নারায়ণী ভিলা
নারায়ণী ভিলা


নামটা শুনতে একটু অদ্ভুত লাগলেও শিবতোষবাবুর এই নামই খুব পছন্দের ছিল। খুবই মোহময়ী পরিবেশে তৈরি এই ভিলা। তিনতলা ঝাঁ চকচকে বাংলো। চারপাশে বুগেনভিলিয়া এবং আরো অনেক আধুনিক গাছপালায় ভর্তি। ছাদ থেকে ঝুলছে বাহারী গাছের পাতা। আরো কতো রকম সুন্দর গাছের আর টবের সমারোহ।
শিবতোষবাবুর পত্নী বছর পাঁচেক হল গত হয়েছেন। মেয়ে নিকিতা বাইরে থাকে। পড়াশুনা করছে। একা বাড়িতে তাঁর সঙ্গী বলতে এই গাছপালা আর বাদ্যযন্ত্র। হরেক রকম বাদ্যযন্ত্র পাওয়া যায় তাঁর কাছে। একটা ঘর শুধু এইসব বাদ্যযন্ত্রে ঠাঁসা। পত্নী বিয়োগের পর এই দুই শখই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
সকালবেলা উঠেই গাছে জল দেন তিনি। ঘুরে ঘুরে সব গাছগুলোয় জল দিতে দিতে পাতাগুলোর সাথে কথা বলেন। কতো দিনের তাঁর মনের মধ্যে জমে থাকা কতো কথা বলেন তাদের কানে কানে। গায়ে হাত বুলিয়ে স্পর্শ করে মনের পরশ পান তিনি.... আলাদা এক সুরভিতে ভরে ওঠে তাঁর মনপ্রাণ।।
শিবতোষবাবুর রেওয়াজের সময় সন্ধ্যাবেলায়। তখন তাঁর এস্রাজের শব্দে চারপাশ গমগম করে ওঠে। এমনিই নারায়ণী ভিলা একটু ফাঁকা জায়গাতেই দাঁড়িয়ে। তাই জ্যোৎস্নাস্নাত সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গীত এক অপরূপ রমণীয় পরিবেশের সৃষ্টি করে।।
এহেন হঠাৎ একদিন তাঁর বাড়িতে এক নতুন অতিথি সমাগমের সম্ভাবনা উপস্থিত। আসলে এক নতুন মানুষ তাঁদের এলাকায় থাকতে এসে হঠাৎ ই বিপদে পড়ে গেছেন। তাঁকে বাড়ি দেওয়ার কথা হলেও শেষ মুহূর্তে কথার খেলাপ করে লোকটা। এরপর অবধারিত ভাবে পাড়ার কিছু লোক এসে ধরেন বিচক্ষণ ঠান্ডা মাথার ভালো মানুষ শিবতোষবাবুকে। একজন কথা বলার সঙ্গী পাবেন বলে বা বিপদ থেকে তাকে উদ্ধারের জন্য, যে কারণেই হোক না কেন,, তিনি সাথে সাথেই রাজি হয়ে যান।।
নতুন অতিথিটি কিন্তু খুবই অদ্ভুতুড়ে মানুষ। লম্বা চওড়া একটু গম্ভীর প্রকৃতির। নারায়ণী ভিলা এমনিতেই একটু ফাঁকায় অবস্থিত,, তার চারপাশে বেশ কিছু ফাঁকা গা ছমছমে জায়গায়.... যেখানে কেউ কেউ দিনের বেলা যেতেই ভয় পেত.. সেইসব জায়গায় ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। শিবতোষবাবুর মতোন শৌখিন তো একেবারেই নন.. বরং তাঁর ঘর দেখলে ধারণা হবে যে বুঝি একটু নোংরাতেই থাকতে ভালোবাসেন তিনি। ভদ্রলোকের নাম কুন্তল সেন। একটু অদ্ভুত হলেও শিবতোষবাবু একটা কথা বলার সঙ্গী পেয়েই একটু বাঁচলেন যেন। আবার ইনি তাঁর সঙ্গীতেরও একজন ভাল শ্রোতা। চুপ করে বসে শোনেন। কথা একটু কমই বলেন নিজে। দিন কেটে যাচ্ছিল ভালই,, যতোক্ষণ না কিছুদিন পর থেকে এমন সব ঘটনা ঘটা শুরু হল এই নারায়ণী ভিলায়.... যা শিবতোষবাবুর কিছুটা হলেও চিন্তার উদ্রেক করল।।
একদিন যেমন রোজকারের মতোন সকালে উঠে দেখেন কুন্তলবাবু নিজের ঘরে নেই। খুঁজতে গিয়ে তাকে পূবদিকের বারান্দায় একটি দড়ি বেয়ে উঠে আসতে দেখা গেল! ধরা পড়েই তার মুখ কাঁচুমাচু,, কোনো কথা না বলে কোনোমতে পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। আর এক দিন.... তাঁর অনেক দিনের পুরোনো কাজের লোক বদ্রী বলল সে নাকি কুন্তলবাবুকে তাঁর বাদ্যযন্ত্রের ঘরে ঢুকতে দেখেছে এবং তারপর সেখান থেকে কিছু অদ্ভুত আওয়াজ শোনা গেছে!! এমনিতে নারায়ণী ভিলায় কোনো ঘরই আলাদা করে তালাবন্ধ হয়ে থাকতোনা। মুক্ত বাতাস সব জায়গায় সমান ভাবেই খেলা করত। তাই কুন্তল বাবুর ও অবাধ যাতায়াত ছিল সব জায়গাতে একইভাবেই। এমনিতে হাসিখুশি নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ হলেও এইরকম কিছু কিছু অদ্ভুত ঘটনা তাঁকে একটু চিন্তান্বিত করল।।
সমস্যার কিছুটা সমাধান হয় হঠাৎ নিকিতার কদিনের জন্য এখানে ছুটি কাটাতে আসার কথায়। আগে ঠিক ছিল না বলে, শিবতোষবাবু খুব একটা প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ ই পান না। ভাবেন ও এলে পর এই অদ্ভুতুড়ে ব্যাপারগুলোর কথা জানাবেন ওকে!! এরই মধ্যে কুন্তলবাবু একদিন সকালবেলা এসে অনেক্ষণ গল্প করে গেলেন তাঁর সাথে.. দিব্য সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ, কোনো অস্বাভাবিকত্ব চোখে পড়ল না। অথচ.. তবে মাঝে মাঝে এমন কাজ কেন করেন তিনি!! যাক্, আর এই নিয়ে বেশী ভাববেন না, পরে মেয়ে এলে দেখা যাবে, ভাবেন শিবতোষবাবু। এ নিয়ে পাড়ার কারুর সাথেও কোনো আলোচনা করেননি তিনি।অনেক বিশ্বাসে তাঁর কাছে কুন্তলবাবুর থাকার কথা বলেছিলেন তারা।।
মাঝে শুধু বদ্রীর সাথে কুন্তলবাবুর দু একবার ঝামেলা লেগে যাওয়া ছাড়া আর খুব একটা কোনো উৎপাত এই কদিনে নারায়ণী ভিলায় হলনা।
দিনকয়েক পরে একদিন দুপুরবেলা নাগাদ নিকিতার আবির্ভাব হল। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংলিশ অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পরে। বুদ্ধিমতী চটুল স্বভাবের মেয়ে। এসেই সকলের পিছনে লেগে মজা করে বাড়ি মাতিয়ে রাখল। নারায়ণী ভিলা আবার গমগম করতে লাগল। শিবতোষবাবুও খুব খুশী.. এর ই মধ্যে একদিন কাছেই এক জায়গায় চড়ুইভাতি করা স্থির হল। গাছপালায় ঘেরা সুন্দর জায়গা পাশে একটা মন্দির ও আছে। পাড়ার আরো কয়েকজনও যাবেন ঠিক হল। আর শিবতোষবাবু বদ্রী ও তাঁর কন্যা। কুন্তলবাবুর কথাটা তিনি আসার রাতেই নিকিতার কাছে পেড়েছিলেন। তাঁর মতোন সেও খুব অবাকই হয়েছে, যদিও বাবার কাছে সেটা আর প্রকাশ করেনি, পাছে তিনি চিন্তা করেন, বলেছে..
"ও কোনো ব্যাপার নয়, আমার মনে হয় উনি কেবল একটু খেয়ালী মানুষ।
কুন্তলবাবু কিন্তু তাদের সাথে যাওয়ার ব্যাপারে এক পায়ে খাঁড়া। বললেন এখানে আসার পর থেকে নাকি আর তার তেমন কোথাও যাওয়াই হয়নি, তাই তিনি অবশ্যই যাবেন।।
নির্দিষ্ট দিনে সকালেই জলখাবার খেয়েই রওনা হয়ে পড়ল সকলে। দুটো গাড়িতেই মোটামুটি ধরে গেল। শিবতোষবাবুর গাড়িতে তার কন্যা সহ কুন্তলবাবুও ছিলেন। নিকিতার সাথে অনেক গল্প করতে লাগলেন, তিনিও দিল্লী তে কিছুদিন ছিলেন কাজের জন্য, সেই সব গল্প। কোলকাতা শহরেই তাঁর জীবনের বেশীরভাগ সময়টা কেটেছে। বাইরেই জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েও কেন এখানে এই মফস্বলে থাকতে এসেছেন, এ প্রশ্ন নিকিতার মনে জাগলেও এই নিয়ে এক্ষুনি কোনো কথা বলা সে সমীচীন মনে করল না।।
যতোক্ষণ কুন্তলবাবুর সাথে কথা হল, নিকিতা কোনো অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করল না তার মধ্যে। যদিও তার বাবার মুখে সে শুনেইছিল যে কিছু অদ্ভুত ঘটনা বাদ দিলে, তিনি যথেষ্ট ই রুচিশীল শান্ত স্বভাবের মানুষ।।
ওখানে পৌঁছে আগেই সকলে একটা শতরঞ্চি পেতে হাত পা ছড়িয়ে বসলেন। কাছেপিঠেই কোথাও একটা ছোট জলপ্রপাত আছে। কথা হল, একটু বসে নিয়েই সেদিকেই যাবেন সকলে। রান্নার লোক সাথে আনা হয়েছিল, মেনু ঠিক হয়েছিল ভাত আর মাংস। অনেক সময় আছে পরে চাপালেও হবে। যদিও মেয়ের আব্দারেই প্রধানত: আসা,, তবুও বাকি সকলের মতোন শিবতোষবাবুরও এই সুন্দর মনোরম পরিবেশ খুবই ভালোলাগতে লাগলো। বাড়ির থেকে বড়ো একটা কোথাও বেরোতেনন না তিনি। এই মুক্ত পরিবেশে খোলা আকাশের নীচে তার মনও যেন এক অনন্য অনুভূতি লাভ করল। হঠাৎ তিনি খেয়াল করলেন, কুন্তলবাবুকে কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। এদিক ওদিক তাকালেন, না তো!! অথচ বাকি সবাই তো আছে!! কথাটা নিকিতার কাছে পাড়বেন মনে করে উঠতে যেতেই, দেখলেন সেও উৎসুক মুখে ইতিউতি দেখছে। হঠাৎ বদ্রী প্রায় লাফাতে লাফাতে সেখানে হাজির.. মুখে বক্র হাসি....
" কত্তাবাবু, দেখবেন আয়েন.. আমাদের পাগলবাবুর কান্ড!!
বলেই খিকখিক করে হেসে উঠল।।
কুন্তলবাবুকে সে আড়ালে 'পাগল' সম্বোধন করত। শিবতোষবাবু বেশ অবাক হয়েই উঠে দাঁড়ালেন। যেই দিক থেকে বদ্রী এসেছিল, সেই দিকে.. অর্থাৎ মন্দিরের দিকটার উদ্দেশ্যে হাঁটা লাগালেন। নিকিতা ও পাড়ার কিছু মানুষও চললেন সাথে। কিছু দূর যেতেই এক পরমাশ্চর্য ঘটনা চোখে পড়ল সকলের। সামনে বেশ কিছু গ্রাম্য বাচ্চা খেলাধুলা করছে,, তাদের সাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে উচ্চৈঃস্বরে আনন্দধ্বনি করতে করতে সমানভাবে খেলায় রত কুন্তলবাবু!! কি অবাক কান্ড। অতো বড়ো চেহারার মানুষটা লাফিয়ে লাফিয়ে তাদের সাথে কিতকিত খেলছেন পরম আনন্দের সাথে!! হঠাৎ তাদের দিকে চোখ পড়াতেই কুন্তলবাবু কেমন যেন গুটিয়ে গেলেন। কাঁচুমাচু মুখ করে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে পড়লেন। সকলেই বেশ অবাক হয়ে এ ওর মুখ তাকাতাকি করতে লাগল। শিবতোষবাবু তখন সেখানে প্রস্তুত বাকি সকলকেও আগের ঘটনাগুলি খুলে বললেন আর এটাও জানিয়ে দিলেন যে আর ওনার পক্ষে কুন্তলবাবুকে এখানে রাখা সম্ভবপর নয়। এই দৃশ্য দেখার পর কেউ ই আর কিছু বলতে পারলেন না। ঠিক হল আজ ই ফিরে গিয়ে ওনার সাথে এই নিয়ে কথা বলা হবে।।
সেদিন অনেক আনন্দের পর সকলে যখন ফিরলেন, তখন আর এই নিয়ে কথা বলার কারুরই কোনো ইচ্ছা হল না। পরের দিন সকাল হতেই শিবতোষবাবু তাঁর বারান্দার চেয়ারে বসে পাশে বসা কুন্তলবাবুর কাছে কিভাবে কথাটা পাড়বেন সবে ভাবছেন,, এমন সময় উনি নিজেই বলে উঠলেন....
"শিবতোষবাবু, আপনি আমার জন্য যা করেছেন, তা নিজের লোক করে কি সন্দেহ। আমার বাড়ি কোলকাতায় তা তো সকলেই জানেন। একটাই ছেলে.. পড়াশুনা করার জন্য বাইরে পাঠিয়েছিলাম। সেই বুঝি আমার কাল হল। সেই যে গেল, আর ফিরল না। ওর মা সেই দু:খে ওর পথ চেয়ে থাকতে থাকতেই কখন অনেক দূরে চলে গেল। সেই ছোটবেলার কথাই খালি মনে পড়ে.. সবসময় আমার কাছে থাকতো, কাছ ছেড়ে কোথাও যেতোনা, সব কিছুতে বাবা মা ছাড়া ওর এক দন্ড চলত না। ওর এক বন্ধুও ছিল সেখানে কদিন.. ওর মুখ থেকেই শুনেছি সেখানে নিজের বাসা বেঁধে সে দিব্যি আছে।
এতো অব্দি বলে থামলেন কুন্তলবাবু। চোখ ছলছল করছে। থ হয়ে শুনছিলেন শিবতোষবাবু আর নিকিতা। একটুক্ষণ সকলেই চুপ। কুন্তলবাবুই আবার বলে উঠলেন....
"তারপর থেকেই, বুঝলেন,, একটা ছেলেমানুষিতে পেয়ে বসেছে আমায়। বাচ্চারা যেমন করে,, যেমন ভাবে.. তেমন করতে, ভাবতে ভালবাসি। শহরে প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছিল। তাই এখানে চলে আসি। বাচ্চাদের সাথেই থাকতে মিশতে আমার ভাললাগে বেশী। জানিনা হয়তো রুদ্র, আমার ছেলের নাম, হয়তো ওর সেই শিশুকালটাকে আর পেরিয়ে উঠতে পারিনি আমি। হয়তো তারপর থেকে ওকে আর চিনতেই পারিনি....
স্তব্ধতা প্রথম ভাঙলেন শিবতোষবাবু। মাথা নিচু করে বসে থাকা কুন্তলবাবুর হাতদুটো ধরে বললেন..
"আসলে এমন অনেক কিছু আছে যা এখনো আমাদের চিন্তা ভাবনার থেকে বেশ কিছু আলাদা। সেটা বোধহয় আমরা মাঝে মাঝে ভুলে যাই। তাই আমাদের চেনা গতের বাইরে কেউ কিছু করলেই সেটা আমাদের কাছে 'পাগলামি' মনে হয়। আপনি তো খারাপ কিছু করেন নি। কষ্ট নিয়ে পড়ে না থেকে আরো অনেকের মধ্যে আপনার মনের আনন্দ বিতরণ করে একটু ভাল থাকতে চেয়েছেন। এইটুকুও আমাদের সহ্য হল না.. কি কান্ড বলুন তো!! বলে একটু দু:খসূচক ভাবে ঘাড় নাড়লেন। নিকিতাও এতোক্ষণ প্রায় স্তব্ধ হয়েই সবকিছু শুনছিল। এবারে এগিয়ে এসে তার বাবার পাশে দাঁড়িয়ে বলল...
"কাকু তাহলে এবার থেকে আমাদের এখানেই থাকবেন কি বল,,বাবা.. আর নারায়ণী ভিলায় তোমরা দুজনে একসাথে নতুনভাবে প্রাণ বিতরণ করবে।।