নতুন ডাক্তার
নতুন ডাক্তার


গ্রামের হাসপাতাল ,তবে আর আগের মতন নেই। প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়াও অন্য রোগব্যাধিতে আপদকালিন ব্যবস্থা মিলে যায়। শহর থেকে ডাক্তারও এসেছে। হাসপাতালের পাঁচিল ঘেরা চৌহদ্দির ভেতর স্টাফ কোয়ার্টার। দিব্যি জারুল গাছের ছায়া মাখা উঠোনে খেলে বেড়ায় ছাগল ছানা। পুকুরও আছে একটা,টলটলে জলে বেগনী রঙা কচুরিপানার ফুল ফুটে থাকে। শান বাঁধানো ঘাটের পামে কলমি লতায় জলফড়িং এসে বসে। টিকাকরণ আর পরিবার পরিকল্পনার দেওয়াল লিখনে শেওলার সবজেটে ছোপ। হাসপাতালের গেটের উল্টো দিকে রঘুর চায়ের দোকান। রাত-বিরেতে বা ভর দুপুরে ডিমপাউরুটি আর ঘুগনীও মেলে। বিকেলে ইস্কুল-কলেজ ছুটি হলে,ছেলেমেয়ের দল ফেরে সামনেতিন্নি যখন সন্ধ্যায় টিউশানিতে যায় হাসপাতালের গেটের ভেপার ল্যাম্পটা জলে ওঠে। ঘোলাঘোলা হলদে আলো মাখা মোরেম বিছানো পথের দিকে চোখ চলে যায় তিন্নির। গেটের সামনে রুগীর পরিবারের মানুষগুলো কেমন জবুথবু দাঁড়িয়ে থাকে। তিন্নির এক্কেবারে ভালো লাগে না। কিন্তু সেদিন ভিতরে আসতেই হল। বেলাগাম একটা বাইক ধাক্কা দিল। সাইকেল সমেত পড়ল তিন্নি। কপালটাও কাটলো। সবাই ধরে নিয়ে এল হাসপাতালে। এমারজেন্সীতে ভীড় ছিল না। ডাক্তারবাবু একাই। নার্সদিদি বোধহয় বাহলুদ শার্ট। বয়স বছর তিরিশের মধ্যে। কোঁকড়ানো চুল। চশমার আড়ালে থাকা চোখ দুটো কেমন যেন কাছে চলে এল তিন্নির। কপালের কাটায় হাত বুলিয়ে বললে ডাক্তার— “ সেলাই পড়বে যে”। সেই প্রথম চোখেচোখ। তিন্নির মনে হল এ চোখ যেন কতদিনের চেনা। নার্স কেতকীদি এলেন। স্টিচ হল। তিন্নির কিছুই খেয়াল হল না, এরপর যেদিন তিন্নি এল স্টিচ কাটাতে ডিউটিতে তখন অন্য ডাক্তার। তিন্নির চোখ খুঁজছিল অন্য কাউকে।
—কেয়াদি ওই ডাক্তারবাবু আজ নেই?
—না রে। রাতুলের আজ ছুটি। বাড়ি গেছে।
বাড়ি ফিরেও কেমন মনমরা তিন্নি। বড্ড রাগ হচ্ছে রাতুল ডাক্তারের উপর। আজ কেন ছুটি নিল?
এরপর থেকে যখনই হাসপাতালের সামনে দিয়ে যায়,তিন্নির মনে হত গেট থেকে ওই যে মোরেমের পথ, সেটা যেন নদী। মনে হত ওই নদীবেয়ে একবার চলে যায়। কিন্তু কি বলবে ও রাতুলকে।
সেদিন যখন পাড়ার মালতীপিসির বুকে ব্যথা হল,হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল—তিন্নিও সাথে গেল। রাতুল ছিল ডিউটিতে। রাতুল যদি একবার ওর গলায় ঝোলানো স্টেথো তিন্নির বুকে রাখতো তবে বুঝতে পারতো কেমন জলপ্রপাতের শব্দ হয়। মালতীপিসিকে ভর্তি করতে হয়নি। ওরা যখন ফিরছে রাতুল ডাক্তার মালতীপিসির মেয়েকে ডেকে নিজের ফোন নম্বর দিল।
—আমার মোবাইল নম্বরটা রাখুন,দরকার
নম্বরটা সেভ হয়ে গেল তিন্নির ফোনে। হোয়াটসঅ্যাপে রাতুলের প্রোফাইল পিকচারটা মাঝে মাঝে দেখতো তিন্নি। নতুন ডিপিতে নিজের মনেই লাইক দিত,কমেন্ট করত। ইচ্ছা করত ফোন করতে। করা হত না। দেখতে দেখতে বর্ষা নামল। ফুল ধরল ছাতিমের ডালে ডালে। ছাতিমের গন্ধ মাখা বৃষ্টিতে একদিন তিন্নি আগাপাশতলা ভিজল। ইচ্ছে করেই। তবুও একটু জ্বর এলোনা,একটা-দুটো হাঁচিও হল নাএকদিন তিন্নি হোয়াটসঅ্যাপে রাতুলকে গুডমর্নিং উইশ করল। সারাদিনের পর রাতে রিপ্লাই এল।
“ছবি দেখে চিনতে পারলাম। কিন্তু নামটা জানা নেই যে। ” সাথে একটা স্মাইলি।
তিন্নি ওর ফোনে রাতুলের নম্বর নতুন ডাক্তার নামে সেভ করেছে। এখন মাঝে মাঝেই কথা হয় হোয়াটসঅ্যাপে।
পাড়ার ক্লাবের বিজয়া সন্মেলনে তিন্নি আবৃত্তি করছিল তিন পাহাড়ের গান।
পাহাড়িয়া মধুপুর,মেঠো ধুলিপথ
দিনশেষে বৈকালি মিস্টি শপথ।
আমি শোবো পাশে মোর কেউ শোবে না
তুই ছাড়া এই দেহ কেউ ছোঁবে না।
নতুন ডাক্তার শুনেছিল,প্রচ্ছন্ন প্রশংসা ছিল মেসেজে।
ফেসবুকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল তিন্নি। রাতুল অ্যাকসেপ্টও করে।
এরপর হেমন্ত কেটেছে,বসন্ত পেড়িয়ে গেছে। তিন্নি জানতেও পারেনি রাতুলের বদলী হচ্ছে। চলে যাওয়ার আগের দিন নতুন ডাক্তার অনেক রাতে ফোন করেছিল।
তিন্নি,আমি কোলকাতায় চলে যাচ্ছি। পারসোনাল একটা সমস্যা আছে। বছর তিনেক আগে আমি আর মেধা রেজিস্ট্রি করি। ও আমার ব্যাচমেট। কিন্তু রিলেশানটা বোধহয় আর থাকবে না। ও ডাইভোর্স ফাইল সু করেছে। ভালো থেকো।
তিন্নি উত্তর দেয়নি ।
পরেরদিন জ্বর এল তিন্নির। যখন ও হাসপাতালের এমারজেন্সিতে ঢুকছে, রাতুলের কফিরঙা সিডানটা বেরোচ্ছে গেট দিয়ে। ডিউটিতে অন্য ডাক্তার।