Susmita Goswami

Classics Inspirational

4.0  

Susmita Goswami

Classics Inspirational

নেটদুনিয়ার চক্করে

নেটদুনিয়ার চক্করে

7 mins
613


সকাল থেকে ইনস্টাগ্ৰাম খেয়াল করে, ফেসবুকের মুখ খানি খুব মলিন। ইউটিউব, হোয়াটস অ্যাপ, গুগল সকলেই জিজ্ঞাসা করে করে ব্যর্থ। 

ইনস্টাগ্ৰাম হোয়াটস অ্যাপ কে জিজ্ঞাসা করে, কি ব্যাপার, ফেসবুক বন্ধুর মুখ ভার কেন? 

জানি না ইনস্টা ভায়া, আমি তো বুঝতে পারছি না ফেসবুকের এত মন খারাপ এর কি আছে, ওর কত অনুগামী, কত মানুষ ওকে অনুসরণ করছে অথচ ওকে দেখো, মুখটা হাঁড়ি পানা করে রেখেছে!

ইউটিউব একটু গম্ভীর হয়ে বলে, না না তোমরা যেমন ভাবছ ব্যাপারটা কিন্তু আমার তা মনে হচ্ছে না একদম। 

এই বলে ইউটিউব জিজ্ঞাসা করে ফেসবুক কে, এই ভাই তোমার হয়েছে কি বলোতো? না বললে আমরা বুঝব কি করে বলোতো? 

ফেসবুক কিছুক্ষণ থেমে থেকে বলে, আচ্ছা আমরা কি সত্যিই মানুষের ভালো করতে পারছি? 

সকলে বলে ওঠে, আলবাত করতে পারছি, কেন পারব না। এই দেখো গুগল সকলকে নানা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, ইউটিউবও প্রায় সেই কাজ করছে, পড়াশোনা, খেলাধুলা, মনোরঞ্জন, ওয়েবসিরিজ কি নেই শুনি আমাদের মধ্যে যা মানুষের অভাব পূরণ করতে ব্যর্থ হবে? 

ফেসবুক চুপ করে শোনে। 

হোয়াটস অ্যাপ বলে বুঝতে পেরেছি ফেসবুকের মনে হয়েছে আমরা মানুষের ভালো করতে পারছি না। আচ্ছা ফেসবুক তাহলে তুমিই বলো, কোথা থেকে তোমার মনে হচ্ছে যে আমরা এতগুলো পপুলার অ্যাপ মানুষের খারাপ বৈ ভালো করছি না?

ফেসবুক বলে, গুগলের কথাই ধরি, ও যে বলল সবার সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে আরো অনেক কিছু করছে মানুষের হিতকর্মে কিন্তু আদৌ কি সেটা হিতকর্ম? 

কেন ,কেন ,একথা কেন বলছ? সকলে বলে ওঠে একসাথে। 

গুগল সব উত্তর দিচ্ছে ফলে সব ছাত্রছাত্রীরা ইন্টারনেট নির্ভর ও বলা ভালো ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়ছে। ওদের মনে সবসময়ের জন্য ধারণা জন্মাচ্ছে যে, আমি না পারলে কি হয়েছে, গুগল তো আছে, সেখানে সার্চ করলেই তো বেরিয়ে আসবে। 

কিন্তু কিছু প্রশ্নের উত্তর তো আমিও বের করতে পারি না, বলে গুগল। 

পারো না আর সেটাই একজন ছাত্র বা ছাত্রীর পক্ষে আদর্শ আর ঠিক কাজ। তুমি যেই উত্তরটা বার করতে পারলে না অমনি সেই স্টুডেন্ট সেই উত্তরের খোঁজে ব্যাকুল হয়ে উঠবে আর অনেক অনেক চেষ্টা করবে খুঁজে বের করার আর তার ফলে তার আত্মবিশ্বাস বাড়বে। 

গুগল বলে, তুমি কথাটা খুব একটা ভুল বলোনি ফেসবুক। সত্যিই আমি এখনকার সব ছেলেমেয়েদের দেখি তারা বইয়ের সাথে যেন সব সম্পর্ক চুকিয়ে বুকিয়ে দিয়েছে। সবসময় শুধু ওয়েবসাইট আর সার্চ এই ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই তাদের মুখে।

ফেসবুক বলে, হ্যাঁ গুগল তুমি ঠিকই বলেছো। কিন্তু আমরা কিই বা করতে পারি? বলে সকলে। 

হোয়াটস অ্যাপ বলে, তোমার কথা শুনে এখন আমিও বুঝতে পারছি ফেসবুক, আমার প্রতিও মানুষ অপব্যবহার টাই করছে। সারাক্ষণ ধরে, সারারাত ধরে অনলাইন থেকে চ্যাট, ভিডিও কল ইত্যাদি তে সবসময় মেতে থাকে আজকের দুনিয়া। আগে মাঠে ছেলেমেয়েরা খেলতে যেত, মধ্যবয়সী মানুষেরা পার্কে, গ্যালারী তে খেলা দেখত, আড্ডা দিত, সারাদিন কাজের পর খোশ গল্প হতো, সপ্তাহান্তে কফিহাউসে একসাথে দেখা, অসাধারণ মজা করা। কিন্তু আজ সেসব হারিয়ে গেছে এই নেটদুনিয়ার চক্করে পড়ে! এই বলে হোয়াটস অ্যাপ অত্যন্ত হতাশ বোধ করে। 

ইউটিউব বলে, আমার একটা মত আছে এখানে। দেখো আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো মানুষের তৈরি অ্যাপ। একজন অ্যাপ ডেভেলপার আমাদের ভালো ও মন্দ দুই গুণ দিয়েই তৈরি করেছেন। এখন অধিকাংশ মানুষ যদি আমাদের ভালো গুণ বা ভালো কাজ না খুঁজে শুধু খারাপ টার পেছনে ছুটে বেড়ায়, তাহলে আমরা কি করতে পারি? 

ইনস্টাগ্ৰাম এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল, এবার সে বলে ওঠে, এটা ইউটিউব একদম ঠিক কথা বলেছে। সত্যিই তো গুগল, ফেসবুক বা ইউটিউব বা আমার মধ্যে বা ধরা যাক সারা নেট দুনিয়ায় ভালো কিছু কি নেই, প্রচুর আছে, একটু খুঁজলেই পাওয়া যায়। কিন্ত সবাই খারাপের পেছনে ছোটে, মরীচিকার পেছনে ছোটার মতো। 

গুগলে কত ভালো ভালো জ্ঞানমূলক কন্টেন্ট আছে, কত সুন্দর সুন্দর লেখা আছে, কত জানার জিনিস আছে। আরে, বই যখন পড়ছিস না তখন ফোনেই না বইপত্রের মতো নানান তথ্য, গল্প পড়। তা না, খালি পরীক্ষার সময়ে টুকলি করতে গুগলে উত্তর খোঁজে, হায় রে যুবসমাজ!  

পড়ার জিনিস, শেখার জিনিস, জানার জিনিস সার্চ না করে পর্ন ভিডিও সার্চ করছে, কিছু বলার নেই আজকালকার ছেলেমেয়েদের ! 

ইউটিউব হাসে, বলে, ঠিক তাই, আমি তো একদিন দেখছিলাম, একটা ছেলে তার ফোনে পড়ার টিউটোরিয়াল ভিডিও দেখবে বলে ইয়ারফোন কানে গুঁজে আমাকে ওপেন করল অথচ সার্চ এর বেলায় মিয়া খলিফা বা সানি লিওন। অনেক পরে আমি বুঝলাম ছেলেটার বাবা মা অনেক কষ্ট করে এই ফোন টা কিনেছে ছেলে যাতে অনলাইন ক্লাস করতে পারে আর ছেলে কি উন্নতিই না করছে! মা যাতে বুঝতে না পারে তাই বলল পড়ার ভিডিও দেখব, সত্যি!!  

ফেসবুক বলে বুঝতে পারছ নিশ্চ্য়ই কেন আমার মনটা এত খারাপ ছিল !

 সকলে মিলে বলে, হুম বুঝতে তো পারছি কিন্তু মানুষ যদি নিজের খারাপ নিজে চায় তাহলে তাকে কেউ সে কাজ থেকে সরাতে পারে না। 

ফেসবুক খুব বিষাদগ্ৰস্ত হয়ে বলে, এই আমাকেই দেখো না, আমার মধ্যে কত স্টোরি জমা হয়। কেউ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে তো কেউ আবার প্রতিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। গাছ কাটছে, সেই ছবি তুলে সঙ্গে সঙ্গে পোস্ট করে দিল আমার মধ্যে। কোনো বধূ নির্যাতনের শিকার অমনি ঝুরি ঝুরি লেখা লিখে পাঠিয়ে দিল আমার মধ্যে। কোনো ধর্ষিত মেয়ের প্রতি অন্যায়ের বিচার না হয়ে শুধু পোস্ট, শেয়ার আর লাইকের ঝড়। এই তো হয়েছে দুনিয়া! কৈ একবারও কি কারোর মনে হয় না ঐ ধর্ষিত মেয়েটির পাশে দাঁড়াই, একবার না হয় নাই জানালাম আমার কৃতিত্ব। কারোর ভালো করেছি এই কথাটা তো সকলে বলবে। তা না হয় যে যার নিজের বড়াই নিজেই করছে। একবারও মনে হয় না রাস্তার ঐ ক্ষুধার্ত কুকুরটাকে একটা মাত্র পচা রুটি দিয়ে আমার মধ্যে ছবি পোস্ট আর চারটে ভালো ভালো লেখা না লিখে যদি রাস্তার ঐ কুকুরটাকেই দুটো ভালো রুটি দেওয়া যায়, সেটা তুলনামুলক শান্তির ঐ অত লাইক, শেয়ার পাওয়ার থেকে! কোনোদিন মনেও হবে না। জোর করে তো কিছু হয় না, নিজে না চাইলে। একদিন যদি গাছ কেটে ফেলার ছবি পোস্ট করে নিজে সকলের উদ্দেশ্যে উপদেশ বার্তা না দিয়ে যদি নিজেই সেই গাছটা কাটতে বাধা দিত, সত্যি বলছি আমি হয়ত কিছু দিতে পারতাম না তাকে কিন্তু মনে মনে তাকে ও তার কাজকে ঠিক শ্রদ্ধা জানাতাম। 

ইনস্টাগ্ৰাম বলে, হ্যাঁ বন্ধু তুমি ঠিক বলেছো। যদি কেউ উপদেশ বাণী বা ভালো ভালো কথাগুলো অনুসরণ করে নিজেও ভাল কাজ করতে পারত তাও কাজের কাজ হতো। একজন লেখে লাইক পাওয়ার জন্য আর একজন পড়ে সেটা কপি পেস্ট করে নিজের নামে ছাপানোর জন্য। ভাবলেও হাসি পায়! 

ইনস্টাগ্ৰাম বরাবর খুব মজার মজার কথা বলছে, সকলের খুব হাসি পাচ্ছে। 

হঠাৎ করে Snap chat হাজির, সে এসেই বলে , আরে তোমরা সবাই আমাকে তো ভুলেই গেছো একেবারে !

আরে এসো এসো, তোমাকে কি ভোলা যায়! সবাই বলে তাকে। 

হুম একদম ঠিক, আমি তো সবার আসল মুখটাকেই এডিটিং এর মাধ্যমে পাল্টে দিই বলে হাসে Snap Chat.

সবাই হাসে। এরপর গুগল এক সুন্দর বক্তব্য রাখে। সে বলে, ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্ৰাম ও স্নাপ চ্যাট বন্ধু, তোমাদের সকলের উদ্দেশ্যে বলি, একজন ডেভেলপার যেমন অনেক কষ্ট সাধ্য করে, মানুষের ভালো কাজের জন্য যেমন একটা ভালো ও খারাপ দুই গুণ সম্পন্ন অ্যাপ তৈরি করেন। তেমনভাবেই মানুষের মধ্যেও দুই প্রকার গুণ। ভালো হলে সে সবকিছুর মধ্যে ভাল খুঁজবে, ভাল ব্যবহার করবে, ভালো কে অনুসরণ করবে আর সে নিজেও ভালো টা কেই ছড়িয়ে দেবে। এই ধরো অনেক মানুষ আছে যারা প্রত্যেক টা স্থান থেকে ভালো সংগ্ৰহ করে, ভালো টা কে জানে। ভালো টাকেই ছড়িয়ে দেয় সকলের মাঝে। এবার ভালোরাই ভালোর সংগ্ৰহ করবে। আর খারাপ দেখলে তার সংশোধন করার চেষ্টা করবে।


উল্টোদিকে যারা খারাপ মানসিকতার মানুষ, তাদের মধ্যে সবসময় খারাপ করার প্রবণতা, খারাপ মানসিকতা, ঠকানোর মানসিকতা। তারা ভালো কে অনুসরণ করেই না বরং "ভালো" এই ব্যাপারটা থেকেই তারা অনেক দূরে দূরে থাকে। আর তাই তো একজনের কাছে স্মার্টফোন দেবতুল্য তো একজনের কাছে ওষুরতুল্য ! 

বিজ্ঞান আশীর্বাদ ও অভিশাপ দুটোই, তবে সেটা কার জীবনে কি প্রভাব বিস্তার করবে সেটা পুরোটাই তার নিজের উপরেই নির্ভরশীল। আমাদের একার চেষ্টায় কিছু হবে না। লোকেদের নিজেদেরকে নিজে ঠিক করতে হবে যে তারা কোন পথ বেছে নেবে। 

ফেসবুক বলে, খুব সুন্দর বললে গুগল। আমি আর মন খারাপ করব না। ঠিকই তো, হয়ত সত্যিই অনেক ভালো মানুষ আছে যাদের কেউ আমার মধ্যে খুঁজে পায়নি, কিন্তু সেই ব্যক্তি গাছ কাটা আটকাচ্ছে হয়ত বা ধর্ষিতা মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছে শ্রীকৃষ্ণের মতো অথবা অন্য কোনো ভালো কাজে নিজেকে যুক্ত রেখেছে। কটা লোকের খবরই বা কজন পায়? শুধু সেলিব্রিটিদের প্লাটফর্ম হয়ে গেছে এই সোশাল মিডিয়া। সাধারণ মানুষের প্রতিভা বেশি কিন্তু তা প্রকাশের অভাব বলেই আজকের দিনেও অজানা আছে অনেক ভালো মানুষ। আমি চাই তারা অনলাইন বা সোশাল মিডিয়ার দ্বারা লাইক, কমেন্ট, শেয়ার পেয়ে নয়, তারা যেন সকল মানুষের মধ্যে , সশরীরে , সুশিক্ষা ছড়িয়ে দিতে পারে। কখনো যেন কাউকে বলতে না হয় যে সোশাল নেটওয়ার্ক ঠকবাজির জায়গা। কাউকে যেন বলতে না হয়, Beware of the Online Predator. সবাই ভালো হোক, হোক সবার চেতনা, ঠিক জিনিসের সদ্ব্যবহার শিখুক সকলে, ছড়িয়ে পড়ুক জ্ঞান, সুশিক্ষা। মন থেকে আসক্তি সরে গিয়ে ভালোবাসা আসুক। কেউ যেন বলতে না পারে সোশাল মিডিয়া ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত নষ্ট করছে না বরং সবাই যেন নিজেদের নিজেদের ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে গোটা যুবসমাজটাকে সুন্দর করে তোলে। নিশ্চ্য়ই একদিন ছাত্রসমাজ বইকে বুকে রেখে বলবে, আমরা যে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছি সেই শিক্ষার আলো আমরা সোশাল নেটওয়ার্কেও ছড়িয়ে দেবো। সবাই ভালো শিখবে, ভালো করবে, ভালো মানুষ তৈরি হবে। 

গুগল এতটা বলে থামে আর সকলে আশা নিয়ে একসাথে বলে ওঠে, "এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে? "


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics