মেলবন্ধন
মেলবন্ধন
লেক ভিউ গার্ডেনের লেকে একটি বোটে প্রাণপণে প্যাডেল করে চলেছে মচ্ছর। না, না, মশা নয়, ওর বাবা মায়ের দেওয়া একটা নাম অবশ্যই আছে। রোহিত গুপ্তা, বাবা মায়ের আদরের লাল !
বয়েস একুশ পার হতে চললো। অথচ ছুটিতে বাড়িতে এলে এখনো বাবা মায়ের মাঝখানেই ওকে ঘুমাতে হবে। আহ্লাদ এখনও কমেনি। একমাত্র ছেলেকে যতদিন ছোটো ভাবা যায় আর কি!
উকিল হিসেবে বাবার যথেষ্ট পসার এই জব্বলপুর শহরে। নিজেদের এই দোতলা বাড়িটায় তিনটে ঘর তো খালিই পড়ে থাকে। তবু এখনো একা শোবার কথা বাবা মায়ের মাথায় যেমন আসেনি, রোহিতেরো বলাই হয়ে ওঠেনি বাবা-মাকে। কয়েকটা দিনেই যেন হাঁফিয়ে ওঠে বাড়িতে।
এর চেয়ে বল্লভনগরের হোস্টেল জীবনে অনেক বেশী স্বাধীনতা উপভোগ করা যায়। SVNIT এর ক্যাম্পাসে থার্ড ইয়ার এর স্টুডেন্ট রোহিত। বেশ বন্ধুত্ব হয়েছে লম্বু, মোহন, রাজেশ, শ্রীনীবাসদের সাথে। আর একজনকে মাঝে মধ্যে চোখে না দেখলেও খুব অস্বস্তি হয়। দেখতে না পেলে একটু বেশী সিগারেট খাওয়া হয়ে যায়। এদিকে বাড়িতে কেউ জানেই না যে ও হস্টেলের বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সিগারেট খাওয়া ধরেছে।
টকটকে ফর্সা রোহিত একটু বেঁটে আর রোগা-পটকা। কিন্তু তাতে কি! দারুণ আকর্ষনীয় একরকম ভাঙা গলার অধিকারী। গলাটা একবার শুনলেই মনে গেঁথে থাকে লোকের। অনেকটা যেন পুণীত ঈশারের মতো, কিন্তু শুনতে খুব মিষ্টি। কি কারনে যে বন্ধু বান্ধবেরা ওকে মচ্ছর ডাকা শুরু করলো তা জানতে গেলে এখন ওর বন্ধুদের ধ'রে
ধ'রে জনে জনে জিজ্ঞেস করতে হয়। তাতেও কি আর কেউ সহজে মুখ খুলবে! সবাই যে রোহিতকে মচ্ছর নামেই ডাকতে ভালোবাসে।
কখনও ক্যান্টিনে, কখনও লাইব্রেরীতে অনেক মেয়েদের মাঝেই দেখেছে রেশমাকে। লম্বা ফর্সা দোহারা চেহারা। অনেকটা যেন মাধুরী দিক্ষীত। এটা অবশ্য রোহিতের মনের কথা। কারো সাথেই আলোচনা করেনি। শুধু কোনো এক অসতর্ক মুহুর্তে লম্বুকে বলে ফেলেছিলো রেশমাকে যে ভালো লাগে সেই কথাটা। তাই নিয়ে কি কম হ্যাপা ! মাঝে মাঝেই বদমাশটা রোহিতকে জয়া ভাদুড়ীর কথা মনে করিয়ে দিয়ে হো হো করে হেসে ওঠে।
যেন এভাবেই স্বপ্নের জগৎ থেকে আছাড় মেরে নীচে ফেলে দেয়। মনে মনে বোধ হয় ধোপার কাপড় পেটানো মতো আনন্দ অনুভব করে। অবশ্য ঐ অমিত শর্মা বা লম্বু আসলে ওর সাচ্চা দোস্ত। তা না হলে মই যুগিয়ে গাছে তুলে দিতো। আছাড় খেয়ে তাতে যে ও কষ্ট পাবে সেটা কিছুতেই হতে দেবেনা লম্বু। কি আর করা যাবে, কেন যে আরেকটু লম্বা হলোনা !
কিন্তু স্বপ্ন দেখতে তো আর অসুবিধে নেই। ঐ রেশমা, ওর বাড়ি বোধহয় পান্জাব বা হরিয়ানার দিকেই হবে। শোনা হয়নি, আসলে কথাই তো হয়নি কোনোদিন। লোকে বলে ইন্জিনিয়াররা নাকি অপেক্ষাকৃত স্মার্ট হয়, না আনস্মার্ট ও নয়। তবে জেনে বুঝে নিজের ইগোকে হার্ট হতে তো আর দেওয়া যায় না। কাজে কাজেই মনের দুঃখ মনে চেপে রেখে ও নির্বিবাদে স্বপ্ন দেখে। লেকের জলে প্যাডেল করে চলেছে। বোটটা তরতর করে চলছে। শ্যাম্পু করা খোলা চুলে হাসি হাসি মুখ করে উল্টো পাশে বসে আছে রেশমা। দেখছে ঐ পরিযায়ী পাখিদের। সামুদ্রিক হাওয়ায় জুড়িয়ে যাচ্ছে যেন ওদের শরীর।
লোহার খাটে ধপ করে এসে বসে, চেঁচিয়ে ওঠে লম্বু,
"আবে শ্রীনী, দেখ্ ইসকো দেখ্! লাগতা হ্যায় কি নিদ মে গুলাব কি বাগিচা পে ঘুম রহা থা।
উঠ্, ভুল গ্যায়ে কেয়া? জি.এস নে বুলায়া হ্যায় ক্যান্টিন পে চার বাজে।"
শ্রীনীটাও কম পাজি না, দাঁত বের করে নীরবে হাসতে লেগেছে। আর ওর পেছনে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রাম বাবু আর শ্যাম বাবু। ওদের আসল নাম গুলো সকলে ভুলেই গেছে। ওয়েষ্ট বাঙ্গাল থেকে এসেছিলো এই দুই জমজ ভাই। চেহারায় সামান্য পার্থক্য আছে ভাগ্যিস! তবে দুজনেই শ্যামলা আর দুবলা। গুডবয় বলতে যা বোঝায় ওরা তাই। কলকাতার নয়, জেলার স্কুল থেকেই ভালো রেজাল্ট করেছে ওরা দুজনেই। অনেক সাধাসাধি করেও কেউ ওদের সিগারেট ধরাতে পারেনি। আর কিছু না হোক ওরা সকলের মন ভালো করে দেয় ওদের উপস্থিতিটুকু দিয়েই।
নবীন বরনের সেই দৃশ্যটা তো এখনও ওদের সব বন্ধুদের চোখে ভাসে। ওরা সকলে সবে ভাবা ভবনে থাকা শুরু করেছে তখন। একেবারে নতুন পরিবেশ। বন্ধু বান্ধব হওয়া তো দূরের কথা, ভালো করে পরিচয় পর্যন্ত হয়নি সকলের সাথে। কিন্তু যমজ হবার সুবাদে ওরা তো দুজন দুজনকে চেনে। দুজনেই সিভিলে চান্স পেয়েছে। শুধু টয়লেটে যাওয়া ছাড়া সব সময় একসাথেই থাকে। আলাদা পাশাপাশি বেডে ঘুমায়।
একটা বড় হলে আয়োজন করা হয়েছিলো নবীন বরণ বা পরিচয় পর্বের। আনন্দ্ আর জ্যাঙ্গো দুজনেই তখন সেকেন্ড ইয়ারের নামকরা জুটি। ক্লাসের সময়গুলো ছাড়া আনন্দের হাতে সবসময় একটা হকি স্টিক আর জ্যাঙ্গোর হাতে গীটার। এভাবেই সকলে ওদের চেনে। একটা কেমন ডোন্ট কেয়ার এ্যাটিচিউড।
একে একে সকলকে ডাকা হচ্ছে। কাউকে শুধুই নাম জিজ্ঞেস করে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, কাউকে বা নিজের সুবিধা মতো কিছু পারফর্ম করতে বলা হচ্ছে।
সে, হিন্দি গান হোক, বাঙলার সুমন চ্যাটুজ্যের জীবনমুখী গান বা মাইকেল জ্যাকসনের নাচ কিছুতেই সুবিধে নেই। কিন্তু সিনিয়রদের স্যার বলতেই হবে, আর অর্ডার মানতেই হবে। যে যা পারছে করে দেখাচ্ছে । কিন্তু ভয়ে সকলের মুখ শুকনো। একসময়ে রামবাবুকেও ডাকা হলো। বলা হলো গান করতে। রামবাবু সোজা হয়ে কাঠের মতো দাঁড়িয়ে গলা খুলে গেয়ে উঠলো _________
"একবার বিদায় দে মা _আআআ___
ঘুরে আসি।
হাসি, হাসি, পড়বো ফাঁসি ই ই,
দে খবে ভা_রত_বাসী______
এ ক বার বি দায় দে এএ মা আ আ
ঘুরে আসি।"
আনন্দ্ আর জ্যাঙ্গোর পাশে বসেছিল মনা। ও বাঙালী। আর পুরো হলেই ছিলো আরও কিছু বাঙালী ছেলে। সবার আগে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে মনা। তারপর অন্য সিনিয়র বাঙালী ছেলেরা। হাসি জিনিসটা যে সংক্রামিত তা প্রমাণ করতেই যেন সিনিয়র, জুনিয়র, বাঙালী, অবাঙালী, পান্জাবী, গুজরাটি, মারাঠী, সাউথ ইন্ডিয়ান সকল ছেলেই হাসতে থাকে প্রায় মিনিট খানে ধরে। হাততালিতে ভরে ওঠে হলঘর। সবাই মুহূর্তেই উপলব্ধি করে কাউকে ভয় দেখিয়ে ভালোবাসা আদায় করা যায়না।
ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে কে কোথায় চলে যাবে চাকরির সূত্রে, হয়তো জীবনে কারো সাথে কারো আর কখনও দেখাও হবেনা। যেটুকু সময় পাওয়া গেছে তা নষ্ট করা যাবে না। পড়াশোনা বন্ধুত্ব আর পরস্পরের মেলবন্ধনটাই হয়ে উঠুক এই হস্টেল জীবনের পাথেয়।