Partha Pratim Guha Neogy

Tragedy Classics

3.7  

Partha Pratim Guha Neogy

Tragedy Classics

মৃত্যুহীন ভালোবাসা

মৃত্যুহীন ভালোবাসা

4 mins
1.5K


আজ সকালে ঘুম ভাঙতে দেরী হয়েছে, গতকাল শরীরটা ভালো ছিল না। কেন জানিনা ভীষণ অস্থির লাগছিল মনটা, ফলে ভালো ঘুম হয়নি। ঘুমই তো আসলো ভোরের দিকে। সকালে উঠতে দেরী হল। বাজার করার ছিল, তাতেও দেরী - আর এই রোদের মধ্যে বাজার করতে খুব কষ্ট হয়। তার উপরে ভালোবাসা ঘুম হয়নি, শরীরটাও ভালোবাসা লাগছে না - এছাড়া বয়সের একটা চাপ তো আছেই।

বাজার থেকে ফিরে ব্যাগ মাটিতে নামিয়ে ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে সোফায় বসলেন নিরুপা দেবী | বয়স হচ্ছে তো, সামনের ভাদ্র-এ ৫৫-এ পড়বেন |


গাছ গুলোয় জল দিয়ে পাখিটাকে খেতে দিয়ে কাগজ নিয়ে বসলেন, রোজ দুপুরের এই সময়টা ওঁর একান্ত আপন সময়, সারাটা দিনের প্রতিটা সেকেন্ড তো অন্যের জন্য বাঁচা, নিজের জন্য বাঁচার এইটুকুই | সেলাই করা, ডায়েরি লেখা, কাগজ পড়া – নিজের ইচ্ছে মতো সময়টাতে বাঁচেন | ঘরের বাইরের লম্বা দোলনাটাই প্রিয় জায়গা | পড়ন্ত বিকেলে দক্ষিণমুখো বারান্দাটায় বড়ো সুন্দর হাওয়া দেয়, চা খেতে খেতে রক্ত লাল আকাশটাকে দেখেন, সোনালী সূর্য তখন অস্তগামী, শেষ সময়ের লাল আবিরটা আকাশকে মাখিয়ে দিতে ব্যস্ত, পাখিগুলো ঘরে ফেরে | আজও রোজকার মতো কাগজটা নিয়ে বসলেন, সকাল থেকে তো বাইরের জগতের সাথে কোন সম্পর্কই থাকে না, কাগজটা খুলতেই নজর গেল খবরটায়, বাজারেও শুনছিলেন বটে, তখন অতটা আমল দেননি | এখন খবরটা পড়ে আর মানুষটার ছবিগুলো দেখে আর কিছু ভাবতে পারছিলেন না, পুরো স্মৃতিটাই আটকে গেছিল ৩৫ বছর আগের মধুর স্মৃতিগুলোয় | আজ আর কোন সেলাই করতে পারলেন না | নিজের যা কিছু সম্পত্তি তার মধ্যে একটা হলো আলমারিটা, সেই আলমারির নীচের তাক থেকে বের করলেন ডায়েরিটা | অনেকদিন আগের ডায়েরি এটা, বলা ভালো ডায়েরিটা অন্যগুলোর থেকে একটু আলাদা তো বটেই | হবে নাই বা কেন, কত স্মৃতি জড়িয়ে এটার সাথে | পরম আদরে ডায়েরিটা একবার নিজের হাতে নিয়ে মুছলেন, গন্ধ নিলেন শুকনো গোলাপের মৃত কোষগুলোর, হলদেটে পাতাগুলোর, ডায়েরির ভিতর রাখা সাদা কালো ছবিগুলোর | ঐ মানুষটাই প্রথম উপহার দিয়েছিল, ওনার উনিশতম জন্মদিনে, এই ডায়েরিটা |


নিজের কাঁচা বয়সের হাতের লেখাটা দেখে বারবার হারিয়ে যাচ্ছিলেন অতীতে | লোহিত কণিকাগুলোর গতি যেন বেড়ে যাচ্ছিল, প্রথম প্রেমকে কী ভোলা যায়? নাহ, যে যতই মতামত শোনাক, স্বীকার বা অস্বীকার করুক, যায় না | খুব ভাগ্যবান তারা যারা নিজের প্রথম প্রেমকেই জীবনের শেষ দিন অবধি সাথে পায়, কিন্তু সবার ভাগ্যে তো হয় না তা’, যেমন হয়নি নিরুপা দেবীর | প্রথম ভালবাসার মানুষটাকে স্বেচ্ছায় মুক্তি দিয়েছিলেন, নিজের শরীরে তাদের ভালবাসার প্রথম চিহ্ন, প্রাণের স্পন্দন টুকুর অস্তিত্বের কথা, তার আগমনের কথা তখন যে জানতেন না, চিঠি ছাড়া আর কিছুই ছিল না তখন, ঠিকানা বার বার ভুল বলে ফেরত আসত চিঠিগুলো | আর কোন উপায় ছিল না, বাবার পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলেন | ঠকেননি, ভালবাসা পেয়েছেন, নিজের ছেলেকেও পরিচয় দিতে পেরেছেন এই মানুষটার জন্যই | পরিবর্তে নিরুপা দেবীর স্বামী কোনদিন কিছু চেয়েছেন বলে নিরুপমা দেবীর মনে পড়ে না | বাপের বাড়িতে যখন চিঠি এসেছিল প্রথম প্রেমের, তখন একবছর কেটে গেছে | সুদূর মুম্বইতে তখন একটা স্থায়ী ঠিকানা জোগাড় করতে সক্ষম হয়ে তবেই চিঠি দিয়েছিল বাবুদা, নিরুপা দেবীর প্রথম প্রেম | মাঝের দিনের এত ঘটনা নিজের কোন স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় জানতেও পারেননি | কথা ছিল অপেক্ষা করার, নিরুপা দেবীর কাছে সমাজের চোখ রাঙানির হাত থেকে নিজের সন্তানকে বাঁচানোর জন্য আর কোন উপায়, কোন রাস্তা ছিল না | পরে সবটা জানিয়েছিলেন ঠিকানা পেয়ে বাবুদাকে, বাবুদা একবার দেখা করতে চেয়েছিল, করেননি উনিই | কী লাভ মায়া বাড়িয়ে? তার থেকে প্রাণের বাবুদাকে খবরের পাতায়, টিভিতে দেখতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছিলেন, বাবুদা মুম্বই-এর বড়ো সড়ো তারকা হয়ে গিয়েছিল কি না |


সেই বাবুদা আজ নেই, খবরের কাগজের কালো হরফ, ছবি, টিভি তো তাই বলছে | নিজেদের একসাথে তোলা গুটিকয়েক ছবির একখানা দেখতে দেখতেই চোখের জল পড়ল ছবিটার উপর | কখন চোখের জল বাঁধ ভেঙেছে বুঝতেই পারেননি |


নাহ, বাবুদা আর বিয়ে করেননি, আর কাউকে ভালোও বাসেননি, দেহদান করে গেলেন ওনারই তৈরি নিরুপা নার্সিং হোমকে |


নিরুপা দেবী তার স্বামীকে ভালবেসেছেন | হ্যাঁ, ভালবেসেছেন, কিন্তু বাবুদাকেও ভালবাসেন, হ্যাঁ, অতীত না, বর্তমান কাল, ভালবাসেন এখনও |


প্রেমের অনেক তত্ত্ব, মতবাদ বলে একসাথে নাকি দুজনকে ভালবাসা যায় না, কিন্তু প্রেম কী তত্ত্ব, মতবাদের ধার ধারে? নিবিড় চুম্বনে ডায়েরিটাকে ভরিয়ে দিলেন, সযত্নে লুকিয়ে রাখলেন আগের মত | সন্ধ্যা নামছে, আবার ডিউটি শুরু, সবাইকে ভাল রাখার ডিউটি, সবার ভাল থাকার মধ্যে দিয়ে ভাল থাকার অভ্যেস | আজ আর কাজ করতে মন সায় দিচ্ছে না, বুকটা কেমন ভারী লাগছে, চাপ লাগছে, কে যেন গলার কাছটা চেপে ধরেছে, চোখের জলে বালিশ ভিজছে | নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে হিঁচড়েও তুলতে পারছিলেন না বিছানা থেকে, আশপাশটা বড়ো ঘোলাটে, বার বার চোখের জল মুছলেন, তাও কেন ঝাপসা ভাব যায় না, অবশেষে চোখ বুজলেন, তখনও বোঝেননি, শেষবার চোখ বুঝলেন | রেখে গেলেন নিজের প্রথম প্রেমের একমাত্র চিহ্ন, নিজের সন্তান আশীষকে, নিজের স্বামী অরিজিৎকে | চারপাশে তখন শাঁখ বাজছে, সন্ধ্যা নামছে যে | শোনা যাচ্ছে দূরে রেডিওতে বাজছে -

“যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,….”


 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy