ফিমেল বেস্টি-১
ফিমেল বেস্টি-১


"কী, আজও দেরি হলো আসতে, উফ, তোর দেরিতে আসার অভ্যেস যে কবে যাবে", তিয়াশা চুলের খোঁপা ঠিক করতে করতে তন্ময়কে এইভাবেই স্বাগত জানালো।
তন্ময়র আসার ইচ্ছে বিন্দুমাত্র ছিল না। নেহাত আবির আর তিয়াশা দুজনেই তার খুব কাছের। বারদুয়েক বলা সত্ত্বেও যখন আবির-তিয়াশা দুজনেই একসঙ্গে বাসায় এসে হাজির হলো, তখন বাধ্য হয়ে তন্ময় হ্যাঁ করলো।
আজ তিয়াশার বিয়ে। আবিরের সাথে। আবির আর তিয়াশার পরিচয় তন্ময়ই করিয়েছিল। আসলে তন্ময়, আবির আর রাহুল একসাথেই পড়তো। চাকরিসূত্রে তন্ময় বাইরে চলে যাওয়াতে ফোনেই ওদের যোগাযোগ ছিল। তিন অভিন্নহৃদয় বন্ধু ওরা। একে অপরের জন্য সবই করতে পারে। আজকের যুগে এরকম গলায় গলায় বন্ধুত্ব সত্যি বেমানান।
আবার ওদিকে তিয়াশা তন্ময় এর যাকে বলে ফিমেল বেষ্টি। সবকথা তারা খোলাখুলি বলতো। তন্ময় তিয়াসার বাবা মার খুব কাছের ছিল। আর তিয়াসাও তাই ছিল তন্ময়র পরিবারের কাছে। তিয়াশার সঙ্গে তন্ময়ের পরিচয় কলেজে। প্রথম দেখাতে তন্ময় বিরক্তই হতো তিয়াশার ওপর । কেউ কিছু একটু বলে দিলেই তিয়াশার ঘেনঘেন শুরু। এদিকে তন্ময় আবার এইসব ঘেনঘেনানি পছন্দ নাহলেও তিয়াশার বাবাকে কথা দিয়েছিল এডমিশনের সময়, যে তিয়াশাকে সবসময়ই সাহায্য করবে। আসলে তন্ময়ের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই একটু ভরসাজোগ্য ভাব। তন্ময়কে কোনো কাজ দিলে না করতে পারতোনা, বরঞ্চ অন্যের সহায়তা করতে পারলে খুশিই হতো। এইভাবেই তন্ময় আর তিয়াশা কাছাকাছি চলে এসেছিল। দুজনেই একসাথে লাঞ্চ করতো প্রজেক্টের কাজের পর। উইকেন্ডে সিনেমা দেখা, ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করা, কলেজে ওয়র্কশপ করানো, নবীনবরণ, মনে সব কাজ জুটি বেধে করতো ওরা। স্বাভাবিক ভাবেই , সবাই ভাবত ওরা হৃদয়ের দিকেও একিসুত্রে বাঁধা। কিন্তু তন্ময় আর তিয়াসা দুজনেই হেসে উড়িয়ে দিত। মাঝে মাঝে একে অপরকে খেপাতও এইসব নিয়ে পরে ভ্যালেন্টাইন ডের সময় আগে আমাকে চকোলেট দিবি, তারপর নিজের বউকে।" সেই সময় তন্ময়ও বলতো " এককাজ কর, এমনিতেও তো তোকে আমি ছাড়া কেউ সহ্য করবেনা, আমাকেই বিয়ে করে নিস, তাহলে বউ আর গার্লফ্রেন্ড দুটো চকোলেট তোরই হবে"। তিয়াশা তবে রে বলে তন্ময়ের পেছনে ছুটতে শুরু করতো, আর তন্ময় দৌড়িয়ে পালিয়ে যেত। এইরকম নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের মধ্যেই ওদের কলেজ জীবন চলছিল।
হটাৎ এরইমধ্যে আবির একদিন হাজির হলো তন্ময়ের কলেজে, রাহুল কে নিয়ে। দিনটা ছিল তন্ময়র জন্মদিন। তন্ময়কে সারপ্রাইজ দেওয়ার উদ্দেশে। এদিকে তিয়াশা সব প্ল্যানিং ফ্যানিং করে জমিয়ে তন্ময়ের জন্য হল সাজাছিল্লো। আসলে এবছরই তাদের লাস্ট ইয়ার। তাই সেলিব্রেশন তাও একটু বেশি। হটাৎ উপরে একটা বেলুন লাগাতে গিয়ে তিয়াশার চেয়ারটা হড়কে গিয়ে যেই না তিয়াশা পড়ে যাবে, সেই মুহূর্তে আবিরের প্রবেশ, যেটাকে বলে সঠিক সময় সঠিক জাগাতে।
আবির -"তোমার লাগেনি তো?"।
তিয়াশা-"না, থ্যাংকস"।
দুজনেরই চোখাচোখি হলো। আবির তো তিয়াশাকে দেখেই থ। তিয়াশাও হালকা একটা হাসি দিল। বেশ মনে ধরেছে তার আবিরকে। রাহুলের চোখ এড়ালো না ব্যাপারটা।
এরইমধ্যে তন্ময়ের প্রবেশ।
তন্ময় :- '" আরে আবির, রাহুল তোরা এখানে", বলে জড়িয়ে ধরলো। এরপর তিয়াশার দিকে চোখ যেতে তন্ময় বললো "আলাপ করিয়ে দি, ও আবির, এ রাহুল, আর এই হলো তিয়াশা, আমার পার্টনার ইন ক্রাইম, যার কথা তোদের বলেছিলাম ফোনে"।
চারজনে মিলে হইহই করে জন্মদিন পালন করলো, সেলফি তুললো, খুবসে নাচগান করে যে যার হোস্টেল ফিরে গেলো।
বিকেলে তিন বন্ধু ঘুরতে বেরোলো কাছের শপিং মলে। তন্ময় তো এতদিন পরে বন্ধুদের পেয়ে খুব খুশি।
তন্ময়: " আমরা তিনজন একসঙ্গে, ভাবতেও কেমন লাগছে, এরকম অসাধারন সারপ্রাইজ খুব কমই পেয়েছি, বহুৎ শুকরিয়া"।
রাহুল: " পুরোটা আবিরের প্ল্যান রে, ওই আমাকে বললো তন্ময়কে একটা ভালো সারপ্রাইজ পার্টি দিতে হবে, সঙ্গে তিনবন্ধুও একসঙ্গে বসা হবে অনেকদিন পর"।
তন্ময়:" আরে বাহ, থ্যাংকস আবির"।
আবির কোনো উত্তর দিল না।
তন্ময়: " এই আবির, বলছি এরকম সারপ্রাইজ দেবার জন্যে থ্যাংকস, শুনছিস?" বলে হালকা একটা চাপর দিল।
আবির (হটাৎ সম্বিৎ ফিরে): " ও ও ও আচ্ছা, হ্যাঁ ওয়েলকাম, চল ফিরে যাই, ভাল লাগছে না।"
তন্ময়, রাহুল (দুজনেই একসাথে) "কেনো শরীর খারাপ, তখন থেকে মনমরা দেখচি, চুপচাপ হতে আছিস, কি হোয়েছে বল?"।
আবির: " না এমনিতেই, চল না ফিরে যাই, কালই তো চলে যাবো, গিয়ে একটু রেস্ট নেব নাহয়।"
রাহুল মুচকি হাসলো। কিছু বললোনা।
তন্ময়: " কালই চলে যাবি? আরে বলবি তো। চল তাহলে"।
রাতে আবির আর রাহুল কলেজ গেষ্ট হাউজ এ থেকে গেলো। তন্ময় অনেক রাত অব্দি আড্ডা মেরে হোস্টেল ফিরে গেলো।
আবিরের মনে খালি তিয়াশা ঘুরছিল। এরকম অপরূপ লাবন্য, গভীর চোখ, শিশুসলুভ চপলতা, আজকের যুগে খুব একটা দেখা যায়না। ভাবতে ভাবতে অজান্তেই আবিরের মুখে চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
রাহুল : "রাত হয়েছে, তিয়াসাকে একটু ঘুমোতে তো দে মেয়েটাকে । হাসছিস মিটি মিটি, কথা বলছিস না, চুপচাপ চেয়ে আছিস, তোকে কি নতুন চিনি? নাহ, তন্ময়কে বলতে হবে"।
যেই না এই কথা বলা, অমনি আবির খপ করে রাহুলের হাতটা ধরে বসলো।
আবির " এই খবরদার,তন্ময়কে ভুলেও বলবি না। খুব খারাপ পাবে। খবরদার বলবিনা কিন্তু, আমি বন্ধুত্বে চিড় সহ্য করতে পারবোনা, আর তন্ময়ের সাথে তো নাই। ওরা ভালো থাক। বলবিনা কিন্তু। "
রাহুল:" আচ্ছা আচ্ছা বলবনা, কিন্তু ঘুমোতে যা। সকালে জার্নি।"
পরদিন ভোরে তন্ময় ওদের স্টেশন ছেড়ে দিল। যেতে যেতে লক্ষ্য করলো আবির একটাও কথা বললো না। খালি হ্যাঁ, না তে জবাব।
এদিকে তিয়াশাও কেমন জানি চুপচাপ হোয়ে গেছে। আগের মত বকবক করেনা। অন্যমনস্ক থাকে। তন্ময় মজা করলে হটাৎ হটাৎ খেপেও যায়। ব্যাপারটা তন্ময় লক্ষ্য করলেও কিছু বলেনা। ভাবে কলেজ শেষ, সবাই আলাদা হবে। সেটা নিয়েই মনমরা ।
এদিকে তন্ময়রেও জানি আজকাল তিয়াশাকে একটু অন্যরকম লাগে। এই নতুন চুপচাপ তিয়াশা তার অচেনা। কিন্তু কেনো জানি এই নতুন রূপ তন্ময়কে ভাবায়, ইচ্ছে করে তন্ময়ের কলম ধরতে, ইচ্ছে করে তিয়াশকে আরও কাছে পেতে, তাকে নিয়ে লিখতে, তাকে আরো বুঝতে।
কিন্তু তন্ময় জানে সে একটু আলাদা, আর পাঁচটা ছেলের মত হইহই করতে পছন্দ করেনা বেশি একটা। তার উপর আজকালকার ছেলেদের তথাকথিত আলফা মেল আউটলুক থেকে তো পুরো উল্টো। সে পারবে না ভালোবাসি বলে মুখ ফেরাতে।পারবেনা সে দুমদাম বাইকে বসে ঘুরতে। এখনকার স্মার্ট, ডাইনামিক, যুগে কেন জানি নিজেকে মাঝে মাঝে ভিনগ্রহের প্রজাতি বলে মনে হয় তার। তিয়াশার মত এরকম সুন্দরী, স্মার্ট মেয়ে তার সঙ্গে একসাথে থাকবে, সেটা তার কল্পনাতীত। সে মজা করে, কিন্তু সেটা খালি তিয়াশার সঙ্গেই, এছাড়া রীতিমতো গোবেচারা সে বাইরের জগতের কাছে। মাঝে মাঝে যখন তিয়াশা মজারছলেই বলত তোকে আবার কে পছন্দ করবে , হাঁদারাম, উপরে হাসলেও ভিতরে ভিতরে তন্ময় সত্যি টি জানত।
তবুও তন্ময়ের মনে হতো যা হবে হবে, তিয়াশাকে প্রপোজ করেই ফেলি। দেখিনা কি হয়। আবার ভাবে, যদি তাদের মধ্যে এতদিনের একটা সুন্দর সম্পর্ক, হটাৎ একটা ভুলবোঝাতে শেষ হয়ে যায়, সেটা তন্ময় সহ্য করতে পারবেনা। বড়ো ভালোবাসে সে এই বন্ধুকে। তাকে দুঃখ দেওয়ার কথা ভাবতেই পারবেনা সে। তাই মনের দুঃখ কলমের ডগা দিয়ে বের করে।
লিখে তন্ময়। লেখা শুরু করে।
" জানিনা কখন আমি হয়েছি যে তোর; ভালোবেসে খুব,
জানিনা মন কেনো প্রেমেতে বিভোর; দিয়েছি যে ডুব,
তুই ছাড়া একদিন; বেঁচে থাকা কঠিন; বুঝে গেছি খুব"।
খাতা বন্ধ করে তন্ময়। ছাদে যায়। খোলা আকাশের নিচে শুয়ে কবিতার পরের লাইনগুলো ভাবে।
হটাৎ তিয়াশার ফোন।
"এত রাত্রে? শরীর ভালো? কি হোয়েছে বল", মোবাইলটাকে আরও কাছে নেয় তন্ময়। শুনতে চায় তিয়াশাকে আরো গভীরে।
"হমম, না ঠিকই আছি, আচ্ছা একটা কথা বলব। কাউকে বলবিনা কিন্তু, প্রমিস" তিয়াশা ধীরে ধীরে বলে।
" কাউকে বলবনা, প্রমিস, কিন্ত খোলাখুলি বল, চেপে রাখিসনা"।
তিয়াশা চুপ আবার। গভীরভাবে নিশ্বাসের শব্দ।
তন্ময়ের মনে হালকা একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে যায়। তবে কি তিয়াশাই আগে প্রপোজ করবে? পাবে সে তিয়াশাকে নিজের মতো করে? থাকবে কি তিয়াশা পাশে তার? সারাজীবনের মত? ভাবে তন্ময়।
"হ্যালো, হ্যাঁ, চুপ করে আছিস কেন? কি বলবি? হ্যালো? ঘোমালি নাকি?" তন্ময় হালকা অসহিষ্ণু। জানতেই হবে আজ তার।
"হ্যাঁ ,না বলছি, তোর যে বন্ধু আবির, তোর জন্মদিনে এসেছিল?"
"হ্যাঁ, কেনো ?"
"সিঙ্গেল নাকি", বলে তিয়াশা জোরে শ্বাস নিল।
"হ্যাঁ, তো মনে হয়, কেনো কোনো বান্ধবী প্রেমে পড়েছে?"
"নাহ, আমিই পড়েছি", তিয়াশার সলজ্জ হাসির ছোয়া ফোনে টের পেলো তন্ময়।
পড়ে গেলো হাতের থেকে ফোন। বুকের কাছটায় কেমন জানি একটা হাহাকার করে উঠলো তন্ময়ের। কেমন যেনো একটা দমড়ানো, মচড়ানো কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠতে চাইলো। মনে হলো এই পুরো বিশ্বে আজ সে একেবারেই একা। চোখের কোনা থেকে টপটপ জল পড়তে লাগলো। কবিতার খাতাকে কুচিকুচি করে ছিড়তে ইচ্ছে করলো। তার তিয়াশা আর তার নেই।
"হ্যালো, কিরে শকড নাকি, হেলো, কিছু বল?" ওপারে তিয়াশা কথা বলেই যাচ্ছে।
তন্ময় আর কিছু শুনতে পারছেনা। কিছু শুনতে চাইছেও না। আসতে ফোনটা কেটে দিলো।
কাদলো তন্ময়, ধিক্কার এলো নিজের উপর। কি করে সে ভাবতে পারে যে তিয়াশা তাকে ভালোবাসবে? ছি:।
কানে হেডফোন লাগলো তন্ময়। "তুঝে ভুলা দিয়া" গানটা চালালো। এই গান আজ তার বড়ো প্রিয়, বড়ো আপন। না, ঘুমোবে না আজ ।
আরও ২-৩ বার তিয়াশার ফোন কেটে দিলো। সকালে কথা বলবে। এই রাত একান্ত তন্ময়ের।
সকাল হতেই তন্ময় আজকে আগে আগে চলে গেলো কলেজে। আরেকটা নতুন জায়গা খুঁজবে সে। তিয়াশার থেকে দুরে।
হটাৎ পিঠে আলতো একটা হাত।
"কিরে কোথাও যাচ্ছিস?"
তিয়াশার প্রশ্ন।
"হ্যাঁ, আরেকটা জাগায়" তন্ময় আরেদিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়।
"কেনো , এখানে কি অসুবিধা, ও আচ্ছা, রাগ হয়েছিশ এত রাতে ফোন করাতে? ঘুমের ডিসটার্ব করেছি না অজগর সাপের?"
"না রে, অনেক কাজ বাকি , সেমিস্টার ও মোটামুটি শেষের পথে, প্রজেক্টটা গোটাতে হবে"
তিয়াশা টান দিয়ে তন্ময়ের ব্যাগটা নিয়ে নিল।
"শোন, এই ল্যাব থেকে এক পা বাইরে দিবি, তোর একদিন কি আমার একদিন। প্লিজ তোর মত কেউ নেইরে আর। শেষের কটা দিনের জন্য আর জাগা পালটাস না, পার্টনার।"
"না রে , চলে যাবো, গাইড ও তোড়জোড় করছে , স্যারের রুমেই চলে যাবো।"
"ঠিক আছে, আজকের দিনটা বাদ দে, কাল যাস, আটকাবো না, কথা দিলাম, আজকে অনেক কথা শেষ করবো" বলে তিয়াশা চোখটিপ দিল।
"হ্যাঁ বল, আচ্ছা তোর সত্যি আবিরকে ভালো লেগেছে"?
"হাঁ রে , কি হান্দু বল, আবার কি ভদ্র" তিয়াশা লজ্জায় রাঙা।
হাসে তন্ময়। এই তিয়াশা তার বড়ো অচেনা।
"আচ্ছা দাড়া, দেখচি, আবিরের গলাতেই তোকে ঝলাবো, কথা দিলাম"।
হোস্টেলে এসে তন্ময় আবিরকে ফোন করে। বার দুই চেষ্টা করেও আবির রিসিভ করেনা। বাধ্য হয়ে রাহুলকে ফোন করে। সবশুনে রাহুল বলে হাসতে হাসতে যাক আগুন দুইদিকে লেগেছে, বেশ।
তন্ময়:" মানে, আবিরও? বলিসনি কেন আগে?"।
"আবির না করেছিল, ভেবেছিল তুই আর তিয়াশা বুঝি একসাথে", রাহুলের উত্তর।
"না রে , কি করে ভাবলি, কই তিয়াশা, কই আমি, কই রাজপাল যাদব, আর কই কাটরিনা কাইফ", হাসে তন্ময়।
"আবির যা খুশি হবে, পাগল হয়ে যাবে খুশিতে, আচ্ছা রাখছি, জানাই ওকে", ফোন কাটলো রাহুল।
তারপর শুরু হলো আবির ও তিয়াশার গল্পো। তিয়াশা খুব খুশি থাকে আজকাল। ওদিকে আবির তো হাওয়ায় উড়ছে। তবে মজার ব্যাপার, দুজনেই তন্ময়কে ফোন করে একে অপরের পছন্দের জিনিষ জেনে নেই। আর তন্ময় মুখ বুজে সব বলে। দুজনের ঝগড়াও তন্ময় মেটায়। তিনজন একসাথে বেরোলে আবির মাঝে মাঝে মজা করে যে বিয়ে করলে তন্ময়কে ওরা নিজেদের সঙ্গেই রাখবে, তাহলে ওদের সব প্রবলেম হ্যান্ডেল করার লোক থাকবে। হাসে তন্ময় উদাশিনভাবে। উত্তর দেয়না। তন্ময়ের এই উদাসীন ভাব তাঁদের দুজনের চোখ এড়ালেও রাহুল ঠিকই বোঝে।
এরপর কেটে যায় অনেক বছর। কিছু সম্পর্ক শিথিল হই দূরত্বের কারণে। আবার কিছু আরও দৃঢ়তা পায়। আবির আর তিয়াশা নিজের নিজের জাগায় সেটেল্ড। ওদের দুই পরিবারেরও কোনো আপত্তি নেই আর। দুইহাত চারহাত হওয়া জাস্ট খালি অপেক্ষা।
তন্ময় নিজেকে আরও গুটিয়ে নিয়েছে। একটা বিশাল আধাসরকারি কোম্পানির সহকারী ম্যানেজার। সব আছে তার। কিন্তু না, বিয়ে করার ইচ্ছেও হয়না তার। তন্ময়ের মা বাবা যাও চেষ্টা করতেন, তন্ময় ও চেষ্টা করতো মাঝে মাঝে, কিন্তু সব মিলে উঠত না। আস্তে আস্তে তন্ময় ও হাল ছেড়ে দিল। অফিস বাড়ি, বাড়ি অফিস, এই তার জীবন। আর হ্যাঁ মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে তার সেই কবিতার খাতা বের করতো আর লিখত।যদিও প্রথম কবিতাটা আজও শেষ করতে পারেনি সে, যেটা তিয়াশার জন্যে সেই রাত্রে লিখছিল। তার লেখার নামযশ হালকা ছড়িয়েও পড়তে লাগলো।
হটাৎ আবিরের ফোন।
আবির:"তন্ময় নাকি? চিনেছিস?"।
তন্ময়: "চিনবনা কেনরে প্রাণের বন্ধু আমার? কেমন আছিস? তিয়াশা কেমন?"।
আবির: "তিয়াশা নয়, বৌদি বল"।
তন্ময়:"বলিস কিরে ? করবি না করে ফেলেছিস?"।
আবির: "নারে এই করবো, একমাস আগে জানিয়ে দিলাম, কোনও ওজর আপত্তি সুনবনা কিন্তু, রাহুলকে ও জানিয়েছি"।
তন্ময়: " দেখিরে কাজের খুব চাপ, মা বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা বেশি, কথা দিতে পারছিনা"।
আবির:" তুই আয় আগে, আমি আর তিয়াশা তোর বাড়ি গিয়ে সবাইকে নিমন্ত্রণ করে আসব, তাহলে তো আসবি নাকি?".।
তন্ময় হাসলো। না, আবির টা মোটেই পাল্টালো না। সেই একরোখা।
তন্ময়:" আচ্ছা, আসলে খবর দেব।"
আবির: " ভাই একটা জিনিষ চাইবো , দিবি?"।
তন্ময়:" আবার জিজ্ঞেস করছিস কেনো, বল?"।
আবির:"তুই তো একটুআধটু ভালই লিখিস আজকাল, আমায় একটা কবিতা লিখে দেনা, রিসেপশনে সবার সামনে পড়ে ইমপ্রেস করবো, শেষে তোর নামই বলবো", বলে আবিরের একচট হাসি।
তন্ময়:" আমিও একটা শর্তে লিখবো। আমার নাম বলবিনা। আর আমি না আসতে পারলেও কবিতা ঠিকই পাঠাবো, কিন্তু এই শর্তে।"
আবির:" কিন্তু?"
তন্ময়:"কোনো কিন্তু নয়, এই শর্ত আমার।"
তন্ময়:"আচ্ছা ঠিক আছে, কিন্তু দিস ভাই প্লিজ"।
তন্ময়:"হবে হবে, আচ্ছা এখন রাখছি"।
বলে রাহুলকে ফোন করলো। ওপারে রাহুল ফোন ধরেই "হ্যাঁ, যেতে তো হবেই, আবিরের বিয়ে বলে কথা, তো তুই বরপক্ষ না কনেপক্ষ" বলে হাসতে লাগলো।
তন্ময়:" নারে যাবনা ভাবছি"।
রাহুল:"স্বাভাবিক", বলে একটা কৌতুকপূর্ণ হাসি দিল।
তন্ময়:" কেনো বললি এরকম"।
রাহুল:" কোনোকিছুই আমার চোখ এড়ায় না, তবে চল। ভেবে লাভ নেই। যথেষ্ট বড়ো হয়েছ খোকা"।
তন্ময়:"আচ্ছা রাখ।
" জানিনা কখন আমি হয়েছি যে তোর; ভালোবেসে খুব,
জানিনা মন কেনো প্রেমেতে বিভোর; দিয়েছি যে ডুব,
তুই ছাড়া একদিন; বেঁচে থাকা কঠিন; বুঝে গেছি খুব"।
"স্বপ্নরা ডানা মেলে; করে তোকে ধারণ,
তুই আমার বেঁচে থাকার অগণিত কারণ,
মন জমা রেখেছি, তোর চোখে দেখেছি, প্রেমেরই রূপ"।
"হাজার জনের মাঝে তুই প্রিয় মুখ, শত দুঃখের মাঝে তুই যে সুখ;
তুই রবি অন্তরে, জন্ম জন্মান্তরে, হয়ে অপরূপ, বুঝেছি যে খুব"।
"জানিনা কখন আমি হয়েছি যে তোর; ভালোবেসে খুব,
জানিনা মন কেনো প্রেমেতে বিভোর; দিয়েছি যে ডুব,
তুই ছাড়া একদিন; বেঁচে থাকা কঠিন; বুঝে গেছি খুব"।
আর পারলো না তন্ময়। খাতা ভিজে গেছে জলে।
বিয়েতে তন্ময় খুব সুন্দর উপহার দিল দুজনকেই। কিন্তু থাকলো ন বেশিক্ষণ। তিয়াসা আর আবিরের সাথে দুটো কথা বলেই বেরিয়ে পরলো। তিয়াসা যদিও খেয়ে যেতে বারবার বলে দিল, তবুও বিয়ে শুরু হওয়ার আগেই এসে পরলো চুপ করে। কারণ পারবেনা সে সহ্য করতে , তার তিয়াশার সিঁথিতে আবিরের সিদুর পরানোর দৃশ্য। যেকোনো প্রেমিকের কাছেই এই দৃশ্য বড়ো নির্মম, বড়ো কঠিন। তন্ময়ের ক্ষেত্রেও একই। তাহোকনা অব্যক্ত প্রেম।
রিসেপশনে তিয়াসাকে যা লাগছিলনা। তন্ময় হাঁ করে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। একটা প্যাস্টেল পিঙ্ক কালারের বেনারসী পড়েছিল তিয়াসা। তার সঙ্গে ম্যাচিং ব্লৌসে আর ডিজাইনার গয়নাতে পুরো ডানাকাটা পরী।
তিয়াসা: " কিরে হাঁ করে দেখছিস কি? কখন এলি?"।
তন্ময়: "এই এলাম। ভালো লাগছে রে তোকে।"
তিয়াসা:" সে ছার, হাতে ওটা কিসের কাগজ?, দেখি? "।
আবিরের জন্য লেখা কবিতাটা যে হাতেই নিয়ে আছে, তন্ময়ের এতক্ষণে খেয়াল হলো।
তন্ময়:" ও কিছুনা, আমার কিছু দরকারি কাগজ, আবির কোথায়?"।
তিয়াসা: "গেছে অ্যাপায়ন করতে, কাগজটা লাভ লেটার বুঝি, কাউকে পছন্দ হয়ছে, বল কাকে, আলাপ করিয়ে দেই, সঙ্গে চিঠির ডেলিভারি ও দিবি। " এই বলে তিয়াসা হেসে গড়িয়ে পরলো।
তন্ময় হালকা হাসি দিল একটা। আর কি পারবে।
তন্ময়:" আচ্ছা আমি একটু আবিরের দিকে যাই তাহলে"।
তিয়াসা: "ওকে"।
আবিরের কাছে যেতেই হাতে দিল কবিতাটা। আবির একবার পড়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো।
আবির:" অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই। আমি হালকা চিন্তায় পড়ে গেছিলাম নাহয়"।
তন্ময়: " মনে আছে তো শর্তের কথা?"
আবির:" হ্যাঁ রে, তবে খারাপ লাগছে, কেউ জানতেই পারবেনা তোর লেখা"।
তন্ময়:"তুই জেনেছিস, তাতেই হবে আমার"।
খাওয়াদাওয়ার পর ওদের ফাংশন শুরু হলো। আবির উঠতেই সবাই হইহই শুরু করলো। তিয়াসা তো অবাক। তন্ময় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আবির দারুনভাবে উপস্হাপনা করলো তন্ময়ের কবিতাকে। এত সুন্দর ভাবে উপস্হাপনা তন্ময় ও আশা করেনি। তিয়াসার চোখে হালকা খুশির জল। জল আবিরের চোখেও। দুজনের এই অপরূপ মিলন দেখে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করলো তন্ময়। তার ভালোবাসা সার্থক আজ।
"বেরোবি, না থাকবি আরো"; রাহুলের হালকা টোকা।
"আরে কখন এলি, দেখলাম নাতো", তন্ময় অবাক।
"ছিলাম আরেকদিকে, চল বেরিয়ে যাই আবিরকে বলে"
"হ্যাঁ চল"
দুজনেই আবিরকে বলে বেরিয়ে এলো। রাস্তায় হাটতে হাটতে রাহুল বললো "কবিতাটা তোর লেখানা?"
তন্ময়:" সুনলিনা আবির লিখেছে"।
রাহুল :" আবার মিথ্যে কথা?"।
তন্ময় (হাসতে হাসতে)" হ্যাঁ কোনোকিছুই তোর চোখ এড়িয়ে যায়না"।
রাহুলের থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটছে তন্ময়। হেঁটেই যাচ্ছে। কাল ভোরেই ফ্লাইট। বাড়িটাও বিক্রি করবে কিনা ভাবছে। কী আর করবে থেকে। মা বাবা গত হলে সে যে ভীষণ একা।
হাতজোড় করলো তন্ময় আকাশের দিকে তাকিয়ে: " ঠাকুর, বেঁচে থাকুক ওদের ভালোবাসা, খুব ভালো থাকুক ওরা দুজনে, পূর্ণতা পাক ওদের সংসার; আর একটু ভালো রেখো আমার মা বাবাকে, আর কিছু চাইনা আমি।"