সৃজার গন্ধ
সৃজার গন্ধ
ল্যাবের ভেতরটায় কোন এক অজানা অ্যারোমেটিকের গন্ধে ভরে উঠেছে। গন্ধটা ঠিক ফ্লোরাল না হলেও,খুব চড়া। বকযন্ত্রে রাখা গাঢ় হলদে তরলের রঙ আস্তে আস্তে ফিকে হচ্ছে। নীচে বসানো বিকারে সরু সূচের মতন ক্রিস্টাল ঘনিভূত হচ্ছে। ডিস্টিলড ওয়াটারের তলায় সেই ফ্লুরোসেন্ট গ্রীন ক্রিস্টাল পৃথ্বীশকে চুম্বকের মতন টানছে। টানা সাতাশ দিন,এই ল্যাবের ঘরেই নিজেকে আটকে ফেলেছে পৃথ্বীশ। আজ সফলতা আসছে বোধহয়। উত্তেজনায় পৃথ্বীশ ছটফট করছে। রাইটিং ডেস্কে এসে ল্যাব নোটের ফাইনাল ড্রাফ্টটা আর একবার ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে নিল। রাত প্রায় দুটো। জানালার কাঁচে চাঁদের আলো লেগে আছে। বোধহয় পূর্নিমা। ফোনটা হাতে নিল পৃথ্বীশ। সৃজাকে একবার ফোন করতে ইচ্ছে করছে,যদিও এত রাত হয়েছে,তার উপর সৃজার আর হানিমুনের তৃতীয় রাত। বিব্রত করা ঠিক হবে না। ইতস্ততঃ করে ফোনটা বন্ধ করে দিল পৃথ্বীশ। ল্যাপটপের স্ক্রিন সেভারটা সরে যেতেই এক বিশাল হাইড্রোকার্বোন চেইনের স্ট্রাকচার ভেসে উঠল স্ক্রিনে। এইটাই পৃথ্বীশের আবিষ্কার। এর আগেও তৈরি করেছে,কিন্তু কিছুতেই স্টেবল হয়নি ডেরিভেটিভটা। কয়েক মিনিটের মধ্যে ভেঙে গেছে দীর্ঘ চেইন। এবার টানা দেড় ঘন্টা স্ট্রাকচার টা স্টেবল রয়েছে! ফিল্টার করে ক্রিস্টালগুলো একটা কোন্টামিনেশন রেজিস্টেড টিউবে ভরে ফেলল পৃথ্বীশ। কেমিক্যাল নামটা ভীষন বড় তাই এই পলি অ্যারোমেটিক কম্পাউন্ডের একটা ডাক নাম দিতে হবে। কিছু ভাবার আগেই স্টিকারটা টাইপ করে ফেলে পৃথ্বীশ। সৃজা‘স ডিলাইট!
প্রায় বছর পাঁচেক আগের কথা। সৃজার ঠোঁট সেদিন পৃথ্বীশের ঠোঁট ছোঁয়ার পার্মিশন পেয়েছিল। সৃজার ফিজিক্স আর পৃথ্বীশের কেমিস্ট্রি তবুও মিলটা ছিল কবিতায়,ছবিতে। ক্যাম্পাসের বড়বড় গাছের নীচে,পাখির কিচির মিচির বিকেলে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে স্টিরিওকেমিস্ট্রি একাকার হয়ে যেত ভালোবাসায়। ক্রমে ভালোবাসায় ঘনিষ্ঠতা এসেছে। সৃজার লিপস্টিকের রঙ, নাভির গন্ধ, ঘামের গন্ধ,চুলের স্পা সব ছাপিয়েও অন্য একটা গন্ধ পেয়ে বসেছিল, পৃথ্বীশ আর সৃজার সম্পর্কে। সে গন্ধ চুরি করে নেওয়ার ইচ্ছে পৃথ্বীশের বহুদিনের। গন্ধটা কিসের? বডি স্প্রে, হেয়ার কন্ডিশনার , বডি লোশন ,নতুন অন্তর্বাস —ওসবের নয়,গন্ধটা সৃজার। সেটা আলাদা করে চেনা যেত। মাঝে মাঝে পালটে যেত গন্ধটা তবুও ওটা যে সৃজার সেটা চিনতে পারতো পৃথ্বীশ। অনেকটা সূর্যের আলোর মতন,কখনও ভোরের মতন নরম,কখনও দুপুরের মতন দাপুটে,কখন দুপুরের মতন একা,কখনও বিকেলের মতন দুষ্টু আবার কখনো গোধুলির মতন সর্বনাশী!আলোতো সেই একই উৎস থেকে বিচ্ছুরিত ইলেকট্রোম্যাগনেটিভ ওয়েভ,তবুও স্পেকট্রাম রেঞ্জের ভিন্ন ভিন্ন রঙে দেখা দেয়। সৃজার গন্ধটাও তেমন। কখনো রাগি,কখনো অভিমানী,কখনো নিমন্ত্রণের আবার কখনো সমর্পণের। আসলে পৃথ্বীশ জানে ওটা মনের গন্ধ। ওটা মিশে যায় শরীরের গন্ধে,তাই এত ভিন্নতা কিন্তু সেই অদ্বিতীয় অনুভব। সৃজা মানতে চাইতো না। পৃথ্বীশ পণ করেছিল,প্রমান করেই ছাড়বে।
ধুপ পুড়লে যেমন গন্ধ আসে,তেমন মনের ভেতর থেকেও গন্ধ আসে। সেটা টের পেথ পৃথ্বীশ। কেবল গন্ধটাকে বন্দী করতে পারছিল না। ঘুমিয়েও স্বপ্ন দেখতো । প্রতিটা প্রতিবর্তে যেই মুহূর্তে স্নায়ুসন্ধির মুখে অ্যাসিটাইল কোলিন ক্ষরিত হয় বর্ণহীন বাষ্পের মতন কিছু একটা মনের পর্দা ভেদ করে ব্যাপিত হয়। এটার সাথে ওটা মিশিয়ে গন্ধটা বানিয়ে ফেলতে মন চাইত পৃথ্বীশের। এরই মধ্যে একদিন টের পেল সৃজার গন্ধটা ফিকে হচ্ছে। আদরের মুহূর্তেও সৃজার সেই আদুরে গন্ধটাতে এড়িয়ে যাওয়ার গন্ধ পেত। শরীর সাড়া দিতে চাইত না তাই।সৃজার শরীরের আনাচে কানাচে পৃথ্বীশ খুঁজত সেই আদর গন্ধটা। পেত না। তাই পৃথ্বীশও কুঁকড়ে যেত। সৃজা বলতো পৃথ্বীশ নাকি ক্রমশ ইমপোটেন্ট হয়ে যাচ্ছে। পৃথ্বীশ জানত সেটা ভুল,তবুও জোর করেনি। মনের পাতা হাতড়িয়ে সেই আদুরে গন্ধের একটুকরো মনে মনে গুছিয়ে নিয়ে দূরে চলে এসেছিল সৃজার থেকে। সৃজা পৃথ্বীশকে ছেড়ে খুঁজে নিয়েছিল নতুন প্রেমিক।
সৃজা এই মুহূর্তে এক আদিম মহাসাগরের পাড়ে,নতুন প্রেমিকের বুকে। সৃজার নাভিমূল আর উরুসন্ধি থেকে উথাল পাতাল গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে তার প্রেমিকের বুকে,পিঠে,গালে। কিন্তু সবটুকু গন্ধই কেবলই ঘনীভূত হতে থাকে রিসোর্টের পর্দা দেওয়া বেডরুমে। বাইরে নরকের মতন শীতলতা অবিরাম তুষারপাতে বরফের নির্জনতা বিছিয়ে দিয়েছে কালো বালির তটে। ঢেউ ভাঙার শব্দ জানলায় বারবার আঘাত পেয়ে আহত হচ্ছে। আর সবটুকু উষ্ণতার রুম হিটারের ওম ঢেলে দিয়েছে ঘরের মধ্যে। গন্ধ জমতে জমতে ভরে ফেলছে ঘর। কোই এতটুকু গন্ধও তো জারিত হচ্ছে না প্রেমিকের শরীরে। সৃজা বোধ হারিয়েছে। ক্রমশ গন্ধহীন হয়ে যাচ্ছে সৃজা। এ গন্ধ আগে পৃথ্বীশ নিয়ে নিত। তা আজ অব্যবহৃত। পরীক্ষাগারে জন্ম নেওয়া অবাঞ্ছিত বাইপ্রোডাক্টের মতন থিথিয়ে পড়ছে সৃজার গন্ধ। নেওয়ার নেই কেউ। কার্পেট পাতা মেজেতে পড়ে থাকা প্যান্টি,ব্রা আর নাইট গাউনের ফেব্রিক শুষে নিচ্ছে অতিপৃক্ত গন্ধটা।
পৃথ্বীশ আলতো হাতে সেন্ট্রিফিউজার থেকে তুলে আনলো মুখবন্ধ টেস্ট টিউবটা। গন্ধটা চাপ চাপ, কনসেনট্রেটেট হয়ে আছে। ফ্লুরোসেন্ট আভা দপদপ করছে। বিজ্ঞানীর লোভ করতে নেই, সেটা পৃথ্বীশ জানে। তবুও নিজের প্রেমের গন্ধ একবার প্রানভরে অনুভব করে নিতে চাইছে সব ইন্দ্রিয়। কোষে কোষে অ্যাড্রিনালিন যেন ছ্যাঁকা দিচ্ছে। পেটেন্ট, অর্থ ,যশ সব তুচ্ছ এই উদ্দীপনার কাছে। পিরিওডিক টেবিলের এলিমেন্ট গুলোতে যেন প্রান সঞ্চার হল। অদৃশ্য ভেন্ট্রিলোকুইস্টের মতন কেউ পৃথ্বীশকে পাপেট বানিয়ে ফেলেছে। পৃথ্বীশ ফিসফিসিয়ে উঠছে আদরের ভাষায়।নিয়ন্ত্রণ হীনতা পৃথ্বীশকে বাধ্য করল,গন্ধ ভরা সেই টেস্ট টিউব খুলে ফেলতে। কি উগ্র সেই গন্ধ। নিমেষে সম্মোহিত করে ফেলল পৃথ্বীশ কে। সৃজার গন্ধ যেন সৃজার মনটাকে আবার ফিরিয়ে দিয়েছে একই বিছানায়,পৃথ্বীশের সাথে। গন্ধের চুম্বনে ফিরে আসছে সৃজার স্পর্শ। সৃজা তো আজ অন্য কারোর গল্পের নায়িকা ,তবে কি এ সহবাস প্রেম না পরকীয়া। গলা দিয়ে মোনিংয়ের স্বর ছাড়া আর কিছু বের হয় না পৃথ্বীশের।
নদীর মতও মনও উৎস সন্ধানী। তাই মনের গন্ধও পতঙ্গ স্বভাবী,ছুটে যায় উৎসের আগুনে। নদী যেমন সাগরে মিলে যায় মোহনায় আর আবার সেই সাগর বাষ্প হয়ে যায়,মেঘ ভাঙা বৃষ্টি হয়ে নদীতে মেশে—ঠিক সেভাবেই উৎসের অভিমূখে ছুটে গেল সেই গন্ধ দুর্বার আকর্ষণে। যাবতীয় আনসার্টেনটির তোয়াক্কা না করে বন্ধনহীন গন্ধ পৃথ্বীশের ল্যাবের জানলা দিয়ে রওনা দিল। উড়ান পথে ছুঁয়ে গেল সেই বোগেনভ্যালিয়ার পাতা, যেটা সৃজা কোন এক শ্রাবণে উপহার দিয়েছিল। সৃজার হানিমুন সুটের জানালায় এসে আটকে রইল পৃথ্বীশের সিন্থেটিক গন্ধ—সৃজাস ডিলাইট। সে এখন সৃজার অপেক্ষায়। জানলার ওপারে বিছানায় নগ্ন দুটো শরীর। সৃজার নগ্নতায় গন্ধহীনতার ছাপ পড়েছে। কে যেন ডাকছে সৃজাকে। সম্মোহিত সৃজা উঠে এল জানালার কাছে। এক ঝটকায় খুলে দিল জানালা। এক রাশ গন্ধে ঢেকে গেল সৃজার শরীর। প্রচন্ড ঠান্ডাতেও গলার লাজুক ভাঁজে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে সৃজার । পিঠ,কোমর আর বুকের উত্থানে যত চিহ্ন ছিল রাতের সব মিলিয়ে যাচ্ছে। গন্ধের বাষ্পে কুয়াশার মতন আবছা হয়ে আসছে চারপাশ। কোন প্রেমিক নেই সৃজার। সৃজা চলে যাচ্ছে সেই বোগেনভ্যালিয়ার ফুলের রেনুতে। সৃজার শরীর জুড়ে জোনাকির সবুজ আলো।