জীবন
জীবন


আজ থেকে বহুবছর আগে আমাদের দেশের ঘটনা। তখনো এদেশে ইংরেজরা আসেনি। ভারতবর্ষ তখন নিজের ঐতিহ্য নিয়ে গর্বিত। আমাদের দেশ যেমন সবচেয়ে প্রচীন সভ্যতার মধ্যে একটা, তেমনি আমাদের দেশের সংস্কৃতিটাও আলাদা একদম আদিম। তখনো কোন সংস্কারক সংস্কার করেনি এই দেশ সাথে তার বহমান সংস্কৃতি।
বাংলাদেশের মধ্যে এমন এক জায়গা ছিল, সেই জায়গাটা অদ্ভুত বললেই চলে।কিন্তু মানুষের মধ্যে বাঙালীয়ানা ছিল ভরপুর। জায়গাটার নাম মনোহরপুর। একটি নিম্ন মানের গ্রাম বলতে পারেন। গ্রাম টি চারিদিক থেকে এমন ভাবে ঘেরা যেন মনে হয় এটা একটা আলাদা দ্বীপ।গ্রামের বেশির ভাগ লোকের চাষবাস ছিল তাদের প্রধান রোজগার। তবে তাদের শুধু আয়-ব্যয় এর কারণে অন্য গ্রামের সাথে যোগাযোগ রাখতে হতো।
গ্রামের মধ্যে একটাই পাকা বাড়ি দেখতে পাবেন। সেটা গ্রামপ্রধান শশধর কুন্ডুর। পুরো গ্রামে শ দুয়েক বাড়ি আছে। তবে গ্রামের নিয়ম কানুন সবটা জুড়েই রাজত্ব শশধর কুন্ডুর। একদিন প্রধানের কাছে বিচার চাইতে এলো দুই চাষি।কারণ টা ছিল, বিমল মিত্রের ছেলে নয়ন, শ্যামল ধরের মেয়েকে নিয়ে ভেগেছে। তাই শ্যামল ধর প্রধানের কাছে বিচার চাইতে এসেছে।
“হুজুর, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে” এই বলে প্রধানের পায়ের কাছে এসে বসে পড়ল শ্যামল।তখন শশধর কুন্ডু জিজ্ঞাসা করল তাকে, “ কি হয়েছে?”
“হুজুর আমার মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে ওই বিমলের ছেলে নয়ন। আমার মেয়ে কে ভুলিয়ে ভালিয়ে.....” এই বলে কাঁদতে আরম্ভ করল। তখন শশধর বলল, “ঠিক আছে ওই বিমল কে ডেকে নিয়ে এসো আমি এর বিচার করব”।
কিছুক্ষণ পরেই হাজির শ্যামল ধর ও বিমল মিত্র। শশধর দুজন কে একসাথে বলল সেই সব কথা যে কথা গুলো শ্যামল নিজে বলেছে। বিমল মিত্র নিজেও সেটা স্বীকার করল। তখনি গ্রামের প্রধান শশধর হুকুম করল, “ যাও ওদের দুজন কে ধরে নিয়ে এসো, আর তাদের বলো আমি তাদের জন্য সুব্যবস্থা করেছি”।
এদিকে শশধর কুণ্ডুর একমাত্র ছেলে বিজয়ের স্ত্রীর শরীর অসুস্থ।মেয়েটা গর্ভবতী। আজ থেকে দুবছর আগেই মেয়েটাকে গ্রামের বাইরে জঙ্গল থেকে তুলে এনেছিল।সেদিন ওই বছর চোদ্দবয়সী মেয়েটার কেউ নেই শুনেই শশধর তাকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেয়।ধীরে ধীরে মেয়েটার প্রতি মায়া এতোই বেড়েছিল , অন্য কোন ছেলের সাথে বিয়ে দেয়নি। নিজের একমাত্র পুত্র কেই ডেকে বলে, “শোনো বিজয়! একটা কথা বলার ছিল”
বিজয় উত্তর দিয়ে বলল, “ বলুন বাবা, কি বলার ছিল?”
“দেখো তোমার এখন সতেরো বছর হয়ে গেল। এবার তোমাকে বিয়ে দেওয়া আমার কর্তব্য। তাই সামনের আষাঢ় মাসে ২ তারিখে, সুমিত্রীর সাথে বিয়ে”।
সুমিত্রী হল সেই মেয়ে যাকে একবছর আগে সীমানার জঙ্গল থেকে তুলে এনেছিল। কান্নার জল মুছে দিয়েছিল সে তাই তাকে নিজের পুত্রবধূ বানাবে এই জন্য খুবই খুশি শশধর।
সে তো একবছর আগের সব কথা বাড়ির দালানে বসে বসে নিজের মনেই আজ কতই নিজের এই ভালোলাগার কাজের জন্য বুকটা ফুলে উঠছে কোন এক আবেগে। ঠিক তখনই শশধর ভাবলো কেনই মেয়েটা এক কথায় রাজী হয়ে গেল আমার ছেলের সাথে বিয়ে করার! হয়ত মেয়ে মানুষের ভালোবাসার অভাবী হয়, ভালোবাসা ছাড়া তাদের কে নত করা কঠিন। হয়ত আমার ভালোবাসায় সে রাজী হয়েছে আমার ছেলের সাথে বিয়ে করতে।
এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে, ঘরের দরজায় সামনে একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে শশধর কুণ্ডু ও তার পুত্র বিজয় কুন্ডু বসে। দুজনেই চুপচাপ বসে আছে কেউ কথা বলছে না। মাঝে মাঝে ভিতরের ঘরে গিয়ে সুমিত্রীর পাশে বসছে, তাকে দেখছে। সুমিত্রী অসুস্থ খুবই। এখন সে ঘুমাচ্ছে, কয়েকদিন যন্ত্রণায় তার একবিন্দুও ঘুম হয়নি। আজ তাই ক্লান্ত। পাশে বসে বিজয় তার স্ত্রী সুমিত্রীর মুখের দিকে তাকাচ্ছে আর মাঝে মাঝে কপালে চুমু খেয়ে নিজেকেই বলছেই, ‘বিজয় তোর সুমির কিছুই হবে না’। একজন আঠারো বছরের স্বামী আর একজন পনেরো বছরের গর্ভবতী স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসার কষ্ট। ঘরের ভিতর কে এক অন্য আবহাওয়ায় পরিবর্তন করেছে। উপরের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে বিজয় পরম করুণাময় ঈশ্বরের কাছে তার স্ত্রীর জন্য প্রার্থনা করছে আর দুচোখ থেকে ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ তরল যেটা বিজয়ের হৃদয়ের গহিনে কষ্টের আকারে জমে আছে।
দালানে দুইজন বসে একজন অপেক্ষায় তার স্ত্রীর জন্য, আর একজন তার কন্যা স্নেহ পুত্রবধূর জন্য। গভীর রাত, প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছে সুমিত্রী। বিজয় গিয়ে বুড়িমাকে ডেকে আনল। বুড়িমা হল, সন্তান জন্মদেওয়ার সময় গর্ভবতীর পাশে থাকে এবং গ্রামে বহুজনের সন্তান তার হাতেই হয়েছে। এমন কি বিজয়ও জন্ম পৃথিবীর আলো দেখেছে এই বুড়ি মার কারণে।
ঘরের ভিতরে সুমিত্রীর বেদনার শব্দ কানে আসছে বাইরে থাকা দুইজন পুরুষের কানে।বিজয় কাঁদছে সুমিত্রীর জন্য। তার মনে পড়ে যাচ্ছে সেই দিন যখন তার বয়স ছয় বছর, সাপে কামড়ে মরে পড়ে আছে মা বাড়ির দরজায়। কিন্তু তখন এতো কষ্ট হয়নি তার, কিন্তু কেন? আজ কেনই এতো কষ্ট হছে! নাকি একবছরের সুমিত্রী কে মায়ের চেয়ে বেশি ভালোবেসেছি নাকি! না, মাকে হারানোর কষ্ট কমে গেছে এ হৃদয়ে। বোধহয় প্রতি পুরুষের বুকে সময়ের সাথে তার হৃদয় টাকেও দখল করে কোন এক নারি।
তখনই মনে পড়ে গেল, সেই বিয়ের দিনের কথা । আষাঢ় মাসে প্রবল বৃষ্টির দিনে সুমিত্রীর সাথে বিয়ে হয়। আর বিয়েতে আগত নিমন্ত্রিতরা যখন বাড়ির দালানে খেতে ব্যাস্ত তখনই চুপি চুপি সুমিত্রীর প্রথম হাত ধরি বউ এর অধিকারে। আর নিয়ে যাই বাড়ির পিছনের জলায় আর দুজন ভিজতে থাকি ওই বাদলার দিনে। সুমিত্রী খুবই হাসছিল আমার সাথে, আগের মতো আর বিজয় দা বলে ডাকেনি । বৃষ্টির সাথে যখন একবার দূরে বাজ পড়ার ভয়ঙ্কর শব্দ ওঠে, তখনি আমাকে জড়িয়ে ধরে। আর তার হাতদুটো আমার পাঞ্জাবী ছাড়িয়ে আমার শরীর কে খামচে ধরে। আর ভয় ভয় গলায় বলছে, “ওগো আমার খুব ভয় করছে” এই বাদলার দিনে বিজয়ের মনে প্রথম প্রেম এসেছিল বিজয়ের।
তার পর থেকে তাদের প্রেম বাড়তে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে। সারাদিন একসাথে খেলা। বিজয় মাঠে গেলে তার সাথে বসে থাকাই ছিল সুমিত্রীর। সুমিত্রীর এতই পাগলি মেয়েছিল, মাঝে নাঝে বিজয় মাঠ দেখাশোনা করছে হঠাত পাশে বসে থাকা বছর পনেরোর মেয়ে সুমিত্রী কোলে ঝাপিয়ে পড়ছে। মাঠে চাষীর দল এই নব দম্পতিকে এইভাবে দেখতেও তাদের ভালো লাগতো।
সবচেয়ে আনন্দিত বিজয় সেদিন হয়েছিল, প্রতিদিনের মতো যেমন মাঠে দেখাশোনার জন্য যায় । ওই দিন ও গিয়েছে। সঙ্গে সুমিত্রীও পিছু নিয়েছে। বিয়ের ছয়মাস হয়ে গেল কিন্তু পনেরো বছরের সুমিত্রী বিজয় কে ছাড়া একটুও চলে না। শীত আমেজ লেগেছে তখন মাঝে ফসলও ফলেছে অনেক। এদিকে মাঝদুপুরে সুমিত্রী শরীর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বার কয়েক বমিও করেছে, তাই অসুস্থ স্ত্রীকে কোলে করে তুলে আনতে হয়েছিল বিজয় কে আর কোলে অসুস্থ স্ত্রীকে কপালে চুমু দিতে দিতে বলেছিল, “ পাগলি, শরীর খারাপ তাহলে এলে কেন আমার সাথে”।
মনে পড়ছে আজ সেই সব দিনের কথা, মনে প্রেম আর বুকে কষ্ট নিয়ে কাঁদছে আঠারো বছরের যুবক বিজয়। এখনো সুমিত্রীর বেদনাকাতর গোঙানি থামেনি। সুমিত্রীর থেকে বেশি কষ্ট পাচ্ছে বিজয়। হঠাৎ পাশে বসে থাকা শশধর কে জড়িয়ে ধরল বিজয়, তারপর বিজয় বলল, “বাবা ,আমার সুমির কিছু হবে না তো!” এতো কষ্ট নিয়ে বিজয় কখনো কথা বলেনি তার বাবার সাথে। তাই শশধরও কাঁদছে। বাবা তার সন্তান কে বোঝাচ্ছে, সব ঠিক হয়ে যাবে। এমন সময় সেই কঠিন চিৎকার করে উঠল সুমিত্রী, “ বি........জয়”।
তার পর সব চুপ। সবাই চুপ, হয়ত বিশ্বনিখিল শান্ত হয়ে গেছে কয়েক মিনিত।তার পর বুড়ির মার কান্না ভেসে এলো ঘরে, দুজনেই ছুটে ঘরে প্রবেশ করল। আর সামনে যেটা দেখল তা দেখে বিজয় অজ্ঞান হয়ে পড়ল।আর সঙ্গে সঙ্গে একটা শিশুর কান্নার শব্দ উঠল। শশধর দেখল সুমিত্রীর মতোই এক ফুটফুটো শিশু। শশধর আবার এক মাতৃহীনা কন্যা কে কোলে তুলে নিল।
ভোর শেষ হয়ে সকালের সূর্য উঠছে। বিমল মিত্র ও শ্যামল ধর উপস্থিত। সঙ্গে তাদের বিচারের জন্য পলাতক ছেলে মেয়েকেও ধরে এনেছে তারা কিন্তু বিচার হয়নি।
এদিকে বিজয় কেঁদে কেঁদে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। গ্রামের সকল মিলে সুমিত্রীকে শ্বশানে নিয়ে যাবার জন্য ব্যবস্থা করছে। আর দালানে একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তান কে নিয়ে কাঁদছে বিজয়।
সময় পার করে সব শ্বশানে উপস্থিত। চিতার উপরে শুয়ে আছে সুমিত্রী। বিজয় বার বার দেখছে আর মনে মনে বলছে, “ সুমি আমার কাছে ফিরে আসবে না!” তার পরই পন্ডিতের কথা মেনে চিতায় আগুন ছোঁয়াবে, তখনই বিজয়ের আবার মনে পড়ে গেল সেই সব দিনের কথা যে শরীর টা শুধু বিজয়ের অধিকার ছিল, যে ভালোবাসা গুলো ছিল সবটাই এই শরীর আর মন পেয়েছে। অবশেষে চিতায় আগুন টা ছুঁয়ে দিল বিজয়, আর চোখের সামনে পুড়তে থাকল সুমিত্রীর দেহ, আর মুছে যাচ্ছে সমস্ত স্মৃতি। কিন্তু বিজয় এই স্মৃতি মুছতে চায় না, সে চায় না তার ভালোবাসা মুছে যাক। তাই সে তার কন্যার কপালে চুমু দিয়ে একবার বলে উঠল, “সুমিত্রী”। তার পর নিজের কন্যাকে বিজয় তার বাবার কোলে দিয়ে আকাশের দিকে তাকালো করুন সুরে। আর বাবাকে বলল, “ সুমিকে ভালো রেখো” এটা বলেই ঝাঁপ দিল বিজয় নিজের স্ত্রীর চিতায়। আর বার বার চিৎকার করে বলছে, “আমি ভালোবাসি তোমায় সুমি, ভালোবাসি”।
“ভালোবাসা এমন হয় নাকি! হয়ত হয়, তবে পুরুষের অন্ধ প্রেম জীবন-মরণের পরোয়া করে না। ভালো থেকো বিজয়, আর ভালো থেকো সুমি। তোমাদের ভালোবাসা বেঁচে থাকুক হাজার বছর ধরে”।