মাইলস্টোন
মাইলস্টোন
দিনটা অষ্টমী ছিল। পরনে মায়ের লাল রঙের তাঁতের শাড়ি, হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি, গলায় পুঁতির নকশা তোলা হার, পায়ে ভর্তি আলতা। বেশ লাগছিল টগরকে। আজ থেকে পনেরো-কুড়ি বছর আগে যেমন সাজতো আর কি গ্ৰামের মেয়েরা! ঠিক তেমনই লাগছিল চোদ্দো পনেরোর টগরীকে।
পুজো প্যান্ডেলে পা দিতে না দিতেই গুঞ্জন শুরু! ‘যতই শাড়ি গয়না পড়ো, মদ্দা তো আর মেয়ে হয়ে যাবে না।’ আবার কেউ বলেন ‘নারে টগর তোকে খুব সুন্দর লাগছে।’ কেউ সিমপ্যাথি দেখায় ‘ইশ্ মেয়েটার সব ভালো শুধু.... নেতাইটারই কপাল খারাপ!’কেউ আবার টগরের বাবা নিতাইয়ের সত্যি প্রশংসা করে।‘সাহস আছে নেতাইটার, নইলে এরকম মেয়ে ঘরে রাখার কথা ক' জন বাপ মায় ভাবে।' ‘ঠিক বলেছো, তা নাতো কি! মাসিরা এলে দেখোনা মেয়েটারে এখনো কেরাম দোর এঁটে লুক্কে রাখে।'
এ ছিল চোদ্দো পনেরোর টগরের গল্প। এখন সময়টা ছাব্বিশ সাতাশ। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছে টগর; ওকে নিয়ে আজকাল আর কেউ সমালোচনা করে না! কেন করেনা? বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে তাই! আর বিবাহ নামক মাইলস্টোনটি পার করতে পারবেনা টগর, তাই? কে জানে! হবে হয়তো!
টগরের যা বয়স! গ্ৰামে গঞ্জে এ বয়সে কেউ মেয়ে বিয়ে দেয়না। দেওয়ার কথা ভাবেও না। এ বয়সে তাদের মেয়েরা দুই বাচ্চার মা। আর তাছাড়া, টগরের চেয়ে ছোট বোন দুটোরই কবে বিয়ে সাদি হয়ে গেছে, তারাই এখন দু বাচ্চার মা। তাই টগরকে নিয়ে পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন কারোরই আর তেমন মাথা ব্যাথা দেখিনা। মাঝেমধ্যে দু একটা হায় ভরা বাক্য কানে আসে অবশ্য। দু একজন তো সহানুভূতিও লুটায় আজকাল। ভালো! ভালোই তো!...দেখে ভালোই লাগে সমাজের এই বিবর্তন। দেখে ভালো লাগে টগরের জীবনের এই বিবর্তন। সমাজের এই অপমান, অসম্মান, ছোট চোখে দেখা; দেরিতে হলেও, কিছুটা হলেও মুক্তি পেয়েছে মেয়েটা। শুধু সমাজে কেন পরিবারের সদস্যদের হায়, আক্ষেপ থেকেও তে
তো মুক্তি পেয়েছে টগর!
পরিবার পরিজন এখন ওকে অনেক ভালোবাসে। সংসারে ওর দাম এখন অনেক। টগরকে না হলে দিনই শুরু হয়না কারোর। বাসি উঠোনের গোবর ছড়া দিতে টগর; এরপর একে একে গরুদের গোবর তোলা, খাটাল ধোয়া, খড় বিছালি দেওয়া। বাড়ি ফিরে আবার হেঁসেল; মায়ের বয়স হচ্ছে, নানান ব্যাথাশূল। জলখাবারের তদবির, রান্নার জোগাড়। রান্না সেরে আবার ঘাটালে ছোটে টগর। ঘুঁটে দিয়ে, শের-বালতি-
দুধের ক্যান মেজে দুপুর গড়িয়ে চারটে বাজে ওর দুপুরের ভাত খেতে। কী শীত কী বর্ষা একটাই ব্যামো মেয়েটার, হাজা! তবুও, ভালো আছে টগর। সংসার, ব্যারাম, সব নিয়ে ভালো আছে টগর!
এখন অষ্টমীতে আর চোখের জল ফেলতে হয়না ওকে। ভারী জাঁকজমক কাটে দিনগুলো। পুজোর একমাস আগে থেকে হৈ-হল্লা। বোনেদের বাড়িতে নতুন জামা-কাপড় পাঠানো, পুজো আর্চায় এলে বোন-বোনাই, বোনপো-বোনঝিদের রেঁধে বেড়ে খাওয়ানো, ঠাকুর দেখতে যাওয়া সব কিছুতেই টগরমাসি, টগরদি। একটাই ডাক টগর! এই নিয়ে ছিল টগর। জীবনে যে মাইলস্টোনটি সে পেরোতে পারলোনা, সে নিয়ে আজ আর তার কোনো আক্ষেপ নেই। ইদানিং নিজেকে বড়ো ভাগ্যবতী মনে করে সে। এমন বাবা মা, এমন ভাই বোন, পরিবার পরিজন ক' জন পায়!
তবে, চেনা জীবনের ছন্দপতনটা হয় ভাই বিয়ে করে এলে। মায়ের সংসারে এতোদিন ভালো ছিল টগর। যদিও মার খেতো তখনও; এখন আরো বেশি খায়। কিন্তু, এতদিন শুধু বাবা গায়ে হাত তুলতো, আজ ভাইয়েরাও। নতুন বউয়ের পছন্দ নয় টগরকে; অভিযোগ? টগর বড্ডো মুখরা, পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে। এই বয়সে মার খাওয়াটা বড়ো সম্মানে লাগে টগরের।
টগর এখন ত্রিশ ঊর্ধ্ব। সময়ের স্রোতে ওর বাবা মা এখন বার্ধক্যের দোর গোড়ায়। বাবার রক্তের তেজ ফুরিয়েছে, ফুরিয়েছে কর্তৃত্ব; সংসারের কর্তা ভাইয়েরা। তাই শুনতে হয় খাওয়ার খোটা। সারা জীবন বিনি পয়সার বেগার খাটার পর, বিনি পয়সায় খাওয়ার খোঁটাটা হজম করতে বড্ডো কষ্ট হয় টগরে।
আবার অনেকদিন পর ফিরে আসে সেই পুরোনো যন্ত্রনাটা। সে কেন আর সকলের মতো নয়? কেন তার শরীরটা সম্পূর্ণ নারী নয়? প্রকৃতি তো তাকে একটা নারী শরীরই দিয়েছে, দিয়েছে একটা নারী মনও! তবে, কেন সে রজঃস্বলা নয়? কেন তার শরীরে নারীদেহের কমনীয়তার এতো অভাব? কেন তাকে ঘরের বউ করা যায় না? কেন বিয়ে নামক মাইলফলকটি পেরতে পারলো না সে? কেন সে সংসার নামক ম্যারাথনের জন্য এভাবে ডিসকোয়ালিফাই হলো? নিরুত্তর প্রশ্নেরা চোখের জল হয়েই বয়ে যায়। আর ভাসে বালিশ।
অবশেষে চাকরিটা পেল টগর। নিজের এইট পাশের যোগ্যতায় কাছেরই একটা কারখানায় রান্নার চাকরি। বিনি পয়সায় খাওয়ার খোঁটাটাও ঘুচলো শেষমেশ। সাড়ে তিন দেবে ওরা। সংসার সামলে চাকরিটা করছে টগর। ফিরে এসে আবার হাল ধরে হেঁসেলের। দু'টো ঘন্টা ওর নিজের।
এভাবেই চললো একটা বছর। একদিন হঠাৎ ঠিক হলো বিয়ে! হ্যাঁ! টগরের বিয়ে! বোনেরা তো শুনেই অবাক! তবে প্রতিবেশীরা সাধু! সাধু! করলো খুব। আজকাল সমাজ পাল্টাচ্ছে। তবে যুদ্ধ এখনো বাকি! যুদ্ধটা তো এবার ঘরের লোকেদের সঙ্গে। ব্যাকা মন্তব্য করতে কেউ ছাড়লো না। এমনকি প্রিয় বোনেরাও না! তবু, মা বাবার কথায় বিয়ের পিঁড়িতে বসলো টগর। বিয়ে হলো! পাত্র দুটো গ্ৰাম পরে, বউটা অসুখে মরেছে, দুই ছেলের বাপ। বড়োটা ষোলো আর ছোটটা বারো। কারখানায় শ্রমিক।
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। অনেকদিন কোনো খবরে নেই টগর। না আলোচনায় না সমালোচনায়। তবে, সেদিন হঠাৎই দেখা হয়ে গেল একটা স্টেশনারি দোকানে। ভালো করে লক্ষ্য করলাম ওকে, লক্ষ্য করলাম ওর লাল হলুদের ছাপা শাড়ি, অল্প একটু সিঁদুর, শাঁখা পলা। আরো একটা অদ্ভূত ব্যাপারও লক্ষ্য করলাম; হাতে পায়ের হাজা গুলো আর নেই।
স্মিত হাসল টগর, কথা হলোনা যদিও। জিজ্ঞেস করা হলোনা কেমন আছো, টগর? তার আগেই ক্রিং ক্রিং... “চলো মা! সন্ধ্যে হয়ে গেল!”
দাঁড়িয়ে দেখলাম, একটা বারো বছরের রাজকুমার তার পক্ষীরাজ সাইকেল ছুটিয়ে এসে, তার মাকে নিয়ে সুখপুরীতে ফিরে গেল।