পাপ
পাপ
![](https://cdn.storymirror.com/static/1pximage.jpeg)
![](https://cdn.storymirror.com/static/1pximage.jpeg)
বাড়ির বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে আছি। মুখে একটা পান গুজে দিয়েছি। অনেক দিন পর ফুরফুরে মেজাজ আজ। ইচ্ছে করছে কিছু রোমান্টিক গান শুনতে। কিন্তু আজকালের গান গুলো তো কিছুই বোঝা যায় না। ঠিক এসব কথা ভাবছি, এমন সময়ে শুনতে পেলাম
" দিওয়ানেকা নাম তো পুঁছো, প্যার সে দেখো...."
আহা, অনেক দিন পর রফি সাহেব এর মধুর কন্ঠের গান টা শুনতে পেলাম। তখন একজন ভদ্র লোক হাতে রেডিও বাজিয়ে আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছে। লোকটাকে দেখতে অদ্ভুত। খালি গায়ে লুঙ্গি পড়ে আছে শুধু, আর পায়েও জুতো নেই। এই ধরণের মানুষেরা কি গান শুনতে ভালোবাসে নাকি?
আমিও গানটিকে গুনগুন করে গাইতেছিলাম। হঠাৎ একটা পুরুষ কণ্ঠে আমার ঘোর ভাঙলো। দেখি মখবুল সাহেব। আমার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে হালকা হাসির ভঙ্গি করছে। বোধ হয় হাসি টা ভান করছে,মানুষ কথা বলার আগে ভান করে বেশি। মখবুল সাহেবের ও একই অবস্থা।
"কি খবর মখবুল সাহেব?"
"আরে, সাহেব টাহেব বলবেন না আমায়!"
" ওকে। তাহলে বেশ বলব না।" বলে একটু হালকা হাসি দিলাম। যাতে মখবুল সাহেব উত্তেজিত থেকে কিছুটা কমে। তার পর আমি জিজ্ঞাসা করলাম, " বলুন মখবুল ভাই, কি ব্যাপার! আজ এই সাদা পাঞ্জাবী পড়ে?"
মখবুল সাহেব হলেন একজন ভদ্রপুরুষ। বয়স মোটামুটি চল্লিশ এর কাছাকাছি হবে, কিন্তু ওনাকে প্রায় পঞ্চাশ -এর বেশি দেখাচ্ছে। কারণ মাথায় টাক পড়েছে আর বাকি চুল গুলোও চুন লাগিয়ে দিলে যেমন হয়, ঠিক তেমনই। তবে এই মখবুল সাহেব গ্রামের খুব সন্মানীয় মানুষ। সবাই ওনাকে সন্মান করে। তার একটা বিশিষ্ট কারণ আছে গ্রামের শেষপ্রান্তে যে স্কুল টা আছে, সেখানে উনি শিক্ষক। তবে মাইনের টাকা দিয়ে খোরাকি বাদ দিয়ে যত টা বাঁচে গ্রামের গরিবদের পড়াশোনার জন্য বই পত্র কিনে দেয়। আবার উনি গ্রামের গরিব শিশুদের রাতে ফ্রিতে পড়ান। এই কারণেই মখবুল সাহেবের এত সন্মান এই গ্রামে। যদি কেউ শোনে মখবুল সাহেব ওমুক দরকার, গ্রামের লোকেরা সব কাছ ছেড়ে মখবুল সাহেবের দরকার মেটানোর জন্য তোলপাড় শুরু করে দেয়।
এই দেখুন গ্রামের নামই বলা হয়নি! গ্রামের নাম বনকাশীপুর। ছোট্ট একটা গ্রাম। গ্রামের পাকা বাড়ি দুই -তিনটে আছে বাদ বাকি এখনো কাঁচা। দেশ আধুনিকতায় উন্নতি লাভ করছে, কিন্তু এই গ্রাম ঠিক চুপটি মেরে বসে আছে একই অবস্থায়। বোধহয় এরা এদের জীবন নিয়েই খুশি। আমিও একটা মাটির ঘরে আছি।কাজের জন্য প্রায় দুইবছর হল এই গ্রামে আছি,বোধ হয় আমার জীবন টা এদের সাথেই কাটবে।
মখবুল সাহেবের জন্য একটা চেয়ার বার করে আনলাম। মখবুল সাহেব এই প্রথম আমার কাছে এলেন। এর আগে গ্রামের আসরে বা সালিশি তে আলাপ হয়। মাসের প্রথম তারিখে গ্রামে যে সাংস্কৃতিক আসর হয় তাতে মখবুল সাহেব আর আমিই প্রধান অতিথি।
"মখবুল সাহেব বসেন।"
মখবুল সাহেব বসলেন। মুখটা ফেকাসে হয়ে গেছে, মনে হয় কোন গভীর আঘাত পেয়েছে মনে। আর কাউকে বলতে পারছে না, আমাকেই তাই বলতে এসেছেন। মনের কষ্টের কথা অপর কে বললে কষ্ট কমে যায়। মখবুল সাহেব নিশ্চয় কষ্ট কমাতে আসেনি।
"মখবুল সাহেব! সরি মখবুল ভাই।"
"বলুন"
" চা খাবেন?"
"না! "
"পান খাবেন তাহলে?"
মখবুল সাহেব পাঞ্জাবীর পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে একটা সিগারেট মুখে দিল। আর আমাকে একটা অফার করল। আমি সিগারেট খাই না, কিন্তু মখবুল সাহেবের অঙ্গিভঙ্গি দেখে আমিও সিগারেট ধরালাম। মখবুল সাহেব বললেন," আচ্ছা রমন বাবু, আমি কি খারাপ মানুষ?"
আমি কিছু বুঝতে না পেরে বললাম, "না আপনি ভদ্র ও ভালোমানুষ। আর একজন সমাজসেবী আপনি।আর এই গ্রামের মানুষ সবাই সাহেব সাহেব বলে সন্মান করেন। আজ এমন প্রশ্ন কেন?"
মখবুল সাহেব সিগারেটের একটা বড় মেজাজের টান দিয়ে সিগারেট টা ফেলে দিলেন। আর নাক-মুখ দিয়ে একসঙ্গে অনেক ধোঁয়া বার করে বলল, " না কেউ বলেনি! তবে আমার ধারণা আমি খারাপ মানুষ।"
আমি অবাক ভঙ্গিতে বললাম, " বলেন কি?"
" হ্যাঁ ঠিক বলছি। কারণ জীবনে পাপ প্রচুর করেছি। আমি মোটেও ভালো লোক নয়। "
" সে যা পারেন করেছেন। এখন তো আপনি ভালো কাজ করেন, আপনাকে তো সবাই ভালো বলে।"
মখবুল সাহেবের চোখ লাল হয়ে গেছে, আবার গর্জন করেই প্রায় বলল, " না আমি সবাই কে ঠকাচ্ছি। আমি নাটক করছি। আমি ভালো সাজার চেষ্টা করছি।"
আমি সিগারেট টার সুখের টান দিয়ে বললাম, "আচ্ছা মখবুল সাহেব একটু ঠান্ডা হন।"
" হ্যাঁ চেষ্টা করছি। তবে আপনি কবিতা লেখেন তো একটা শোনান যদি উত্তেজনা কমে। মানসিক উত্তেজনায় শরীর খারাপ করে তাই তো।"
"হ্যাঁ" বলেই আমি কবিতার খাতা আনতে ঘরে ঢুকলাম। আসলে কবিদের কাছে কেউ কবিতা শুনতে আসেনা।যে আসে তাদের কে কবিরা কবিতা তো শোনায় তার সঙ্গে বাড়িতে যা কিছু ভালো মন্দ থাকে সব খাওয়ায়। আমার বাড়িতে কিছুই নেই যে মখবুল সাহেব কে খাওয়াব।
আমি কবিতা শোনাতে শুরু করলাম,
" জীবন যুদ্ধ এখন তোমার কাছে আসে
বন্ধু বানিয়েছ নাকি, তাহলে হারবে
তুমি পরাজিত হতে চেও না,
বন্ধুর আবেশে থাকে যুদ্ধ ময়ী বেইমানেরা
তুমি দেখো, ওঠো জাগো
দেখো রণক্ষেত্রে তুমি,
হাতে তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে সজাগ
তুমি ঘুমাও নি,
ঘুম হল বন্ধুর সাজে বেইমান
আজ তুমি জয়ী হলে
শত্রু হল তার বন্ধুর চেয়ে আপন।"
মখবুল সাহেব চুপ করে বসে ঝিমোচ্ছেন। মনেহয় কবিতাটা ভালো লাগেনি তার।
"মখবুল ভাই, আর একটা কবিতা শুনবেন নাকি?"
"না থাক!"
"তাহলে চলুন একটু বেড়িয়ে আসি নদীর ধার থেকে।"
মখবুল সাহেব আর আমি দুজনে ইটভাটার ধারে একটা ইটের গাদার উপরে উঠে বসলাম। মখবুল সাহেব আবার সিগারেট ধরালেন। আমাকেও দিলেন আবার। দুজনে সিগারেটের টান মারছি আর নদীর জলের গতিপথ ও নদীর ওপারের দিকে তাকিয়ে আছি।
"রমেন বাবু, আমি অনেক বড় পাপ করেছি" মখবুল সাহেব হটাৎ বললেন।
আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বললাম, "কি পাপ করেছেন?"
সিগারেটের সুখটান দিয়েই উনি বলতে শুরু করলেন।
আমাদের একটা সুন্দর সংসার ছিল। যখন কলেজে পড়তাম তখন আমার একটা বান্ধবির প্রেমে পড়ি। তার নাম রাজিয়া। রোগা, ফর্শা ও সুন্দর মুখশ্রী তার। খুব ভালোবাসতাম তাকে আমি। গ্যাজুয়েশন পাশ করেই আমরা বিয়ে করলাম। বিয়ের পরের আমি নিজের গ্রাম মানে হরিষগ্রামের স্কুলে চাকরি করছি। সুখের সংসার। সংসারে আমি আর আমার স্ত্রী। প্রায় তিন চারবছর আমাদের এই ভাবেই সুখেই কাটতে থাকল। যৌবন পার হয়নি বলে আমরা সন্তানও নিই নি। তবে পাঁচ বছরের মাথার রাজিয়া এবার প্রেগন্যান্ট হল। ডাক্তার বলল মাত্র তিনমাস হয়েছে।
মখবুল সাহেব কথা থামিয়ে সিগারেট ধরালেন। তার পর টান মারতে থাকলেন ঘন ঘন। আমি চুপ করে তাকিয়ে আছি শুধু মখবুল সাহেবের দিকে। আবার শুরু করল মখবুল সাহেব।
আমাদের বাড়িতে তখন একটা বিড়াল ছানা কোথা থেকে এলো। মাত্র চোখ ফুটেছে, হাটতেও ঠিকঠাক পারছে না। রোগা বিড়াল ছানা মনে হয় বিড়ালের মা নেই, সে ছেড়ে চলে গেছে। বিড়াল ছানা টা কুচকুচে কালো। বিড়ালের চোখ গুলো ভয়ানক হয় কিন্তু এই বিড়ালছানা টার চোখ ছিল মায়াবী। আমরা দুই স্বামী-স্ত্রী তার মায়ার জালে পড়ে গেলাম। সকালে, দুপুরে, রাতে তিন টাইমে খেতো। আমরা যা খেতাম তাই তাকেও দিতাম। তবে বিড়ালছানা টা খেলত আমাদের সাথে । রাতে খাবার সময় কোলে উঠে বসত। রাজিয়া আমাকে একবার বলেছিল যে, "আমার বিড়াল ভালো লাগে না। তবে এই বিড়াল টাকে খুব ভালোবাসি একে ছাড়া বাঁচব না।" আমি কিছুই বলিনি শুধু বিড়ালের সাথে খেলত এটা খুব ভালো লাগত। একজন গর্ভাবস্থায় মা, ইঁদুর ছানাকেও নিজের সন্তান ভাবে, রাজিয়াও হয়ত এই বিড়ালছানা কে নিজের সন্তান মনে করত। জানেন রমেন বাবু বিড়াল টা অদ্ভুত খুব। রাতে যখন শুতাম তখন আমাদের দুজনের মাঝে এসে মানুষের মতো চিত হয়ে শুয়ে থাকত। আর ঘুমন্ত বিড়াল ছানা কে রাজিয়া আদর করত।
মখবুল সাহেব কাশছেন। চোখ ছল ছল করছে, হয়ত তার পুরানো স্মৃতি তাকে কষ্ট দিচ্ছে। তিনি আবার বলতে শুরু করলেন।
রোজ এইভাবে ঘুমাত বিড়াল। আমি একদিন জ্বরে অঘোর। অনেক জ্বর হয়ত বেহুশ হয়ে ঘুমাচ্ছিলাম। সকাল বেলা যখন ঘুম ভাঙে রাজিয়ার ডাকে। রাজিয়া ফুঁপিয়ে কাঁদছে, আর বলছে তুমি একি করলে? আমি অবাক হয়ে দেখি বিড়ালছানা টা মাথা নিচু করে ঘুমাচ্ছে। না ওটা ঘুম নয় চিরনিদ্রা বলতে পারেন। তারপর রাজিয়া বলল, "তুমি পাশ ফিরে শোবার সময় দেখবে তো বিড়াল টা শুয়ে?"
আমি ভয়ে কিছু বলতে পারিনি। তাও ভয় ভয়ে বললাম, "বিড়াল টা আমাকে আঁচড়ে নেয়নি , কোন চ্যাঁচামেচি ও করেনি কেন?"
"সে জানি না। মায়া বিড়াল টা আঁচড় দেবে কিভাবে, তোমাকে তো ভালোবাসে সে!"
আমি এইবার হয়ত কেঁদে ফেলব, কিন্তু কান্না চাপলাম কষ্ট করে।মেয়েরা কান্না চাপতে পারে না। পরের দুঃখে সবাই দুঃখিত হয় কিন্তু কাঁদে মেয়েরা। একটা বিড়ালের জন্য এতো মায়া আমি কোন মেয়ে কে দেখিনি। রাজিয়া প্রায় দুই -তিন দিন আমার সাথে কথাই বলেনি। আমার ঘরে শুতেও আসেনি। হয়ত কিছু খাবারও খায়নি। কারণ মেয়েরা প্রথমে খাবার ত্যাগ করে।
এবার লক্ষ্য করলাম মখবুল সাহেবের চোখ দিয়ে জল পড়ছে। আমি ভদ্রতার খাতিরে বললাম "মখবুল ভাই কাঁদছেন কেন? তার পর কি হল বলবেন তো!"
একটু কেশে নিয়ে বললেন, "ও হ্যাঁ।"
তার ঠিক দুমাস পর আমার স্ত্রী রাজিয়ার সন্তানপ্রসব হয়। সন্তান প্রসবের আগে রাজিয়া আমাকে বলল, "তুমি খুনি তুমি আমার সন্তান কে মেরেছ। আজ আবার একটা সন্তান হবে তুমি কিন্তু একে মেরো না প্লিজ।"
হাসপাতালে নিয়ে গেলাম রাজিয়াকে, রাজিয়ার সাথে আর কথা হয়নি আর। অপারেশন রুমে নিয়ে গেল রাজিয়াকে, তারপর আর ফিরল না। শুধু ডাক্তার বলল, "আপনার একটা পুত্র সন্তান হয়েছে।" বউ কে ছেড়ে যখন সন্তান কে দেখতে যাই তখন দেখি আশ্চর্য ব্যাপার। ছেলের গায়ের লোম বড় বড়, ছেলের গায়ের রঙও কালো কুচকুচে। কিন্তু চোখ দুটো মায়াবি। ভাগ্য যখন খারাপ হয় তখন অসহায় ও ঠাট্টা করা হয়। এই ছেলেও তিন ঘন্টার বেশি বাঁচল না। পরের দিনে একসঙ্গে মা ও ছেলের কবর দিলাম।
কিছুক্ষণ দুজনে চুপচাপ। মখবুল সাহেব একটা সিগারেট ধরিয়েছেন। আমিও একটা চেয়ে ধরিয়ে নিলাম। তার পর মখবুল সাহেব কে বললাম, " আচ্ছা মখবুল ভাই, এটা নিয়তি। এতে আপনি পাপ খুঁজলেন কোথায়?"
"পাপ তো জগৎময় ছড়িয়ে আছে বলুন। আমার গায়েও এসে মিশেছে কিছুটা।"
কেউ জীবনের গল্প শোনানোর পর দার্শনিক ভাবনা মাথায় আনেন, হয়ত মখবুল সাহেবেরও একই অবস্থা। আমি বললাম, " তা কিভাবে?"আমার প্রশ্ন টা হয়ত অস্বস্তি লাগল মখবুল সাহেবের। তারপর সিগারেটের টান মেরে লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে বলল," রাজিয়া প্রায়ই স্বপ্নে এসে আমাকে পাপী বলে।বলে আমি খুনি। আমার পাপের নাকি ক্ষমা নেই।"
আমি একটু হাসলাম, তারপর বললাম,"আপনার কল্পনা ওসব। আপনি ওসব ভাববেন না।আপনার অবচেতন মনের কল্পনা আপনাকে এইসব দেখিয়েছে।"
" হ্যাঁ তা জানি! তবুও মানতে পারছি না"
আমি সিগারেটের শেষ টান মেরে বলি, "আচ্ছা মখবুল ভাই আজ বাড়ি যান। নিয়তি আপনার সাথে খেলেছে। আর এখন আপনার মন আপনার সাথে মজা করছে। আপনি বাড়ি চলুন, সব ঠিক হয়ে যাবে।"
মখবুল সাহেব বাড়ি ফিরে গেছে, আমিও বাড়ি এসে দেখি চেয়ারের উপরে একটা কালো কুচকুচে রঙের বিড়ার শাবক শুয়ে। এমন ভাবে শুয়ে আছে যেভাবে মানুষ হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকে। আর যে চেয়ারে শুয়ে আছে, সেই চেয়ারে কিছুক্ষণ আগেই বসেছিলেন মখবুল সাহেব।