নজরবন্দি
নজরবন্দি


“এই শাড়িগুলো কোথা থেকে এলো গিন্নি?”
“কিনে আনলাম।”
“কত পড়লো?”
“হেঁ হেঁ বেশি না…”
“বেশি না টা কত শুনি না।”
“হেঁ হেঁ… বলছি শোনো না আর দু’মাস পরেই তো তুলির বিয়ে তার একমাস পরেই আবার রিন্টুর বিয়ে তা বাপের বাড়ির তরফে দু দুটো বিয়ে বাড়ি আছে, সেখানে একটু ভালো শাড়ি না পরলে চলে নাকি! তোমার মানটা কোথায় থাকবে বলো?”
“আলমারি ভর্তি ভালো ভালো শাড়ি আছে তো কত, আবার কেনার কোনো দরকার ছিলো কি খুব?”
“ওগুলোকে ভালো শাড়ি বলে না, তোমার মা বেঁচে থাকতে আমায় ভালো শাড়ি কিনতে দিতেন নাকি! একটু ভালো শাড়ি কিনলেই তো ওনার চোখ টাটাতো।”
“আমার মাকে শুধু শুধু টেনে আনছ কেন!”
“টানবো না! বেঁচে থাকতে তিনি হিটলারগিরি ফলাতেন আমার ওপর এখন আবার তুমি শুরু করেছো দেখছি।”
“হিটলারগিরির কি দেখলে শুনি? আমি তো শুধু জিজ্ঞেস করছি শাড়িগুলোর দাম কত। থাক তোমাকে বলতে হবে না, আমি নিজেই দেখে নিচ্ছি।
রিসিট কোথায়! এই তো…”
“এই না না রিসিট দেখবে না, এই…”
“একি! বাআ...আরো হাজার! ওমাগো, তুলে নাও গো, এই মহিলা আমায় দেউলিয়া করে ছাড়বে।”
“ঢঙ যত। আমার দিদি আরও কত দামি দামি শাড়ি পরে জানো সেটা!”
“তোমার জামাইবাবুর ঘুষের পয়সায় সে তিনি পরতেই পারেন কিন্তু আমার তো আর ওরকম কোনো উপরি প্রাপ্তি হয়না… গোটা আলমারিতে তোমার কতগুলো শাড়ি পড়ে আছে গুনে দেখেছো কোনোদিন! এখন তো আবার বাড়িতে দিনের বেলাও রাতের ওই ঝলংঝপ্পা পোশাক গুলোকে পরে থাকো। সেখানে আরও দুখানা শাড়ি কেনার কি কোনো প্রয়োজন ছিল!”
“দেখো মেয়েরা কি পরবে না পরবে সেটা সম্পূর্ণ মেয়েদের ব্যাপার, আমার স্বাধীনতায় একদম হস্তক্ষেপ করতে আসবে না।”
“তুমি আমার পকেটে এরকম বেহিসেবি হস্তক্ষেপ বন্ধ করলে আমিও কিছু বলবোনা।”
“এমন করে বললে আমায়! আজ আমার নিজের রোজগার থাকলে এ কথা বলতে পারতেনা নিশ্চয়।”
“অপচয়টা সব সময়ই অপচয়, সে রোজগার যারই হোক না কেন।”
“তুমি কিন্তু আমাকে ইনসাল্ট করছো এবার।”
“যাহ বাবা ইনসাল্টের কি হলো!”
“আমি কিন্তু বাবার বাড়ি চলে যাবো, এখন তোমার মাও নেই যে আমাকে ধমকে আটকে দেবেন।”
কথাটা বলেই মুখ টিপে হাসল অঞ্জনা, সে জানে তার ভালোমানুষ বরটাকে ভয় দেখানোর জন্য বাপের বাড়ি যাওয়ার দরকার নেই, শুধু একরাত অন্যঘরে থাকলেই হলো। কাল সকালে সুড়সুড় করে এসে ক্ষমা চাইবে আর শাড়ির ব্যাপারটা নিয়েও আর কিছু বলবে না। তার হিটলার শ্বাশুড়ি মাও নেই যে তাকে ধমকে থামিয়ে দেবেন, আহ কি আনন্দ শ্বাশুড়ি মার অবর্তমানে এখন অঞ্জনাই তো রাজা থুড়ি রাণী। বুড়িটা বেঁচে থাকতে কম জ্বালিয়েছিল নাকি! শুধু বৌমা এটা কোরো না, সেটা কোরো না, এটা কিনোনা, সেটা কিনোনা… এখন থেকে অঞ্জনা প্রাণ খুলে যা খুশি করবে, যেটা ইচ্ছে কিনবে, রোজ শপিং এ যাবে। আর বরটাকে কিভাবে সামাল দিতে হয় সেটাও তার বেশ জানা আছে তাই নো টেনশন।
একটা লম্বা হাই তুলে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো অঞ্জনা। কাল সকালে তার শান্তশিষ্ট পত্নীনিষ্ঠ বরটার মুখটার অবস্থা কেমন হবে সেটা ভেবে বেশ পুলক অনুভব করতে করতে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল সে। রাতের দিকে হঠাৎ মনে হলো কেউ যেন ওর গায়ে ধাক্কা দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করছে, অঞ্জনা ভাবলো লোকটা তাহলে সকাল অবধিও অপেক্ষা করতে পারলোনা! মনে মনে বেশ মজা লাগলেও ঘুমোবার ভান করে চোখ বুজে পড়ে রইল সে। কিন্তু লোকটা এমন জোরে ধাক্কা দেওয়া শুরু করল যে অগত্যা চোখ খুলতেই হলো অঞ্জনাকে, এবার চোখ খুলে যাকে পাশে বসে থাকতে দেখলো তাকে দেখে তো ওর মুর্চ্ছা যাওয়ার জোগাড়... এতো বর নয়, স্বয়ং বরের মা! অঞ্জনা অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম করতেই শ্বাশুড়ি মা ধমকে উঠলেন, “এই মেয়ে একদম মুর্চ্ছা যাবে না, ড্যাবা ড্যাবা চোখে আমার দিকে তাকাও বলছি।”
“ম্মা মা… আপনি! মা…আ… আমায়…”
“তোতলা কবে থেকে হলে শুনি?”
“আ… আমায় ছেড়ে দিন মা…”
“এতো সহজে তোমায় ছেড়ে দিই কি করে বলোতো! ছেড়ে দিয়ে তো দেখলাম আমার নিরীহ ছেলেটার ওপর কি অত্যাচারটাই না শুরু করেছো; কি ভেবেছিলে আমি মরে গেছি বলে যা খুশি করবে!”
“না...মা… মানে…না...”
“আমার ছেলের সাথে ঝগড়া করেছো কেন? আবার আমার ছেলেটাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করবে বলে আলাদা শোওয়া হয়েছে!”
“আ… আমি আর কক্ষনো এরকম করবোনা মা… আমায় ছেড়ে দিন।”
“তোমার যা হাবভাব দেখছি ছাড়া তো তোমায় যাবেনা বাপু, তা এখন যাও সে ঘরে। আমার বাছা বলে একলা ঘুমোচ্ছে।”
“এক্ষুনি যাচ্ছি মা, এক্ষুনি যাচ্ছি।”
এক ছুটে ঘরটা থেকে বেরিয়ে এসে সুরেশের পাশে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ল অঞ্জনা। সকালে পাশে অঞ্জনাকে দেখে সুরেশ তো হেসেই খুন, নানারকম ভাবে লেগ পুলিং করতে লাগলো অঞ্জনার, কিন্তু অঞ্জনা সুরেশের ওপর রাগ করতে গিয়েও চেপে গেল। বলা তো যায়না শ্বাশুড়ি মা এক্ষুণি এসে হয়তো ঘাড়টা মটকে দেবেন, তিনি তো বলেইছেন অঞ্জনাকে তিনি ছাড়বেন না।
বছর দুয়েক পরের কথা, আজ অঞ্জনার মেয়ে দিতির দ্বিতীয় জন্মদিন। সকাল হতেই সুরেশ মেয়েকে নিয়ে এলো তার মায়ের ঘরে, পেছন পেছন এলো অঞ্জনা। এরপর তিনজনে মিলে সুরেশের মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে প্রণাম করলো। সেই রাতের পর থেকে অঞ্জনা পারতপক্ষে এই ঘরটাকে এড়িয়ে চলে, যদিও সুরেশ বলেছে সেদিন পুরোটাই অঞ্জনার স্বপ্ন ছিল তাও সেদিনের পরেও অঞ্জনার প্রায়ই মনে হতো শ্বাশুড়ি মা যেন গোপনে নজর রাখছেন ওর ওপর। সুরেশ এরও ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিল প্রেগন্যান্সির টাইমে এরকম মুড সুইং, হ্যালুসিনেশন হয়েই থাকে; সুরেশের কথাটা অবশ্য একেবারে ফেলে দেওয়া যায়না কেননা দিতির জন্মের পর ঐরকম অনুভূতি হওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তাও অঞ্জনা নিতান্ত প্রয়োজন না পড়লে এই ঘরটায় এখনো ঢোকে না। আজ অবশ্য শ্বাশুড়ি মার ছবিটার দিকে তাকিয়ে অঞ্জনার মনে হলো মিছিমিছিই সে ভয় পায়, যে চলে গেছে সে কি আর ফিরে আসে কখনো! নিজের মনেই হেসে ঘর থেকে বেরোতে গেল অঞ্জনা, দিতি পেছন থেকে টেনে ধরলো ওর ম্যাক্সি। অঞ্জনা মাথাটা ফিরিয়ে বললো, “ছাড়ো মা, অনেক কাজ পড়ে আছে আমার।”
ছোট্ট দিতি মুখটা গম্ভীর করে বলে উঠলো, “তোমার যা হাবভাব দেখছি ছাড়া তো তোমায় যাবে না বাপু, তা এখন যাও রান্নাঘরে, পায়েসটা আনো আমার জন্য।”
মেয়ের কথা বলার ধরণ দেখে চমকে উঠলো অঞ্জনা, যে যায় সে কি আর সত্যিই ফিরে আসে না!
***শেষ***