Meghna Dutta

Horror Classics Crime

3  

Meghna Dutta

Horror Classics Crime

মৃত্যুঞ্জয় মেশিন

মৃত্যুঞ্জয় মেশিন

6 mins
321



ঠাকুমাকে কোনোদিন চোখে না দেখলেও তাঁর মৃত্যু সংবাদে বেশ কষ্ট পেলো অপরাজিতা। শেষ বয়সে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার ফলে আসামে একা থাকতেন, কারোর সাথে দেখা করতে চাইতেন না- সেই জন্যই অপরাজিতার আর নিজের ঠাকুমাকে কোনোদিন দেখা হয়নি।

রাতের ফ্লাইটেই আসাম পৌঁছাতে হল ঠাকুমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য। জোরহাটে বিশাল বাগানবাড়ি অপরাজিতার পূর্বপুরুষদের, সেইখানেই নিজের শেষ জীবন কাটিয়েছেন তার ঠাকুমা। ঠাকুমার মুখটি প্রথম ও শেষ বারের জন্য দেখে নিল- কেমন যেন একটা অনুতাপের ছাপ মুখে, দেখে মনে হয় মৃত্যু যন্ত্রণার থেকেও ভয়ংকর কোনো যন্ত্রনা সহ্য করেছেন শেষ জীবনে।

শ্মশান থেকে ফিরে এসে রাতে আর ঘুম এলো না অপরাজিতার, শুয়ে ভাবলো কাল পুরো বাড়িটি ঘুরে দেখবে। একই সঙ্গে তার মনে অনেকগুলি প্রশ্নের উদয় হল যেমন- কেনই বা তার ঠাকুমার মাথা খারাপ হয়েছিল? কেনই বা তার বাবা মা একটি বারের জন্যেও তাকে ঠাকুমার কাছে আসতে দিত না? কেনই বা তার মন বলছে তার জীবনে একটা বড় কিছু ঘটতে চলেছে?

সকালে পরিচারিকা ডোমার হাতের লুচি তরকারি খেয়ে মা-বাবার চোখের আড়ালে পুরো বাড়িটি ঘুরে দেখতে গেল অপরাজিতা। বিশাল তিন তলা বাড়ি, প্রত্যেক তলায় চারটি করে ঘর- সব ঘরেরই দরজা আটকানো, তবে তালা দেওয়া নেই একটিতেও। নিচের ঘরগুলির একটিতে দেওয়ালে প্রচুর ছবি টানানো- সব ছবিতেই তার ঠাকুমা আছেন আর তাঁর সঙ্গে এক-একজন করে বিদেশি ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা। ঘুরতে ঘুরতে সে গিয়ে পৌঁছালো তিন তলায়, সব ঘরই দস্তুর মতো বন্ধ করা শুধু একটি ঘরে তালা দেওয়া! তার আগ্রহ হলো ওই ঘরটিতে প্রবেশ করার- কিন্ত চাবি কই?

রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে সে নীরবতা দূর করবার জন্য তার বাবা কে জিজ্ঞেস করল সেই ছবিগুলির কথা।

"বাবা ঠাকুমার পাশে ওই বিদেশি মানুষগুলো কারা?"

- " যখন তুই জিজ্ঞেস করলই তখন আর লুকিয়ে লাভ নেই..... তোর ঠাকুমার পুরো নাম ড. শ্রেষ্ট্যা সম্মাদার। মা একজন বৈজ্ঞানিক ছিলেন। Harvard থেকে পড়াশুনা করেছিলেন। আসামে একটি বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে বাবার সাথে প্রথম পরিচয়। বিয়ের পর মা আসাম উনইভেরিসিটিতে শিক্ষকতা করতেন।" বলে সমরেশ একটি দীর্ঘনিঃস্বাস ছাড়লেন।

"আমার ঠাকুমা একজন scientist ছিলেন আর তোমরা আমায় কোনোদিন জানাও অব্ধিনি?"

- "বিজ্ঞানই তাঁর মাথার গন্ডগোলের কারণ রে অপু। সেই সময় আমি বিদেশে ছিলাম তাই ঠিক জানিনা কি হয়েছিল তবে বাবা বলতেন 'বিজ্ঞানের জন্যই তোর মা পাগল হয়েছে।' যাকগে এইসব স্মৃতি আর না মনে করাই ভালো।"


বাবা শ্রাদ্ধের কাজের জিনিস জোগাড় করতে সকালে বেরিয়ে যাওয়ার পর অপরাজিতা আর তার মা তার ঠাকুমার জিনিসগুলি ঘাটাঘাটি করে দেখছিল। তার মধ্যে একটি পুরোনো ডাইরি পেলো সে, ওপরে ইংরেজি অক্ষরে লেখা - 1989, বুঝতে পারল এটা তার ঠাকুমারই ডাইরি। ওপরের তলার ঘরে নিয়ে গিয়ে ডাইরিটি পড়া শুরু করল- একবারেই পুরোটা পড়ে ফেলতে ইচ্ছে করল কারণ তার ধারণা বৈজ্ঞানিকদের জীবন অনেক রোমাঞ্চকর হয় কিন্তু ডাইরির প্রথম ভাগে রোমাঞ্চের কিছুই নেই উল্টে কিছু মর্মান্তিক ঘটনার উল্লেখ আছে। তাঁর ছোটো ছেলের খুব অসুখ হয়েছিল। ডাইরিতে লেখা এই যে- তাঁর ছেলেকে কেউ 'বিষ দিয়েছে, এটা কোনো ডিসেন্ট্রি বা অন্য পেট খারাপ নয়।' তারপর একটি পাতার লেখা পড়ে অপরাজিতার হাড় হিম হয়ে গেল, লেখা-


"যদি বিজ্ঞান আমার ছেলেকে বাঁচাতেই না পারে তবে সে বিজ্ঞানের চর্চা করার মানে কি? আমার ছেলেকে আমি বাঁচিয়েই ছাড়বো কিন্তু ওর হাতে যে সময় কম। আমায় 'মৃত্যুঞ্জয় মেশিন' বানাতেই হবে সময় থাকতে....."


তারপরের পাতাগুলিতে অনেক যন্ত্রের ছবি আঁকা আর ইংরেজিতে কি সব যেন লেখা। শুধু একটি ছবি অপরাজিতার দৃষ্টি আকর্ষণ করল- একটি 'যান্ত্রিক মানুষের' ছবি। সে বুঝতে পারল যে এই ছবিগুলি 'মৃত্যুঞ্জয় মেশিনের'। সে এটাও বুঝতে পারল যে তার ঠাকুমা মেশিনটি বানাতে সক্ষম হয়েছিলেন কারণ ডাইরির শেষে লেখা- "আজ আবারও আমি প্রমান করে দিলাম মানবজাতির জন্য কিছুই অসম্ভব নয়।" অপরাজিতার মনে হলো যদি সত্যিই তার ঠাকুমা মৃত্যুঞ্জয় মেশিন আবিষ্কার করে থাকেন তাহলে সেই মেশিনটি এখন কোথায়? তার হটাৎ করে তিন তলার তালাবন্ধ ঘরটির কথা মনে পড়ে গেল। সেই ঘরেই কি তাহলে মৃত্যুঞ্জয় মেশিনটি রাখা? সে ভেবে কুল করতে পারল না চাবি কোথায় থাকতে পারে, ঠিক করল ঠাকুমার ঘরেই আরেকবার গিয়ে চাবির সন্ধান করবে। তা আর বলতে, একটি ছবির পিছনেই একটি চাবি পেলো সে। আর বিলম্ব না করে দৌড়ে তিন তলার ঘরটিতে চলে গেল। হ্যাঁ, এই ঘরেরই চাবি সেটা। দরজা খুলেই সে বুঝতে পারল এটাই তার ঠাকুমার গবেষণাগার ছিল। ঘরটি দেখে মনে হলো এখানে কতকাল কেউ পা রাখেনি। "আজ অনেক রাত হয়ে গেছে, কাল আসবো।"- মনে মনে এই বলে অপরাজিতা নিজের ঘরে চলে এলো।


সকালে জলখাবার খেতে নিচে এসে দেখে মা বসে কাঁদছেন। সে জিজ্ঞেশ করতেই একটি খবরেরকাগজ এগিয়ে দিলেন তার মা। খবরেরকাগজ দেখেই তারও দু'চোখ জলে ভরে গেল। তাদের পরিচারিকা ডোমা খুন হয়েছে, শুধু তাই নয় ডোমার সাত বছরের শিশুটিও খুন হয়েছে। পাড়াপর্শীদের দৃঢ় বিশ্বাস এই নৃশংস হত্যার পিছনে শুধু মাত্র ডোমার স্বামী রবীর হাত কারণ এর আগেও ডোমাকে টাকা পয়শার জন্য পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিত রবী। অপরাজিতা বিদ্যুৎ বেগে তিন তলার ঘরটিতে চলে গেল, তার মনে হলো এর থেকে ভালো সুযোগ সে আর পাবে না নিজের ঠাকুমার আবিষ্কারকে কাজে লাগানোর। ঘরটিকে ঘর না বলে হলঘর বললেও চলে, ঘরের এক প্রান্তে কি যেন একটা সাদা কাপড়ে মোড়া। সাদা কাপড় সরাতেই একটি বিশাল মেশিন দেখতে পেল সে। ভাবলো যদি একবার মেশিনটি সে চালু করতে পারে তবে ডোমা আর তাঁর শিশুকে আবার ইহলোকে ফিরিয়ে আনতে পারবে। কিন্তু চালু করবেই বা কি করে ? ভালো করে মেশিনটিকে দেখল অপরাজিতা। একটি সবুজ আর একটি লাল বোতাম দেখতে পেলো সে। সবুজ বোতাম তা টিপতেই একটা খ্যাঁচ করে আওয়াজ হলো মেশিনটিতে আর একটি হলুদ বাল্ব জ্বলে উঠলো। বাল্বটির নিচে কি যেন একটা লেখা ইংরেজি অক্ষরে -" V E N G E C E D"- সে বুঝতে পারলো বাকি অক্ষর গুলো উঠে গেছে। মেশিনের স্ক্রিনে লেখা - "Enter name and picture of the killer"। অপরাজিতা হাথের কাগজটি দেখে খুনির নাম লিখে দিলো - 'রবী বরদলৈ' আর খবরেরকাগজ থেকে ছবিটি কায়দা করে ছিড়ে মেশিনের স্ক্যানারে রেখে দিল। মেশিনে কোনো শব্দও হলো না বা লেখাও ফুটে উঠলো না। অপরাজিতা ভাবলো হয়তো এতদিন ব্যবহার না হওয়ার ফলে মেশিনটি খারাপ হয়ে গেছে। সে ঘরের এদিক-ওদিক দেখতে লাগলো যদি আর কিছু অবিশাস্যকর পায়ে। আরেকটি ডাইরি খুঁজে পেল সে। ডাইরির ওপরে 1990 লেখা। 

-"অপু খেতে আয়।" মায়ের ডাক শুনে অপরাজিতা তাড়াতাড়ি নীচে চলে গেল নিজের ঘরে ডাইরিটি রেখে।


দুপুর বেলা অপরাজিতা জানলার ধারে বসে ডাইরিটি পড়তে শুরু করল। বাইরে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন- দেখেই মনে হয় কিছু অনর্থ ঘটতে চলেছে- তার মনও কু ডাকছে। ডাইরির প্রথম পাতায় লেখা - " আজ আমি বুঝতে পারলাম 'Death is inevitable', মৃত্যুকে আটকানো যায়না।রোবট চলে গেছে , এত দিন পর আমার ছেলের অপরাধীরা সাজা পাবে।" তারপর পর পর পাতার লেখা পড়ে অপরাজিতার মাথায় বজ্রাঘাত হলো! ডাইরিতে লেখা এই যে অপরাজিতার কাকার মৃত্যুর জন্যে তার এক বন্ধু দায়ী- তাকে স্লো পয়জেন করে মেরেছিল। ডাইরির শেষ পাতাতে লেখা-


"হে ঠাকুর! এ আমি কি করলাম?!আমি প্রতিশোধ নিতে গিয়ে খুন করে বসলাম। আমায় ক্ষমা কর। আমি একটি নিজের ছেলের বয়সী ছেলের এই অবস্থা করে ফেললাম! আমায় ক্ষমা কর। আমি আমার বিজ্ঞান চর্চা এখানেই বন্ধ করলাম। আর কোনোদিন এই লাবরোটোরি তে ফিরে আসব না।"

অপরাজিতা বুঝতে পারল এই মেশিন মৃত্যু কে জয় করতে পারে না, এই মেশিন পাপী কে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরী, এই মেশিন 'প্রাণঘাতক'! 

কিন্তু সে তো এ মেশিন চালু করে ফেলেছে, তাহলে কি খুনি রবীর খুন হবে? তার মাথা ঘুরতে শুরু করল- পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে লাগল- বুকের ভিতর থেকে হৃদপিন্ড বেরিয়ে আসতে চাইল। তাহলে কি সে নিজের ঠাকুমার মত খুনি হয়ে যাবে? 

সেই দিন তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোলো না। সে সারা রাত শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলো।

-"জানো মেঘা, ওই ডোমার খুনি স্বামী আজ সকালে জোরহাট স্টেশনে কাটা পড়েছে?" জলখাবারের টেবিলে বসে সমরেশ বলল।

-" কি বলছ কী?" অপরাজিতার মা মেঘা বলল।

-"হ্যাঁ, আবার কি, পালাতে যাচ্ছিল খুন করে তখন এই কান্ড ঘটে তবে ঘটনাস্থলে যারা ছিল তাদের বক্তব্য যে তাকে লাইনে কেউ ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল।" সমরেশ বলল।

অপরাজিতা জলখাবার খেয়ে আর দেরি না করে তিন তলার লাবরোটোরিতে চলে গেল। গিয়ে দেখে মেশিনে একটি সবুজ বাল্ব জ্বলছে। অক্ষর গুলো অস্পষ্ট হয়ে গেলেও এখন সে বুঝতে পারল বাল্বের ওপর আসলে কি লেখা ছিল- "Revenge exacted"!


             


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror