নতুন আলো
নতুন আলো


ঠক ঠক ঠক, দরজায় এত রাতে আবার কে কড়া নাড়ে। ধরফড় করে উঠে বসল কণাদ। হাসপাতাল থেকে কেউ কি? তবে কি আবার কোনো ঝামেলা হল!! তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খোলে ও।
-''ডাক্তারবাবু, আপনে এখনি পলায় যান। ওরা আপনারে খুন কইরা ফেলবে। এখনি চইলা যান। '' আগন্তুকের কথায় খুব একটা অবাক হয় না কণাদ।
গত ছমাস ধরেই ও খুনের হুমকি পেয়ে আসছে। বাকুড়ায় শেষ প্রান্তে রুখাশুখা এই গ্ৰাম মাগুর ডিহা। একটাই ছোট্ট স্বাস্থ্যকেন্দ্র আসেপাশের চারটা গ্ৰাম নিয়ে। সেখানেই পোষ্টিং নিয়ে এসেছিল সে ছয় মাস আগে। স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পাশে ছোট্ট একটা ইনডোর ইউনিট ও ছিল পরিত্যক্ত অবস্থায়। মাত্র ছটা বেড, প্রয়োজনে প্রসুতিদের ডেলিভারি হত একসময়। রাত বিরাতে দু এক জনকে ভর্তি করা হত অনেক সময়। তবে পরে সবাইকে নাকি জেলা সদরে পাঠিয়ে দেওয়া হত। আসলে কোনো ডাক্তার আসতে চাইত না এই গণ্ডগ্ৰামে। চিকিৎসার সঠিক পরিকাঠামো নেই এখানে। রয়েছে হাজারটা অসুবিধা। হারান কম্পাউণ্ডার এখানের অলিখিত ডাক্তার। ও একাই সব সামলে নেয়। যে যে ডাক্তার এখানে বদলি হয়ে আসে দু দিনেই সিএমওএইচ কে টপকে ডিএইচএসপটিয়ে অন্য কোথাও পালিয়ে যায়। হারান কে এখানে সবাই হারান ডাক্তার বলেই চেনে। একটা কান ভাঙা স্টেথো নিয়ে ও একাই ডাক্তারি করে এখানে। তবে কাউকে ভর্তি নিয়ে ঝামেলা বাড়ায় না। একটু বেগতিক বুঝলেই সদরে ঠেলে দেয়। এভাবেই হারানের বেশ চলছিল। দুটো পাকা বাড়ি, জমি, বাইক বেশ অবস্থা খুলে গেছিল ওর।
কিন্তু কণাদ এসে প্রথমেই ইনডোর ইউনিটটা পরিস্কার করিয়ে চালু করেছিল। দু জন নার্সকে নিয়ে একাই ডেলিভারি ও করিয়েছে কয়েকবার। হারানের বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে ছমাস পার করে ফেলেছিল কণাদ। তবে হারান আড়ালে আড়ালে মেঘনাদের মতো বেশ কিছুদিন যাবৎ কলকাঠি নাড়ছিল। কণাদ এখানে গেঁড়ে বসে থাকলে তো হারনের রুজিরোজগার শিকেয় উঠবে।
গত সপ্তাহে পরাণের রোগা এনিমিক বউটা পঞ্চম বাচ্চার জন্মদিতে এসেছিল। অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে সদর অবধি পৌঁছানোর ধকল নিতে পারত না বেচারি বৌটা। আর তাছাড়া পরাণের সেরকম আর্থিক সামর্থ্য ও ছিল না। কণাদ নিজে দায়িত্ব নিয়ে ডেলিভারি করলেও বাচ্চাটা বাঁচেনি, গলায় নাড়ি জড়িয়ে গেছিলো। গ্ৰামের লোককে খেপিয়ে তুলেছিল হারানের লোকেরা। হাসপাতাল ঘেরাও করেছিল ওরা। কিন্তু একই৷ সময় প্রধানের মেয়ের বিয়ের আট বছর পর যমজ ছেলে হওয়ায় প্রধানের লোকেরা সামলে নিয়েছিল। কিন্তু আজ আটদিনের জ্বরে ভোগা পনেরো বছরের ছেলেটা যখন বিকেলে এসে ভর্তি হলো, তখনি হারান ওকে রেফার করতে বলেছিল। কিন্তু কণাদ নিজের দায়িত্বে ওকে ভর্তি নিয়েছিল। ওদিকে একটা পাঁচ বছরের মেয়ে জলে ডুবে এসে ভর্তি হয়েছিল সন্ধ্যাবেলা, ফুসফুসে জল ঢুকে গেছিল। ওকে সদরে রেফার করতেই গন্ডগোল শুরু হয়েছিল। কণাদ মেয়েটার বাড়ির লোককে বুঝিয়ে বলেছিল এই হাসপাতালে ঐ ব্যবস্থা নেই। অক্সিজেন লাগিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ওকে সদরে নিয়ে যাবার কথা বলতেই কিছু লোক ক্ষেপে উঠেছিল। ওদের সামর্থ্য নেই, অথচ কনাদ বারবার বলেছিল ঐ মেয়েটির অবস্থা খুব খারাপ। এরমধ্যে ঐ জ্বরে ভোগা ছেলেটির কন্ডিশনও ডিটরিয়েট করে।
-''ডাক্তারবাবু, রমেনের মেয়েটা চইলা গেলো বোধহয়.. ওরা ভাঙচুর করতাসে। ছেলেটার অবস্থাও খারাপ। '' হসপিটালের জমাদার বাবলু বলে ওঠে।
কণাদ বলে -''চল আমি যাচ্ছি। ''
-''পাগল হইসেন? আপনে গাড়ি লইয়া সদরে যান গিয়া....''
-''না , আমি হাসপাতালেই যাবো। চলো।''
কনাদ তাড়াতাড়ি হাঁটা দেয়। জমাদার বাবলু পেছনে ছুটতে থাকে। কিন্তু একরোখা ডাক্তারকে আটকাতে পারে না।
*****
-''আজ অবধি সিএমওএইচ বা ডিএইচএসের কাছে ধর্ণা দিয়ে ডাক্তাররা শহরে বা টাউনে বদলি হতে চেয়েছে। কখনো গ্ৰামে যাবো বলে আবেদন করেনি। ডঃ কণাদ এমন একজন ডাক্তার যিনি নিজে থেকে ঐ গ্ৰামে যেতে চেয়েছিলেন, ওখানকার স্বাস্থ্য কেন্দ্র চালু করিয়েছিলেন। আর আজ তাকেই এমন অবস্থার শিকার হতে হল!'' ডঃ মুখার্জীর কথায় কেউ কোনো উত্তর খুঁজে পান না।
আপাতত ভোররাতেই তিন সদস্যর দল চলেছে মাগুরডিহায়, কাল রাতে ভাঙচুর করে আগুন লাগানো হয়েছে ঐ হাসপাতালে। ডঃ কণাদ আক্রান্ত হয়েছেন বলে খবর এসেছে।
হাসপাতালের সামনে গিয়ে সবাই অবাক, তিনটে গ্ৰামের লোক উপচে পড়েছে। লোকাল থানা থেকে পুলিশ এসে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছয় বেডের ছোট্ট হাসপাতালটায় ভাঙচুর চলেছে, ফাঁকা বেড গুলো ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে।আগুনে পুড়ে গেছে বিছানা, পর্দা। পাশেই আউটডোরেরও জানালা দরজা ভাঙা হয়েছে। কিন্তু এত লোক আপাতত শান্ত। কেমন যেন একটা চাপা উত্তেজনা চারপাশে। ডঃ কণাদকেও নাকি ঘেরাও করা হয়েছিল রাতে। তেমনি খবর গেছিল জেলা হেডকোয়ার্টারে। কিন্তু কোথায় এখন সে!! হাসপাতালের বাইরেই একটা ভাঙাচোরা ঘরকে কণাদ রেস্টরুম বানিয়েছিলো, দুপুরে বাড়ি যেতোনা, ওখানেই একটু বিশ্রাম নিয়ে নিতো। জনতা সেই বাড়ির সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। রেষ্ট রুমের দরজা বন্ধ, বাবলু জমাদার আর গ্রাম প্রধান দাঁড়িয়ে রয়েছে বাইরে দারোয়ানের মতো। পাশেই ভিজে বিড়ালের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে হারান কম্পাঊন্ডার। হঠাৎ ভেতর থেকে ভেসে আসে নবজাতকের ক্ষীণ কান্নার আওয়াজ। খানিক পরেই নার্স মায়া দরজা খুলে বেরিয়ে আসে, কোলে সাদা কাপড় জড়ানো এক দেবশিশু, পেছনে ডঃ কণাদ, মাথায় ব্যান্ডেজ। চোখের পাশটা লাল হয়ে ফুলে। কম্পাউন্ডার হারানের নাতি হয়েছে। কাল ভোর রাতে বাথরুম যেতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেছিল ওর ছেলের বৌ। আট মাস পুরোয়নি এখনো। জল ভেঙ্গে গেছিল, অনবরত রক্তপাত হচ্ছিলো, প্রসব বেদনা শুরু হয়ে গেছিলো, আর সদরে নেওয়ার মতো সময় ছিল না। এদিকে হাসপাতাল তখন জ্বলছে। হারান তখন কণাদের বিরুদ্ধে আক্রমনের ইন্ধন জোগাচ্ছে। সেই সময়ই হারানের নাতি বৌকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে আসে হাসপাতালে। হারান দিশাহারা বোধ করে, কী করবে ভেবে পায়না। কণাদ কিন্তু ওই অবস্থাতেও মানসিক স্থৈর্য হারায়নি। ওর ডাক্তারির চোখ একঝলক দেখেই বুঝে গেছিলো, প্রিটার্ম ব্রিচ ডেলিভারি, তার উপরে প্লাসেন্টা প্রিভিয়া। ইমেডিয়েটলি ডেলিভারি না করাতে পারলে রক্তক্ষরণ হয়েই বৌটা মারা যাবে। এদিকে প্রসব করাতে গিয়েও মা আর বাচ্চা দু'জনেরই প্রাণসংশয় হতে পারে। তখন এই উন্মাদ জনতা কি তাকে ছেড়ে দেবে? কিন্তু ডাক্তারি শপথ যখন নিয়েছে, তখন যা করা দরকার, তা তাকে করতেই হবে। নিজের ভালমন্দের কথা না ভেবে পেশেন্টের কথা আগে ভাবাই কণাদের শিক্ষা। ওদিকে হারানের নাতবৌটা তখন নেতিয়ে পড়েছে। হাত জোড় করে সে বলেছিলো, "আমায় আপনারা পরে মারবেন, এখন আগে এই মেয়েটাকে বাঁচাতে দিন।" মারমুখী জনতা ওর কথা শুনে থমকে যায়, সেই সুযোগে ঐ গণ্ডগোলের মধ্যে কণাদ পেশেন্ট আর একজন নার্সজে নিয়ে নিজের রেষ্ট রুমে ডেলিভারী করাতে ঢুকেছিল, কারণ হাসপাতালের ওয়ার্ড আর লেবার রুম ততক্ষণে জ্বলছে।
*****
-''সার আমার দাদু বলেছিল শহরে অনেক ডাক্তার আছে, গ্ৰাম গুলোয় নেই। এই মাগুর ডিহায় থাকত মিতু মাসী। আমার আয়ামাসি, আমায় মানুষ করেছিলো। বলেছিল ওর মেয়েটা বাচ্চা হতে গিয়ে মারা গেছিল। ওর বর তিনদিনের জ্বরে চলে গেছিল বিনা চিকিৎসায়। আমি এখনো এখানেই থাকতে চাই।'' কণাদের কথায় সবাই অবাক।
-''সব দোষ আমার সার। ডাক্তারবাবু কে আমি যেতে দেবো না। এখানে ওর দরকার আছে।'' হারানের চোখে জল।
জনতা র মধ্যে এতক্ষন চাপা গুঞ্জন ছিল। এবার ওরাও বলে -''ডাক্তাব বাবু কে যাইতে দিব না। উনি ভগমান। ''
কণাদের মুখে হাসির রেশ ফোটে। নতুন প্রভাত আসে মাগুরডিহায়।