Chitta Ranjan Chakraborty

Romance Tragedy Classics

3  

Chitta Ranjan Chakraborty

Romance Tragedy Classics

নতুন করে শুরু

নতুন করে শুরু

7 mins
545



আমি অপেক্ষায় আছি। মনটা ভীষণ দুরুদুরু করছে, এখন সময় বারোটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। বারোটায় আসার কথা তার। আমি সাত দিন আগে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। বিজ্ঞাপন দেখে, ও ফোন করেছিল। নাম বলেছিল সর্বাণী, আমার নাম জানতে চেয়েছিল, আমি আমার আসল নাম না বলে প্রশান্ত বলেছিলাম। ফোনে কথা হয়েছে, সে ডিভোর্সি। তিন বছর আগে নাকি স্বামীর সাথে মিউচুয়াল ডিভোর্স হয়েছিল। কোন সন্তান হয়নি। ডিভোর্সের কারণ জানতে চেয়েছিলাম, সে বলে সময়ে সব ঠিক ছিল কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পরে ওর স্বামী নাকি রোজ নেশা করে বাড়িতে অশান্তি করত। মাঝে মাঝে গায়ে হাত তুলতো।এসব অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ডিভোর্সের পথ বেছে নেয়। তার স্বামী নাকি কোন এক কোম্পানিতে কাজ করত। বাড়িতে স্বামী, শাশুড়ি আর ও এই তিন জনের সংসার। শাশুড়ি ভীষণ ভালো মনের মানুষ ছিলেন। প্রতিদিন ছেলে অশান্তি করত বলে ভীষণ বকাবকি করত ছেলেকে। ওর শাশুড়ি মা ওকে ভীষণ ভালোবাসতো। কিন্তু কি হলো এক বছরের মাথায় শাশুড়ি মারা যান, তারপর থেকে অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যায়। নিরুপায় হয়েই ডিভোর্স দিয়ে দেয়।

সে একটি স্কুলে পড়ায়, আমি বলেছিলাম,নিজে উপার্জন করো অনেকদিন হলো ডিভোর্স হয়ে গেছে এখন আবার নতুন করে বিয়ে করতে চাও কেন? সে বলে তার বাবা-মা নেই এক দাদা চাকরি করে বউ নিয়ে অন্য জায়গায় থাকে। সব মেয়েরাই চায় একটি আশ্রয়, একটি অবলম্বন। সে অবলম্বন একমাত্র স্বামী ছাড়া কেউ নয়। তাই দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে চায় সে।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে আজ 12 টায় হোটেলে আসতে বলি। দুজনে একসাথে কথা হবে। সেও রাজি হয়। তাই অপেক্ষা করছি। এখন সময় বারোটা, ওর আসার সময় হয়েই গেছে। মনের ভিতর আজানা যুদ্ধ চলছে। বারবার ভাবি কেমন হবে সে দেখতে। এবং তাকে দেখে আমার পছন্দ হবে কিনা, তারও পছন্দ হবে কিনা এসব আবোল-তাবোল ভাবছি। বারবার ঘড়ির দিকে দেখছি, মনে হল এই বুঝি এসে পড়বে। নিজেকে বারবার তৈরি করে নিচ্ছি। এমন সময় আমার ঘরের দরজায় কলিং বেলের আওয়াজ পেলাম, চমকে উঠলাম। নিজেকে তৈরি করে নিয়ে দরজা খুললাম। দেখলাম, আমার কাঙ্খিত লোক নয়। হোটেলের বয় এসে আমাকে ডাকছে। আমি বললাম কি হয়েছে? বয় বলল, একজন ম্যাডাম এসেছেন আপনার সাথে দেখা করতে, তাকে পাঠিয়ে দেবো কি স্যার? আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, পাঠিয়ে দাও, এই বলে দরজাটা চাপিয়ে দিলাম।

আমি বিছানায় এসে বসলাম। একটু পরেই মৃদু পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। কলিংবেলের আওয়াজ শুনলাম, আমি বললাম ভেতরে আসুন, দরজা খোলাই আছে। ও ঘরে ঢুকতেই ওর মুখটা দেখেই হতবাক হয়ে যাই।এ কি সত্যি? স্বপ্ন নয় তো?কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিনা এতদিন পরে এভাবে ওর সাথে আবার দেখা হবে। কখনোই ভাবতে পারিনি। আমি ওকে দেখে পাগলের মত চিৎকার করে বললাম, তুমি সর্বানী নও তুমি সোমা! বোসো বোসো, কতদিন পরে এভাবে তোমার সাথে আমার দেখা হবে ভাবতেও পারিনি।

সোমা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমিও ভাবতে পারিনি। আমি বলি বোসো আগে বিশ্রাম নাও তারপর কথা হবে। ও আমার পাশে বসে। অনেকক্ষণ দুজনে কোনো কথাই বলতে পারছিলাম না। মনে হলো দুজনের মনের মাঝে কি যেন একটা অজানা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষন দুজনে চুপ করে বসে থেকে তারপর আমি শুরু করলাম, তুমি কেমন আছো? শরীরটা তো অনেক ভেঙ্গে গেছে। ও আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে ও বলল, তুমি কেমন আছো? তোমারও তো শরীর ভেঙে গেছে। এখনো কি সেই নেশার অভ্যাস আছে? আমি বললাম, না।তুমি চলে যাবার পর আমার সেই চাকরিটা চলে যায়। আমি ভীষণ ভেঙে পরি। তারপর আমার এক বন্ধু অন্য কোম্পানিতে কাজ জোগাড় করে দেয়। ওর কথায় আমি নেশা করা ছেড়ে দিই। ও বলল, সেই ছাড়লে কিন্তু আমার কথায় নয়, আমি কতবার নিষেধ করেছি তোমার হাতে পায়ে পর্যন্ত ধরেছি। শাশুড়ি মা কতবার বারণ করেছে। কিন্তু তুমি কারো কথা শোনোনি। একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলে, ওই নেশার জন্যই আমাদের ছাড়াছাড়ি হল। সংসার নষ্ট হলো, জীবনের কত কিছু স্বপ্ন ধুলোয় মিশে গেল। তুমিও কত কষ্ট পেলে আর আমিও কত কষ্ট পেলাম। এই জীবন চলার পথে নিজের লোক না থাকলে চলা যে কি কঠিন আমি মর্মে মর্মে বুঝতে পেরেছি। আমি তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম সুন্দর একটি ঘর বাঁধবো যে ঘরে সুখ শান্তি চিরদিন থাকবে, হাসিখুশিতে আমরা সারা জীবন কাটিয়ে দেবো। কিন্তু তুমি তা করতে দিলে না। আমি বলি, ওসব কথা আজ থাক। ও বলে, কেন থাকবে বলো? তুমি বল আমাদের সম্পর্ক ভাঙার জন্য কে দায়ী? সময়ে-অসময়ে তুমি নেশা করে এসে আমাকে মারধর করতে। এখনো দেখো সেই মারার দাগগুলি রয়েছে। একদিন তুমি চাকু দিয়ে আমার গলা কাটতে গিয়েছিলে, দেখো সে দাগ এখনো আছে। আমি ইচ্ছে করলে পুলিশের যেতে পারতাম কিন্তু আমি যাইনি। তোমার সব অত্যাচার সহ্য করে তোমাকে নিয়ে সারা জীবন থাকতে চেয়েছিলাম। আমার অনেক স্বপ্ন ছিল, তুমি আমার সব স্বপ্ন ভেঙে গুঁড়িয়ে চুরমার করে দিলে।

আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর আমি বললাম, ওসব কথা থাক সোমা, আমাকে আর লজ্জা দিওনা। আমার পাপের শাস্তি অনেক পেয়েছি। আজ যখন তোমাকে ফিরে পেয়েছি এবার আমরা দুজনে নতুন করে ঘর বাঁধবো। তুমি চলে যাবার পর আমি ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম। অনেকদিন অফিসে যাইনি, দিনের পর দিন মাসের পর মাস নেশা করে ঘরে পড়ে থাকতাম। অনিমেষ আমাকে বুঝিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করল। আমি প্রতিজ্ঞা করে বলছি আর কোনদিন নেশা করব না। সোমা বলে, এতদিনেও বিয়ে করোনি কেন? আমি বললাম, তোমার স্মৃতি আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আর তোমার উপর যে অবিচার করেছি মনে হতেই আমি যেন কেমন হয়ে যাই। নিজেকে দোষী, পাপী মনে হয়। তাইতো ঠিক করেছিলাম বিয়ে আর করব না। বহুদিন তোমাকে খুঁজেছি কিন্তু পাইনি। তোমার ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু ফোন বন্ধ ছিল। তাই তোমাকে খুঁজে না পেয়ে সিদ্ধান্ত নেই এবার বিয়ে করবো। কিন্তু মেয়ে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম কে জানে সেই বিজ্ঞাপন দেখে তুমি আবার আমার কাছে আসবে। দুজনেই অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম, নীরবতা ভেঙে আমি বললাম, তুমি কি করছো আজকাল? সোমা বলল, তোমার সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর আমি ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম। তখন মা জীবিত, আমাকে আবার বিয়ে করতে বলে মা। কিন্তু আমি রাজি হইনি। ভাবি একবার বিয়েতে যার সুখ হয়না তার দুবার বিয়ে হলে কি সুখ হবে? আর তোমার সাথে ছাড়াছাড়ি হবার পরেও মন থেকে তোমাকে ভুলতে পারিনি। সেই সময়ের স্মৃতি গুলো দগদগে আগুন হয়ে আমাকে পুড়ে খাক করে দিচ্ছিল। আমি পাগলিনীর মত হয়ে যাই।আমার অবস্থা দেখে আমার দাদা আমাকে একটি বাচ্চাদের স্কুলে কাজ জোগাড় করে দিল। ওখানে গিয়ে অনেকটা ভালো আছি। তবু মনের আকুতি বারবার তোমার মুখটি আমার সামনে ভেসে ওঠে। কারণে অকারণে মনটা যেন কেমন অবশ হয়ে যায়। অসহায় বোধ করি। পরে একসময় সিদ্ধান্ত নিই যদি তেমন সহৃদয়বান কাউকে পাই তবে তার সাথে নতুন করে ঘর বাধবো। তাই তোমার বিজ্ঞাপন দেখে কথা বলি। ফোনে নিজের নামটিও গোপন করি। আমি বলি, আগে যদি জানতে বিজ্ঞাপনটি আমি দিয়েছি তাহলে কি করতে? ও বলে, তখন হয়তো ভাবতাম আসবো কিনা। আবার সোমা বলে, তুমি যদি জানতে আমি ফোন করেছি তাহলে তুমি কি করতে? আমি বললাম, একবারে রাজি হয়ে যেতাম। দুজনে হেসে উঠলাম।কতদিন পর যে এভাবে দুজন একসাথে বসে থাকলাম মনে করতে পারছিনা। আমি ওকে বললাম, একটু চা নয় কফি খাবে? ও বলল, কিছুই খাব না। আমি বললাম, না তা কী করে হয়, তুমি কড়া করে কফি ভালবাসতে। আজ দুজনে একসাথে কফি খাবো। না বলবে না। আমি বয় কে দুটো কফি আনতে বললাম। বয় দুটো কফি দিয়ে গেল, কফি খেতে খেতে বললাম, বলো তুমি কি ভাবছো? ও বলল কি নিয়ে? আমি বললাম, যে জন্য তুমি বিজ্ঞাপন দেখে এসেছো। ও একটু মিষ্টি হেসে বলল, একটু ভাবতে সময় দাও। আমি বললাম, এতে আর ভাবনার কি আছে, আমি তো তোমার কাছে সব ভুল স্বীকার করে নিলাম। আর তোমাকে না পেলে আমি বাঁচবো না সোমা।ও বলে এতদিনের ভাঙ্গা সম্পর্ক একটু তো ভাবতেই হবে। আর বিবাহবিচ্ছেদের কাগজ হয়ে গেছে। ওটাও তো একটা সমস্যা আছে। তুমি দুটো দিন আমাকে ভাববার সময় দাও। আমি বললাম, না ভাবনার সময় নেই। কালই নতুন করে রেজিস্ট্রি করাবো। ঝামেলা চুকে যাবে প্লিজ তুমি রাজি হয়ে যাও সোমা। সোমা মাথা নিচু করে নীরবে বসে থাকল। কোন কথা বলে না। আমি আবার বলি, কিছু তো বলছো না সোমা। প্লিজ কিছু বলো। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না।আমি ঠিক করেছি আজ অফিসে ছুটির অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে দেব। কাল তোমার আমার রেজিস্ট্রি বিয়ে হবার পর আমরা দুজনে কদিনের জন্য দীঘা চলে যাব। দীঘা থেকে পুরীতে গিয়ে জগন্নাথ দেবের কাছে আশীর্বাদ চেয়ে নেব। বলে ওর দুই হাত চেপে বললাম, বলো তোমার অভিমান কেটে গেছে, তোমার আর আমার ওপর রাগ নেই, আবার নতুন করে আমরা সংসার পাতবো। তুমি আমার জন্য এতটুকু মেনে নাও। ও কোন কথা না বলে আমার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে লাগল। ওর চোখের জলে আমার জামা ভিজে গেল। আমি ওকে বুকে চেপে ধরলাম, মনে ভাবলাম এ যেন স্বর্গসুখ। অনেকদিন পরে তোমাকে পেয়েছি আমরা দুজনে নতুন জীবন খুঁজতে পরীর মত পাখা মেলে আকাশে উড়ে যাব।

দুজনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম ও হয়তো ইচ্ছে করেই আমার বুক থেকে ওকে সরিয়ে নিচ্ছে না। আমিও ওকে জোর করে চেপে ধরে থাকলাম।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance