লক্ষ্যপূরণ
লক্ষ্যপূরণ


ঘন পাইন বনের উপর দিয়ে উপর দিয়ে বয়ে আসা উত্তরে হাওয়ায় পাহাড়ের গায়ের পবিত্র পতাকা গুলি উড়ছে পত পত করে। সেদিকে তাকিয়ে মনে সাহস আনতে চেষ্টা করে ওয়াংচুক। হাওয়ার বেগ আর দূরের পাথরের গায়ে আঁকা লাল হলুদ বৃত্তের ঠিক মাঝের কালো বিন্দুটাকে মেপে নেয় মনে মনে। ধনুকের জ্যাটা টেনে একবার চোখ বুজে তথাগতকে প্রণাম করেই তিরটা ছুঁঁড়ে দেয়। কয়েকটা সেকেণ্ড দম বন্ধ করে অপেক্ষা.... তারপর... নাঃ, ..... এবারেও পারেনি।চারপাশ থেকে একটা হাসির আওয়াজ ভেসে আসে। দোলমা, ওর বন্ধু পিঠে হাত দিয়ে বলে, -''তোর হবে না, তুই অন্য কিছু দেখ।''
ওয়াংচুক তাকিয়ে দেখে পাথরের গায়ে তার ছোড়া একটা তির ও লাগেনি। সব পড়ে রয়েছে নিচে।
ভুটানের জাতীয় খেলা এই তিরন্দাজি। আর রাজ বংশের সন্তান হয়ে ওয়াংচুক আজ অবধি লক্ষ্যভেদ দূরে থাক, লক্ষ্যর কাছাকাছিও পৌছাতে পারেনি। এ অপমান তার একার নয়, পরিবারের। ভুটানের ছেলেরা তিরন্দাজি শেখে মায়ের পেটে থাকতেই। কিন্তু ওয়াংচুক এই উনিশেও একবারের জন্য লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি। শেষ মুহূর্তে ওর হাত কেঁঁপে যায়, নয়তো তিরের মুখ নড়ে যায়।
ধনুকটা রেখে আস্তে আস্তে একপাশে সরে আসে ওয়াংচুক। পুনাখায় দুই পাহাড়ি নদীর সঙ্গমের মাঝে এক ছোট্ট দ্বীপের উপর এই জং যেখানে আজ এক ঘরোয়া তিরন্দাজির আয়োজন হয়েছে। বংশের সবাই একে একে লক্ষ্য ভেদ করছে। ছোট্ট কাঠের ব্রিজটার গায়ে হলুদ নীল কমলা সাদা হোলি ফ্ল্যাগ উড়ছে। ব্রীজ পার হয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ও নেমে আসে নদীর কাছে। একটা বড় পাথরে বসে নদীর জলে পা ডুবিয়ে দেয়। দুঃখটা ভুলতে চায়।
যতবার চোখ বন্ধ করে ওয়াংচুকের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ওর বাবা নামগিয়ালের রক্ত মাখা মুখটা, তিরন্দাজিতে নামগিয়াল ছিল বংশের সেরা। থিম্পূ পারো পুনাখায় ওর বাবার সামনে দাঁড়াবার ক্ষমতা ছিল না কারোর। বাৎসরিক উৎসবের সময় চারদিকে তিরন্দাজি চলে। মাকে ওর মনে পড়ে না, খুব ছোটবেলায় সে চলে গেছিল নাফেরার দেশে। বাবাই ওকে বড় করছিল। পাঁচ বছরের ওয়াংচুক কে নিয়ে ওর বাবা ঘুরতে বেরিয়েছিল পারো নদীর ধারে। তখনি একটা তির কি করে যেন এসে ওর বাবার কানের পাশ দিয়ে ঢুকে মাথার মাঝে আটকে যায়। বাবাকে সঙ্গে সঙ্গে শিলিগুড়ি নিয়ে গেছিল সবাই। পথ তো প্রায় আট ঘন্টার, কিন্তু পথেই সব শেষ। ছোট্ট ওয়াংচুকের স্মৃতিতে ওর বাবার সেই তিরবিদ্ধ রক্ত মাখা মুখটাই রয়ে গেছে। তির ধনুক দেখলেই ও কেমন ভয় পেয়ে যায়। এত বছর পরেও ও পারে না ঘটনাটা ভুলে যেতে।
পাশের মঠের অধ্যক্ষ লামা খিপা এসে হাত রাখে ওর কাঁধে। বলে -''সবাই সব কিছু পারে না ওয়াং। তোমার দুঃখের জায়গাটা আমি বুঝি। এসব ভুলে একজন মানুষের মত মানুষ হও। এমন মানুষ যে নিজেই নিজের পরিচয় গড়বে। আমি জানি তুমি তা পারবে। তোমার ভাগ্যচক্রে রয়েছে সে ক্ষমতা। শুধু তোমায় সাহস করে জাগ্ৰত করতে হবে সেই লুকিয়ে থাকা শক্তির। ''
ওয়াংচুকের মাথায় এত কঠিন শব্দ ঢোকে না। ও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
রাজপরিবারের সদস্য হয়েও ওয়াংচুক রাজদরবারে কোনো কাজ পায়নি। কারণ ও সেভাবে পড়াশোনাও করেনি। মা বাবা না থাকায় ছোটবেলা স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল ও। পড়তে ওর ভালো লাগত না। ও ভালোবাসত পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে, পাখি, ফুল গাছ পাতা দেখতে, ঝর্ণার গান শুনতে। একা একাই পাহাড়ে ঘুরে বেড়াত ও। কয়েকদিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যেত। যদিও পরিবারের বাকি সবাই ওর মজা উড়াত। তেমন কেউ ওর বন্ধু ছিল না।
একমাত্র বৃদ্ধ লামা খিপাই ওর খবর রাখত। মাঝেমাঝেই পুনাখার ঐ মনেষ্ট্রিতে ঘুরে যেত ওয়াং। লামা খিপার সাথে গল্প করতে ওর খুব ভালো লাগত।
আজ ডোকলাম উপত্যকায় ঘুরতে এসেছিল ওয়াং, শীতের শেষ। বরফ সরে গিয়ে কচি সবুজ ঘাসের দল মাথা তুলেছ। নীল আকাশের গায়ে সাদা মেঘের দল উড়ছে আপনমনে। একপাল ভেড়ার পিছু পিছু আপেল বাগানের ভেতর দিয়ে পাহাড়ের বেশ কিছুটা উপরে উঠে আসে ওয়াংচুক। বেশ কয়েকটা বহু পুরানো চোর্তেন রয়েছে এদিকে। সামনের পাহাড়টা ইন্ডিয়ান আর্মির দখলে। ভুটানকে সবরকম ভাবে সাহায্য করে এই দেশটা। রাস্তা বানিয়ে দেওয়া, চিকিৎসা, শিক্ষা সব সময় ইন্ডিয়া রয়েছে ভুটানের পাশে, ঠিক বড় ভাইয়ের মতো। এই আর্মি সদা জাগ্ৰত রয়েছে বলে চীন আর তিব্বত দখল করতে পারে না ভুটানের মাটি।
আর্মি ক্যাম্পের খুব কাছে চলে এসেছিল ওয়াংচুক। হঠাৎ ফায়ারিং এর আওয়াজে ও আশেপাশে তাকায় । এসময় তো প্র্যাকটিস হয় না। তাছাড়া এই ক্যাম্পটা বর্ডারের কাছে, এখানে খুব অল্প জওয়ান থাকে পাহারারত। বেশ কিছুটা নিচে ওদের বড় বেস ক্যাম্প, সেখানে নদীর ধারে প্র্যাকটিস হলেও এ উপরে আওয়াজ আসবে না। ঠিক কি হচ্ছে বোঝার জন্য এগিয়ে যায় ওয়াংচুক। গাছের আড়ালে লুকিয়ে ও বুঝতে চেষ্টা করে কি হচ্ছে। আর তখনি ও দেখে ইন্ডিয়ার তিন রঙের পতাকাটা টাঙানো নেই পাহাড়ের ওপর। একটা ঠাণ্ডা স্রোত শিরদাড়া দিয়ে নেমে যায় ধীরে ধীরে। বুকে হেঁটে আরেকটু এগিয়ে যেতে গিয়েই ঝোপের ধারে এক ইণ্ডিয়ান সৈনিকের রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখতে পায় ও। ওধারে বড় গাছটার আড়ালে বুট পরা রক্তাক্ত দুটো পা !! চীনের সাথে তো ইন্ডিয়ার সম্পর্ক শান্তিপূর্ণ। তবে এসব কি ?
মোটা গুড়ির পাইন গাছটার আড়ালে নিজের শরীরটা লুকিয়ে রেখে ও ভাবে এবার কি করবে। নিচের ক্যাম্প কি টের পেয়েছে এই ঘটনা? ফায়ারিং এর আওয়াজ কি ওদের কানে গেছে ?
দুটো চিনা সৈন্য ওর পাশ দিয়ে নিচু গলায় কথা বলতে বলতে চলে যায় অন্যদিকে।
দ্রুত নিচের দিকে নামতে থাকে ওয়াংচুক। খাড়া পাহাড় বেয়ে বন্য শ্বাপদের মত নামতে থাকে ও। সামনে আবার এক আহত সৈনিক। তবে এর দেহে প্রাণ রয়েছে। ওয়াংচুক ওর কোমরে গোঁজা বোতল থেকে জল দেয় সৈনিকের মুখে। সৈনিক চোখ মেলে চায়। ওয়াংচুকের পরনে ঘো, ওদের জাতীয় পোশাক, যা দেখে সৈনিক বোঝে ও ভুটানি। ওকে বলে -''মাতৃভুমিকে রক্ষা করতে চাইলে এখনি নিচের ক্যাম্পে খবর করো চীনারা দখল করেছে এই ক্যাম্প। আমাদের কিছু সেনা আহত, কিছু বন্দী। '' আবার জ্ঞান হাআয় সৈনিক।
দ্রুত খাড়াই বেয়ে নেমে যায় ওয়াংচুক।পথ ধরে যেতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে যে। আধঘন্টায় ও পৌঁছে যায় নিচের বেস ক্যাম্পে। খুলে বলে সবকিছু।
এরপরের কয়েক ঘন্টা কাটে গভীর এক উৎকন্ঠায়। বিকেলের মধ্যে ইন্ডিয়ান আর্মির তৎপরতায় ঘাঁটি উদ্ধার হয়।
এই ক্যাম্পের হেড কর্নেল সখাবত ওয়াংচুককে নিয়ে থিম্পু এসে পৌঁছায় পরের দিন সকালে। উনি জানান ইন্ডিয়ান আর্মির তরফ থেকে ওয়াংচুককে দেওয়া হবে সাহসিকতার জন্য বিশেষ সম্মান। নিজের জীবনকে বাজি রেখে ওয়াংচুক দেশকে বাঁচিয়েছে। সবার মুখে আজ ওয়াংংচুকের নাম। রাজা রাণী সবাই আজ ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
ওয়াংচুক মনে মনে তথাগতকে প্রণাম জানায়। লামা খিপাও আজ রাজধানীতে উপস্থিত। উনিও খুব খুশি। ওয়াংচুকের মাথায় হাত রেখে লামা খিপা বলেন -''আজ তুমি জীবনের লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছো।নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে মানুষের মত একটা কাজ করেছো। দুটো দেশ তোমায় মনে রাখবে এই সাহসিকতার জন্য।''
ওয়াংচুকের মনে হয় মেঘের আড়ালে বাবা হাসছে, তিরটা আর নেই বাবার মাথায়।