সবিনয় নিবেদন
সবিনয় নিবেদন


ট্রেনের জানলা দিয়ে হলদে সূর্যের পাঠে বসা আলো ঢুকছিল কাঁচের আড়াল ভেদ করে। ওই জানলাতেই হেলান দেওয়া একটা মুখ। বেলাশেষের মায়াবী আলোয় চকচক করছিল চোখদুটো। কানে হেডফোন আর হাতে বন্ধকরা পেঙ্গুইন পেপার ব্যাক। ম্যানিকিউর করা নোখ বইটার ভেতর পেজমার্কের মতন ঢোকানো আছে। গলার লাজুক ভাঁজে রূপকথার লাইন। চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা নয়, পার্লারের যত্নে ঈষৎ লালাভ । জানলার ওদিকে ছুটে চলা নদী, ছুটে চলা গাছপালা আর ঘরবাড়ী। ওকি দেখতে পাচ্ছে সেসব। আদৌ বুঝতে পারছে কি এমন একটা বিকেল রোজ রোজ হয় না। চকমকি মন রোজ রোজ এমন জ্বালিয়ে দিতে উস্কানি দেয় না। তবুত্ত ব্যথা ঠোঁটে কথা ফোটে না। তাকিয়ে ছিলাম তার দিকেই,আপার বার্থ থেকে । সঙ্গে ছিল বুদ্ধদেব গুহর “সবিনয় নিবেদন”। মনে হল বুঝি ওর নামও ঋতি। ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে এল। ও মুখ ঘোরালো,এবার এক্কেবারে চোখাচোখি। মহিষাসুরমর্দিণীর চোখ। মনে হল আমি কৃষ্ণেন্দু আর ও রীনা ব্রাউন । আমার দিকে তাকিয়ে বলবে “ও যেন আমায় টাচ্ না করে”। আমি যে চোখ মেলেছি! প্রাণ ঢেলেছি!
তাই বুঝি মিরাকেল হল। চোখ নামিয়ে নেওয়ার সময় একফালি হাসি দেখলাম ঠিক যেন চাঁদের গায়ে চাঁদ। ট্রেন পৌঁছালো গন্তব্যে। প্লাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর আর দেখলাম না। এরপর দিককতক ইতি উতি বেড়িয়েছি। ভ্রমণসূচী মেনেই সেদিন চলেছি কেদার। বেলা তখন ১১টা। রামওয়ারার কাছে পিঠের রুকস্যাক নামিয়ে বসে আছি। কিছুক্ষণ আগেই ক্যামেরা টি গত হয়েছে। মন খারাপ।
কে যেন ডাকল, মনে হল। গলাটা চিনি না। ঘাড় ফেরাতেই দেখি সেই রোদ চুপচুপে মুখ। জিন্স,লেদার জ্যাকেট আর কালো রোদ চশমায় বেশ দেখাচ্ছিল। রামওয়ারা না হয়ে যদি এটা ময়নাপাড়ার মাঠ হতো, কালো সে নাই বা হলো, ঋতি তবে কৃষ্ণকলি হতো। বললাম-একা কেন? বাকীরা কোই?
-ওরা ঘোড়ায়,এতক্ষনে নেমে গেছে।
-এরপর কোথায়?
-দুদিন হরিদ্বারে কাটিয়ে ফিরে যাব। আর তোমরা?
-আমরাও এখান থেকে ফিরে কোলকাতার ট্রেন ।
-ঠিক আছে চলি তাহলে। তুমিও এগোও।
আবার সেই এক হাসি আর তারপর হঠাৎ পিছন ফিরে বলল—তুমি ছবি আঁকতে পারো,তাই না।
অবাক হলাম। কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই বলল-আমি তোমার বার্থে স্কেচবুক দেখেছি।
কোন উত্তরের অপেক্ষা না করে রুকস্যাক পিঠে চাপিয়ে নামতে থাকল। ফিরে তাকালই না আর। মিলিয়ে গেল দূরে কোথাও । আমি কেবল বসে রইলাম,ভিজে একশা হয়ে। মেঘবালিকা বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে গেল যে।
অগত্যা মন্দাকিনীর পাড় ধরে চলতে থাকলাম। সামনেই দেওদেখানি। কিন্তু মেঘপিওন দরজায় কড়া নাড়া দিল আর দিয়ে গেল মনখারাপের দিস্তা। নামটাই তো জানা হয়নি। যদি কোনদিন রবিঠাকুর বলে তবু মনে রেখ, কি নামে ডাকবো? কখনও মনে হয়েছিল ঋতি,কখনও রীনা ব্রাউন,কখন আবার কৃষ্ণকলি। মেঘবালিকাও হতে পারত। গ্রেটা গারবো এমনকি করিনা কাপুরও মনে হতে পারত। সে যা হোক,নামে কি আসে যায়।
বাড়ি ফিরে ভাবলাম একটা ছবি আঁকি। ক্যানভাসে রঙ চাপালাম। নীল আকাশ, বরফমোড়া পাহাড় সবই হল। রোদের সোনা ছড়িয়ে গেল মাটির আঁচলে। কিন্তু কিছুতেই তার অবয়ব স্পষ্ট করতে পারলাম না। ক্যানভাস জুড়ে কুয়াশা এল,হঠাৎ করেই।