ফিরে দেখা
ফিরে দেখা
ঢং ঢং ঢং করে থার্ড পিরিয়ডের ঘন্টা পড়তেই আমরা একটু সতর্ক হয়ে উঠলাম| এখন ইংলিশ ক্লাস| আমাদের ইংলিশ টিচার বাসু স্যার একটু খিটখিটে টাইপের| আমাদের কয়েকজন বাঙালি ছাত্রের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকলেও অবাঙালিদের তিনি খুব একটা পছন্দ করতেন না| বিশেষ করে বিহারী ছাত্রদের প্রতি অপছন্দের মাত্রা একটু বেশিই ছিল| বিহারী ছাত্রদের নিয়ে ঠাট্টা- তামাশা প্রায়ই করতেন| স্যারের এই অপছন্দের কারণ জিজ্ঞাসা করার সাহস কোনদিন হয়নি|
আমার বন্ধু ছিল বিকাশ ঠাকুর| স্যারের অপছন্দের তালিকার একজন| বিকাশকে দেখলেই স্যার বলতেন তোরা তো হনুমানের পুজো করিস| পড়াশোনা আর কি করবি? গাছেই ঝুলে থাক এই ধরণের বাধাধরা কথা তো প্রায়ই স্যার বলতেন| স্যার হিন্দি বলতেন বাংলা উচ্চারণে| যেমন সেবার ক্লাসে ঢুকেই বললেন‚
-তুমলোগ কো পাতা হেয় আমেরিকা নে এক কুত্তা কো চান্দ মে ভেজা হেয়?
আমাদের উত্তর দেওয়ার অপেক্ষা না করেই পিছনের বেঞ্চ থেকে বিকাশ উত্তর দেয় হ্যাঁ স্যরজি‚ পতা হ্যায়|
আমরা মনে মনে বললাম গেল রে বিকাশ আজকে| কেউ বাসুস্যারের সাথে পঙ্গা নেয়? কিন্তু বিকাশ তো বিকাশই|
- কি করে জানলি? নিউজ পেপার পড়া তো তোদের অভ্যাস নেই ভুরু কুঁচকে জানতে চান বাসুস্যার|
- নহি স্যরজি পেপার নহি পড়া| ও কাল রাতে খুব গরম ছিল কিনা‚ তাই রাতে ছদ পে শোয়া থা| হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি একটা রকেট যাচ্ছে‚ আর তার ভেতর থেকে কুভৌক রহা থা‚ তব হি পতা চলা কে কুত্তা চান্দ পে যা রহা হ্যায়|
হাসির চোটে আমাদের পেট ফেটে যাছিল| কিন্তু হাসার উপায় নেই| হাসি পেলে হাসতে না পারার মত শাস্তি বুঝি আর কিছু নেই|
বলাবাহুল্য, বিকাশ, স্যারর কিছু বলার আগেই বেঞ্চের উপর সটান দাঁড়িয়ে পড়লো | জানা কথাই ছিল সবার | বাসু স্যার একবার ওর দিকে তাকিয়ে নিজের কাজে, মানে আমাদের পড়ানোতে মন দিলেন | সারাটা পিরিয়ড সে বেঞ্চে দাঁড়িয়েই কাটিয়ে দিল|
বিকাশ‚ বিকাশ ঠাকুর‚ আমাদের গ্রুপে ছিল সবচেয়ে বড়লোক | ওর বাবা এখানকার নামকরা জমিদার|যদিও ওনার জমিদারি আমাদের এই ছোট শিল্পনগরীর এক্তিয়ারের মধ্যে পরতো না | ওনার জমিদারি শুরু হতো আমাদের এই শহরের সীমানার পর| প্রচুর জমি আর লেঠেল ছিল ওদের| এই জমিদারী গড়ে উঠেছিল ডাকাতি করা সম্পদের ওপর ভিত্তি করেই, অবশ্য এ সব আমাদের শোনা কথা| দুর্জনেরা বলে ওদের পূর্বপুরুষরা নাকি ডাকাত ছিল | কিন্তু বিকাশ যেমন ভোলাভালা ছিল তাতে কিছুতেই ওকে ডাকাতের ঘরের ছেলে বলে মনেই হত না| সে কথা ওকে আমরা বহুবার জিজ্ঞেস ও করেছি| আর প্রতিবার ও হেসে উত্তর দিত ' পতা নেহি য়ার '|
ও যখন স্কুলে আসত ওর সাথে দুজন বর্ডিগার্ড আসত| দুটোই ব্যায়াম করা হোৎকা চেহারার মালিক | কম্পাউন্ডে ঢোকার অনুমতি ওদের ছিল না‚ তাই ওরা গেটের বাইরে দারোয়ানদের সাথে বসে থাকত|
আমাদের বাসু স্যার ছিলেন একসময়ের নামকরা শিকারী| এ তথ্য অবশ্য তিনি নিজেই আমাদের জানিয়েছিলেন| নিজের শিকার করা নিয়ে মাঝে মাঝেই গল্প করতেন পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে| ওঁনার একটা দোনলা বন্দুকও ছিল| অনেকবার দেখেছি ছুটিছাটার দিনে খাঁকি হাফ শার্ট আর হাফ প্যান্ট পড়ে‚ দো-নলা বন্দুকটা কাঁধে ঝুলিয়ে রিক্সায় করে গম্ভীরভাবে শিকার করতে যেতেন| মজার ব্যাপার হল‚ যেতে দেখতাম কিন্তু কোনদিন ফিরতে দেখিনি| বিকাশ অবশ্য অন্য কথা বলত‚ অরে তুযে পতা নহী ও নিজের রখেলের কাছে যায় ছুটিছাটার দিনে| বলাবাহুল্য আমরা বিশ্বাস করতাম না| বাসুস্যার ওর ট্যাং খিচত বলেই এসব ও বলত আমরা মনে করতাম|
একদিন বাসু স্যার ক্লাস নিচ্ছেন| হঠাৎ করেই বিকাশ হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এলো| ও টয়লেটে গেছিলো|
- স্যারজি সাঁপ সাঁপ!
- কোথায় আবার সাপ দেখলি? স্যার জানতে চাইলেন|
- টয়লেটকে উপর‚ পানিকে ট্যাঙ্ককে পাস|
আমাদের স্কুল বাড়িটা ছিল খুব পুরোনো| ১৯২৫ সালে তৈরী হয়েছিল| টয়লেটগুলো ছিল মূল বাড়িটির বাইরে‚ আর টয়লেটের ছাদে পাতলা লোহার জলের ট্যাঙ্কগুলো ছিল ততোধিক পুরোনো| সুতরাং সাপ-খোপ থাকা কোনো বিচিত্র ব্যাপার নয়|
দাবানলের মত সারা স্কুলে খবরটা ছড়িয়ে পড়তে সময় নিল না| সারা স্কুলের সমস্ত ছেলে জড়ো হল মাঠের ধারের ঐ টয়লেটের কাছে| সবাই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে জল্পনা-কল্পনা করছে কি করা যায়| হেড স্যার আর অন্যান্য স্যারেরাও এসে গেছেন‚ কিন্তু ভিড়ের মধ্যে বাসুস্যার বেমালুম উধাও| ভয় পেল নাকি?
হঠাৎই স্যারের হুঙ্কার শোনা গেল‚
- কহা হ্যায় সাঁপ?
প্রায় পঁচিশ শো ছাত্র সন্মিলিতভাবে তাদের আঙুল তুলে টয়লেটের জলের ট্যাঙ্কের দিকে নির্দেশ করল|
এদিকে স্যারের পোশাক দেখে তো আমাদের চক্ষু চরকগাছ| এরই মধ্যে পোশাক বদলেও ফেলেছেন| স্যারের পরণে সেই খাঁকি শার্ট‚ হাফ প্যান্ট‚ মাথায় শোলার টুপি আর হাতে দো-নলা বন্দুক| ছেলেরা চেঁচানোর সাথে সাথেই হেডস্যার কিছু বলার আগেই বন্দুক জলের ট্যাঙ্কের দিকে তাক করে দড়াম দড়াম করে দুটো গুলি| ট্যাঙ্ক পুরো ফুটো হয়ে ধারাস্রোতের মত জল ভাসিয়ে দিল চারিদিক| বাসুস্যার আরও দুটো গুলি তার বন্দুকে পুরতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন|
- রুকিয়ে বাসু স্যার .... হেডস্যরের বললেন| কিন্তু হেডস্যারের কথা শেষ হবার আগেই বাসু স্যার বলে ওঠেন‚
- নহী জী! সাঁপ অভি মরা নহী|
- আপ মেরে কামরে মে আইয়ে|
বাসু স্যার কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন| তারপর চুপচাপ হেডস্যারের পেছু পেছু তাঁর কামরায় গিয়ে ঢুকলেন|
স্যাররা চলে যেতেই আমরা বিকাশকে চেপে ধরি|
- তুই ঠিক কোন জায়গায় সাপটা দেখেছিলি?
- সাঁপ নেহী থা কৈ‚ আমি তো এমনিই মজাক করছিলাম| নির্বিকার মুখে বলল বিকাশ|
আমরা অবাক|
-তুই শুধু শুধু স্যারকে বকা খাওয়ালি?
- উনিও তো শুধু শুধু আমায় বকেন| নির্বিকারভাবে বলে বিকাশ|
আমাদের বাসুস্যার ছিলেন অত্যন্ত সুপুরুষ| ধবধবে সাদা-ধুতি-পাঞ্জাবী পড়ে পামশু মচমচিয়ে যখন করিডর দিয়ে হেঁটে যেতেন তখন সবাই বুঝতে পারত‚ যে বাসুস্যার ক্লাসে আসছেন| মুহুর্তে ক্লাস চুপচাপ হয়ে যেত| এই বাসুস্যারের ছয় মেয়ে ছিল| প্রত্যেকেই রুপে লক্ষী আর গুণে সরস্বতী| ওঁনার গিন্নী ছিলেন চিররুগ্না| কোনদিনই আমরা তাকে দেখিনি| কিন্তু স্যারের মেয়েরা পাড়ার সমস্ত বাংলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সক্রিয় অংশ নিত যদিও খুব একটা সবার সাথে মিশত না|
এক শীতের সকাল| আমরা ক্লাসে বসে আছি| একটু পরেই টিফিনের ঘন্টা পড়বে| হঠাৎ করেই বচ্চা সিং ‚ আমাদের গেম টিচার ক্লাসে ঢুকে ক্লাসের ছেলেদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েই বিকাশের দিকে ইশারা করে বললেন
- আমার সাথে তাড়াতাড়ি এসো তুমি’| বলে বিকাশকে নিয়ে বেড়িয়ে গিয়েও ফিরে এসে স্যার আমাদের সবাইকে বললেন‚
-শুনো তুম সব‚ এখুনি ছুটির ঘন্টা বাজবে‚ আর ছুটির ঘন্টা বাজলেই তোমরা গেমস রুমের দিকে চলে আসবে| জিতেন্দ্র‚ অলোক আর সুরেন্দ্র তোমরা ক্লাস এইট থেকে ক্লাস ইলেভেন পর্যন্ত সব সেকশানে গিয়ে বলে এসো ওরাও যেন ছুটির ঘন্টা বাজলে গেমস রুমের সামনে চলে আসে| আর তোমরা খেয়াল রাখবে যাতে নিচু ক্লাসের বাচ্চারা একদম না বার হয়|’
কথাগুলো ঝড়ের মত বলে স্যার আর দাঁড়ালেন না‚ বিকাশকে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে চলে গেলেন|
আমরা তো হতবাক‚ কিন্তু বুঝতে পারছিলাম যে আজ কিছু একটা হাথাপাই হবে| কারণ এধরনের হুকুম শেষই হত মারামারি দিয়েই| কখনো মেরে আসতাম কখনো মার খেয়ে আসতাম| কিন্তু এবার মনে হচ্ছে গুরুতর কিছু| ছুটির ঘন্টা পরার সাথে সাথেই আমরা দৌড়লাম ফুটবল মাঠের পাশের গেমস রুমের দিকে|আমাদের গেমস স্যার বচ্চা সিং তখন পুরোপুরি সেনাপতির ভুমিকায়| NCC বন্দুকের কুঁদো‚ হকি স্টিক এবং হাতের কাছে যা যা পেয়েছেন সবই আমাদের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিলেন| ইশারা করে ফুটবল গ্রাউন্ডের দিকে নির্দেশ করলেন| স্যারের নির্দেশ মত মাঠের দিকে তাকিয়ে দেখলাম গোটা তিনেক হুডখোলা জিপ গাড়ি দাঁড়িয়ে আর সেগুলোতে গোটা পনেরোজন ষন্ডামার্কা লোক কারও হাতে বন্দুক‚ কারও হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে| এরপর আমাদের কি করতে হবে তা আর বলবার দরকার ছিল না| খুব একটা কিছু চমকে যায়নি আমরা| কারণ এই দৃশ্য আমাদের কাছে তেমন কিছু নতুন নয়| যারা বিহারের গয়া‚ রোহতাস‚ আরা জেলায় থেকেছেন তারা ভালো বুঝবেন|
বুঝতেই পারছিলাম বিকাশকে মারতে বা তুলতে মানে কিডন্যাপ করতে এসেছে‚ স্যারের নির্দেশ পেতেই প্রায় হাজারখানেকের মত ছেলে রে রে করে তেড়ে গেল ঐ লোকগুলো দিকে| | এর পরের দৃশ্য সিনেমার মত| লোকগুলো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলেরা পুরো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওদের ওপর| মিনিট কুড়ি ছেলেদের চিৎকারে ঐ লোকগুলোর আওয়াজ পুরো ঢাকা পড়ে গেছিল‚ আর বেধড়ক পিটুনি কাকে বলে সেদিন ওরা টের পেয়েছিল| কিন্তু মুশকিল হল জনা পনেরো লোককে মারার জন্য গোটা পঁচিশ-তিরিশজন ছেলেই ছিল যথেষ্ট কিন্তু অস্ত্র সবার হাতে| আর সবাই হাতের সুখ করে নিতে চাইছিল| কারণ তাদেরও অধিকার আছে ঐ লেঠেলদের মারার| এর ফলে কি হল‚ যারা প্রথম দিকে মারছিলো তারা কিন্তু সরে আসেনি‚ আর যারা তাদের পিছনে ছিল তারাও বেধড়ক লাঠি‚ হকিস্টিক চালাতে লাগল| আর সেগুলো পড়তে লাগল যারা প্রথমদিকে মারছিল তাদের ঘাড়ে-পিঠে| সে যাকে বলে বিশৃঙ্খলার এক চুড়ান্ত অবস্থা| একদিকে দেখলাম ক্লাস টেন এর সেকশান বি আর সেকশান সি-এর মধ্যে হাতাহাতি লেগে গেছে| অন্যদিকে তিন-চারজন ছেলে নিজেদের মধ্যে কি কারণে যেন মারামারি করছে|
এরই মধ্য হেড স্যার আর অন্যান্য স্যাররা এসে ধমকে ধামকে ছেলেদের থামাবার চেষ্টা করতে লাগলেন| উত্তেজনার চরমে সবাই তখন‚ থামতে বললেই কি আর থামা যায়‚ না থামানো সম্ভব| শেষে স্যাররা কিঞ্চিত চড়-থাপ্পড় দিয়ে অবস্থা আয়ত্তে আনলেন| এদিকে লেঠেলগুলোর অবস্থা আর কহতব্য নয়‚ তাদের সবকটাই উৎপাত করতে এসে চিৎপাত হয়ে মাঠে পরে রয়েছে‚ জামাকাপড় ছিঁড়ে খুড়ে একসা|কারো ধুতি আর নিজের জায়গায় নেই, জামা বলতে আর কিছু বাকি ছিল না ওদের |
এর মধ্যেই বিকাশের বাবার পাঠানো মুন্সিজি আর তাদের দলবল হাজির| তারা এসেই বিনা বাক্যব্যায়ে ওই লোকগুলো কে নিজেদের গাড়িতে তুলে নিয়ে ওখান থেকে চলে গেল | ওদের যাওয়ার একটু পরেই বিকাশের বাবা এসে গেলেন| তিনি গাড়ি থেকে নেমেই সোজা প্রিন্সিপালের ঘরে চলে গেলেন | বচ্চা সিং ও ওনার পিছু পিছু চলে গেলেন | আমরাও আর ওখানে দাঁড়ালাম না | সবাই নিজের নিজের ক্লাসে ঢুকে পড়লাম | স্কুলের মাঠ আবার আগের মতো খালি হয় গেল, যেন কিছুই হয় নি| স্কুলের ছুটির পর জানতে পারলাম যে বিকাশের বাবা কাল স্কুলের সব বাচ্চাদের জন্য মিষ্টি পাঠাবেন, সাথে পুরি আর সবজি | তাই কেউ যেন কাল টিফিন না আনে |
কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝলাম না গেমস স্যার জানলেন কি করে যে আজ এই কান্ডটা হতে পারে?
- ‘আসলে পিতাজী কালকেই গেমসস্যারকে ডেকে জানিয়ে দিয়েছিলেন| জমিন - জায়দাদ নিয়ে তো পিতাজির সাথে ওনার চচেরা ভাইদের অনেক দিন থেকেই ঝগড়া চলছে | ওদের পিতাজী মানে আমার পিতাজির চাচা কিছু বছর আগে খুন হয় | তাতে ওদের ধারণা ওটা পিতাজিই করিয়েছিলো, তাই ওরা আমাকে খুন করে তার বদলা নিতে চায়| ‘ বিকাশ নির্বিকার ভাবেই জানালো|
আমরা বিশেষ অবাক হলাম না| জমি-জায়গা নিয়ে তো এখানে আকছার খুন খারাপী হতেই থাকতো|
আমাদের সময় ক্লাস ১১ এ মাট্রিকুলেশন হত এবং প্রিবোর্ড এক্সাম হত ফাইনাল সিলেকশনের জন্য| কিন্তু সেবার জয়প্রাকাশ নারায়ণের মুভমেন্টের জন্য প্রিবোর্ড এক্সাম হল না‚ সবাইকেই পাশ করিয়ে দেওয়া হল| বিকাশও তৃতীয়বারে প্রিবোর্ড ক্লিয়ার করল বিনা এক্সামে|এবার সোজাসুজি আমরা মাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বসতে পারব| আমরা সবাই খুব খুশি‚ ভেবেছিলাম বিকাশও খুশি হবে‚ কিন্তু কোথায় কি? ও বেশ অখুশি| এইখানে জানিয়ে রাখি‚ স্কুলে আমাদের সাতজনের দলটাকে হেডস্যার থেকে স্কুলের পিওন সকলেই সমীহ করে চলত| তার অনেক কারণও অবশ্য ছিল| আমাদের গ্রুপটা লেখাপড়ায় খারাপ ছিল না| সবচেয়ে বড় কথা আমাদের গ্রুপটার দৌলতে আমাদের স্কুল দুবার ক্রিকেটের জেলা চ্যাম্পিয়ানশিপে ট্রফি ঘরে এনেছিল| এসব সত্ত্বেও আমাদের গ্রুপটা 'সেভেন প্রব্লেমস' নামে কুখ্যাত বা বিখ্যাত ছিল| আমি‚ বিকাশ‚ জিতেন্দ্র‚ অলোক‚ সুনীল‚ সুরেন্দ্র আর দেবাশিস এই সাতজনকে নিয়েই ছিল সেভেন প্রব্লেমস|
ফিরে যাই যেকথা বলছিলাম‚ তো বিকাশ তো মোটেই খুশি ছিল না যে প্রি বোর্ড এক্সাম ওকে দিতে হল না অথচ পাশ করে গেল| ও আমাদের কমনরুমে ডেকে নিয়ে গেল আর বলল‚
- ইয়ার তুমলোগ বতাও আমি কি করি?
- কেন রে তোর আবার কি হল?
-ভাই বাড়িতে আমার বিয়ে ঠিক করেছে|
- কেয়া তেরা সাদি!!! আমরা বিস্ময়ে হতবাক| প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে আমাদের হাসি শুরু হল‚ হাসি না বলে অট্টহাসি বলাই ভালো‚ সে আর থামতেই চায় না| যদিও বিকাশ আমাদের থেকে বছর তিনেকের বড় তা সত্ত্বেও এটা কি একটা বিয়ের বয়স হল নাকি! আর মাট্রিকুলেশেনে চান্স পাওয়ার সাথে বিয়ের কি সম্পর্ক? জিজ্ঞাসা করাতে বিকাশ বলল‚
- হাঁ রে‚ আসলে মেয়ের বাড়ির একটা ডিমান্ড ছিল যে‚ ছেলে মাট্রিক পাশ করলেই‚ ওদের মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দেবে|
- জয় জয়প্রকাশ নারায়ণজী কি জয়! আমরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম|
- তাহলে আর প্রবলেম কি? তুই বিয়ে করে নে| এমনিতেই তো তোর দাড়ি-মোছ ভালো বেরিয়ে গেছে| অলোক বলল|
- য়ার মজাক মত কর| আমার অনেক প্রব্লেম| বলতে বলতেই দেখলাম বিকাশ যেন লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে|
-ওয়ে কি বলছিস তুই? প্রব্লেম মতলব .... দেবাশিস চোখ কপালে তুলে প্রশ্ন করে|
- আরে নহী নহী ওরম কোন প্রব্লেম না| ও সব তো ঠিকই আছে| বিকাশ তাড়াতাড়ি ভুল ভাঙাতে উদ্যোগী হয়| বাত ইয়ে হ্যায় কি‚ মুঝে কিসি সে প্যার হো গয়া হ্যায়|
প্যার হো গয়া!!! আমাদের সময় পেয়ার-বেয়ার রুপোলি পর্দাতেই সীমাবদ্ধ ছিল| বাস্তব জীবনেও যে সেটা সত্যি হতে পারে এমনটাই আমাদের কল্পনায় ছিল না|
- অগর সাদি করুঙ্গা তো উসিসেই করুঙ্গা| বিকাশ ঘোষনা করে আমাদের বিহ্ববলতার মাঝেই|
- তো ঠিক আছে‚ তোর বাবাকে বল সেই কথা ‚ আমি বললাম|
- দিমাগ খরাব তো নহী হো গয়া তেরা? বাবা জানতে পারলে‚ চাবকে আমারা পিছওয়াড়া লাল করে দেবে| বিকাশের চোখে স্পষ্ট আতঙ্ক|
অনেকক্ষণ ধরেই নানান জল্পনা-কল্পনা চলল কি করে কি করা যায়| কিন্তু কোন উপায় বের হল না|
- এক চিজ বতা‚ ও লড়কি কৌন হ্যায় জিসসে তু প্যার করতা হ্যায়? হঠাৎ করেই সুনীল জানতে চায়| তাই তো? আমাদের তো আসল কথাই জানা হয় নি !
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয় না বিকাশ‚ কিছুটা সময় নেয়| তারপর কেটে কেটে উচ্চারণ করে‚
- অ ন্ত রা|
বেশ শকিং আমাদের কাছে নামটা| আমরা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম| কারও মুখেই যেন কোন কথা যোগাচ্ছিল না| নিস্তব্ধতা ভেঙে জিতেন্দ্র বলে উঠল‚
-চলে বে সব‚ শালা পিটওয়ায়েগা হমে| প্যার করনে কে লিয়ে কৈ ঔর নহী মিলা থা তুঝে ? শেষে বাসুস্যারের ছোট মেয়ে অন্তরা!!!
বিকাশকে রেখে আমরা নিজেদের ক্লাসের দিকে হনহন করে হাঁটা লাগালাম| হাঁটা নয়‚ প্রায় দৌড় লাগালাম| আর ক্লাসে এসে যে যার সিটে বসে পড়লাম| কেউ কারও সাথে কথা বলছিলাম না| কিছুক্ষণের জন্য যেন আমরা থম মেরে গেছিলাম| একটু পরেই বিকাশ ক্লাসে এসে আমার পাশে বসল|
- ইয়ার তু হি কুছ কর| কাতরভাবে বলল বিকাশ|
- ভাগ যা বে| আর কোন মেয়ে পেলি না? আমার রাগ তখন তুঙ্গে| প্রায় ধাক্কা দিয়ে ওকে আমি আমার বেঞ্চ থেকে সরিয়ে দিলাম| ও চুপচাপ পিছনের সারির একটা খালি বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়ল| ইতিহাস ক্লাসে স্যার এসে কি পড়ালেন আর কি লেখালেন কিছুই যেন মাথায় ঢুকলো না|
স্কুল ছুটির পর আমরা ছজন একসাথে ফিরছিলাম বিকাশকে বাদ দিয়ে| কিন্তু ছাড়ালে না ছাড়ে‚ দেখি বিকাশ আমাদের পেছু পেছু আসছে পেছনে দুজন হোৎকা দেহরক্ষী নিয়ে| পাত্তা দি না ওকে| কিন্তু ও আমাদের ছাড়ে না|
- ইয়ার‚ কুছ তো বোল? কেন এত রেগে আছিস তোরা আমার ওপর? আরে প্যার কিয়া নহী যাতা হো যাতা হ্যায়| আর ওর সাথে আমার বিয়ে না হলে আমি সুইসাইড করব|
- যা মর যা সালে| আমরা প্রায় সমস্বরেই আমাদের রায়ে শুনিয়ে দিলাম |
ও চুপ করে দাঁড়িয়ে গেল| বিকাশ আমাদের বন্ধু| কতদিন আমাদের রেস্টুরেন্টে খাইয়েছে| দরকারে-অদরকারে আমাদের পাশে থেকেছে| স্বভাঃবতই মনটা একটু নরম হয়ে গেল ওর প্রতি|
- ঠিক হ্যায় চল‚ পহলে আমাদের রসমালাই খাওয়া‚ তারপর ভাবছি| আমি বললাম | অন্য বন্ধুরাও আমাকে সাপোর্ট করল| বিকাশ এক পায়ে রাজি| ও আমাদের রসমালাই খাওয়াতে নিয়ে চলল| বিকাশের মুষড়ে পড়া মুখে হাসি ফুটে উঠল| ওর মুখে হাসি দেখে ওর হোৎকা দেহরক্ষীদেরও মুখে যেন হাসি দেখলাম মনে হল|
রসমালাই খেতে খেতেই আমি বললাম‚
- এক কাজ করা যায় আমরা বরং বচ্চা সিং-এর কাছে যাই‚ উনি যদি কোন রাস্তা দেখান|
বচ্চা সিং শুধু আমাদের গেমস টিচারই নন‚ আমাদের বন্ধুও বটে| সময়ে-অসময়ে‚ দরকারে-অদরকারে আমরা ওঁনার দ্বারস্থ হই| বিশাল লম্বা-চওড়া চেহারার দিলদরিয়া মানুষ বচ্চা সিং| আগে নেভিতে ছিলেন| স্কুলের সবার বন্ধু উনি|
সব শুনে উনিও থ| কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর বিকাশকে কাছে ডেকে যাকে বলে বিরাশি সিক্কার একটা থাপ্পড় কষালেন| বিকাশ সামলাতে না পেরে সোজা মাটিতে পড়ে গেল|
- উল্লু কঁহি কা| পড়াই মেঁ লড্ডু‚ চলা হেয় ইস্ক লড়ানে| প্রচন্ড রাগে স্যার যেন দিশেহারা| সাথে চলছে বিকাশের চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করা গালাগাল|
স্যারকে কোনদিন এত রাগতে দেখিনি| মনে হচ্ছিল আজ বিকাশের শেষ দিন | কোনরকমে আমরা স্যারকে ঠান্ডা করলাম| স্যার একটু সময় নিলেন ঠান্ডা হতে | তারপর একটু চিন্তা করে স্যার বললেন‚
- ঠিক আছে তোর বাবার সাথে আমি কথা বলব| কিন্তু একটা কথা জেনে রাখ বাসুস্যার কিন্তু মানবেন না| আর বাসুস্যারের সাথে একমাত্র তোর বাবাকেই কথা বলতে হবে| তা একটা কথা বলতো‚ অন্তরা কি তোকে ভালোবাসে?
- সেটা তো জানি না....| ঢোঁক গিলে বলে বিকাশ|
এবার আমাদের পালানোর সময় এসে গিয়েছে | এখানে সময় নষ্ট করা যে সমীচীন নয় তা বুঝতে কারো এক মুহূর্ত সময় লাগলো না | স্যার কি বললেন বা করলেন সে শোনার বা জানার অপেক্ষা না করেই আমরা সোজা ঘরের বাইরে| কিন্তু আমরা যথেষ্ঠ কর্তব্যপরায়ণ‚ তাই ওর দেহরক্ষীদের ডেকে বললাম‚
- ভইয়াজী‚ আপনারা ওর গাড়িটা এখানেই নিয়ে আসুন‚ এখান থেকেই ও গাড়িতে উঠে বাড়ি যাবে|
2
হর্নের আওয়াজে বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে দেখি আমাদের বিকাশ গেটের বাইরে একটা ঝা চকচকে নতুন য়েজদি বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে| সেই সময় ওই মোটরসাইকেল বা বাইক হওয়া একটা দারুন ব্যাপার ছিল | চোখে একটা কালো চশমা‚ বাহারি শার্ট গায়ে দাঁত বের করে হাসছে|
- একি রে! নতুন বাইক তাও আবার য়েজদি‚ পেলি কোথায়?
-পিতাজি দিয়েছে| চল বসে যা পেছনে |
- বাহ বাহ বেশ দেখতে বলে বাইকটার তারিফ করি| তা কোথায় যাবি?
- বস তো আগে তারপর বলছি, ও বলল|
আমিও কিছু জিজ্ঞাসা না করে ওর বাইকে চেপে বসলাম|
- পতা হ্যায়‚ পিতাজি বলেছে পরে আমাকে একটা বিদেশী কট্টাও দেবে| তাহলে আমার বডিগার্ডগুলো আর থাকবে না| বেশ ভালো হবে বল! আমি কি এখন বাচ্চা নাকি? এমনিতেই আমি তোদের থেকে তিনবছরের বড়‚ কি লজ্জা লাগে বল‚ যখন ওরা আমার পেছন পেছন আমাকে পাহারা দেবার জন্য ঘোরে|
ও বাইক চালাতে চালাতে কথা বলে যাচ্ছে‚ আর আমি ওর হাঁ-তে হাঁ মিলিয়ে যাচ্ছি| উপায়ও নেই| যা জোরে চালাচ্ছে‚ না বললে যদি ভিড়িয়ে দেয়| ব্যাটার ওপর কোন ভরসা নেই| হঠাৎ করেই ব্রেক কষল ঘ্যাঁচ করে আর আমিও টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে ওর ঘাড়ে|
- দাঁড় করালি কেন এখানে?
তাকিয়ে হুঁশ হয় যে‚ আমরা বাসুস্যারের বাড়ির উল্টোদিকের মাঠে এসে থেমেছি| এখান থেকে স্যারের বাড়ি সত্তর - আশি গজ দূর হবে| আস্তে আস্তে মাথায় ঢুকতে শুরু করল ব্যাপারটা কি ঘটছে| আমার তো হাত-পা ঠান্ডা| স্যার একবার যদি দেখতে পান তো হয়েছে! ইনি এখন কেষ্টঠাকুরের মত বাইকে হেলান দিয়ে ঝাড়ি মারার প্ল্যান করেছেন আগে জানলে কোন শালা এর সাথে আসত|
- ভাই তু যা ভাঁড় মে ‚ আমি তো চললাম| বলে আর দাঁড়ালাম না লম্বা লম্বা পা ফেলে রাস্তার দিকে হাঁটা দিলাম| কিন্তু কথায় আছে না‚ যেখানে বাঘের ভয়‚ সেখানেই সন্ধ্যা হয়| দেখি বাসু স্যার বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাগানের গেট খুলে বেরোবেন বলে দাঁড়িয়ে আছেন| আর পিছন পিছন অন্তরা| আমাকে দেখতে পেয়ে বাসু স্যার ইশারা করে ডাকলেন |
- এই যে কি ব্যাপার এই সময় এখানে যে? স্যারের চোখ বিকাশের দিকে আর প্রশ্ন করলেন আমাকে |
- স্যার আপনার কাছেই আসছিলাম| ঘাবড়ে গিয়ে বলে ফেললাম| পেপারের ওপর কিছু আপনার কাছে জানার ছিল|
- ঐ গর্দভটাও কি তোমার সাথে এসেছে নাকি? পরের প্রশ্ন, চোখ কিন্তু বিকাশের দিকেই
- ঠিক আছে তুমি ভেতরে গিয়ে বসো‚ আমি এই সামনের দোকান থেকে হয়ে আসছি|
- না না‚ ও এদিকে আসছিল‚ তাই আমি ওর সাথে চলে এলাম| তাড়াতাড়ি বললাম আমি|
- হুম‚ তুমি বসো‚ আমি আসছি এখুনি| বলে স্যার বেরিয়ে গেলেন|
অন্তরা আমায় ডাকল‚
- আয় ভেতরে আয়|
কেন জানিনা অন্তরার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না| যেন অপরাধটা আমারই| কোনরকমে আমি ভেতরে গিয়ে বসলাম| অন্তরা আমার থেকে বছর দুয়েকের বড় ছিল‚ কিন্তু আমি নাম ধরেই ডাকতাম|
- আয়ে বস, কিছু খাবি ? খুব ভালো করেছিস এসে, তোর সাথে আমারও দরকার ছিল| আমি তো আজকেই যেতাম তোর কাছে | কাকিমার সাথেও একটু দরকার ছিল আমার | সে যাক,বাংলা স্কুলের প্রকাশ চক্রবর্তী স্যার এসেছিলেন| এবার সরস্বতী পুজোয় কি নাটক হবে সেই নিয়ে কথা বলতে|
- ও‚ আমি বললাম|
- তুই করবি তো নাটক?
- হুঁ করবো তো | আমি বললাম|
- উনি বলছিলেন একটা পৌরাণিক নাটক|
- আচ্ছা|
- ব্যাপার কি তোর? আমি তখন থেকে একাই কথা বলে চলেছি আর তুই দায়সারা ভাবে বোবার মত হুঁ-হাঁ করে যাচ্ছিস|
কি কথা বলব| আসলে আমি কোন কথাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না| সেই ছোটবেলা থেকেই পাড়ার মেয়েদের দেখে আসছি| এদের সাথে কত খেলাধুলা করেছি| এমনকি বড় হয়ে যাবার পরও ওদের সাথে নাটক বা পাড়ার নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি| কিন্তু কোনদিন ওদের নিয়ে অন্যরকম কোন চিন্তা মাথাতেও আসেনি|
আমাদের এই ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল বেল্টে সর্বসাকুল্যে মোট একশটা বাঙালি পরিবার বসবাস করত| বাবা-কাকাদের উদ্যোগে একটা বাংলা প্রাইমারী স্কুলও গড়ে তোলা হয়েছিল| ক্লাস ওয়ান থেকে ফোর বা ফাইভ অবধি ক্লাস ছিল| ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কোনভাবেই ৫০-৬০ এর বেশি ছিল না| তাই ঐ স্কুলের হয়ে নাটক ইত্যাদি আমরাই করে দিতাম| কোম্পানী থেকে কিছু সাহায্য পেত তাতেই স্কুলের শিক্ষকদের মাইনে ও অন্যান্য খরচ চলে যেত| আমাদের স্কুলবাড়িটাতেই ওদের সকাল ৬-১০ পর্যন্ত ক্লাস চলত| তারপর আমাদের ক্লাস শুরু হত|
- কি রে ভ্যাবলার মত বসে আছিস কেন? বল কিছু|
-হ্যাঁ মানে ঠিক আছে| আমি আর দেবাশিষ তো প্রতিবারের মত আছিই‚ আর এতে হ্যাঁ - না বলার মত নতুন কি আছে|
- ঠিক আছে তাহলে প্রকাশ স্যারকে সেকথাই বলে দেব আমি| আচ্ছ শোন‚ ঐ যে বাইরে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ও তোর বন্ধু বিকাশ না? নেতা বসাওন ঠাকুরের ছেলে?
- হুঁ‚ আমার তখন ঘাম ছুটে গেছে|
- একটা কথা বলছি তোকে‚ কাউকে বলবি না বল?
হে ভগবান! কি এমন কথা বলবে? আবার কি করেছে বিকাশ?
- ঐ ছেলেটা আমাকে একটা চিঠি দিয়েছে|
আমি তখন চোখের সামনে লাল সবুজ বেগুনি রঙের বল দেখছি | মূর্ছা যাবার আগে বোধহয় এমনি সব জিনিস দেখতে পাওয়া যায় | আগে কখনো হয়নি কি না! তাই ঠিক জানিনা |
উঠা লে ভগওয়ান, উঠা লে| আমাকে না‚ ঐ হতচ্ছাড়াকে| মনে মনে প্রার্থনা করি ভগবানকে
- তুই কি কিছু জানিস?
- না না‚ আমি কিছুই জানি না এ ব্যাপারে| প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে কথাটা বললাম| ব্যাটা এর মধ্যে এই কান্ড বাধিয়ে বসেছে? আর চিঠি লিখলি তো লিখলি, একবার জানাবি না আমাদের? ব্যাটা নমকহরাম!
- তাই বল‚ তুই কিছু জানিস না| তুই ওকে বলিস না যে তোকে আমি চিঠির কথা বলেছি| এসব ছেলেমানুষী ব্যাপার এদের মাথায় আসে কি করে বলতো? পড়শোনা না করে খালি লোফারবাজি | যাকগে, তোকে একটা কথা বলি, কাউকে এখনো জানাই নি| আমি বেনারসের ইউনিভার্সিটি তে চলে যাচ্ছি| দু-এক মাসের মধ্যেই যাবার সব ঠিক হয়ে যাবে| তাই ওই ছেলেটার বেয়াদপি এবারের মতো মাফ করে দিলাম | না হলে বাবাকে দিয়ে ওর বাবা কে এই চিঠি লেখার খবর পাঠিয়ে দিতাম |
আহা, ভগবান যে আমার প্রার্থনা এতো তাড়াতাড়ি শুনে নেবেন একদম বুঝতে পারি নি |ওই চিঠি বিকাশের বাবার হাতে পড়লে যে কি হত সেটা মানস চক্ষে দেখে মনটা বড় ভালো হয় গেল | ভাবলাম একবার অন্তরাকে বলি যে চিঠিটা পাঠিয়েই দে ওর বাবার কাছে | | কিন্তু না, আমিও মানুষ, ওর খাওয়ানো রসমালাই, সিঙ্গারা ইত্যাদিরা মনে হল আমার পেট এর ভেতর থেকে প্রতিবাদ করলো | না, তা আর করা গেল না | কিন্তু এদিকে বিকাশের কীর্তি আমাকে যে কি লজ্জায় ফেলে দিয়েছে সে আর কি বলব| অন্তরাকে সবকথা বলে দেওয়াই ভালো মনে করে এ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে‚ সব বললাম ওকে‚ মায় বচ্চা সিংহের হাতে ওর মার খাওয়ার কথাও গোপন করলাম না| সব শুনে অন্তরার হাসি আর থামতেই চায় না| দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হতে‚ অন্তরার হাসি থামল|
বাসুস্যার এসে গিয়েছেন| এবার আমার এখানে আসার কারণটা ওঁনাকে বলতে হবে|
- স্যার‚ বাবা বলছিলেন পরীক্ষাটা তো এসে গেল‚ কটা দিন যদি ইংলিশ গ্রামারটা একটু দেখিয়ে দেন,...
- ওহহ বাবা বলছিলেন বলে তুমি এসেছ? কেন নিজের থেকে আসতে পার না? নিজের কোন গরজ নেই? ঐ বাঁদরগুলোর বন্ধুত্ব ছাড় আর এবার পড়ায় মন দাও|
- হ্যাঁ স্যার|আমি এবার আসি স্যার ? বলে সোজা বাড়ির বাইরে|
বেরিয়ে দেখি বিকাশ তখনও দাঁড়িয়ে আছে| আমায় দেখে কান এঁটো করা একটা হাসি হাসল| দেখে পিত্তি জ্বলে গেল| আমাদের সময়‚ এই চিঠি দেওয়া-নেওয়াটা একটা অপরাধ ছাড়া আর কিছু ছিল না| একবার আমাদের এক দাদাস্থানীয় ‚ সে আবার খড়গপুর আই আই টির ছাত্র‚ কাকে যেন চিঠি দিয়েছিল| তাই নিয়ে যা হাঙ্গামা হয়েছিল তাতে সেই দাদার বাড়ি আসাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল| এমনকি যাকে তিনি চিঠি দিয়েছিলেন সেই দিদি স্থানীয়াকেও কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল যাতে তার নাগাল আর সেই দাদাটি না পায়|
- হাঁ রে কুছ বোলি উসনে? বিকাশ উৎসুক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল|
- না তো কি বলবে? আমি একটু ন্যাকার মত প্রশ্ন করলাম| এমনিতে তো রাগে পিত্তি জ্বলছিল|
- নহি ‚ এমনিই ..
বুঝলাম চিঠির ব্যাপারে জানতে চাইছে | তাই আমাকে এখানে নিয়ে আসা |
বাইক স্টার্ট করে ও আমায় বাড়িতে ছেড়ে দিল| রাস্তায় আর কোন কথা হয় নি|
কিছুদিনের মধ্যেই সরস্বতী পুজো| আমাদের রিহার্সাল শুরু হয়ে গেল| আমাদের বাড়ির উঠোনেই এইসব রিহার্সাল হত| প্রায় গোটা পনেরোজন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে প্রোগ্রাম| নাচ-গান ছাড়াও ছিল আমাদের নাটক| যতদূর মনে পড়ে‚ নাটকের নাম ছিল 'একলব্য'| অন্তরা একলব্যের ভুমিকায় আর আমি দ্রোণাচার্য্য| বাকিরা অন্যান্য নানা ভুমিকায়| আসলে বাঙালী ছেলেদের অভাবে অনেক সময় মেয়েদেরকেই ছেলেদের ভুমিকায় অভিনয় করতে হত| তাই ওটা অন্তরাই করল| নাটকের শেষ দৃশ্য ছিল একলব্য গুরু দ্রোণাচার্য্যকে বুড়ো আঙুল কেটে গুরুদক্ষিণা দেবার পর‚ "দ্রোণাচার্য্য অভিভুত হইয়া একলব্যকে বক্ষে জড়াইয়া ধরিলেন|" কিন্তু রিহার্সালে প্রকাশ স্যার আমাকে বলেছিলেন‚ 'শুধু কাঁধে হাত দিয়ে ওকে দাঁড় করাবে এবং বাকি ডায়লগ বলবে'| কিন্তু প্রম্প্ট করার সময় বারবার উনি ভুল করে বলে ফেলছিলেন‚ "দ্রোণাচার্য্য অভিভুত হইয়া একলব্যকে বক্ষে জড়াইয়া ধরিলেন|" আর প্রতিবার আমরা প্র্যাকটিস করব কি হেসে কুটিপাটি হচ্ছিলাম|
আমাদের নিয়ম ছিল যে‚ রিহার্সালের পর‚ প্রতিটা ছেলে, মেয়েদের তাদের বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে তবেই নিজের বাড়িতে যাবে| সেইমত‚ আমার প্রতিদিনের দায়িত্ব ছিল অন্তরাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবার| প্রতিদিন পৌঁছতে গিয়ে স্পষ্ট টের পেতাম বিকাশ আমাদের অনুসরণ করছে|
একদিন বিকালে‚ খেলা প্র্যাকটিস শেষে আমরা মাঠে বসে এমনিই কিছুক্ষণ গল্প-গুজব করছি‚ হঠাৎ দেখি বিকাশ এসে আমার পাশে ঘাসের ওপর সটান শুয়ে পড়ল| গুনগুন করে কি যেন একটা গান গাইছে শুনতে পেলাম|
- ‘অবে ক্যা গা রহা হ্যায় বে? ওরে এতো বাংলা গান গাইছে!’ সুরেন্দ্র বলে উঠল|
- কি‚ বাংলা গান!!! কি গাইছিস রে? আমি জানতে চাইলাম|
- জোরে গাইব? সলজ্জ মুখে আমার দিকে চেয়ে জানতে চায় সে|
- গা দেখি‚ আমিও নির্লিপ্তভাবে কথাটা বললাম|
-'তোমার পটলচেরা চক্ষু আমায় চাককু মেরেছে'|
এবার আমার ভিরমি খাওয়ার জোগাড়| চক্ষু!! চাককু!!‚ শালা গানের তো মা-বহন করে ছেড়ে দিয়েছে‚ দেখছি|
- ভাই ইয়ে বতা‚ তেরা প্রব্লেম কেয়া হ্যায়? বাংলা গান ধরেছিস কেন আবার? একটু খচেই জানতে চাইলাম|
- ভাই ইমপ্রেস করতে হলে তো এটা করতেই হবে কি না? বোঝা গেল এবার এনার বাংলা গান গাইবার কারণ |
- বুঝলি এখনো পুরোটা শিখে উঠতে পারিনি| পুরোটা শিখে তোদের শোনাবো| তা কেমন লাগল সেটা তো বল? খুব গম্ভীর গলায় সে জানতে চাইলো |
-‘বাংলায় একটা কথা আছে জানিস তো কুঁজোর চিৎ হয়ে শোবার ইচ্ছে| তোর দেখছি তাই‚ যেটা তুই পারবি না সেটা করতে যাবার এত কি দরকার?’ আমার কথার মধ্যে মনে হয় বিরক্তির ঝাঁঝ বেশি ছিল|
- ‘চল ভাই‚ আমাকে রিহার্সালে যেতে হবে| চল দেবা’ বলে আমি আর দেবাশিষ মাঠ থেকে উঠে পড়লাম|
দেবাশিষ বরাবর আমার অনুগত| সে আমাকে বরাবর লক্ষ্য করেছে| তাই আমার কাছে জানতে চাইল‚
-কি ব্যাপার বল তো‚ তুই আজকাল এমন খচে থাকিস কেন বিকাশের ওপর?
আসলে ভেতরে ভেতরে আমি যেন কাউকে কিছু না বলতে পেরে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম| অথচ কাউকে বলতে পারলে ভালো হয়| মন ভারমুক্ত হয়| তাই ভাবলাম দেবাকেই বলি| সব খুলে ওকে বলতে ও তো শুনে অবাক| বলল‚
- তুই আগে আমাদের এসব কথা বলিসনি কেন? আমরা ওকে আমাদের গ্রুপ থেকে বের করে দিতাম|
- ‘ওসব করিস না| তাহলে সবাই সবকিছু জেনে গেলে অনেক সমস্যা তৈরি হয়ে যাবে সে তো তুইও বুঝিস| অন্তরা বাইরে চলে গেলে এমনিতেই সব ঠান্ডা হয়ে যাবে|’ আমি বললাম|
- কিন্তু তার কি গ্যারান্টি আছে যে অন্তরার বাইরে যাবার আগে বিকাশ অন্য কিছু প্রবলেম ক্রিয়েট করবে না? শুনেছি প্রেমে পড়লে মানুষের বোধ-বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়| আবেগ নিয়ে চলে মানুষ| তার চেয়ে চল বচ্চা সিংয়ের কাছে যাই| উনি নিশ্চয় কিছু হেল্প করবেন| দেবাশিস বলল|
বচ্চা সিং এর কাছে যাবার কথা যে আমার মাথাতে আসেনি তা নয়| আসলে আমি ভয় পাচ্ছিলাম সবাই যদি সবকিছু জেনে যায় তো জিনা হারাম হয়ে যাবে| কিন্তু সেই মুহুর্তে মনে হল বচ্চা সিং-এর মত বড় কারও মতামত প্রয়োজন|
- চ তবে এখনি যাই| বলে আমি আর দেবাশিষ বচ্চা সিংয়ের ঘরের দরজায় গিয়ে ঘা দিলাম| বচ্চা সিং একটা হাফ প্যান্ট পড়ে সবে ডন-বৈঠক দিয়ে উঠছেন| গায়ে ঘাম ভরতি| আমাদের দেখে বললেন‚
- কেয়া রে? এখন তোরা? বস‚ আমি আসছি ফ্রেশ হয়ে| হা জি শুনতি হো? বাচ্চাদের কিছু খেতে দাও| আজ প্রাকটিস ঠিক ছিল তো?
- হ্যাঁ স্যার| আমরা একসাথে বললাম|
আমাদের সামনে কাজের লোক এসে জিলিপি আর দুধ রেখে গেল | স্যারের ধারণা জিলিপি আর দুধ খেলে শরীরে শক্তি হয় | নিজেও তাই স্কুলে ঢোকার আগে রোজ কাছের মিঠাইয়ের দোকান থেকে আধা কিলো জিলিপি আর আধা কিলো দুধ দিয়ে জলযোগ সেরে আসেন | এ আমাদের নিজের চোখে দেখা |
একটু পরে স্যার এসে গেলেন‚
- অব বোল‚ বাত কেয়া হ্যায়?
দেবা আমার দিকে তাকালো| আমি প্রায় চোখ বন্ধ করে গড়গড় করে সব বলে গেলাম|
- অব কেয়া করে স্যার? উত্তেজনা‚ ভয়-ভাবনা সব মিলিয়ে আমার চোখে প্রায় জল চলে এসেছিল|
আমাকে আগে বলিস নি কেন? স্যার জানতে চাইলেন|
- কি করব স্যার| বিকাশ তো আমাদের খুব কাছের বন্ধু| ও বারবার মার খাক সেটা আমরা চাই না| কিন্তু ও যা শুরু করেছে সেটাও তো ঠিক না| পরিণাম তো ভালো হবে না এর‚ আমরা সবাই জানি| আমি বললাম|
-পতা হ্যায় মুঝে‚ তোদের বন্ধু তোদের কাছে খুব প্রিয়| কিন্তু ও যে বেশ বিগড়ে গেছে সেটা তো নজরে আসছে| ঠিক আছে আমি কাল ওর বাবার সাথে কথা বলে কিছু একটা করব| তোরা চিন্তা করিস না| তোদের ওপর কোন আঁচ আসতে দেব না পক্কা| অব যাঃ‚ পড়শোনায় মন দে| পরীক্ষা সর পে এসে গেছে| অন্যদিকে মন না দিয়ে‚ পড়াশোনায় মন দে|
দেখতে দেখতে সরস্বতী পুজো এসে গেল| বলতে গেলে বিদ্যার এই বাঙালি দেবীটি কোনদিন তেমন একটা সুপ্রসন্ন ছিলেন না আমার ওপর| আমি ভাবতাম‚ সরস্বতী পুজোর আগে কূল খেয়ে নিতাম আর অঞ্জলির আগেই কিছু খেয়ে নিতাম বলেই হয়ত দেবী কূপিত হতেন| দেব-দেবীর ব্যাপার-স্যাপার বোঝা মুশকিল! নিয়ম মত অঞ্জলির পর প্রসাদ খেয়ে‚ দুপুরে ভোগ খেয়ে স্টেজে চলে এলাম ফাইনাল রিহার্সালের জন্য| বিকালেই নাটক| অজস্রবার রিহার্সাল দেওয়া‚ তা সত্বেও একটা চাপা টেনশন তো থাকেই| সন্ধ্যের পর নাটক শুরু হল| আমাদের টাউনে একটা সিনেমা হল ছিল‚ যেটা বন্ধ হয়ে যাবার পর ওটা বাঙালিদের ক্লাবে পরিণত হয় | দুর্গাপুজো থেকে শুরু করে সব অনুষ্ঠান ঐ হলেই হত| বেশ বড় হল‚ একসঙ্গে ২০০-২৫০ লোক স্বচ্ছন্দে বসতে পারত| স্টেজটা বেশ বড় ছিল| আর স্টেজের পেছনে বেশ বড় একটা গ্রিনরুম ও ছিল | নাটক ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও ওখানেই হত| দু একটা ছোটোখাটো ভুল ছাড়া আমাদের নাটক বেশ ভালোভাবেই উতরে গেল|
নাটক শেষে আমরা গ্রীনরুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম আর বাংলা স্কুলের দেওয়া প্যাকেটের খাবার শেষ করছিলাম | হঠাৎ দেখি পিছনের জানলায় হাসি হাসি মুখে বিকাশের মুন্ডুটা উঁকি মারছে| আমায় ডেকে বলল‚
- শোন‚ আমি দু-চারদিন স্কুলে আসব না|
- কেন রে? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করি|
- বাবা বলেছে কিছুদিন স্কুলে না যেতে‚ কিছু একটা ব্যাপার আছে মনে হয়| আজ অনেক কষ্টে বাবার কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে এখানে তোদের নাটক দেখতে এসেছি| কেয়া লগ রহি থি ইয়ার‚ অন্তরাকো| চোখ চক্চক করে ওঠে বিকাশের|
-চল আমি যাই| বলেই বিকাশের মুন্ডু জানলা থেকে উধাও|
3.
জয়প্রকাশ নারায়নের মুভমেন্ট আমাদের বিহার বোর্ডের ওপর ভালো প্রভাব ফেলেছিল| সব পরীক্ষাই এবার দেরীতে হবে| আমাদের এক্সাম ও বেশ মাসখানেক পিছিয়ে গিয়েছিল| তাই বলে পড়ার চাপ কোন অংশেই কমে যায়নি| তখনকার দিনে টীচাররা পরীক্ষার আগে নিজেদের প্রিয় স্টুডেন্টদের বাড়িতে গিয়ে পড়াত| তার জন্য আলাদা করে ওনারা কোনো ফিস নিতেন না | এখনও হয় নিশ্চয় ‚ ঠিক জানা নেই| তাই পরীক্ষা পিছিয়ে গিয়েছিল বলে আমাদের কোন রেহাই ছিল না| আবার পরীক্ষা সামনে বলে যে ক্রিকেট প্র্যাক্টিস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাও নয়| দিনে দু-ঘন্টা নিয়ম করে খেলতে যেতাম| কিন্তু বিকাশ কোথায়? ওর কোন খবর নেই| আর ও না থাকায় খেলাও জমছে না| সবচেয়ে বড় কথা বিকাশ না থাকায় খেলার পর কোন দোকানে গিয়ে সিঙ্গারা‚ চপ‚ মিস্টি কপালে জুটছিল না| বৃহস্পতিবার মায়ের লক্ষীপুজোর পর যা একটু সন্দেশের টুকরো জুটছিল‚ কিন্তু তাতে কি আর মন ভরে?
একদিন প্রাকটিস করছি‚ হঠাৎ অলোক ওর সাইকেলটা পাঁই পাঁই করে চালিয়ে এনে একদম পিচের মাঝখানে এসে হাজির হল|
- ওয়ে, হট বিচ মে সে| বোলিং করতে গিয়ে মাঝ পথেই দাঁড়িয়ে হাঁক পারলো সুনীল
- জলদি আ‚ একটা খবর আছে| অলোক সাইকেলটা কোনরকমে দাঁড় করিয়ে ঐ নোংরা পিচ ম্যাটের ওপরই বসে পড়ে হাঁপাতে লাগল| তারপর একটু স্থির হয় বলল‚
-য়ার‚ বিকাশ সামনের সপ্তাহেই বিয়ে!
- কেয়া!! আমরা একসাথে বলে উঠলাম|
- ওর তো এক্সামের পর বিয়ে হবার কথা ছিল| জিতেন্দ্র বলল|
- না না পক্কা খবর এনেছি| সামনের কুড়ি তারিখে ওর বিয়ে‚ মানে দু সপ্তাহ পরেই|ওর লেঠেল এসে আমাকে জানিয়ে গেল‚ আরও বলে গেল কাল স্পেশাল ক্লাসের পর আমরা কজন যেন ওর বাবার সাথে দেখা করি| ঠিক সাড়ে চারটের সময় এখানেই গাড়ি চলে আসবে| এক সাথে এতোগুলো কথা বলে অলোক আবার হাঁপাতে লাগল|
আমাদের তো হাওয়া-পানি বন্ধ হবার জোগাড়| ওর বাবা যে কি পরিমাণ রাগী আর জাঁদরেল মানুষ আমরা ভালো-ই জানতাম| এ ব্যাপারে অন্যরা যত না চিন্তিত‚ আমার অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয় | এক তো আমি বিকাশ আর অন্তরার ব্যাপারটা জানতাম| আর বচ্চা স্যার যখন ওর পিতাজির সাথে কথা বলেছে তখন আমার নাম ও নিশ্চই কোথাও না কোথাও এসেছে | এখন ওর বাবা আমাদের কেন দেখা করতে বলেছেন সেটাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না| দেবা আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ইশারা করল চুপ করে থাকতে| ও বুঝতে পারছিল আমার অব্স্থাটা| সে দিনের মত খেলার সব সরঞ্জাম গুছিয়ে গেমস রুমে রেখে দিয়ে চুপচাপ আমরা যে যার বাড়ির দিকে এগোলাম| সাইকেল চালাতে গিয়ে বেশ বুঝতে পারছিলাম হাঁটু দুটো কাঁপছে | কি আছে কপালে কে জানে |
বাড়ি এসে মুখ-হাত ধুয়ে পড়তে বসলাম| কিন্তু পড়ায় মন বসলে তো! একে তো ওখানে যেতে হবে সেই চিন্তা‚ তার ওপর ওখানে যাবার জন্য বাবার কাছ থেকে অনুমতি নেওয়াটাও একটা কঠিন ব্যাপার ছিল| মাত্র কদিন আগে বাবার কাছ থেকে হাতে পায়ে ধরে একটা সিনেম নাকি শরীর স্বাস্থ্য ভালো থাকে, তাই বাবা আজকাল এই খড়মের পেছনে পড়েছেন | বাড়ির সবাই এখন এই খড়মের আওয়াজে অতিষ্ট হয়ে আছে | কিন্তু প্রতিবাদ কেউ করেনি | করার সাহস ও নেই কারো | তবে একটা সুবিধে হয়েছে যে বাবা এখন কোনদিকে যাচ্ছেন, কোথায় আছেন সে আন্দাজ ভালো ভাবেই করা যেত | কান পেতে শুনেই বুঝলাম বাবা এ ঘরেই আসছেন| তাড়াতাড়ি পড়ায় মন দিলাম|
-প্রিপারেশন কেমন চলছে? ঘরে ঢুকেই বাবার প্রশ্ন| এর বেশি কিছু জিজ্ঞাসা করতে বাবাকে কোনদিন শুনিনি|
- ভালো‚ আমি বললাম|
-হুম‚ মন দিয়ে পড়‚ মনে রেখো তোমার দাদা পুরো বিহার বোর্ডে থার্ড হয়েছিল| তোমার কাছ থেকে অবশ্য সেরকম কিছু আশা করি না| কিন্তু তোমার দাদা স্কুলে যে নাম করেছিল‚ ওর ছোট ভাই হয়ে সেই সুনামটা অক্ষুন্ন রেখো|
মাথা নিচু করে শুনলাম| আহা‚ কি এনক্যারেজমেন্ট!! আমার থেকে কোন আশাই নেই তার মানে!! একটা মুদির দোকান খুলে দিলেই পারে যদি কোন আশা না থাকে| স্কুলেও তাই| তুম উসকা ভাই হো না? শুনে শুনে কান পচে গিয়েছিল| দাদার মত পড়াশোনা তো দূরের কথা‚ ওর মত ফাস্ট বোলার আমাদের ত্রিসীমানায় কেউ ছিল না‚ সেটা এখনও আমার বন্ধুরা বলে|
বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েও ফেরত এলেন|
- বসাওন ঠাকুরের লোক এসেছিল| মানে তোমাদের বিকাশের বাবা বলে পাঠিয়েছেন কাল বিকালে তোমাদের কজনের ওঁনার বাড়িতে নিমন্ত্রণ| বিকাল চারটে তিরিশে উনি গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন| তোমাকে নিয়ে যাবার জন্য অনুমতি চেয়ে পাঠিয়েছিলেন| আমি বলে দিয়েছি তুমি যাবে| তাই কালকের পড়াটা খেলতে না গিয়ে পুরো করে নিও|
আমি মাথা নাড়লাম| যাক বাঁচা গেল, ছুটি নিয়ে আর কোনো অসুবিধা নেই |
সময় দাঁড়িয়ে থাকে না| নির্দিষ্ট সময় আমরা রওনা হলাম বিকাশের বাড়ির উদ্দেশ্যে| একটা হুডখোলা জিপে আমরা ছজন আর দুজন লেঠেল সামনে বসে| বিকাশদের বাড়ি আমাদের কমপ্লেক্স থেকে প্রায় মাইল পাঁচেক দুরে| খানিকটা পাকা রাস্তার পরই কাঁচা রাস্তা শুরু হল| তাও ঐ মাইল দেড়েক তো হবেই| আমরা পৌঁছলাম ওদের বাড়ি| আগেও আমরা অনেক বার ওর বাড়ি এসেছি | বাড়ি বললে ভুল হবে, মহলে এসেছি| বিশাল সাদা রঙের পুরো মহলটা উঁচু একটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা| মেইন গেট দিয়ে ঢুকেই মস্ত বাগান| বাগানে পোষা আছে গোটাচারেক ময়ূর | সেখান থেকে অনেকটা গিয়েই ওদের মহল| মহলের ঠিক পেছনেই আম বাগান আর বেশ বড় দুটো পুকুর| একটা পুকুরের চারধার কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা| শুনেছি ঐ পুকুরে ওদের পোষা গোটা চারেক নরখাদক কুমীর আছে| কানাঘুষোয় শোনা যায়‚ বেয়াদব প্রজাদের শাস্তি দিতেই কুমীর পোষা| মহলের ভেতরটাও ততধিক সুন্দর | দামি আসবাবপত্রে সাজানো প্রত্যেকটা ঘর | বসবার ঘরের ছাদ থেকে ঝুলছে বিশাল আকারের ঝাড়লণ্ঠন | ওদের ওই বসবার ঘরটাই এতো বিশাল যে মনে হয় আমাদের চার পাঁচটা ক্লাসরুম ওর মধ্যে সেঁধিয়ে যাবে| আর কত যে কামরা ওই মহলে কে জানে, কুড়ি পঁচিশটা তো হবেই, তার বেশিও হতে পারে |
মহলের সিংহ দরজাতেই বিকাশ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল| আমরা পৌঁছতেই হৈ হৈ করে প্রীতি সম্ভাষন জানালো|
- আযা আযা সালো ...... আহা কি মধুর ও প্রীতি সম্ভাষণ |
-অন্দর চল মেরে কমরেমে| বলে সোজা ও আমাদের ওর নিজের ঘরে নিয়ে গেল|
- বাবা বলেছে তোদের সাথে আমার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবে| ঘাবড়াস না‚ তোরা কজন যাবি‚ রাতে থাকতে পারবি কিনা এইসব আর কি!
ইতিমধ্যে বিকাশের মা আমাদের জন্য বিশাল ট্রে তে সাজিয়ে নানা রকমের মিষ্টি আর নমকীন দিয়ে গেলেন | আর বলে গেলেন যে খাবার তৈরিই আছে, যখনই ইচ্ছে হবে জানিয়ে দিতে | বিকাশের মা মানে আমাদের চাচীজি খুব ভালো মানুষ| আমাদের খুব স্নেহ করেন | উনি ভালো করেই জানেন যে আমাদের উদোর গুলো এক একটা যজ্ঞকুন্ড | যাই ঢাল না কেন মুহূর্তে ভষ্ম হয়ে যাবে | খাবার ব্যাপারে আমরা কোনো দিন না বলতে শিখিনি | না বলা পাপ মনে করতাম| তাই ওই মিষ্টি আর ভাজাভুজি শেষ করতে আমাদের বেশি সময় লাগলো না |
গল্পগুজব আর জলখাবার খেতে খেতে কখন যে সময় কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না | ফেরার সময় ও হয় এসেছিলো | বিকাশ বাড়ির ভেতরে খবর পাঠালো খাবার লাগাবার জন্য |কিছুক্ষণ পর ই কাজের লোক এসে খবর দিলো
- খানা লগ্ গইল বা |
আর কেউ বসে তখন ? দুদ্দাড় করে উঠে দাঁড়ালো সবাই | আমরা ঘর থেকে বেরোতে যাচ্ছি‚ বিকাশ আমার জামা পিছন থেকে টান মেরে ইশারায় আমাকে একটু দাঁড়াতে বলল|
- হাঁ রে অন্তরার কি খবর?
- কি খবর? আমি অবাক হবার ভান করে বললাম|
-মানে আমার ব্যাপারে কিছু বলল?
- না তো|
বলে আর দাঁড়াইনি| সোজা খাবার জায়গায় চলে গেলাম| কবুতরের মাংস‚ পরাঠা‚ আলুভাজি আরও নানান খাবার বেশ জমিয়েই খেলাম| কিন্তু ভেতরে যে একটা গুড়গুড়ানি চলছিল সেটার যেন তর সইছিল না| খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে করতেই রাত আটটা বেজে গেল| আমরা তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে বসার ঘরে গিয়ে বসলাম|কয়েক মিনিটের মধ্যে একজন পেয়াদা এসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল‚
- রাজাসাব আপ কো বুলায়া হ্যায় অন্দর মে|
সবাই উঠতে যাচ্ছিল‚ কিন্তু পেয়াদা বাঁধা দিয়ে বলল‚
-ওঁনাকেই ডেকেছেন‚ বাকিরা বসুন|
একটু আগের ভরপেট খাবার যেন গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল| পুরোনো হাঁটুর ঠকঠকানিটা যেন আবার শুরু হয়ে গিয়েছে টের পেলাম |পেয়াদার পেছন পেছন চলতে শুরু করলাম| বেশ কয়েকটা কামরা পেড়িয়ে পেয়াদা একটা কামরার সামনে দাঁড়িয়ে দরজাটা ভেতরের দিকে ঠেলে দিয়ে আমাকে ভেতরে যাবার জন্য ইশারা করল|
সুসজ্জিত কামরায় একটা আরাম কেদারায় বসে বিকাশের বাবা গড়গড়া টানছিলেন| আমাকে ইশারা করে বললেন কাছের চেয়ারে বসতে| আমি সেইমত বসলাম| তারপর কয়েক মুহুর্ত আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন‚
- য্যয়সা বাপ ওয়েসা বেটা‚ হাঁ? ঠিক বাপের মতোই বুদ্ধি রাখো! খুব ভালো খুব ভালো| বাঙালিরা তো বুদ্ধিমানই হয়
কথাটা শুনে আমার হাঁটুর ঠকঠকানি একটু কমল| আমিও হেসে বললাম‚
- জী| যদিও এটা একটু বোকার মত উত্তর হয়ে গেল|
- শোনো তোমাকে ডাকার একটা কারণ আছে| প্রথমত‚ বিকাশের বিয়ে আমি তাড়াতাড়ি করাচ্ছি| বচ্চা সিং এর কাছে সব খবরই আমি পেয়েছি| আমি যে সব জানি সেটা বিকাশ জানে না| তাই কোন কারণ না দেখিয়েই ওকে আমি এই বিয়ে করতে আদেশ করেছি| আমাদের বাসু মাস্টারজীর ইজ্জতে যেন কোন আঁচ না আসে সেটা তুমি দেখবে| জানি তুমি অনেক ছোট‚ আমি চাইলে বিকাশকে পিটিয়েও এই কথাটা বোঝাতে পারতাম| কিন্তু বচ্চা সিং-এর তোমার ওপর খুব ভরসা| তাই কাজটা তুমিই করবে|
নিজেকে বেশ একটা কেউকেটা মনে হচ্ছিল| মনে যে একটা আত্মবিশ্বাস উঁকি দিচ্ছিল সেটা টের পাচ্ছিলাম|
- হাঁ আর বিয়েতে তোমরা সবাই যাবে| আমি জানি পরীক্ষা বলে তোমাদের বাড়ি থেকে আপত্তি থাকতে পারে‚ কিন্তু আমি তোমাদের বাবাদের সাথে কথা বলে ওঁনাদের অনুরোধ করব|আশা করি‚ ওঁনারা আপত্তি করবেন না| খাওয়া হয়েছে তো তোমাদের? অনেক রাত হয়ে গেছে‚ এবার তোমরা বাড়ি যাও| আমার কথাগুলো মনে রেখো| এবার যেতে পারো|
বাঘের গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে আমি অন্যদের সাথে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম| রাস্তায় অন্য কথা বাদ ই নিয়ে এ কদিনের যাবতীয় জল্পনা- কল্পনার আজকেই অবসান| কার কোন সাইজের বেলবটম আছে সে আলোচনাই মুখ্য বিষয় এখন | অলোকের কাছেই একমাত্র ছোত্রিশ ইঞ্চির ঘেরের বেলবটম ছিল | ঈর্ষা করার মতোই ব্যাপার সেই সময়| আমার কাছে শুধু চব্বিশ ইঞ্চির ছিল| জীবনে প্রথমবার কোন বন্ধুর বিয়েতে বরযাত্রী যাচ্ছি| উত্তেজনা চরমে| যদিও পড়াশোনা সেভাবেই করতে হচ্ছিল| খেলধুলো কদিন ধরে পুরো বন্ধ| একটা দিনের ছুটির মাশুল অভিভাবকরা কড়ায়-গন্ডায় বুঝে নিচ্ছিলেন|
তা বরযাত্রী বিরাট আয়তনের| আমরা ক্লাস থেকেই প্রায় ২৫ -৩০ জনের মত| তা ছাড়াও কিছু টীচারও আছেন| বাড়ির লোকজন আর আত্মীয় স্বজন মিলিয়ে বোধহয় দেড়শো দুশো বরযাত্রী | দুপুরে একটা বাস শুধু আমাদের জন্যই আসবে স্কুল গেটে| সেখান থেকেই বিয়েবাড়িতে আমরা সরাসরি যাব‚ তাই আমাদের সাথে চারজন লেঠেলও যাবে| যথাসময়ে স্কুল গেটে বাস এসে গেল| আমরাও তৈরি হয়ে চড়ে বসলাম বাসে| বিয়েবাড়িটা যে গ্রামে সেটা কম করেও ৩০-৪০ কিমি দূরে‚ রাস্তাও সব জায়গায় ভালো না| এদিকে সকাল থেকেই আকাশের মুখ গোমড়া| বৃষ্টি এই নামে তো ঐ নামে অবস্থা| সবার পরণেই ভদ্রস্থ পোশাক| বরযাত্রী বলে কথা| মনে মনে আমরা কেউই চাইছিলাম না বৃষ্টি আসুক| বৃষ্টি আসলে সব মাটি| এই নিয়েই আমাদের জোরদার আলোচনা চলছিল| দু-একজন প্রস্তাব করল‚ ছাতা নিয়ে নিলে কেমন হয়?
- দিমাগ খরাব হো গয়া কেয়া ? এতসব জামাকাপড় পড়ে ছাতা হাতে বিয়েবাড়ি? চুপ হো যা| সবাই একবাক্যে চিরবিড়িয়ে উঠে প্রস্তাব খারিজ করে দিল|
হঠাৎ আমাদের নজরে পরল বাসের পিছনের সিটে গোটা পাঁচেক মাইক‚ চার-পাঁচটা ব্যাটারি আর তখনকার দিনের হ্যান্ডেল দেওয়া প্লেয়ার| দেখে তো আমাদের চক্ষু ছানাবড়া| এগুলো এই বাসে কেন? লেঠেলদের জিজ্ঞাসা করলাম‚
- এগুলো কোথায় যাবে রে?
ওরা যা বোঝালো‚ তাতে এইটুকু বুঝলাম আমরা যে‚ বিয়েবাড়িতে ইলেকট্রিসিটি তো আছে‚ কিন্তু সমসময় পাওয়ার থাকে না| তাই ব্যাটারি নিয়ে যাচ্ছে| তা না হয় বুঝলাম কিন্তু মাইক আর প্লেয়ার কেন? না‚ মেয়েবাড়ি থেকে খবর পাঠিয়েছে যে‚ মাইকের ব্যবস্থা করা হয়েছিল‚ কিন্তু ঠিক সময়ে গিয়ে দেখা গেল প্লেয়ার চলছে না| আর ঐ গন্ডগ্রামে একটা মাইকওয়ালা ছাড়া আর কেউ নেই|
- ইসিলিয়ে ছোটে রাজাসাব কে ফরমাইশ সে এখানকার জগ্গু ডেকরেটার্স থেকে মাইক লে লিয়া| কৈ বাত নেহি জি‚ ওরাও লোক পাঠাবে আর আমরাও তো আছি| সব নিয়ে যাব| আপলোগ মৌজ করো | বলে খৈনি খাওয়া দন্ত প্রদর্শন করল লেঠেলগুলো|
কিন্তু কপালের নাম গোপাল| সেই শীতেই শুরু হল মুষলধারায় বৃষ্টি| বাস গড়িয়ে গড়িয়ে চলল ঐ বৃষ্টি ঠেলে|যেন মহাপ্রলয়ের সেই বৃষ্টি| আকাশ‚ রাস্তা সব অন্ধকারে একাকার| দৃষ্টি চলছিল না| রাস্তায় এক হাঁটু জল দাঁড়িয়ে গেছে| বৃষ্টির বিরাম নেই| একটানা বাসের ঘড়্ঘড় আর বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ মিলে-মিশে এক হয়ে গেছে| এদিকে বৃষ্টি শুরু হবার সাথে সাথেই আমাদের উৎসাহে ভাঁটা পরেছে| সবাই চুপচাপ‚ একমাত্রা ধুতিপড়া স্যার আর লেঠেলরা বাদে| ওরা সকাল থেকেই আমাদের সাজপোশাক নিয়ে যেসব টিপ্পনী শুরু করেছিল বৃষ্টির দাপটে সেগুলো আরও সরস হয়ে উঠছিল| ওদের তো কোন চিন্তাই নেই| ধুতি গুটিয়ে মাথায় ছাতা দিয়ে এক হাঁটু জল পেরিয়ে ছপছপ করে চলে যাবেন|
আমি তো দুঃখে প্রায় কেঁদে ফেলি আর কি! মেরে ইয়ার কি সাদি হ্যায় বলে দাদার কাছ থেকে অনেক কষ্টে সেই সময়কার সাদা স্ট্রেচলনের ছোত্রিশ ইঞ্চির বেলবটমটা ম্যানেজ করেছিলাম আলোককে টেক্কা দেবার জন্য | আজ তার বারোটা বাজবে পক্কা| তাতে দাদা আমার পিটিয়ে পিঠের চামড়া গুটিয়ে হাতে দেবে না দেওয়ালে টাঙাবে সেটা জানা নেই‚ কিন্তু কপালে যে দুঃখ আছে সে খন্ডাবে না নিশ্চিত| সব রাগ গিয়ে পরছিল বিকাশের ওপর| এই শা... বিকাশ যে কি কুক্ষণে জন্ম নিয়েছিল‚ আজ হাতে হাতে তা টের পেলাম|
বাস ড্রাইভার ঘোষনা করল‚
- বাস আর আগে যেতে পারবে না|কাঁচা রাস্তায় বাস নামালে বস একদম বৈঠ যায়েগা‚ ফির বাপস নহি হো পায়েগা| ইস লিয়ে আপলোগ পৈদল চলে যাইয়ে‚ ঐ তো দুরে বিয়েবাড়ি দেখা যাচ্ছে| বেশি দুর না মনে হয়| বিয়েবাড়ি দেখা যাচ্ছে বটে কিন্তু সেটা দুর নয় বললেও কম করে আড়াই-তিন কিলোমিটার হবে এখান থেকে| খোলা ক্ষেতের ওপর দিয়ে দেখছি বলে মনে হচ্ছে বেশি দুর না| অগত্যা আর কি করা! হাতে জুতো নিয়ে আমাদের জলে নামতেই হল| খবর পেয়ে মেয়ের বাড়ির কিছু লোক ছাতা, হারিকেনে আর হেজাক নিয়ে হাজির হয়েছে| কিন্তু লোক অনুপাতে ছাতার সংখ্যা কম| আমাদের সেই বন্ধুরা ফুট কাটলো যারা ছাতা নিয়ে আসবার কথা বলেছিল‚ গরীবের কথা সত্যি হয় বাসি হলে| যাইহোক এক একটা ছাতার তলাতে দু-তিনজন করে মাথা বাঁচাবার জন্য ঢুকে পরতে হল| বাকি ব্যাটারি আর মাইকের চোঙের তলায় মাথা বাঁচিয়ে লেঠেলরা আমাদের পেছু পেছু হাঁটা দিল|
আহা‚ বরযাত্রী দলের চেহারা দেখার মতন হয়েছিল! আগে আগে আমরা‚ পেছনে স্যাররা আর তার পিছনে চোঙ আর ব্যাটারি মাথায় লেঠেলের দল| জল ঠেলে বেশ খানিকটা পথা আসার পর হঠাৎ পিছন থেকে লেঠেলদের হাঁউমাউ করে চিৎকার কানে এলো| আমরা দাঁড়িয়ে পরলাম ওদের অপেক্ষায়| হ্যারিকেনের হেজাকের আলো-আঁধারিতে কিছুই চোখে পড়ছিল না| কাছকাছি আসার পর দেখলাম ওদের|
- কেয়া রে? চেঁচাস কেন তোরা? বচ্চা সিং জিজ্ঞাসা করলেন|
-খুজলা রহা হ্যায় স্যরজি| ওরা হাঁউমাউ করেই উত্তর দিল|
- কেয়া খুজলা রহা হ্যায়? স্যার তো অবাক|
ওরা একটু কাছে আসতেই স্যার হ্যারিকেন ওদের দিকে তুলে ধরলেন| হ্যারিকেনের আলোয় ওদের অবস্থা দেখে আমাদের চক্ষু ছানাবড়া| এ কি সাজ এদের !! বেশ নতুন ধোপদুরস্ত ধুতি আরা পাঞ্জাবীই তো পড়েছিল ওরা| তার এই করুণ হাল হল কি করে ? পুরো পাঞ্জাবী ফালাফালা হয়ে ঝুলছে‚ ধুতির অবস্থাও প্রায় এক| কোনরকমে মাথার ওপর রাখা ব্যাটারি এক হাতে ব্যালেন্স করে রেখে অন্য হাতে পিঠ-বুক চুলকোচ্ছে| ব্যাপারটা এবার বোঝা গেল| বৃষ্টির জল‚ ব্যাটারিতে পড়ে ওর ভেতরে অ্যাসিড মেশানো জল বেরিয়ে এসেছে তার ফলশ্রুতিতে ওদের জামা-কাপড়ের এই দশা করেছে| বচ্চা স্যার কথামত আমরা সবাই ধরাধরি করে ওই ভারী ব্যাটারিগুলো ওদের মাথা থেকে নামিয়ে দিলাম | বচ্চা স্যার ওদের বললেন‚
- জলদি সে নালে কে পানি সে নহা লে|
ওরাও বাধ্য ছেলের মত সব খুলে পাশের নালাতে নেমে পড়ে গা-হাত-পা সব ধুতে লাগল| স্যারও মেয়ে বাড়ি থেকে আসা লোকেদের কিছু ধুতি-গামছা আনার জন্য হুকুম করলেন| স্যারের হম্বিতম্বীতে তারাও দৌড় লাগালো সেসব আনতে|
বুঝতেই পারছিলাম বিকাশের বিয়ে ঘটানাহীন হতে পারে না| একে বৃষ্টি তায় লেঠেলদের এই হাল| আর আমাদের হাল‚ সেও নিশ্চিত দেখার মত| কোনরকমে বিয়ে বাড়িতে পৌঁছালাম| বিয়েবাড়ির আলোকে একজন আরেকজনকে দেখে মাথা চাপড়ে কাঁদতে বাকি রেখেছিলাম| জলকাদায় আমার সাধের সাদা স্ট্রেচলনের প্যান্টের রং যা দাঁড়িয়েছিল সে আর বলার মত নয়| জুতোর অবস্থাও তাই| ক্ষেতের মাটি লেপে সব জামা - প্যান্ট গেরুয়া রঙ ধারন করেছে| আমাদের মনেও কেন জানি না এসব দেখে টেখে একটা বৈরাগ্যভাব এসে গিয়েছিল| মন ভাবছিল‚ এইসব ছোটখাটো স্ট্রেচলনের প্যান্ট ‚ আর জুতোর অবস্থা নিয়ে ভাবছিস পাগল‚ ওরে এই দুনিয়ায় তুমি কার‚ কে তোমার| বাড়ি ফিরে দাদাকেও সেইকথা বোঝাতে হবে| হঠাৎ করেই আমার ধ্যানভঙ্গ হল| বিয়েবাড়ির কাজের লোকেরা এসে আমাদের হাতে একটা করে ধুতি আর চাদর ধরিয়ে দিয়ে গেল‚
- রাজাসাব বোলে হেয়‚ ভেজা জামাকাপড় ছেড়ে এগুলো পড়ে নিতে|
আহা কিসব রঙের ধুতি| কারো কপালে গোলাপী তো কারও কপালে হলুদ| নানা রঙের ধুতি| হোরি খেলত নন্দলালা... কিন্তু আমাদের বিশেষ করে আমার মনটা তখনও উদাস হয়েই ছিল| বিনা বাক্যব্যয় আমি ওগুলো পরে নিলাম‚ চুলটাও আঁচড়ে নিলাম| দেখলাম বাকি বন্ধুদেরও একই অবস্থা| মনে হচ্ছিল " ওগুলো পরে ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে ব্যস এখুনি বেরোবো ভবতি ভিক্ষাং দেহি " ধরনের কিছু যেন করতে | ধুতিটা কোমরে কোন রকমে জড়ানো আর গায়ে জড়ানো চাদর|
এদিকে বিকাশের দ্বারপুজা হয়ে গেছে| বরযাত্রীরা সব ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে| বাড়ির মেয়ে-বৌরা বড় বড় ঘোমটা টেনে তাদের রীতি অনুযায়ী প্রথমে ছেলের মা‚ তারপর বাবা‚ জ্যাঠা‚ কাকা‚ মাসি-মেসোদের গানের মাধ্যমে সুমধুর গালাগাল দিচ্ছেন এর পর গোবরজল ছুড়বে বরযাত্রীদের উপর, এটাই নিয়ম| বাকি বরযাত্রীরা যারা ধোপদুরস্ত ছিল তারা এদিক ওদিক নিজেদের বাঁচাবার জন্য আড়ালে যেতে লাগলো | আমরা কিন্তু ঠায়ে দাঁড়িয়ে রইলাম | গোবরজল আর আমাদের কি ক্ষতি করবে ?| যা ক্ষতি হবার তা তো হয় গিয়েছে |
একটা জিনিস কিন্তু লক্ষ্য করলাম‚ বিকাশ কিন্তু খুব চুপচাপ হয়ে গেছে| বিশেষ কারও সাথে তেমন কথা-বার্তা বলছে না| হাসি-ঠাট্টাতে বসে আছে ঠিকই তবু যেন কোনকিছুই ওর কানে ঢুকছে না| এর মধ্যেই খাওয়ার ডাক আসাতে সবাই প্রায় দুড়দাড় করে চলে গেল খেতে| ঘরে আমি‚ দেবা আর বিকাশ রয়ে গেলাম|
- কি রে বিকাশ কেমন লাগছে? আমি একটু ঠাট্টা করেই জিজ্ঞাসা করলাম|
- বাস ঠিকই আছে‚ আনমোনা উত্তর আসে বিকাশের কাছ থেকে| একটু থেমে আবার বলে‚ আমার হবু বৌয়ের নাম তো চন্দা| খুব ভালো মেয়ে| আমার বাবার বন্ধুরই মেয়ে| ছোটোবেলা থেকেই তো চিনি| এখন কলেজে পড়ছে| আমার থেকে পড়াশোনায় অনেক ভালো‚ দেখতেও সুন্দর| বলল বটে কিন্তু কথাগুলোয় যেন উদাসীনতার ছাপ স্পষ্ট| আমি ওর পিঠে হাত রেখে বললাম‚
- য়ার‚ তাহলে তো খুব ভালো রে| কিন্তু তু ইতনা উদাস কিয়ু দিখ রহা হ্যায়?
- কুছ নহি| কিন্তু তুই একটা কথা বল‚ তুই তো সব জানতিস তাই না ও বনারস চলে যাবে? সেটা কিন্তু তুই ভরসা করে আমায় বলতে পারতিস| ওর চোখে আমার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অনুযোগ|
- লেকিন সচ বতা রহা হুঁ‚ আমি কিন্তু ওকে কোনদিনই ভুলতে পারব না| আমি জানি অন্তরা আমায় ভালোবাসে না‚ তাতে কি হয়েছে‚ আমি তো বাসি| কিন্তু তোরা আমার য়ার‚ তোরা কি করে ধরে নিলি যে আমি এমন কিছু করব যাতে বাবা‚ স্যার সবকি ইজ্জত পে আয়েগা? যদি পারিস‚ আমার বাবাকে বলিস‚ বিয়ে তো আমি তোমার মতে করে নিলাম| সচ্চাইকে সাথ ইয়ে সাদি নিভাউঙ্গা ভি| চন্দা কো ধোখা নহি দুঙ্গা মেয়| কিন্তু অন্তরাকেও ভুলবো না কোনদিন‚ চাহে কুছ ভি হো যায়ে| বলে মাথা নিচু করে বসে রইল বিকাশ| হয়
4.
হঠাৎ করেই গতকাল পিতাজি আমাকে তার ঘরে ডাকলেন| পারতপক্ষে বাবার সাথে আমাদের কথাবার্তা কমই হয়| আর পাঁচজন সাধারণ পিতা-পুত্রের মত সম্পর্ক আমাদের নয়| সবসময় একটা দুরত্ব বজায় থাকে| যে দুরত্বের সবটাই সন্মানের‚ শ্রদ্ধার আর পারিবারিক প্রথা মেনে| পিতাজি ডেকেছে কেন সেটা বেশ রহস্যের| খুব দরকার না থাকলে তো আমাদের ডাকেন না| কিন্তু সেই ডাককে উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমার নেই| দাদারাই কোনদিন পারল না‚ আমি তো কোন ছার!
- এসো আমার কাছে বসো|
পিতাজি যে ডিভানে বসে হুক্কা খাচ্ছিলেন‚ আমি তার পাশে রাখা চেয়ারটায় বসতে গেলাম|
- নাহ‚ ওখানে নয় আমার কাছে এসে বসো|
এবার আমার চমকানোর পালা| বাবা তো কখনো এমনভাবে আমাকে কাছে ডাকেননি! মনেও পড়ে না কখনো এমন মুহুর্ত আমার জীবনে এসেছে|
- আমাকে তোমরা খুব ভয় পাও তাই না? পিঠে আলতো করে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন |
- হাঁ জি‚ না জি !! থতমত খেয়ে যাই‚ ঠিক কি বলতে হয় এমন পরিস্থিতিতে আমি তো জানি না|
বাবা মুচকি হাসলেন একটু| এটাও বেশ দুর্লভ| আজ কেন জানি না সব কিছু ভীষন ভালো লাগছে| মনে হচ্ছে মা আর দাদিকে বাদ দিলে এমন আপন ব্যবহার বাবার কাছ থেকে কখনো পায়নি| এই প্রথম বাবাকে বড় আপনজন মনে হচ্ছে| বাবার খুব কাছ ঘেঁষে বসলাম আমি|
- আমি জানি‚ আমি জানি‚ তোমরা সবাই আমাকে ভয় পাও| পিতাজি কথাগুলো বলতে বলতে মাথা নাড়লেন| একটু দুরে দাঁড়ানো বাবার খাস নৌকরকে হাতের ইশারা করতেই সে তাড়াতাড়ি এসে বাবার সামনের টেবিলে রাখা বাহারি গ্লাসে দারু ঢেলে দিল| বাবাকে কখনও দারু খেয়ে নেশা করতে দেখিনি| খাওয়ার পর একটু খান মাপ বুঝে| ভরা গ্লাসে চুমুক দিয়ে পাশে রাখা তোয়ালে দিয়ে মোচটা মুছলেন| তারপর বললেন‚
- যে জন্য তোমায় ডেকেছিলাম‚ সম্বন্ধীজি আজ এসেছিলেন ওঁনার একটা প্রস্তাব নিয়ে| উনি চান বিয়েটা তোমার পরীক্ষার আগেই হয়ে যাক|
- কেন? বেশ জোরেই হয়ত শব্দটা বেরিয়েছে আমার মুখ থেকে| পিতাজি দেখলাম ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন|
- আগে পুরো কথাটা শোন| ওঁনার মাতাজির শরীর খুব খারাপ| যেকোন সময় যা কিছু একটা হয়ে যেতে পারে| মাতাজির ইচ্ছে উনি ওঁনার প্রিয় নাতনীর বিয়ে দেখবেন| তুমি তো জানো সম্বন্ধীজির ইচ্ছে ছিল তুমি মাট্রিক পাশ করলে বিয়েটা দেবেন‚ কিন্তু ওঁনার মাতাজির জন্য উনি বিয়েটা এগিয়ে আনতে চেয়ে আমার হাত ধরে অনুরোধ করলেন| আমি ওঁনাকে কথা দিয়ে দিয়েছি| সেইমত আমরা তৈয়ারি শুরু করে দিয়েছি‚ তুমিও তৈরি হও|
- লেকিন পিতাজি‚ আমি কিছু বলবার অক্ষম চেষ্টা করলাম কিন্তু বাবা থামিয়ে দিলেন‚
-তোমাকে জানিয়ে দিলাম মাত্র| এখন তুমি যেতে পারো|
মাথা নিচু করে পিতাজির ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম| বাবার মুখের ওপর কথা বলার মত স্পর্ধা আর সাহস কোনটাই আমার নেই| এখন সেটা পরিস্কার হল| কিন্তু ঠিক এখনই তো আমি বিয়ে করার জন্য মনে মনে তৈরি নই| আমার তো কত কাজ বাকি আছে‚ অনেক কিছু করতে হবে|
সেদিনের কথা খুব মনে পড়ছে| অন্তরাকে চিঠি দিয়েছিলাম খুব আশা নিয়ে| অন্তরা উত্তর দেয়নি| উল্টে ওদের পাশের বাড়ির সন্তোষ ভৈয়া এসে আমাকে ধমকে গেল| আমি চাইলে তখনই ওর কাম তমাম করে দিতে পারতাম‚ এত গুস্সা আমার হচ্ছিল কিন্তু আমি চেপে গেছিলাম| এক তো চিঠিটা দিয়েছিলাম সেটা কেউ জানতই না| এই ব্যাপারে আমি জানি আমার বন্ধুরা আমাকে হেল্প করবেই না| এমনকি আমার সবসে করিবি দোস্ত চন্নুও আমাকে হেল্প করছে না| তাই চন্নুকেও চেপে গেছি ব্যাপারটা| তবে একমাত্র চন্নুটাই আমাকে একটু বোঝে‚ দিল খোলকে ওর সাথেই কথা বলা যায়| কিন্তু কেন জানি না এই ব্যাপারটায় ও একদম আমায় হেল্প করছে না|একবার তো ব্যাটা বচ্চা সিংয়ের কাছে অচ্ছাখাসা ধুলাই ভি করিয়ে দিল|
বাইরের বাগানে চলে এলাম| মগরমছ তলাবের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম| কাজের লোকেরা ওখানে ওদের খেতে দিচ্ছে| ওদের খেতে দিতে আমারও খুব ভালো লাগে|
-ছোটেমালিক ইয়ে লো‚ ইনলোগো কো খিলাও| একজন এগিয়ে এসে কাঁচামাংসের বালতিটা আমার দিকে এগিয়ে দিল|
- নাহ! তোরাই খাওয়া‚ বলে নিজের ঘরে চলে আসলাম| মনটা বেশ চঞ্চল হয়ে আছে| অন্তরার সাথে কি সন্তোষ ভৈয়ার কিছু চক্কর আছে? কোথায় অন্তরা আর কোথায় সন্তোষভৈয়া! বেতুকি সোচ‚ কিন্তু অসম্ভবও নয়| কাউকে লাগাতে হবে অসলি বাত জাননে কে লিয়ে| সন্তোষ ভৈয়া‚ লোক মোটেই ভালো না| শহরে একটা রেস্টোরেন্ট-কাম-বার আছে| খুব খারাপ লোগোকে সাথ উঠনা-বৈঠনা ওর| কি যেন নাম ওর বারটার.. মনে পড়েছে "শাকিবালা"| অনেক খারাপ মেয়েরা তো ওখানে যায়| হে ভগবান‚ অন্তরা যেন ঐ লোকের পাল্লায় না পড়ে| তবাহ হ যায়েগি ও লড়কি!!
এখুনি কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হয়| বাইকটা বের করলাম| কপাল বটে আমার ‚ ঠিক এসে হাজির বাবার বিশ্বাসী লেঠেল সিপাহি|
- ছোটামালিক মেঁ বৈঠটা হুঁ আপকে পিছে| বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে বসেই পড়ল বাইকের পিছনে বন্দুকটা কাঁধে নিয়ে|
যদিও জানি সিপাহী বাবার অনুগত তবু আমাকেও কিছুটা সমঝে চলে|
- এক বাত য়াদ রখ‚ এখন কোথায় যাচ্ছি‚ কেউ যেন জানতে না পারে| মনে থাকবে?
- হাঁ ছোটে মালিক|
হাওয়াতে ভর করে বাইকটাকে উড়িয়ে একেবারে শাকিবালা বারের সামনে হাজির হলাম| বাইকটা আর সিপাহীকে বাইরে দাঁড় করিয়ে আমি ভেতরে ঢুকলাম| এই প্রথম আমি এখানে এলাম| জমজমাট বার| সিগারেটের ধোঁয়া আর দারুর উৎকট গন্ধে জায়গাটা একদম যেন নরক লাগছে| আমাকে লল্লন বলেছিলে ও এইখানে কাজ করে| একজন ওয়েটারকে ডেকে বললাম যে লল্লন কে ডেকে দিতে |
- লল্লন কে বোলো যে আমি বাইরে ওর জন্য অপেক্ষা করছি|
আমি বাইরে চলে এসে ওর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম| লল্লন আমাদের মুন্সির ছেলে| আমার খুব অনুগত| লেখাপড়া তেমন একটা ওর দ্বারা হবে না বুঝেই এই বারে কাজ নিয়েছে| বেশ চৌকস ছেলে|
-আরে ছোটে মালিক‚ আপ য়হা? আমাকে ডেকে নিতেন| এখানে কি ব্যাপার|
- না‚ একটা জরুরী দরকার আছে| একটু দুরে চল ‚ কথা আছে|
বার থেকে বেশ একটু দূরে একটা চায়ের দোকানে চলে এলাম|
- সন্তোষ ভৈয়া হ্যায় য়ঁহাপর? কোনো ভনিতা না করেই প্রশ্ন করলাম ওকে
- হাঁ উপরে আছে‚ যেখানে ডান্স চলছে| ও বলে|
- একটা কথা বল‚ সন্তোষ ভৈয়ার সাথে কি আমাদের স্কুলের বাসুস্যারের মেয়ের কোন চক্কর আছে?সচ সচ বোলিও|
লল্লন একটু ঘাবড়ে গিয়ে আমার দিকে বোকার মত তাকিয়ে রইল| ওর হাবভাব দেখে বোঝাই যাচ্ছিল ও অনেক কিছুই জানে‚ কিন্তু বলতে ভয় পাচ্ছে|
- ডর মত‚ সচ বতা আমি ওকে আশ্বস্ত করে জানতে চাইলাম|
-ছোটেমালিক আমার নৌকরি চলে যাবে ভৈয়া যদি জানতে পারেন|
-নৌকরি যাবে না‚ তুই সব বল| আমি ওকে আবারও আশ্বস্ত করলাম|
-মালিক চক্কর তো হ্যায়|
ওর কাছ থেকে যা জানলাম সেটা হল‚ সন্তোষ ভৈয়া প্রায়ই বনারস যায়‚ অন্তরার সাথে দেখা করতে| ওদের মনে হয় কিছু প্ল্যান আছে‚ কিছুদিন আগে লল্লন শুনেছিল সন্তোষ ভৈয়া নাকি বেশ কিছুদিনের জন্য বনারস যাবে‚ তারপর সেখান থেকে অন্য কোথাও| কিন্তু ঠিক কোথায় যাবে সেটা শুনতে পায়নি|
- ঠিক হ্যায়| অব যা‚আরও কিছু জানতে পারলে আমাকে জানাতে ভুলবি না‚ ঠিক হ্যায়|
- অচ্ছা মালিক‚ লেকিন দেখনা মেরি নৌকরি না চলি যায়ে|
ওর চোখের কাতর অনুনয় আমার চোখ এড়ায় না| আমি বাইকে উঠতে উঠতে ওকে হাত তুলে আশ্বস্ত করলাম শুধু| মাথাটা ঠিক কাজ করছে না| এবার কি করব আমি? সামনেই বিয়ে‚ অন্তরা বনারসে| জানি অন্তরা আমায় ভালোবাসে না| আচ্ছা ও কি সত্যি জানে না সন্তোষ ভৈয়া কিরম বাজে লোক| কি করে ওর সাথে জড়িয়ে পরল? বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে| কার কাছে যাব? কাকে জানাব এসব কথা? কে আমায় বুদ্ধি জোগাবে? চাইলে আমি নিজেই অনেক কিছু করতে পারি‚ কিন্তু সিচুয়েশন কুছ অলগ হ্যায়| শালা চুন্নুকে পাশ যাব? কিন্তু বেশ রাত হয়ে গেছে| এখন যদি চন্নুর কাছে যাই তাহলে ফিরতে দেরি হবে| বাড়িতে শোরগোল পড়ে যাবে আমাকে খোঁজার জন্য| এমনিতেই ফতোয়া আছে‚ বিয়ের আগে আগে বাড়ি থেকে বেরোনো চলবে না| কাল বরং চুন্নুর সাথে একবার দেখা করে নেবো|
রাতে দাদির কাছে শুয়ে পড়লাম| বাবার কাছে বকুনি খেলে‚ মনখারাপ থাকলে আমি দাদির কাছেই শুই| দাদির পিঠে মুখ গুঁজে দিলেই আমার ঘুম চলে আসে| দাদির গায়ের গন্ধটা আমার খুব ভালো লাগে| দাদি জিজ্ঞেস করেছিল‚
- কেয়া রে আজ ফির পিতাজি সে ডাট খায়া কেয়া?
-উঁহু বলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম|
দুদিন বাদেই বিয়ে| বাড়িতে নাতে-রিস্তেদার ভরে গেছে| আজ সত্যনারায়ণ কথা আছে সকালে‚ তারপর কুলদেওতার পুজো হবে| পুরো মহল লাইট দিয়ে সাজানো হয়েছে| বনারস থেকে সাহনাইও এসেছে| সকাল থেকে পোঁ পোঁ করে মাথা খারাপ করে দিয়েছে| আমাদের তো অনেক রসম| এরপর হলদি কুটাই‚ মাতৃপুজন‚ সিলপোহা‚ ইমলি ঘুটাই কত যে কান্ড| দিমাগ খরাব করে রেখে দিয়েছে| কখন যে চুন্নুওয়ার কাছে যাব জানি না| কিন্তু যেমন করেই হোক একবার দেখা করতেই হবে| বিকালে আবার পিতাজির কিছু পরিচিত মিনিস্টাররা আসবেন‚ তাদের জন্য জবরদস্ত খানাপিনার আয়োজন হয়েছে| তখনই একটু যা সময় পাওয়া যাবে| সিপাহিকে আগে থাকতেই বলে রাখি বরং‚ একা তো বেরোতে দেবে না| চাচাদের বাড়ি থেকে কেউ আসবে না| ওদের তো নেওতাই দেওয়া হয়নি|
শাম হতে হতে আমার যে কি বুরা হালত হয়েছে কি বলব| সারা বদন টুট রহা থা| কিন্তু চুন্নুর কাছে একবার না গেলে তো নয়| এখন ঘড়িতে ৭-৩০ বাজে| গেস্টরা সব এসে গেছে| দারুর ফোয়ারা চলছে বাইরের বাগানে| এক্দম সহি সময়| সিপাহিকে ডেকে বাইকে করে সোজা চুন্নুর বাড়ি|
- এ চুন্নুওয়া বাহার আ যা|
- ওয়ে তু য়হা!! চুন্নু অবাক‚ আরে তোর শাদি দুদিন পর‚ তুই বেরোলি কেন এখন? তোর বাবা জানলে তোকে কুটে রেখে দেবে রে!!|
- বকওয়াস বন্ধ কর‚ চল আমার সাথে|
- কঁহা?
-দরকার আছে তোর সাথে| চল রাজভোগ এ গিয়ে কেবিনে বসে কথা বলব| তুই সাইকেল নিয়ে আয়‚ আমি ওখানে গিয়ে তোর জন্য অপেক্ষা করছি| এই মুসতন্ডাটা সাথে আছে তাই‚ না হলে তোকে সাথে নিয়েই যেতাম| বলে সোজা রাজভোগ রেস্টোরেন্টে চলে এলাম| সিপাহিকে বাইরে চা-পানি দিয়ে বসিয়ে আমি কেবিনের ভিতর চলে এলামা| কেবিনে পারতপক্ষে কেউ একটা বসে না‚ কেউ বসে গালগল্প করলেও কেউ ডিস্টার্ব করে না| চুন্নুর পসন্দের আইটেম সামোসা আর রসমালাই আর্ডার করে বসতে না বসতেই চুন্নু দেবা কে নিয়ে হাজির|
-বৈঠ যা|
- কি ব্যাপার কিছু গড়বড় করেছিস মনে হচ্ছে| চন্নু বসতে বসতে সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল|
ইতিমধ্যে খাবার হাজির| আমি আর দেরি না করে আদ্যোপান্ত সব ওদের বললাম| চুন্নুটা খাওয়া ছেড়ে গোল গোল চোখ করে আমার কথা শুনছিল|
- সালে ইতনা কুছ হো গয়া?
- এবার বল কি করি? আমার অবস্থা তখন ডুবতে হুয়ে কো তিনকে কা সহারার মত|
- কিন্তু তুই একটা কথা বল‚ তুই কেন অন্তরার ব্যাপারে এত খোঁজখবর করছিস?
- দেখ ভাই আমি তো বিয়ে করেই নিচ্ছি| কিন্তু বাসুস্যার‚ অন্তরার কিছু উল্টা-সিধা হলে স্কুলে মুখ দেখাতে পারবে না| আর তোদের বঙ্গালী সমাজও ওঁনাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে|কুছ ভি হো‚ স্যার আমাকে পছন্দ করে না জানি‚ কিন্তু উঁনকি ইজ্জত পে আঁচ আয়ে এটা আমি চাই না| আখির হমারে স্কুলকা ইজ্জত কা সওয়াল ভি তো হ্যায় না|
আমি সত্যিটা বলতে পারলাম না ওদের| বাসুস্যারের জন্য না‚ অন্তরার জন্য এসব কিছুই আমি করছি | এ সত্য ওদের বলতে পারলাম না|
-সালে কো মরওয়া দে কেয়া?
- তোর মাথা খারাপ হয়েছে| এক্দম এসব চিন্তা করবি না| যা মাল তুই‚ মাথাগরম করে ওসব করেও ফেলতে পারিস| বনারসে তোদের জানাশোনা কেউ আছে? চন্নু বলল|
- হাঁ হ্যায় তো|
- কে?
- আমার বাবার বন্ধু এক মিনিস্টারের বেটা| বনারস গেলে আমরা ওদের বাড়িতেই উঠি তো| সহি বতায়া য়ার| ওকে বলি লোক লাগিয়ে ওদের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে?
-এক্দম তাই কর| সন্তোষ ভৈয়া মনে হয় না জলদবাজিতে কিছু করবে| ওর ঘর-বাড়ি‚ বার সব এখানে| জানাজানি হয়ে গেলে এখানে টেঁকা মুশকিল হয়ে যাবে|
-লেকিন উস হরামির ওপর ভরসাও তো করা যায় না| আমি বললাম|
-দেখ ভাই‚ এরপরও যদি কিছু হয় তবে আমি বলব অন্তরার নসিব| এত বুদ্ধিমতী মেয়ে ও| আমার মনে হয় না এমন কিছু করবে যাতে ওর ফ্যামিলির ইজ্জতের ফালুদা হো যায়ে| চন্নু বলল|
- রহনে দে তু| অত যদি বুদ্ধিমতী‚ তাহলে ঐ হরামির সাথে ইস্ক করবে কেন? চন্নুর কথা শুনে আমি উত্তেজিত হয়ে পড়লাম|
-ছোড় না য়ার| তুই কেন এত উতলা হচ্ছিস? এসব ছাড় আর মন দিয়ে বিয়েটা কর| হোনেওয়ালা বিবিকা ফটো লায়া হ্যায় কেয়া? হামে ভি দিখা| চুন্নু কথা ঘোরাতে চাইছিলো মনে হলো |
-ভাগ সালে, আমার বৌয়ের ফটো তোকে দেখাবো কোনো রে? মজাক করেই বললাম ওকে | ইতিমধ্যে দেবাও চলে এসেছিলো ওখানে | বেশ কিছুক্ষন আড্ডা মেরে আমরা উঠে পরলাম বাড়ি ফেরার জন্য|
- সালো‚ ঠিক সময়ে শাদি পে পৌঁছে যাস‚ দেরি করিস না|তোরা কেউ না থাকলে আমি কিন্তু বিয়েতে বসব না|
- ফিকর নট| আমরা পৌঁছে যাব|
আমি‚ সিপাহিকে বাইকের পিছনে বসিয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন পার্টি একদম জমজমাট| দু একজন তো টল্লি হয়ে বাইরে বাগানেই উল্টে পরে আছে| হলের ভেতর যারা বসে অছে তাদের অবস্থাও টাইট| বাইরে কত যে পুলিশ আর হওয়ালদার এসেছে আর সেইমত তাদের পার্সোনাল বডিগার্ড| সালে কুত্তেলোগ যতই পয়সাওয়ালা হোক না কেন ফোকটে দারু পেলে‚ মাথার চোটি পর্যন্ত গিলবে| যানে দো! আমার কি? হলে ঢুকে দু একজন যারা তখনও হুঁশে ছিল তাদের গোর লাগি আর নমস্তে করে নিলাম| দু-একজন বিয়ে নিয়ে ভদ্দা মজাকও করল| আমিও মুচকি হেসে‚ সৌজন্য দেখিয়ে ওখান থেকে কেটে পরলাম| বচপন থেকে দেখে আসছি এসব‚ নতুন কিছু নয়| এসব নিয়ে এখন মাথা না ঘামিয়ে এখনই একবার বনারসে ফোন করা দরকার| কপাল ভালো ছিলা‚ ফোনটা ঠিকঠাকই কাজ করছে| নাম্বার মেলাতে পেয়েও গেলাম|
- জগদিশ ভৈয়া আমি বিকাশ বলছি...
রাত পোহালেই বিয়ে আমার| আজ সব মনের কথা খুলে বলতে চেয়েছিলাম চুন্নুকে| কিন্তু বলা হল না| কি বা বলতাম? এই যে চন্দা‚ আমার হোনেওয়ালি বিবি‚ ওকে তো আমি চিনি অনেক আগে থাকতেই| ওকে বিয়ে করছি তাতে তো কই আমার কোন অপরাধবোধ জাগছে না বরং বেশ একটা রোমাঞ্চ জাগছে| তাহলে অন্তরার জন্যই বা আমি এত উতলা হচ্ছি কেন? ও তো আমায় ভালোবাসে না| ভালোবাসা তো দুর কি বাত‚ আমায় পছ্ন্দই করে না| তবে কেন ওকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না? এই এহসাস কে কি বলে জানা নেই আমার | কখনো মনে হয় কি দরকার অন্তরাকে নিয়ে ভেবে, যা হবার হবে | কিন্তু সাথে সাথেই আবার মনে হচ্ছে যে যা হচ্ছে তা গলত হচ্ছে আমি এ হতে দেব না |
আমার সব কথা শুনে চুন্নু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল| বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল ও| সবাই খেতে চলে গেছে‚ শুধু চুন্নু আর দেবা আমার কাছে| এবার ওরাও চলে গেল| মনটা বেশ হালকা লাগছে সব কথাগুলো বলে ফেলার পর| এমনিতেই বিয়েটা চন্দার সাথে আমার এখন হচ্ছে ঠিক কথা‚ কিন্তু চন্দা আরও দুবছর ওদের নিজেদের বাড়িতেই থাকবে| দুবছর পর গওনা হলে চন্দা আমাদের বাড়ির বউ হয়ে আসবে|এটাই আমাদের রসম| আমি কিন্তু বিয়েতে বসেও অন্তরার কথা ভাবছি| আচ্ছা অন্তরা যদি কাউকে ভালোবাসে‚ বিয়ে করে তাতে আমার কি? ওর ভালোমন্দের দায়িত্ব তো আমার নয়| তাহলে আমি জগদিশ ভৈয়ার জন্য অপেক্ষা করছি কেন? জগদিশ ভৈয়া আজ আসতে পারেনি‚ পাটির মিটিং আছে| কাল আসলে অন্তরার ব্যাপারে সব জানতে পারব|
বিয়ের রসম শুরু হয়ে গেছে‚ চলবে রাত একটা অবধি| বৃষ্টি অনেকক্ষণ আগেই থেমে গেছে| আমার বাড়ির লোকেরা এখন বিয়ের তৈয়ারি নিয়ে বেজায় ব্যস্ত| পিতাজি‚ মৌসাজি আর বাকি বড়রা লওন্ডা নাচ দেখতে বসেছে| ঘন ঘন বন্দুকের আওয়াজে বোঝাই যাচ্ছে যে ওখানে মেহফিল ভালো জমেছে| ঐ ছেলেরা মেয়ে সেজে যে নাচে‚ তাদের দেখতে এদের এত কি যে ভালো লাগে বুঝি না| কখনও কখনও তো এই মেয়ে সাজা ছেলেদের কে নিয়ে যাবে‚ তাই নিয়েও মারামারি লেগে যায়|
এদিকে তো আমার কোমর ব্যথা হয়ে গেছে পন্ডিতজির কথায় একবার খাড়া হো যাও আর একবার বেয়ঠ যাও করতে করতে| চন্দাকে একটু পরে ওর বাড়ির লোকেরা মন্ডপে নিয়ে চলে এল| সাথে সেই মেয়েদের নাকি সুরে গানও চলছে‚ কি যে গাইছে তার কিছুই বুঝছি না| কিন্তু চন্দাকে দেখে আমার প্রচন্ড হাসি পেয়ে গেল| আমি নিজেকে ঠিক কন্ট্রোল না করে হেসেই ফেলেছিলাম| চন্দার চিমটি খেয়ে নিজেকে থামালাম| হলুদ রঙের শাড়ি পরে আর বিশাল ঘোমটার ভিতরে যে বসে আছে তাকে আমি ভালো করেই চিনি| কিন্তু এই সাজে তাকে বেশ অচেনা লাগছে| ছোটবেলায় এই চন্দার হাতের চড়-চাপড় যে কত খেয়েছি‚ কিন্তু বিয়ের পরও এসব চলবে নাকি! চিন্তার বিষয়| ও কলেজে পড়ে‚ আমি সবে স্কুল কমপ্লিট করব|ঠিক আছে আমি দুবার ফেল করেছি‚ তাও তো ও আমারে থেকে একটু ছোট| তাও একটু ইজ্জত সে পেশ এলে কি এমন ক্ষতি হবে ওর| আখিরকার আমি তো ওর পতি না কি!!
চন্নু আমার পাশে এসে বসল| ওদের দিকে এতক্ষণে তাকাবার ফুরসৎ পেলাম| এতক্ষণ চন্দার দিকেই মনটা ছিল| কি আশ্চর্য্য মনের এই গতি প্রকৃতি! একটু আগেই আমি অন্তরার কথা ভাবছিলাম‚ চন্নুকে বলছিলাম‚ কত কি? আর এখন আমি চন্দাকে ছেড়ে বন্ধুদের দিকে তাকাবার ফুরসতই পাচ্ছি না| ধোতি আর চাদরের আমার সাত বন্ধুর যা রুপ খোলতাই হয়েছে যে কি বলব| হঠাৎ দেখলাম ঘোমটার ভিতর থেকে চন্দা কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে| কি হল আবার? আমি চন্দাকে জিজ্ঞাসা করলাম‚
- তবিয়ত ঠিক আছে তো?
-য়ে আপকে দোস্ত লোগ হ্যায়? চন্দা কাঁপতে কাঁপতেই জানতে চাইল|
- হাঁ তো?
- কেয়া শানদার দোস্ত হ্যায়| বলে আরও বেশি বেশি কাঁপতে লাগল|
ওহ এবার বুঝলাম‚ চন্দা কাঁপছে না হাসছে আমার বন্ধুদের পোশাক দেখে| সত্যিই মনে হচ্ছে বিয়েবাড়ি নয় হোরি খেলতে এসেছে এরা| এই রে হাসি আমারও পাচ্ছে| চন্দার হাসি এত ছুঁয়া ছুঁত কেন? হাসি নয় আসলে চন্দা‚ চন্দাকে আমার কিন্তু বেশ লাগছে| ওর এই হাসি‚ আমার পাশে ওর এই হাজিরা আমি যেন আবিষ্ট হয়ে যাচ্ছি| তবু কপট রাগ দেখিয়ে বললাম‚ আমার দোস্তদের নিয়ে মজাক আমার একদম পসন্দ না| এই চন্নু তোরা নিজেদের কপড়া বদল কিউ নেহি লেতা হ্যায়?
-আগে কাপড়গুলো শুকিয়ে যাক তবে তো পরব| ওকে হাসতে দে‚ তবজ্জু দিস না|
এই চন্নুটাও একটা চিজ| ধোতি-চাদর পরে কেমন যেন স্বামীজির মত গম্ভীর হয়ে বসে আছে| বাকিরাও তাই| যেন আমার বিয়ে নয়‚ কোন ধরমসন্মেলনে এসেছে এরা|
-কাল কখন বের হবি এখান থেকে? চন্নু জিজ্ঞাসা করল আমাকে|
-য়ে তো পতা নহি‚ তবে শুনেছি বিকেল চারটে - পাঁচটা নাগাদ হবে| কেন?
-না‚ আমরা ভাবছিলাম‚ তোর বিয়েটা শেষ হলে চলে যাব| কাল না হয় তোরা ফিরলে তোদের বাড়িতে গিয়ে তোদের সঙ্গে দেখা করে আসব| কি বলিস তুই?
- চলে যাবি তোরা? রাত এক বজনে কো হ্যায়| তাই কর‚ তোরা বরং ফিরেই যা| শুধু শুধু এখানে বসে থেকে কি করবি| আমার মামেরে ভাইরা আছে ওরাই সব সামলে নিতে পারবে| তোদের যা হালত হয়েছে‚ চলেই যা| তবে তোরা যদি কাল আমার বিদাইর সময় এখানে আসিস তাহলে ভালো হয় | পিতাজিকে বলে তোদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করে দেব আমি | আসবি তো ?
ওদের ঐ হালত দেখে আমারই খারাপ লাগছে‚ ওদের বসিয়ে রাখার কোন মানে হয় না|
- ঠিক হ্যায়| আমরা কজন না হয় চলেই আসবো তোদের নিতে | এখন আমরা যাই| কাল দেখা হবে| আর চন্দা ম্যাডাম‚ হাম য্যায়সে দিখ রহে হ্যায়‚ ওয়েসে তো হ্যায় নহি| আপনার পাশের ছেলেটিকে সামলাতে হলে আমাদের শরনে আপনাকে থাকতেই হবে‚ এইটা আগে থাকতেই বুঝে নিন| চুন্নু হাসতে হাসতে বলল|
- মুঝে পতা হ্যায়| ঘোমটার ভেতর থেকে মিহি কন্ঠ ভেসে এলো| হো হো করে আমরা হেসে উঠলাম|
বিয়ের রসম প্রায় শেষ হবার মুখে| একটু পরেই এখান থেকে উঠতে হবে| পিতাজি আর মামাজি‚ মৌসাজিরা সব এসে গিয়েছেন| ওঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছে|
পিতাজি আমার কাছে এসে বললেন‚
-শোনো আমি বাড়ি ওয়াপস যাচ্ছি| তোমার বন্ধু আর স্যার লোগও চলে গেছে| এখানে তোমার ভাইরা রইল| ঠিক সময় খাওয়া দাওয়া করে রেস্ট নিয়ে নেবে|কাল দোপহর খানা খেয়েই তোমরা রওনা দেবে| সেইভাবেই সিপা৫. আবার চুন্নু …...
বিকাশ আর ওর বৌকে নিতে আমি আর দেবা গিয়েছিলাম | বিয়ে বাড়ির সব আচার অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর আমরা সবাই ওদের দুজন কে নিয়ে বিকাশদের বাড়ি পৌছুলাম | সেখানেও আবার শুরু হল আরেক প্রস্থ অনুষ্ঠান | সে সব শেষ করে আমরা, মানে আমি বিকাশ আর দেবা আমাদের আড্ডা রাজভোগ রেস্টোরেন্টে হাজিরা দিতে পৌঁছে গেলাম | আমি‚ দেবা আর বিকাশ ভিতরে বসে চুপচাপ চা খেতে লাগলাম| |
- আজ জগদিশ ভৈয়ার সাথে কথা হল বুঝলি| বিকাশই প্রথম নিস্তব্ধতা ভাঙল|
-কি বলল?
- সন্তোষ ভৈয়া তো হফতে দো হফতে মে অন্তরার সাথ মুলাকাত করতে যায়| তাছাড়া ও বেটার সাথে বনারসের ফেমাস য়েলচিকো বারের মালিকের সাথে ভালো দোস্তি আছে| শুধু দোস্তি নয়‚ শেয়ারও আছে ঐ বারে আমার মনে হয়| অন্তরা হোস্টেল থেকে বেরিয়ে সন্তোষ ভৈয়ার সাথে মাঝে মাঝে ঐ বারেও যায়| জগদিশ ভৈয়ার খাস জানপহচান আছে ঐ বারের মালিকের সাথে| তাই সব খবর পেতে সুবিধাই হয়েছে| তাছাড়া জগদিশ ভৈয়াকে বলে একটা লোক তো ওদের পিছনে লাগিয়ে রেখেছিলাম নজর রাখার জন্য| সবসে জরুরী বাত ইয়ে হ্যায় ‚ ওরা বেশ কিছুদিন আগেই রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে নিয়েছে. অব বতা কেয়া করনা হ্যায়? জগদিশ ভৈয়া জানতে চেয়েছিল আমার কাছে| আর কি করার আছে বল| আমি তো ভাবছি কি মেয়ে য়ার? সাদি করনে কে লিয়ে দুসরা কৈ নহি মিলা থা কেয়া ? বল? কুছ দিন পহলে তক তো ও দিল মেঁ ছাই হুয়ি থি‚ অভি লগ রহা হ্যায় যো হুয়া হ্যায় অচ্ছা হি হুয়া হ্যায় মেরে লিয়ে|
- একদম ঠিক| আমি বললাম| আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম| গতকাল বিকাশ যেভাবে বলছিল অন্তরাকে কোনদিন ভুলতে পারবে না‚ আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গেছিলাম ছেলেটা না কোন গন্ডগোল করে|
- তুই এখন বিয়ে করেছিস‚ আর চন্দাও এত ভালো মেয়ে‚ তোর জন্য অন্তরাকে দিল সে নিকাল দেনা হি সহি হোগা| ইসবার তো তু পাশ হো হি যায়েগা‚ কি বলিস? না হলে কিন্তু চন্দার সামনে তুই এক্দম ছোট হয়ে যাবি| আমি বোঝালাম |
- হাঁ ইসবার তো পাশ হতেই হবে রে | আর সচ বতায়ে‚ আমার না চন্দাকে বেশ ভালো লাগছে| উসপে দিল আ গয়া য়ার| বেশ একটু লজ্জা লজা মুখে বলে বিকাশ|
আমরা হাসি ওর এই লজ্জা দেখে|
- লেকিন কালই তো ও নিজের বাড়ি ফিরে যাবে| ফির গওনাকে বাদ মেঁ আয়েগী| শুনেছি দু বছর পর গওনা হবে | তব তক আমি কি করি? বেশ কাতর প্রশ্ন বিকাশের|
এক বাত বতানা তো ভুল হি গয়া বে! দেবা হঠাৎ কথার মাঝখানেই বলে উঠলো |
কাল ক্লাবে প্রোগ্রাম ছিল | অফিসারস ফ্ল্যাট নম্বর ৬৩‚ যেটা খালি হয়েছিল সেখানে একটা জৈন ফ্যামিলি এসেছে| ওঁদের দুটো মেয়ে‚ দোনো জুড়ওয়া বহন‚ দোনো কা নাম সোনিয়া অর মোনিয়া| কাল কি গান গাইলো ওরা দুজন ….. গরজত বরসত সাওন আয়ো রে …. আহা কি গান শোনালো | এখানে গার্লস স্কুলে ক্লাস ১০ এ অ্যাডমিশন নিয়েছে| লেকিন কেয়া দিখতি হ্যায় দোনো‚ একদম পঠাকা হ্যায় য়ার| দেবা হৈ হৈ করে বলে উঠল|
-কেয়া‚ বিকাশ প্রায় লাফিয়ে উঠল চেয়ার থেকে| কোষে এক চাপড় মারলো দেবার পিঠে |
-কব আই হ্যায়? আগে বলিস নি সালা‚ বেকার সময় নষ্ট করলাম আমরা| চল চল‚ এখুনি চল
৬.
ট্রেনের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি | এখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে | আরও ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই পৌঁছে যাবো আমার সেই ফেলে আসা পুরোনো শহরে | মনে মনে হিসেবে করে দেখলাম প্রায় তেতত্রিশ বছর পর যাচ্ছি এই শহরে | নিজেদের কেউ আর ওখানে নেই | বন্ধুদের মধ্যেও একমাত্র দেবার সাথেই যোগাযোগ আছে | স্কুল ছাড়ার পর বাকিদের সাথে চিঠি লেখা লেখি বেশ কিছু বছর চলে ছিল | সময়ের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে সে সব আর বেশিদিন টেকেনি| খুব স্বাভাবিক ভাবেই চিঠি লেখালেখি বন্ধ হয় যায় | দেবার বাবা মানে আমাদের ঘোষকাকু ওখানেই শোন নদীর ধারে একটা প্লট কিনে বাড়ী করেছিলেন | শুনেছিলাম খুব সুন্দর সেই বাড়ী | বাড়ি থেকে বেরিয়েই বাগান, তারপর একটু দূরে শোন নদী| দেবা আর তার পরিবার এখন ওখানেই থাকে | ওর আসার কথা স্টেশনে | আমি ওর অনেক আপত্তি থাকা সত্ত্বেও হোটেলের ব্যবস্থা অফিস থেকেই করিয়ে নিয়েছিলাম | তিনদিনের কাজ আমার এখানে | তারপর ফিরে যাবো | তবে কথা দিয়েছিলাম যে রোজ অফিসের কাজ মিটিয়ে ওর বাড়ি যাবো | | রাত্রের খাওয়া খেয়ে তারপর হোটেল এ ঢুকতে পারবো | রাজি না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না | তবে যতবারই বিকাশ বা বাকি বন্ধুদের কথা জিজ্ঞেস করেছি তখনি বিকাশ বাদে সবার খবর দিতো | বিকাশের খবর নাকি ওখানে গিয়েই নিতে হবে | এ আবার কি ঝামেলা | সম্ভিত ফিরে পেলাম যখন এটেনডেন্ট দরজায় টোকা দিলো |
'সাব, আপকা স্টেশন আ গয়া হেয়'
ট্রেন ধীরে ধীরে স্টেশনে ঢুকতে লাগলো | আমি দরজার কাছেই এসে দাঁড়ালাম | মাত্র দু মিনিটের স্টপেজ | ট্রেন থামতেই নেমে পড়লাম আর এদিক ওদিক দেখতে লাগলাম কোথায় দেবা | হঠাৎ পিঠে একটা মোক্ষম চাপড় | সাথে হুঙ্কার|
- আ গয়া রে চুন্নুওয়া!! পেছন থেকে জাপটে ধরলো দেবা | ওর আনন্দ যেন আর ধরে না| দেবার মুখ একই রকম আছে শুধু আরও লম্বা হয় গিয়েছে | আমার থেকে আরও এক হাত তো হবেই |
একটু পর খেয়াল করলাম ওর পেছনে আরেকজন লোক চুপ করে দাঁড়িয়ে আমাকে লক্ষ্য করে যাচ্ছে | লোকটা বেশ মোটাসোটা, বেশ কেন অনেকটাই মোটা চেরয়েডর কালো চশমা| পরনে সাদা ট্রাউসর আর সাদা শার্ট | মাথায় বিশাল টাক| এ আবার কে ?
' চিনতে পারছিস ব্যাটা কে ? ' দেবা আমাকে ছেড়ে লোকটার দিকে ইশারা করে বললো |
' না ঠিক চিনতে পারছি না, আমাদের বন্ধুদেরই কেউ হবে, তবে ধরতে পারছি না রে ' চেনার অনেকে চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেব কে বললাম | এ এক ধরনের শাস্তি | সবাই বলছে আমি চিনি কিন্তু আমি চিনতে পারছি না | এ আমার সাথে অনেকবার হয়েছে |
‘আরে এ বিকাশ রে!! ' এবার আমার অবাক হওয়ার পালা | এই মোটকুটা আমাদের বিকাশ?
বিকাশ এসে আমায় জড়িয়ে ধরলো চোঁখ থেকে দরদর করে জল পড়ছে | দেবাও এসে আবার একসাথে জড়িয়ে ধরলো | কারোরই চোখ শুকনো ছিল না | এতো বছর পর দেখা| এই এহসাস শুধু স্কুলের বন্ধুদের সাথেই বোধহয় হয় | কোনদিন কলেজের বন্ধুদের সাথে তো এমন হয়নি |
একটা তো শুধু ব্যাগ আমার হাতে, তাও ওরা আমায় বইতে দিল না | হাত ধরাধরি করে ওভার ব্রিজ দিয়ে আমরা স্টেশনের বাইরে এলাম | ব্রিজ থেকে নেমেই জোরে একটা নিঃশাস নিলাম এই শহরের সেই পুরোনো গন্ধ সে রকমই আছে কি না বুঝবার জন্য | না, নেই | থাকবে কি করে সেই সব ফ্যাক্টরি তো কবেই বন্ধ হয় গিয়েছে | একসময় যে এই জায়গাটা আলোয় আলো হয় থাকতো , এখন শুধু ঘুটঘুটে আগের মতো | মনে করার চেষ্টা করলাম এই পুরো কমপ্লেক্স এ কতগুলো ফ্যাক্টরি ছিল | এ পাস দিয়ে ছিল পেপার, সুগার, পাওয়ার হাউস তার একটু এগিয়ে তখনকার দিনের নামকরা বনস্পতি ঘি, বিশাল বড় একটা ক্যান্টিন, যেখানকার লাড্ডু আর নিমকি খেয়ে আমরা বড় হয়েছি | | তারপর একটু এগিয়ে কোম্পানির নিজস্ব রেল ট্র্যাক| তারপর শুরু হতো স্টাফ কোয়ার্টার আর তারপর সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট স্টাফদের বিশাল বিশাল বাগানওয়ালা বাংলো | একদম ছবির মতো শহর | সব খবরই পেতাম দেবার কাছ থেকে কিন্তু তার যে এই অবস্থা হবে কল্পনাও করতে পারিনি কখনো | মনটা সত্যি খারাপ হয় গেল শহরের এই হাল দেখে |
' ওয়ে, উধর কেয়া দেখা রহা হেয়? জলদি আ যা' সেই পুরোনো হাঁক বিকাশের |
সম্ভিত ফিরে পেলাম ওর ডাকে | বিশাল একটা কালো রঙের স্করপিওর গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে বিকাশ |
' আয়ে আয়ে দেরি করিস না, সবাই অপেক্ষা করছে তোর জন্য" ব্যস্ত হয় বললো ও |
'কিন্তু , আমার হোটেল তো স্টেশনের ও পারে, তুই এখানে নিয়ে এলি কেনো আমাকে?' আসলে খেয়ালই করিনি কখন এদের সাথে কথা বলতে বলতে এদিকটায় চলে এসেছিলাম |
মোক্ষম এক গালাগাল আমার জন্যই বোধহয় তৈরী করেই রেখেছিলো বিকাশ | তা সময় নষ্ট না করে দিয়েই দিলো |
' বহুত বড় আদমি হয় গিয়েছিস না তুই? বন্ধুদের বাড়ি ছেড়ে হোটেলে উঠবি? আর হোটেল কোথায় বে? আমি সব ক্যানসেল করে দিয়েছি | অব বকওয়াস বন্ধ কর আর সোজা গাড়িতে ওঠ | দেবাও থাকবে আমাদের সাথে এই কদিন | রহি বাত তোর কাজের, ওদিকে আমাদের একটা হোটেল আছে তার স্পেশাল রুম তোর জন্য আছে | সারাদিন ওখানে কাজ সেরে তুই বাড়ি ফিরে আসবি | এই গাড়ি আর ড্রাইভার তোর সাথেই থাকবে | অব নো বকওয়াস |’ ফরমান দিয়ে দিলো বিকাশ | ব্যাটা যে ওই বাপেরই ব্যাটা আমার মনে রাখা উচিত ছিল | যাকগে এর সাথে তর্ক করে আর লাভ নেই বেশ বুঝলাম | অগত্যা গাড়িতে উঠে পড়লাম | তবে গাড়িতে উঠতে গিয়ে নজরে পড়লো আমাদের গাড়ির পেছনেই একটা হুড খোলা জীপ্ গাড়ি আর তাতে বসে আছে ছয় সাতজন লোক | সকলের হাতেই বন্দুক, আমি দেবার দিকে তাকাতেই ও চোখ টিপে ইশারা করলো | আর বুঝতে বাকি রইল না | আমি আর দেবা একসাথেই খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠলাম | বিকাশ ঘাবড়ে গিয়ে আমাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো |
' সালে, তুই যে এখনো বাচ্চাই আছিস জানতাম না, এখনো বডিগার্ড নিয়ে ঘুরিস' আমিও মৌকা ছাড়তে রাজি নই | ব্যাটার লজ্জা লজ্জা মুখ গাড়ির আলো আঁধারিতেও বেশ দেখা গেল | আমরা আরও জোরে হেঁসে উঠলাম |
আর বলিস না ভাই, আমার মা আমার বৌ চন্দা কে বিয়ের পর পর এ মাথার দিব্যি দিয়িয়েছেন যে আমি যেন কখনো বডিগার্ড ছাড়া বাইরে না বেরোয় | বস, চন্দা ও আজ্ঞাকারী বহু কি না ?' প্রায় মাথা চাপড়েই বিকাশ বললো | আমি হেঁসে উঠলাম ওর কথায় | দেবা কিন্তু হাঁসলো না |
' মজাক করিস না বিকাশ | জানিস চুন্নু এটার উপর বেশ কয়েকবার জানলেওয়া হমলা হয়েছে, তাই চাচী আর চন্দা ওই পুরোনো ব্যবস্থায় কায়েম রেখেছে, সচ বল না বে সালা ' দেবা বেশ রেগে গিয়েই বললো |
' য়ে লো, দেখা চুন্নু, এ এখনো সেই কোথায় কোথায় সিরিয়াস হয় যায়, সালা সুধরায়নি একটুও' বিকাশ আবহাওয়াটা হালকা করার জন্য বলে উঠলো |
'হুঁহ ' দেবার মুখ থেকে একটা অবজ্ঞার আওয়াজ বেরোলো | সারা রাস্তা আমার সব পুরোনো কথা বলেই কাটিয়ে দিলাম | পুরোনো স্যারদের মধ্যে অনেকে বিশেষ করে আমাদের প্রিয় বচ্চা সিং ও আর বেঁচে নেই জেনে খুব খারাপ লাগলো | কিই বা বয়েস হয়েছিল ওনার? এখন বেঁচে থাকলে বড়োজোর পঁচাত্তর বা তার একটু বেশি হতেন | চলে যাবার মতন বয়েস তো ছিল না ওনার | খুব আশা করেছিলাম যে ওনার সাথে দেখা হবে |
ইতিমধ্যে কখন যে ওদের বাড়ির প্রধান ফটক পার করে মহলের বিশাল দরজার সামনে পৌঁছে গিয়েছি, টেরই পাইনি | অবশ্য মাজখানে ওর গিন্নির বেশ কয়েকবার ফোন এসে গিয়েছিলো আর আমরা কোথায় পৌঁছেছি তার খবর দিয়ে দেওয়া হয়েছিল | চন্দা দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আমাদের অপেক্ষা করছিলো | আমাদের দাড়াঁতেই কাজের লোকেরা এসে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়ালো | মাথায় কাঁচা পাকা চুল, পরনে হালকা রঙের শাড়ীতে মাথায় ছোট্ট করে ঘোমটা| চেহারায় এই আভিজাত্য যেন আরও সুন্দরী করে দিয়েছে চন্দাকে|
'নমস্তে ভাইসাব, ভেতরে আসুন আপনারা' হাঁসি মুখে আমাদের স্বাগত জানায় উনি | আমরাও প্রতিনমস্কার করলাম | এটাই নিয়ম | কিন্তু আমার পেট গুলিয়ে হাঁসি আসছিলো | আর আটকাতে পারলাম না | ভেতরে ঢুকেই জোরে হেঁসে উঠলাম | তারপর আস্তে করে চন্দার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম
'ম্যাডাম, যতদূর মনে পরে আমাদের কোনোদিনই ভাইসাব বলতে না | বরং বাড়ির লোকেদের অনুপস্থিতি তে বেশ ভালোই গালাগাল পূর্ণ যা কি না আমরাও জানতাম না, নিঃসংকোচে দিতে, তা আজ ক্যা হুয়া ?' চাকরদের কান বাঁচিয়েই বললাম ওনাকে| ততক্ষনে কাজের লোকেরা চলে গিয়েছে আমাদের ব্যাগগুলো নিয়ে|
বিকাশ তারমধ্যেই বলে উঠলো
'ওয়ে, কান মে ক্যা বল রহা হয় বে? জোর সে বল ' মজাক করে বললো ও |
'কি জানি রে বিকাশ, আমাদের চুন্নু তো বেশ ভালোই ছিল জানতাম, কিন্তু হাওভাও তো ভালো ঠেকছে না রে | এসেই তোর বৌয়ের সাথে কানে কানে কথা বলছে? ভাগ্গিস আমাদের বাড়ি নিয়ে যায়নি ব্যাটা কে, তুই বরং এটাকে একটু চোখে চোখেই রাখিস বলে দিলাম | ' বেশ চিন্তিত সুরেই দেবা বললো | আরেকবার হাসির ঠহাকাতে বৈঠকখানা কেঁপে উঠলো |
এলাহী খাওয়াদাওয়ার পর আমরা আবার বৈঠকখানাতে এসে বসলাম | কাজের লোক আমাদের কফি দিয়ে গেল |
এতক্ষণে ভালো করে লক্ষ্য করলাম পুরো বৈঠকখানাটা | বেশ সুন্দর করে সাজানো | বিশেষ করে পুরোনো আসবাবের সাথে নতুন আসবাবের তালমিলটা বেশ তারিফ করার মতো | একদিকের দেয়ালে লক্ষ্য করলাম নানা আকারের ফটো ফ্রেম দিয়ে সাজানো | আমাকে ওদিকে তাকাতে দেখে বিকাশ বললো
- 'চল, কাছ থেকে দেখায় তোকে ' বলে হাত ধরে নিয়ে গেল আমাকে দেখতে | পেছনে দেবা আর ম্যাডাম ও এলেন |
- এইটা দেখ আমাদের গ্রপের ফটো | মনে আছে তোর? ইন্দ্রপুরী স্কুলের সাথে যেবার ক্রিকেট ম্যাচে আমরা ট্রফি জিতেছিলাম?’ প্রচুর উৎসাহ নিয়ে ও ফটো দেখতে লাগলো | বেশিরভাগ ফটো আমাদের স্কুলের আর ম্যাডাম চন্দার স্কুল কলেজের | আরেকটা দেয়ালে দেখলাম ওদের নিজেদের ফ্যামিলি ফটো | ওদিকটা আবার দেখে কি হবে ভেবে ফেরত যেতে লাগলাম |
'আরে ওটাও দেখনা, ভালো লাগবে তোর, আয় আয়' বিকাশ আমার কব্জি ধরে টান দিলো | অনিচ্ছা সত্ত্বেও এগিয়ে গেলাম দেখতে | ওর বাবা, মা, দাদু, পরিবারের অনেকে, যাদের চিনিও না সব তাদের ছবি | ক্রমাগত ভাবে বকে যেতে লাগলো বিকাশ
' য়ে মামাজী, য়ে বুয়াজি , আমাদের বিয়েতে এসেছিলো ? তোর মনে নেই? সালা বুড্ডা কহি কা! কিচ্ছু মনে নেই তোর, চল এবার বল এই ফটোটা কার?' আমাকে একটা ফটো, প্রায় তিন ফিট বাই দু ফিট বড় ফটোর সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো বিকাশ | একটা মেয়ের ছবি | পেছনে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, মনে হয় মেয়েটি ওখানেই থাকে | মুখটা ঠিক আলো আঁধারিতে বোঝা যাচ্ছে না | একটু এগিয়ে কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করলাম | মুখটা যেন চেনা চেনা লাগছে | একটু পর ঠাহর করতে পারলাম | শিড়দাঁড়া দিয়ে যেন একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল | ফিসফিসিয়ে বিকাশকে ঠেলা দিয়ে বললাম
- আরে এ তো অন্তরার ছবি? এখানে লাগিয়েছিস কেন ?
সবাই মানে তিনজনই একসাথে হেসে উঠলো আমার প্রশ্নে | এবার সত্যি আমার ঘাবড়ানোর পালা | আমার চেহারা দেখে চন্দা এবার আমার হাত ধরলো এসে, বললো
'চুন্নুজি এবার বসা যাক | বিকাশ বলবে তোমাকে এই গল্প, কিন্তু এখন তো অনেক রাত হলো, এবার শুয়ে পড় না তোমরা ! কাল তো তোমার কাজে যাওয়ার আছে | কাল কাজ থেকে ফিরে না হয় শুনবে গল্পটা ? ' চন্দা বেশ অনুনয় করেই বললো |
'ম্যাডামজি , কাম তো গয়া তেল লেনে | এই গল্প না শুনে আমি ঘুমোতে কি, বাথরুম ও যাবো না, এই বলে দিলাম' বলে আমি জাঁকিয়ে বসলাম ওদের বিশাল সোফার উপর |
‘তুমি বরং আরেক রাউন্ড কফির ব্যবস্থা কর| এই সালা বিকাশ, শুরু কর এবার | আমার এখনো মাথা ঘুরছে | কাছাকাছি কোনো ডাক্তার থাকলে কাল আমার ব্লাড প্রেসার একবার চেক করিয়ে দিস' ঠাট্টা করেই বললাম|
একটু পর চন্দা নিজেই কফি বানিয়ে নিয়ে আসলো | আমাদের হাতে হাতে কাপগুলো ধরিয়ে নিজে একটা কাপ নিয়ে আমাদের সাথে এসে বসলো | বিকাশ বলা শুরু করলো....
তুই তো চলে গেলি ফাইনাল এক্সাম দিয়ে | আমাদের গ্রূপটাও ভেঙে গেল | কেউ চলে গেল বাইরে, কেউ এখানেই রয়ে গেলো | যেমন আমি | এক দেবার সাথেই যোগাযোগ ছিল আমার | বাকি সবাই যে কে কোথায় চলে গেল জানি না | খবর রাখারও চেষ্টা করিনি | তুই আর দেবাই তো ছিলি আমার কাছের বন্ধু | তোরাই যখন নেই তো কি হবে বাকিদের খবর রেখে | ইতিমধ্যে পিতাজিও হটাৎ করে হার্ট এটাক হয়ে চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে | মা খুব ভেঙে পড়েছিল পিতাজির চলে যাওয়াতে | তোরা তো জানিসই পড়াশুনায় আমার কত মাথা ছিল | তাই ওই রাস্তায় আর গেলাম না | পিতাজির ব্যবসায়ে হাত লাগলাম | পিতাজির অনেক ব্যবসার মধ্যে একটা ছিল কন্ট্রাক্টরির ব্যবসা | রেলওয়ের ব্রিজ বানানো আর তার মেইনটেনেন্সর কন্ট্রাক্ট| ভেবে দেখলাম বাকি ব্যবসা থেকে এটাই সবচেয়ে বেশি লাভদায়ক ছিল| তাই অন্য গুলো কে আস্তে আস্তে বন্ধ করে ওগুলোর টাকা এই কন্ট্রাক্টরিতেই লাগলাম | ঈশ্বরের কৃপা ছিল| বেশ ভালো ভাবেই সামলে নিলাম ব্যবসা | মাঝখানে ফুট কাটলাম আমি
'আহা, ওনার ওই সাধের ডাকাতির ব্যবসা খামোকা বন্ধ করে দিলি ?' আবহাওয়া হালকা করার জন্য বোধহয় দরকার ছিল | সবাই হেসে উঠলো |
'যা যা , সে রকম কোনো ব্যবসা আমাদের ছিল না | সে দাদা পরদাদারা করতো | এখন থোড়াই কেউ করে ' বেশ সিরিয়াস হয়েই জবাব দিলো বিকাশ |
-'আগে শুন' বলে আবার শুরু করলো ও|
পিতাজী চলে যাওয়াতে আমাদের গওনা তাড়াতাড়ি করে করিয়ে দেয়া হল| এই ম্যাডাম আমাদের বাড়িতে মালকিন হয় এলেন তখন| মা তো বলতে গেলে শয্যাশায়ী | কিছুই আর করতে পারেন না | তাই চন্দাকেই এসে এ বাড়ির হাল ধরতে হলো | আর উঠি | ভইয়া কোনোদিনই আমাকে হোটেলে উঠতে দিতো না | ভইয়া তো তখন নাম করা সাংসদ হয়ে গিয়েছেন | আমার ব্যবসাতে উনি অনেক সাহায্য করেছেন সেই সময় | এখনো করেন | আমাকে ছোটভাইয়ের মতোই স্নেহ করেন | একদিন ভইয়ার সাথে খেতে বসেছি | নানা ব্যবসায়ীক কথাবার্তা চলছিল | হটাৎ উনি বলে উঠলেন
'হ্যা রে, তোর সেই অন্তরা কে মনে আছে ' আমি ওনার প্রশ্ন শুনে চমকেই উঠলাম | কি করে বলি যে খুব মনে আছে | বললে তো আমার পিঠে একটা জবরদস্ত রদ্দা পড়তো | খেতে খেতে মাথা না তুলেই বললাম
' কোন অন্তরা ? ও হাঁ মনে পড়েছে| তো কি ?' খুব হালকা করেই প্রশ্ন করলাম |
'না তেমন কিছু না, ওর ওই পতি সন্তোষ ছিল না ? সে ব্যাটা ড্রাগ সাপ্লাইয়ের ব্যবসা শুরু করেছিল | প্রথমে পঞ্জাব থেকে মাল এনে দেশের নানা জায়গায় এজেন্টসদের মারফত বিক্রি করতো| ভালোই চলছিল ব্যবসা | তারপর বেশি মুনাফার আশায় দুবাইর সেলিব্রিটিদের পার্টিতেও সাপ্লাই শুরু করলো | কখনো | দু মহিনা হলো দুবাই এয়ারপোর্ট এ ধরা পড়েছিল | তুই জানিস কি না জানিনা, ওখানে ধরা পড়লে কিন্তু.... কাল শুনলাম যে ওখানকার সরকার ওকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে | '
ভাবীজি তখন কাছেপিঠে ছিল না | আমি খাওয়া ছেড়ে উঠে ভইয়ার হাত চেপে ধরলাম |
'ভইয়া, অন্তরা কোথায় তাহলে ?' আমি আর থাকতে পারলাম না |
জগদীশ ভইয়া আমার পিঠে হাত দিয়ে শান্ত করলো | মুচকি হেঁসে বললো
' বেটা, আমি মানুষ চড়িয়ে খাই, তুই কি ভাবছিস আমি তোর মনের কথা জানি না ? আমি জানি ও কোথায় আছে | কাল আমার লোক তোকে ওর কাছে নিয়ে যাবে, এখন মন দিয়ে খা দেখি, ও জি সুনতি হো! হমলোগো কে লিয়ে দহি-বুন্দি ভেজওয়া দেনা , বিকাশের খুব পছন্দ ' যেন কিছুই হয় নি এমন ভাব ভইয়ার | পলিটিশিয়নরা এমনি হয় |
সারা রাত ঘুমোতে পারলাম না | কত যে চিন্তা ছিল মনে তোদের কি করে বোঝাব| এই যে অন্তরা কে দেখতে যাচ্ছি , চন্দাতো কিছুই জানে না | এ ঠিক না| একটা অপরাধ বোধ যেন মনটাকে কুরে কুরে খাচ্ছিলো | একবার ভাবলাম কি দরকার দেখা করার, আবার ভাবলাম একবারই তো যাবো, দেখে চলে আসবো, দেখিয়ে তো আসতেই পারি যে দেখো তুমি কেমন আছো আর আমি কেমন আছি | এতে তো কোনো অপরাধ নেই ?
সকাল সকালই বেরিয়ে পড়েছিলাম ভইয়ার পার্টির লোকটার সাথে | বঙালিটোলার এ গলি ও গলি ঘুরে শেষে পৌছুলাম আস্তানার দোরগোড়ায় | ভইয়া বলেই দিয়েছিলো যে সেই আমিরি আর আর নেই | পুলিশের ভয়ে এখন লুকিয়েই আছে একরকম বলতে গেলে | সত্যিই তাই, ভইয়ার লোক আমাকে একটা পুরোনো ভাঙা বাড়ির সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিলো |
- 'য়হী মকান হেয় ভাইজি ' ইশারা করে বললো সে
-' ঠিক হেয়, তুম যা সকতে হো অব' ওকে কোনো দরকার ছিল না আর | বাড়ির সামনে গিয়ে দুরু দুরু বুকে দরজার শেকল নাড়ালাম | ভেতর থেকে মেয়েলি আওয়াজ এলো |
'কৌন ?' গলা চিনতে পারলাম না | ঠিক বাড়ি এসেছি তো ?
আবার দরজার শেকল নারা দিলাম | একটু সময় নিয়ে দরজা খুললো | একটা বুড়িদাই মত কেউ দরজা খুলে দিলো |
'অন্তরা আছে ? বোলো আমি ওনার শহর থেকে এসেছি' আমি বললাম |
'আপ রুকিয়ে' বলে বুড়ি আবার দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে গেল | কি অবস্থা আমার বোঝ তোরা, একটু পর ফিরে এসে দরজা খুলে সরে দাঁড়ালো সেই বুড়ি |
'সিধে চলে যান, সিধে হাত কে কমরেমে' আমাকে রাস্তা দেখিয়ে বুড়ি চলে গেল বাইরে | মানে ডানদিকের কমরাতে আমাকে যেতে হবে | আমি ভাবুক হয়ে চলে তো এসেছি কিন্তু এবার সত্যি ভয় করতে লাগলো | কি জানি অন্তরা আমাকে দেখে কি বলবে | একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছি বোধহয়| ভগবানের নাম নিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম | নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যা দেখলাম | এই সেই অন্তরা ? কম করেও প্রায় দু বছর পর দেখছি ওকে | একটা নোংরা বিছানায় শুয়ে আছে ও | প্রায় মিশে গিয়েছে বিছানার সাথে বলতে পারিস তোরা | মাথার ওই ঘন চুল প্রায় কিছুই আর বাকি নেই | ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে বেশ বুঝতে পারলাম অন্তরা এখন দারিদ্রের শেষ সীমায় এসে গিয়েছে | কষ্ট করে উঠে বসলো সে | আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন | চিনতে পারলো না বেশ বোঝা গেল |পাশেই একটা নড়বড়ে চেয়ার দেখে ওটা টেনে নিয়ে বসলাম | বললাম
- আমি বিকাশ ঠাকুর | চিনতে পারছো কি?
মুখ দেখে মনে হলো চেনবার চেষ্টা করছে | আমি আবার বললাম
- আমি বসাওন ঠাকুরের ছেলে বিকাশ ঠাকুর
বেশ কিছু সময় নিলো আমায় চিনতে, কিন্তু চিনতে পেরে মনে হলো না বিশেষ খুশি হয়েছে, একটু রুক্ষ স্বরেই জিজ্ঞেস করলো
- হ্যাঁ হ্যাঁ এবার চিনেছি | কিন্তু তুমি এখানে?
- আমি এখানে কেন এলাম সে পরে না হয় বলবো কিন্তু তোমার এই অবস্থা কি করে হল? বাসু স্যার কে জানিয়েছ কি ? আমি জিজ্ঞেস করলাম | হয়তো আমি একটু কঠিন স্বরেই বলেছিলাম | তাতে মনে হলো কিছু কাজ হলো| একটু সুর নরম হল মনে হয়| তারপর বেশি ভনিতা না করে ওকে সোজাসুজিই বললাম
- অন্তরা, আমি তোমার কাছে এসেছি তোমার সব খবর জেনেই |
আমার কথা শুনে অন্তরা মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো | একটু সময় নিয়ে আস্তে করে বললো
- তাহলে কি আমার দুর্দশার খবর পেয়ে, দেখতে এসেছো যে আমি কি অবস্থায় আছি ? খুব আনন্দ পেয়েছো নিশ্চই ? তাহলে যাও গিয়ে শহরে গিয়ে রটিয়ে এস আমার দুর্দশার কথা | বাড়ির লোকেরাও জানতে পারলে খুশিই হবে |
এ কথার কোনো জবাব আমার কাছে ছিল না| কি জবাব দেব? এই মেয়ের আত্মসম্মান যে খুব সে তো তোরা ভালো করেই জানিস| আর সত্যি তো আমি কেন গিয়েছিলাম ওর কাছে ? নিজেকেই প্রশ্ন করেছিলাম সেদিন আমি| মনের কোনায় একটু প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছে কি জেগেছিলো না আমার? অস্বীকার করা যায় না, হয়তো তাই | আমি বললাম
- তোমার যদি তাই ইচ্ছে, তবে সেটা না হয় আমি পূরণ করে দেব, চিন্তা করো না | কিন্তু আগে বলো তোমার শরীরের এই হাল হল কি করে? আমার কথায় বোধহয় কিছু কাজ হলো | অন্তরাও বোধহয় একটু ভরসা করতে শুরু করেছিল আমায় | তার | ওরা বনারসের এক মন্দিরে গিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করেছিল | বাড়িতে বাসু স্যার সেটা জানার পর অন্তরাকে আর বাড়ি ঢুকতে দেননি| সোজা কথায় বলতে গেলে অন্তরাকে উনি ত্যাজ্য করে দিয়েছিলেন | তাতে কিছু ফরক পড়েনি ওদের | তখন তো ওরা প্রেমের সুখ সাগরে ভাসছে| কিছু বছর বনারসে কাটানোর পর ওরা দুজন চলে গেল কাঠমান্ডু, সেখানে নাকি রোজগার ভালো হবে | এমনটাই বলেছিলো সন্তোষ অন্তরাকে | এমনিতেও টাকা পয়সার অভাব তো ছিল না | নিজের শহরের বার থেকে আর বনারসের মধুশালা থেকেও নিজের শেয়ারের ভালো আয় হচ্ছিলো | কিন্তু কাঠমান্ডু গিয়ে অন্তরার চোখ খুললো | জানতে পারলো সন্তোষ ড্রাগের ব্যবসায়ে হাত দিয়েছে | এই নিয়ে শুরু হলো ওদের মধ্যে অশান্তি|
- আমার তখন কিছুই করার ছিল না একমাত্র ফিরে আসা ছাড়া | রোজ রোজ ঝগড়া আর সহ্য করতে পারছিলাম না | সন্তোষ ও দেখলাম আমার চলে আসার ব্যাপারে বিশেষ আপত্তি করলো না | এতক্ষন কথা বলার পর অন্তরা হাঁপাতে লাগলো | আমি উঠে কাছেই রাখা সুরাহী থেকে কাছে রাখা গ্লাসে ঢেলে ওর দিকে এগিয়ে দিলাম| জলটা খেয়ে বোধ হয় একটু আরাম হল| ইতিমধ্যে কাজের মহিলাটি ও চলে এসেছিলো | অন্তরা ওকে বললো চা করতে |
- না না আমি চা খাবো না, তুমি বরং একটু আরাম করো, আমি বাইরে থেকে একটু হয়ে আসছি |
- কোথায় যাচ্ছো?
- একটা ফোন করে আসছি এক্ষুনি | বলে আমি বাইরে চলে এলাম | এতক্ষন ওই ছোট অন্ধকার ঘরে আমার দম বন্ধ হয় আসছিলো| বাইরে এসে বুক ভোরে নিঃশাস নিলাম আমি | ওখানেই এক দোকান থেকে জগদীশ ভইয়াকে ফোন করলাম|
ভইয়া কে সংক্ষেপে সব কথা বললাম আমি|
- ভইয়া, একটা অ্যাম্বুলেন্স আর একটা ভালো ডাক্তার এখানে পাঠাতে কত সময় লাগবে?
- আধা ঘন্টার মধ্যে চলে আসবে ওখানে| কিন্তু তুই এ সব কেন করছিস বল তো ? তোর বাড়িতে জানলে কি হবে সে খেয়াল আছে?
- সে আমি জানি না ভইয়া, সে কথা পরে ভাববো | তুমি আগে এই ব্যবস্থা করে দাও প্লিজ |
- আচ্ছা ঠিক আছে আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি | আমিও আসবো কি ?
- না ভইয়া তার দরকার নেই | পারলে সাথে কিছু টাকা আর একজন লোক ও পাঠিও | বলে ফোনটা কেটে দোকানি কে পয়সা দিয়ে আবার ফিরে এলাম |
ঘরে ঢুকে দেখলাম অন্তরা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে | আমি চুপ করে ওর সামনে বসে রইলাম | তাকিয়ে ছিলাম ওর মুখের দিকে | হঠাৎ ভিতর ঘর থেকে একটা বাচ্চার কোঁকানোর আওয়াজ আমাকে চমকে দিলো | অন্তরা ও চোখ খুললো |
- ও তুমি এসে গিয়েছো! আমায় ডাকোনি কেন ? একটু ঝিমুনি এসে গিয়েছিলো তাই চোখ বন্ধ করে ছিল | একটু লজ্জিত হয়েই বললো অন্তরা |
- না না সে ঠিক আছে তুমি আরাম করো | কিন্তু .... আমার কথা শেষ হবার আগেই কাজের মেয়ে একটা বাচ্চা কে নিয়ে ঘরে ঢুকলো | আমার চোখের প্রশ্ন বোধহয় অন্তরার চোখ এড়ায়নি|
- আমার মেয়ে, তিতলি
আমি তখন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি | এক সাথে এতগুলো মানসিক ধাক্কা বোধহয় আমি জীবনে পাইনি কখনও |
-পাঁচ মাস বয়স ওর, আমি কাঠমান্ডু থেকে ফিরে আসার পর ও হল| সন্তোষ তো জানেও না যে ও একটা মেয়ের বাবা হয়েছে | জানার চেষ্টাও করেনি কখনও | বলতে বলতে পরম আদরে মেয়ে কে কোলে নিল অন্তরা|
মনে মনে বললাম আর জানতেও পারবে না ওই শুয়োরটা |
- ও হওয়ার সময়ই ডাক্তার বলেছিলো আমার ইউটেরাসে কিছু প্রব্লেম আছে | আলাদা করে চিকিৎসা করাতে হবে | কিন্তু করবো কি করে ? ও তো পাঁচ-ছয় মাস হয়ে গেলো এক পয়সাও পাঠায় নি আমায়, এই কাজের মেয়েটার টাকাও দেয়া হয় নি অনেক মাস | তিতলিকে ভালোবাসে তাই আসে আর আমার রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সব করে দিয়ে যায় | অন্তরা বলে যাচ্ছিলো, আমি শুনছিলাম বটে কিন্তু অন্য চিন্তাও মাথায় ঘুরছিলো | অন্তরা যদি হাসপাতাল চলে যায় তাহলে এই মেয়েটার মানে তিতলির কি হবে ?
- অন্তরা, তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই আশা করি মন দিয়ে শুনবে | আমি এখুনি একজন ডাক্তার আর অ্যাম্বুলেন্স কে খবর দিয়েছি | তোমার এখনই চিকিৎসার দরকার | তুমি মানা করলেও আমি শুনছি না | আমি বললাম
- এ কি করেছো তুমি ? আমি হাসপাতাল চলে গেলে তিতলিকে কে দেখবে? ও তো আমাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারে না | আমায় না জিজ্ঞেস করে তুমি এ কাজ করতে গেলে কেন ? অন্তরা প্রায় চিৎকার করে উঠলো | আমি চুপ করে রইলাম | ও একটু শান্ত হলে আমি বললাম
- তুমি কি আমার উপর ভরসা করতে পারো অন্তরা ? আমি দাবি করছিনা, সে করার আমার কোনো অধিকার ও নেই তবুও জিজ্ঞেস করছি তোমায়, আমার উপর কি একটু ভরসা করতে পারো তুমি ?| আমার কাতর কণ্ঠ বোধহয় ওকে শান্ত করলো |
- বেশ, তোমার উপর বিশ্বাস না হয় করলাম কিন্তু তিতলি কোথায় থাকবে | কার কাছে থাকবে ?
- যদি বলি ও আমার আর আমার বৌ চন্দার কাছে থাকবে যতদিন না তুমি ভালো হয় ফের ? আশ্চর্য আমি একবারও চন্দা কে জিজ্ঞেসও করলাম না ওর কি মত| আমার বোধহয় বিশ্বাস ছিল চন্দার উপর|
- ওকে আমার কোলে দাও অন্তরা| তুমি ভালো হয় ফিরলে ও আবার তোমার কাছে চলে আসবে | আমাকে বিশ্বাস করো অন্তরা|
অন্তরা চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে দিলো তিতলিকে | অন্তরার চোখ দিয়ে তখন অঝোর ধারায় জল পড়ছে | ওর শীর্ণ হাত আমার একটা হাত চেপে ধরলো | কিছু যেন বলতে চাইলো ও, কিন্তু বলতে পারলো না| বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে বোঝা গেল ডাক্তার আর অ্যাম্বুলেন্স এসে গিয়েছে| পেছনে দেখলাম আমার মানা করা সত্ত্বেও ভইয়া ও এসে গিয়েছে | আমার কোলে তিতলিকে দেখে কিছু বলল না ভইয়া | ও তো জানেই যে আমি যা একবার ভেবে নেই তাই করি হাজার কেউ বোঝালেও বুঝবো না ! তার জন্য অবশ্য চন্দা ও অনেকটা দায়ী|
- চায় লাউ মেমসাব?
কাজের লোকের কোথায় আমাদের ঘোর কাটলো| বাইরে জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি সকাল হয়ে এসেছে | বিকাশের কথা শুনতে শুনতে কখন যে সময় কেটে গিয়েছিল আমরা টেরই পাইনি |
- হ্যা, লে আইয়ে | চন্দা বলল কাজের লোকটাকে |
- সালো , এবার বাকিটা চন্দার কাছে শোন, আমি বাথরুম হয়ে আসছি| বলে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল বিকাশ |
চন্দাআমার দিকে ফিরে বললো
- চুন্নুজি, আপনারাও তো চেনেন ওকে| পট থেকে কাপে চা ঢালতে ঢালতে বললো চন্দা|
- আমার কাছে হঠাৎ ফোন ওনার, যত তাড়াতাড়ি পারো বনারস চলে এস| আমি তো ভেবেই মরি আবার কি হল| জগদীশ ভইয়া কে ফোন করলাম, সেখানেও সেই একই জবাব, এখানে এস তারপর বলব | ভাবুন আমার কি অবস্থা সেই সময় | ট্রেন টিকেট না পেয়ে এখান থেকে গাড়ি নিয়েই পৌছুলাম সোজা জগদীশ ভইয়ার বাড়ি | বনারস পৌঁছে সব শোনার পর তো মাথায় হাত দিয়ে বসেই পড়লাম আমি | এই লোকটাকে নিয়ে যে কি করি | উনি তখন হাসপাতালে, হাতের কাছেও নেই যে দু-চার ঘা লাগাই | ইতিমধ্যে জগদীশ ভইয়ার বৌ মানে আমাদের দিদি তিতলি কে নিয়ে ঘরে ঢুকলো| আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম | অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম মেয়েটার দিকে , কি সুন্দর দেখতে! ফর্সা, গোল গোল হাত পা, এক ঝাঁক কোঁকড়া মাথায় চুল সাদা ফিতে দিয়ে বাঁধা | আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে ওই পুচকি মেয়েটা | তারপর ফিক করে হেসে দিলো আমার দিকে তাকিয়ে | তারপর কি মনে করে কে জানে আমার দিকে দু হাত বাড়িয়ে দিলো আমার কোলে আসার জন্য | আমি যেন সম্মোহিত হয় গিয়েছিলাম ওকে দেখে| আমাদের তো অনেক বছর হলো বিয়ে হয়েছে কিন্তু ভগবানের হয়তো এই ইচ্ছেই ছিল যে আমাদের কোনো সন্তান হয়নি | বুকে জড়িয়ে ধরলাম মেয়েটাকে | মনে হলো যেন আমারই মেয়ে, অনেক দিন পর দেখা হয়েছে আমাদের | মেয়েটাও তেমনি, যেন কত চেনা সে ভাবে গলা জড়িয়ে আমার গালে গাল ঠেকিয়ে চুপ করে রইলো | সে দিনকার কথা আজ ভুলতে পারি না চুন্নুজি |
- তার মানে ওই ফটোটা তাহলে তিতলির, অন্তরা নয় ? এবার বোধহয় আমার অবাক হওয়ার পালা |
- হ্যাঁ, চুন্নুজি ও তিতলি, আমাদের একমাত্র মেয়ে, আমাদের প্রাণ |
- তাহলে অন্তরার কি হলো ?
- অ্যাডভান্স স্টেজে ছিল ওর ইয়ুটেরাইন ক্যান্সার, বাঁচার চান্স বলতে গেলে ছিলই না অন্তরার| তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকলো বিকাশ | চায়ের কাপটা নিজের দিকে নিয়ে আবার বলা শুরু করলো |
-বেশ কিছু টেস্ট করার পর ডাক্তাররা রায় দিয়েছিলো | অনেক পুরানো রোগ| ঠিক সময় চিকিৎসা করলে হয়তো ঠিক হয় যেত | কিন্তু কে করবে? কয়েক মাসের মধ্যেই ও চলে গেল | শেষ সময় আমি ওর পাশেই ছিলাম | আমার হাত ধরে ও একটাই অনুরোধ করেছিল আমি যেন মেয়ে কে বাসু স্যার মানে ওর বাবার কাছে না নিয়ে যাই | কিন্তু তোরাই বল তা কি সম্ভব ? আমি একদিন নিয়ে গেলাম চন্দার অনিচ্ছা সত্ত্বেও | তা বাসু স্যার তো আমার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলেন | ভালোই হলো আমাদের জন্য | আইনি ভাবে ওকে গোদ নিতে কোনো অসুবিধা হলো না আমাদের| এখন তিতলি মানে আমাদের গুড়িয়া, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি তে পড়ছে জানিস? হ্যাঁ গো কি পড়ছে ও যেন ? কোর্সটার নাম ঠিক আমার মনে থাকে না |
আমরা ওর কোথায় হো হো করে হেসে উঠলাম| এ ব্যাটা কোনো দিন শুধরোবে না জানি | আমি উঠে বিকাশের হাত চেপে ধরলাম কিন্তু সব কোনো ভাষা বা শব্দ আমার মুখে ছিল না | আবার বলতেই হয়, এই না হলে আমাদের বিকাশ?