মধুরেণ সমাপয়েৎ
মধুরেণ সমাপয়েৎ


ছোটোবেলা থেকেই ডানপিটে ছিল রাই। তার পড়াশোনা প্রায় পুরোটাই কুগার্লস স্কুল, কলেজে হলেও স্কুল জীবনের প্রথম পাঁচ বছর কো-এড স্কুলেই পড়েছিল সে।
ডানপিটে হলেও খুবই মেধাবী মেয়ে রাই। নাচেও ভালোই পারদর্শী ছিল সে। তাই স্কুলে বরাবরই ক্লাস মনিটরের দায়িত্বটা তারই ছিল।
ওদের ক্লাসে অভি নামে একটি ছেলে পড়তো। অত্যন্ত দুরন্ত একেবারে ল্যাজ বিহীন বাঁদর বলা যায়। রাইয়ের মনিটরের খাতায় প্রায় প্রতিদিনই অভির নাম একেবারে প্রথমেই থাকতো।
ক্লাস ফাইভের পর অভি অন্য স্কুলে চলে যায়। সময়ের সাথে সাথে যে যার মতো এগিয়ে
যেতে থাকে নিজেদের লক্ষ্যের দিকে।
প্রায় বারো বছর পর ফেসবুকে সার্চ করতে করতে নোটিফিকেশনে রাইকে দেখতে পায় অভি। একই স্কুল থাকায় নোটিফিকেশনে এসেছিল রাইয়ের নাম ও ছবি।
যে মেয়েটাকে স্কুলে থাকাকালীন দেখলেই খুব রাগ হতো অভির তাকে কিছুতেই ফ্রেন্ডলিস্টে রাখতে মন চায়না তার। তবুও নিতান্তই কৌতূহলের বশে প্রোফাইলটা চেক করতে থাকে অভি। আর রাইয়ের পোস্ট করা সেলফিগুলি দেখে অবাক হতে থাকে।
সময়ের সাথে সাথে কি সুন্দর দেখতে হয়েছে রাইকে। মনে মনে বলে ‘আগে যদি জানতাম তুই বড় হয়ে এতো সুন্দরী হবি তবে তোর সাথে যোগাযোগটা রাখতাম।’
এইভাবে স্ক্রোল করে ছবি দেখতে একটা সময় অভি লক্ষ্য করলো রাইয়ের দুষ্টুমি ভরা চোখ দুটো কেমন যেন শান্ত হয়ে গিয়েছে। আর রাইয়ের কোনো নাচের ছবিও সে দেখতে পেলো না। হঠাৎ কেন যেন অভির মায়া হলো। সে বলল—‘ব্যাপারটাতো একটু জানতে হবে।’
অভি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালো রাইকে। আর রাই সেটা অ্যাকসেপ্টও করলো।
ম্যাসন্জারে মাঝেসাঝে কথা হতে থাকে অভি আর রাইয়ের। কিন্তু যখনই কথা হয় তখনই অভি লক্ষ্য করে যে রাইয়ের মধ্যে একটা পরিবর্তন হয়েছে। তার কন্ঠস্বর আগের থেকে অনেক শান্ত, পরিণত। আস্তে আস্তে কোথাও যেন অভি রাইকে পছন্দ করতে শুরু করে। কিন্তু সে ভাবতে থাকে যে এতোদিনে নিশ্চয়ই রাইয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে।
আরও একটা বিষয় তার নজরে আসে যে যখনই অভি রাইয়ের নাচের ব্যাপারে জানতে চায় তখনই কোনো না কোনো অজুহাতে রাই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যায়।
অভি এখন ব্যাঙ্গালোরে থাকে চাকরীসুত্রে। কিন্তু বাবা, মা কোলকাতায় থাকায় মাঝেমধ্যেই তাকে কোলকাতায় আসতে হয়।
অভি ঠিক করে একবার রাইয়ের সাথে দেখা করবে। কথায় জেনে নেয় তার বাড়ির ঠিকানাও।
চার মাস পর—
কলিংবেলটা বাজতেই মিনতি দেবী (রাইয়ের মা) দরজাটা খোলেন—
অভি—কাকীমা রাই আছে?
মিমতি দেবী—হ্যাঁ আছে। কিন্তু তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না বাবা।
অভি—এতোগুলো বছর পর এটাই স্বাভাবিক। আমি অভি রাইয়ের সঙ্গে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত একই স্কুলে পড়েছি। যার নাম রাইয়ের মনিটরের খাতায় সবসময় সবার ওপরে থাকতো।
মিনতি দেবী—ও এবার একটু একটু মনে পড়ছে। কিন্তু তুমি এতোদিন পর আমাদের বাড়ি চিনে এলে কি করে?
প্রশ্ন শেষ না হতে হতেই অভি লক্ষ্য করলো রাই সেখানে উপস্থিত হয়েছে।
কিন্তু একি, রাই হুইল চেয়ারে বসে কেন, আর ওর ডান পা টা বাদ গেলো কি করে!
অভি—‘রাই এসব কি করে হলো? কবে হলো’?
রাই— ‘তুই? আয় ভিতরে আয় পরে বলছি সব।’
তুইতো জানিস আমি বরাবরই ডানপিটে। জেদ করে বাবার থেকে একটা স্কুটি আদায় করোছিলাম। আর সেটা একদিন অ্যাক্সিডেন্ট হয়। ডাক্তার বললো পা টা বাদ দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আর তারপর থেকেই----
‘তুই বিয়ে করিসনি?’ অভি জিজ্ঞাসা করলো।
রাই হাসতে হাসতে বললো ‘খোঁড়া মেয়েকে কে বিয়ে করবে বল?’
হঠাৎ অভির কি হলো কে জানে! সে রাইয়ের হুইল চেয়ারের সামনে বসে বলল ‘আমি তোকে বিয়ে করতে চাই রাই। প্লিজ মানা করিস না।
‘কিন্তু কেনো অভি? তুই সব জেনে কেনো এরকম সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস?’রাই বললো।
‘ইচ্ছাটা ফেসবুকে তোর পোষ্ট করা সেলফিগুলো দেখে আগেই হয়েছিল কিন্তু এখানে এসে দেখলাম তোর সেলফিগুলির থেকে তোকে আরও অনেকবেশি সুন্দর দেখতে। তাই সিদ্ধান্তটা নিলাম। আর একটা কথা আমার মা বলে অচেনা বন্ধুর থেকে চেনা শত্রু অনেক ভালো। তাই আমি আমার সেই ছোটোবেলার শত্রুকেই জীবনসঙ্গিনী করবো ঠিক করেছি। এখন যদি ম্যাডাম আপনার মত থাকে।’
এরমধ্যে কখন যেন মিনতি দেবী ওদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বললেন—
‘রাই তোর ফোনটা ধর আর আমাদের তিনজনের একটা সেলফি তোল তো।’