । চোখের জলে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল দুজনের মনে জমে থাকা সকল মান - অভিমান । দেখতে দেখতে দুই ঘণ্টা কিভাবে পার হয়ে গেল ওরা দুজনে টের পেলো না । 

এরপর থেকে মাঝে মাঝেই দেখা করতো মেখলা আর ইভান । ভাঙ্গা সম্পর্ক আবার প্রেমের ডোরে বাঁধা পড়লো নতুন করে ।দুজনের হৃদয়ের ক্যানভাসে নতুন করে অঙ্কিত হোলো ফিরে দেখার ছবি । 

  💔 💞 মধুরেণ সমাপয়েৎ 💞 💔