নীল ফুল ও হলুদ পাখী
নীল ফুল ও হলুদ পাখী
নীল ফুল ও হলুদ পাখী
পশ্চিমবঙ্গের ম্যাপের যে জায়গাটা একেবারে সরু হয়ে গিয়েছে, সেই জায়গায় আন্তর্জাতিক সীমানার কাঁটাতার একটি গ্রামকে দুভাগে ভাগ করে দিয়েছে। বিভাজনের আগে কি নাম ছিল মনে নেই, তবে ও দেশের ‘গাঁ’টির নাম রসুলপুর আর এ দেশের ‘গেরাম’এর নাম আঁচল। একটি নীল অপরাজিতা ফুলের গাছ কাঁটাতারের বেড়া বেয়ে উঠে গেছে; যত সবুজ পাতা এতরফে, আর ফুলগুলি ফুটে আছে ওদিকে। একটি হলুদ পাখী ওদিক থেকে উড়ে এসে বসে কাঁটাতারের ওপর। এদিকেও আসে,ডানা ঝাপটিয়ে উড়তে থাকে। কিন্তু এদিকের কোন গাছে বসে না; ক্লান্ত হয়ে আবার চলে যায় সীমানার ওপারে।
গেরামের সব থেকে পুরানো বটগাছের মোটা ঝুরিতে বসে উদাস সুরে বাঁশী বাজাতে বাজাতে রোজ এসব দৃশ্য দেখে নীলকন্ঠ, আর ভাবে, ‘সবই যদি এক, মাটি এক, ঘাসের রঙ এক,গাছের পাতার রঙ এক, মানুষগুলোর রক্তের রঙও এক, তবু কেন এই বিভেদ। যদিও পার্টিশন, স্বাধীনতার যুদ্ধ এ সবই তার দাদুর কাছে গল্প শোনা, তবুও ওদিকের মাটি, মানুষজনের জন্য তার মনটা কেমন কেমন করে। সে ভাবে, ‘এই যে গরু-বাছুরেরা ওদিকের বেড়ে ওঠা গাছের পাতাগুলি মুখ দিয়ে টেনে টেনে খাচ্ছে, ওরা কি জানে এই কাঁটাতারের অর্থ?’
নীলকন্ঠ লেখাপড়া শেখার সুযোগ বিশেষ পায় নি। বেড়ার ধারেই ঘর আর কয়েক ছটাক জমি আছে, যাতে ও পটল, লাউ,কুমড়ো,উচ্ছে, বেগুন ইত্যাদি ফলায় আর তারপর হাটবারে বাজারে বেচে আসে। তাতে তার ও চার বছরের শিবমের কোনমতে দিন চলে যায়। শিবমের মা ওকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়। হঠাৎ’ই রক্তস্রাব শুরু হল। হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে ভোর হয়ে গেল। ততক্ষনে জ্ঞান হারিয়েছে উমা। যে ডাক্তার দিদিমণি বাচ্চার ডেলিভারি করিয়েছিল, সে ছুটিতে। পাক্কা দেড়দিন বৌটা পড়েছিল বারান্দার মেঝেতে। যখন চিকিৎসা শুরু হল, তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। সিস্টার দিদিমনিরা বলাবলি করছিল যে আগেই কি যেন রয়ে গেসল পরিষ্কার হয়নি। নীলকণ্ঠ বুঝতে পারলো না সব; ওকে ভাল করে কেউ কিছু বললোই না। শুধু জেনেছিল যে উমার ‘শরীলে নাকি রক্ত নাই’। সে বেচারা নিজেকেই দোষী সাব্যস্ত করলো। ‘ পুয়াতি বৌটা সারাদিন খেটে খেটে মরতো, একফোঁটা দুধও জোগাড় করতে পারিনি! আমিই অকম্মার ঢেঁকি! আমার দোষেই সে মরলো’ তখন থেকেই উদাসী নীলকন্ঠ অবসর সময়টা এইভাবেই কাটায়। এক বুড়ী পিসী মাঝেমধ্যে আসে, শিবম তখন তার কাছেই থাকে। অন্য সময় পাড়া প্রতিবেশী রহিম চাচা, অন্নদা খুড়ি, সামিন দিদির কোলেপিঠেই সে ঘোরে। এইভাবেই শিবম তরতর করে বড় হয়ে যাচ্ছে। মা কি জিনিষ সে জানেই না। তবুও রাতেরবেলা জ্বরের ঘোরে কখনো প্রশ্ন করে, “বাবা...নিমকি দিদির মা আছে, আমার নাই কেন?”
“সবার কি সব থাকে বাপ? মা না থাউক:আমি তো আছি৷আমি তকে ভালাবাসি না? খেলনা কিনা দিই না? তোর জন্যি রোজ দুধ লিয়ে আসি না?”
“হ বাবা, তুমি খুব ভালা...”
সেই শুনে বুড়ি পিসীটাও ‘বিয়া কর বিয়া কর’ বলে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে; কিন্তু তেমন কাউকে পেলে তো; সৎ মা যদি তার আদরের ছেলেকে মারধোর করে, তখন?
একদিন সে দেখল হলুদ পাখীটা বাচ্চাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। নীল ফুলের ভিতর থেকে পোকা বের করে ঠোঁটে করে বাচ্চাকে খাইয়ে দিচ্ছে। চোখে জল চলে আসে নীলকন্ঠর, ‘আহা রে! আমার শিবম’রে কেউ যদি এমনটা করে যত্ন-আত্তি করত!বুড়ি পিসী আর পারে না,তার তিনকাল গিয়া এক্কালে ঠেকসে...।’ অবশেষে, তার মনোবাসনা পূর্ণ হল। পাখী এল তার ঘরে, হলুদ ছাপা রঙের শাড়ি পরে, রাতের গভীর আঁধারে। খুটখুট আওয়াজে নীলকন্ঠর ঘুম ভেঙে যায়। ভয়ে কাঁপতে থাকা মেয়েমানুষ দেখে তারও গলা শুকিয়ে যায়। তবু সে জানতে চায়,
“তুমি কে গা?কোথ্থেকে আসতেছো…?”
“পানি,পানি দিবা…?”
কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে ওকে খেতে দেয় নীলকন্ঠ।
“উদিকের মেয়েমানুষ বুঝি?”
“হ। ক্যামনে বুঝলা?”
“ঐ যে জলকে পানি কইলে, তা ইদিকে আসলে কেমন করে?”
“জিহাদীদের সঙ্গে…”
নীলকন্ঠ জানে যে প্রায়শই ওপার থেকে অন্য জাতের কিছু লোক এদেশে আসে, সংগঠনের নামে কি সব করে, আবার চলেও যায়। বি.এস.এফ কর্তারা দেখেও দ্যাখে না। কেন কে জানে? মুখ্য-সুখ্যু মানুষ সে, অতশত বোঝে না।
“তা তুমি ওদের ছেড়ে আমার ঘরে ঢুকলে যে?”
“ক’দিনের জন্য এহানে থাকতে দিবা?”
“কি হয়েচে?খুলে কও দিকি৷”
“ওরা ভালা মানষে নয় গো!গুলি, বোমা বানায়। ওদের সঙ্গে মোর কি কাম? কও? আমি ভালা ঘরের মাইয়া…”
“থালে পাইলে আসলে ক্যান?”
“মরদের অত্যাচারে, স্যা অন্য বিবি আনসে, আমায় মারে,খাইতে দেয় না, মুর পোলাডারেও…মুরে তালাক দিসে...”
পাখী মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদে। নীলকন্ঠ প্রসঙ্গ পাল্টায়।
“এই দ্যাখো, তোমার নামটাই তো জানা হয় নাই গো…”
“পাখী…”
‘সেকি! ওদেশের হলুদ পাখীটা শেষ অবধি এদেশে এসে বসলো…!’ পাখীর চোখের জল নীলকন্ঠর মন ভিজিয়ে দিল। সে ওকে থাকতে দিল।
পাখী খুব গুনের মেয়ে, নীলকন্ঠর ভাঙা ঘর পরিপাটী করে গোছায়। শিবমকে মায়ের মত যত্ন করে। রোদ্দুরে সকাল থেকে জল গরম করতে দেয়। তারপর ভাত বসিয়ে শিবমকে তেল মাখিয়ে স্নান করিয়ে দেয়। দলা পাকিয়ে দুধ ভাত খাইয়ে দিয়ে গান গেয়ে ঘুম পাড়ায়। নিজের গলার সোনার মাদুলি, হাতের তাবিজ বিক্রী করে গাই কিনে আনিয়েছে।
“করো কি পাখী!ও গুলান তুমার একমাত্র সম্বল,ও আমি নিতে পারবা না...?”
“ আমার মাথার দিব্যি রইলো নীলু বাবু,পোলাডার দিকে তাকান যায় না।আপনে সারাটাদিন মাঠে খাটেন...দুধ না খাইলে চলবা?”
“তুমি আমায় ঋনের দায়ে ফ্যালছো গো পাখী...”
“কিসের ঋণ? শিবের নামে নাম আপোনার? হিঁদু ঘরের মাইয়ারা ফুল, বেলপাতা চড়ায়।ধরুন আমিও চড়াইলাম,আল্লা আর শিব কি ভেন্ন?”
নীলকন্ঠ বোঝে পাখী তাকে শ্রদ্ধা করে, ভালবাসে। তা নাহলে নিত্যনতুন,কত কি পদ রান্না করে বসে থাকে কেন ওর জন্যে। ওর খাওয়া হলে তবে নিজে খায় কেন? নীলকন্ঠ এমনই একটা মেয়েমানুষ খুঁজছিল; এমনিতেও সোমথ্থ মেয়েমানুষকে শুধু শুধু ঘরে রাখলে গেরামের লোক ছি ছি করবে। তাই আর দেরী না করে ওরা মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করে সুখেই ঘরকন্না করতে থাকে। কিন্তু দুষ্টু লোকের তো অভাব নেই। তারাই পুলিশে খবর দেয় যে নীলকন্ঠ ও দেশের মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছে। নিজামুদ্দিন চাচা দৌড়ে এসে বলে, “অরে নীলকন্ঠ পালা,তোর বউরে নিয়া পালা,পুলিশ আসছে, তরে ধরে নিয়া যাবা…”
নীলকন্ঠ তিলমাত্র দেরী না করে পাখী ও শিবমকে নিয়ে ঝাড়খন্ডে মামার বাড়িতে পালিয়ে যায়। ওখানেই তাদের ভালবাসার সংসার নতুন করে পাতে। ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করে। কিন্তু মাস ছয়েকের মধ্যেই পুলিশ ঠিক ওদের খুঁজে বের করে। গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে নীলকন্ঠকে; মালদার জেলে তার ঠাঁই হয়। বিচার চলতেই থাকে।
ওদিকে পাখী তার স্বামীর অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে। ভাবে, ‘আমি কি অভাগী!যারেই ভালাবাসি তারেই হারাতে হয়। দীর্ঘ তিন বছর পরে আদালতে প্রমাণ হয় যে নীলকন্ঠ অশিক্ষিত, সে নিয়মকানুন না জেনেই ও দেশের মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছিল। তার কোন বদ মতলব ছিল না। তাছাড়া সে তো মেয়েটিকে বিয়েও করেছে। পাখীর কাছে খবর আসে আর ক’দিন পরেই তার মনের মানুষটা ঘরে ফিরবে। আনন্দে আত্মহারা হয় সে। আবার তাদের মিলন হবে। সত্যি কি তাই? না। পাখীকে ওদেশে ফেরৎ পাঠাতে হবে, এই শর্তেই যে ছাড়া পাচ্ছে নীলকন্ঠ। তবে কি পাখী ও নীলকন্ঠের প্রেমের মিলনেও কাঁটাতারের বেড়া উঠবে?
ওরা তিনজনে ফিরে আসে গেরামে। বি. এস. এফের হাতে পাখীকে তুলে দেয় নীলকন্ঠ। আশ্বাস দেয়, “আমি তোমায় ফিরিয়ে আনবই” চোখের জলে বিদায় জানায় তার পাখীকে। পঞ্চায়েতের সাহায্যে, সরকারের মাধ্যমে ওদেশের কনসুলেটে চিঠি পাঠায় সে, তার বউকে যেন ওদেশের সরকার ফেরৎ দেয়। কাঁটাতারের বেড়া তো দুটো ভালবাসি-মনকে আলাদা করতে পারে না। উত্তরের অপেক্ষায় আছে সে। বসে আছে বটগাছের ঝুরিতে। বসে আছে এ পারের নীল ফুল ওপারের হলুদ পাখীর প্রতীক্ষায়। আর তার উদাস বাঁশির সুর, তার ভালবাসার তান বাতাসে ভেসে চলেছে কোন বাধা না মেনে, সীমানা ছাড়িয়ে ।
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
#মূল্যবান প্রেম#