ক্যাপশন
ক্যাপশন
রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে বেবী। বিএ পাশ করেছে ম্যাথস অনার্স নিয়ে,এমএসসি পড়ার খুব ইচ্ছে,তার জন্য ইউনিভার্সিটি যেতে হবে, আর সেটা বাড়ি থেকে বেশ দূরে। কিন্তু বাবা দূরে কোথাও পড়তে যেতে দেবেন না,হোস্টেলেও থাকতে দেবেন না। বেবী পড়াশুনা এখনই শেষ করতে চায় না,সে পড়াশুনা করতে ভালবাসে। তাহলে উপায়? উপায়ন্তর না দেখে তাই সায়েন্স স্টুডেন্ট হয়েও অগত্যা কাছাকাছি ল'কলেজে ভর্তি হল। অ্যাডমিশন টেস্টে বসেছিল ৭৫০এরও বেশি ছেলেমেয়ে, সিলেকশনে বেবী চান্স পেয়ে খুব খুশি,নাহলে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেত ওর। ৮০টা স্টুডেন্ট,তার মধ্যে ৭৫জন ছেলে ও ৫জন মেয়ে। বেশির ভাগই বয়সে অনেক বড়,চাকরির উন্নতির জন্য একটা বাড়তি ডিগ্রি নিতে এসেছে,কিছু পুলিশ অফিসারও রয়েছেন সেখানে,সদ্য পাশ করা ছেলেমেয়ে হাতেগোনা ৫-৬জন। যদিও কো-এড কলেজে পড়েছে তবু অচেনা সবার মাঝে একটু অস্বস্তি তো হতই ওর,সবে ২০পেরিয়ে ২১ চলছে,পায়ে পায়ে লজ্জা,কুণ্ঠাবোধ ওকে জড়িয়ে ধরছে বারেবারে। কারও সঙ্গে আলাপও হয়নি তেমন ওর,অল্প কয়েকজনের সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলে কেবল,নিজে যেচে আলাপটা কোনোদিনই করতে পারে না ,তবে কেউ করলে মুখ ফিরিয়েও নেয় না । আর তাই কলেজে বড় একা ও।
কলেজে অনেকটা সময় থাকতে হয়,যাতায়াতেও কিছু সময় যায়,তাই বাড়ি থেকে রোজ টিফিন নিয়ে যায় ও,সবাই যখন টি-ব্রেকে নিচে ভোলাদার স্টলে গিয়ে চা খায়,ও তখন একা একা ক্লাসরুমে বসে টিফিন খায়। কারও সঙ্গে আলাপ করবে কি,ও যখন কলেজে ঢোকে,বুঝতে পারে জোড়ায় জোড়ায় চোখ ওর দিকে দৃষ্টি দিয়ে রয়েছে। ও তাই খুব সাবধানে থাকে,শামুকের খোলের মধ্যে গুটিয়ে থাকে যেন। বিকাল ৩টে থেকে ৮টা পর্যন্ত ক্লাস,বাবাকে সেটা জানায়নি,তাহলে আর ভর্তি হতে পারত না। বিএসসি পড়ার সময়কার এক সহপাঠী বন্ধুর সঙ্গে লুকিয়ে অ্যাডমিশন নিয়েছিল ও,আর সে ওর বাবার সইটা নকল করে দিয়েছিল। নাহলে বাবাকে নিয়ে গেলে আর হত না অ্যাডমিশন নেওয়া। রাত ৮টা পর্যন্ত ক্লাস জানতে পারলেই বাবা ফেরত নিয়ে চলে আসতেন। প্রথম প্রথম ও তাই ৬টা পর্যন্ত ক্লাস করেই বাড়ী চলে যেত,সন্ধ্যের পর বাইরে থাকার অনুমতি ছিল না যে। একদিন ৬টার পর চলে যাবার সময় হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্টের সামনে পড়ে যায় বেবী। ডেকে বললেন উনি,"কোথায় যাচ্ছ?" বেবী মাথা নিচু করে বলে,"বাড়ি যাচ্ছি স্যার"। উনি বলেন,"ভাল ক্লাসগুলো ৬-৮টা পর্যন্ত হয় আর তুমি কোনোদিন ওই ক্লাসগুলো কর না,এরকম করলে কি করে রেজাল্ট ভাল হবে?" উনি বলার পরে বেবীর উপেক্ষা করার উপায় ছিল না। প্রথম যেদিন ৮টা পর্যন্ত ক্লাস করল,বাড়ী ফিরে দেখে বাবার মুখ থমথম করছে। মাথা নিচু করে বেবী ঘরে চলে গেল যেন কতই অপরাধ করেছে ও। কোনো অন্যায় না করেও অপরাধী হয়ে থাকতে হয় ওকে। পরে অবশ্য বাবা সব জানলেন।
তখন থেকে বেবী পুরো ক্লাস করেই বাড়ী ফেরে। আস্তে আস্তে জড়তা কিছুটা কেটেছে,আলাপও হয়েছে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। একদিন একজন টিচার না আসায়,সকলে ক্লাসরুমে বসে আছে,কেউ কেউ চা খেতে গেছে। সেইসময় দীপক বেবীকে অনুরোধ করল,"আগের ক্লাসে আমি অ্যাবসেন্ট ছিলাম,প্লিজ স্যারের নোটসটা একটু কপি করে দেবে?"বেবীর পড়াশোনা সংক্রান্ত যে কোনো কাজই ভাল লাগে,ও এক কথায় রাজী হয়ে যায়,"কেন নয়?নিশ্চয়ই দেবো"। বলে তখনই কপি করতে শুরু করে দেয়। এমন সময় রাজীব বাইরে থেকে ক্লাসে ঢুকে দেখে বেবী লিখছে। কি লিখছে মুখের ইশারায় জানতে চাইলে, দীপকই রাজীবকে সব বলে। রাজীব দীপককে বলে,"নোটস দেবার জন্য তোমার বেবীকে আমূল চকোলেট দেওয়া উচিৎ"। বেবী হাসে,দীপকও হাসে। রাজীব এবার বেবীকে বলে,"আমূল চকোলেটের ক্যাপশনটা জানো?" বেবী তার সহজ সরল চোখ দুটো তুলে তাকায়। বেবীর এই সরলতা রাজীবকে পাগল করে তোলে। রাজীব মিটমিট করে হাসে আর বলে,"Share it with someone you love","তুমি আমার সাথে share করবে তো?"বেবী কথার মারপ্যাঁচ অত ধরতে পারেনি,সরলভাবে বলে দেয় 'হ্যাঁ'। আবার লিখতে থাকে। এদিকে দীপক খুব হাসছে, ক্লাসের অনেকেই হাসছে। বেবী অত ভ্রূক্ষেপ করেনি,আর রাজীব ওদিকে ভেবে বসে আছে,বেবী সব বুঝেছে আর ওর ছুঁড়ে দেওয়া প্রোপোজাল অ্যাকসেপ্ট করেছে। অনেকদিন ধরেই ও বেবীর মন জয় করার চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু বেবীকে বোঝাতেই পারে না। রাজীব ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিল,সবকটা অ্যাসেসমেন্ট টেস্টেই ওর হায়েস্ট মার্কস থাকত,প্রফেসররা সবাই তাই ওকে ভালবাসতেন,বেবীও তাই ওকে বেশ পছন্দ করত,তার বেশী কিছু নয়। এদিকে রাজীব আর নিজেকে সামলাতে পারছে না কিছুতে,বেবীর ধারেকাছে বেশী থাকার চেষ্টা করে,বেশী ঘনিষ্ঠতা করার চেষ্টা করে। বেবী তাতেও ধরতে পারে না। কখনওবা বলে,"তোমার মত যদি আমার গায়ের রঙ হত,তা
হলে রোজ লাল শার্ট পরে কলেজে আসতাম"। বেবী হাসে,মজা পায়,সত্যিই গায়ের রঙ ওর টকটকে,গালদুটো গোলাপী,যা পরে তাতেই সুন্দর লাগে।
আবার একদিন টি-ব্রেকে হাত দেখার ছল করে বেবীর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বসে থাকে অনেকক্ষণ,বেবী আস্তে আস্তে হাত সরিয়ে নেয় কিন্তু তখনও মনে অন্য কিছু চিন্তা আসে না। এদিকে রাজীব তারপর থেকে রোজ বেবীকে বাসে তুলে দিতে যায়। বেবী কোনো দোকানে গেলে সঙ্গে করে নিয়ে যায় আবার দীপক যখন লঞ্চ ধরতে যায়,বেবীকে বলে,"চল দীপককে ছেড়ে আসি,আর তোমারও লঞ্চঘাটটা চেনা হয়ে যাবে।"এভাবেই চলছিল,একদিন বেবীকে বাসে ছাড়তে গিয়ে বেবীর সাথে বাসে উঠে পড়ল। বেবী মিনিবাসে বাড়ী ফিরত। তখন পাশাপাশি দুজনের সীট থাকতো। বেবী ভাল করে কিছু বোঝবার আগেই বাস ছেড়ে দিল। "নেমে পড়, বাস ছেড়ে দিল যে"বলে বেবী। রাজীব মিষ্টি হেসে ঝুপ করে বেবীর পাশে বসে পড়ল,বলল," চল,তোমার সঙ্গে যাই আজ"। খুব অবাক হয়েছিল ও রাজীবের এমন অদ্ভুত আচরণে,তাই বলে "তোমার মাথায় ভূত চেপেছে"। এমনিই বলেছিল। কিন্তু রাজীবের আবারও মনে হল,বেবী বুঝেশুঝেই বলেছে। সেই ভেবেই রাজীব মনে মনে এগোতে থাকে,বলে,"চল না,গল্প করতে করতে যাই"। বেবীর বাড়ীর আগের স্টপেজে নেমে পড়ে রাজীব,আবার উল্টোপথের বাস ধরে বাড়ি ফেরে। কলেজের কাছাকাছি ছিল ওর বাড়ী। এই ঘটনা তারপর থেকে রোজই চলতে লাগলো। এভাবে ধীরে ধীরে ও বেবীর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে থাকে অতি যত্নে,তার অজান্তে।
এইভাবে চলতে চলতে এবার বেবীও যেন একটু দুর্বল হয়ে পড়তে লাগলো। ছুটির দিনগুলো ভাল লাগে না। ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা হয়ে গেলে অনেকদিন ছুটি,বেবী ছটফট করে,রাজীবও। সে সময় হাতে হাতে মোবাইল ফোন ছিল না,ল্যান্ড লাইনেও কথা বলার অসুবিধে, তাছাড়া বেবী নিজের মনোভাব রাজীবকে বুঝতে দিত না। কিন্তু দেখা করার প্রবল ইচ্ছে,মনে পড়ে রাজীব বলেছিল,"২৩শে জানুয়ারী বৌদিকে দাদার কাছে আসানসোল পৌঁছে দিতে হবে,ব্ল্যাক ডায়মন্ড ধরব"। কথাগুলো বেবীর কানে দেওয়াই বোধহয় উদ্দেশ্য ছিল ওর,আর এতে ও সফলও হয়েছিল। এই কথাগুলো বেবীর মনে হতেই ও ঠিক ওই সময়ে রাজীবের বাড়ির সামনে দিয়ে তিন চারবার ঘোরাফেরা করে যদি দেখা হয় বলে। যদিও অজুহাত খাড়া করে রেখেছিল,দেখা হলে যেন কাকতালীয় মনে হয়। রাজীবদের বাড়ির কাছেই একজন প্রফেসর থাকতেন যিনি ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনায় সাহায্য করতেন,তাই বেবী মাঝে মাঝে ওনার বাড়ি যেত। দেখা হয়ে গেলে সেটাই বলবে ঠিক করে রেখেছিল ও,যদিও সেদিন দেখা হয়নি শেষ অবধি,ছটফটানি নিয়েই বাড়ি ফিরেছিল ও। এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে,পরীক্ষা এগিয়ে আসছে। এমন সময় একদিন ক্লাস অ্যাসেসমেন্টের খাতা জমা দেবার দিন ছিল। সেদিন ছিল ৮ই ফেব্রুয়ারী,অর্থাৎ প্রপোজ ডে। রাজীব আর সুযোগের অপব্যবহার করেনি। গঙ্গার ধারে বেবীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বসে কিছুক্ষণ। হালকা ঠান্ডা রয়েছে তখনও,শীত যাই যাই করেও যেতে চাইছে না,তার সঙ্গে গঙ্গার ধারে মৃদুমন্দ হাওয়ায় দুজনেরই গা শিরশির করছে যদিও গায়ে ওদের রয়েছে হালকা গরমজামা। দুজনেই চুপচাপ,কাটে কিছুকাল। গঙ্গা অবিরাম বয়ে চলে কুলকুল করে। এ চলার শেষ নেই, অনন্ত এ বয়ে চলা। কিছু দূরে নৌকা বাইছে মাঝি,তার বৈঠার জল কাটানোর আওয়াজ ও জলের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ নীরবতাকে আরও যেন বাড়িয়ে তুলছে। রাজীবের মনে হয় যা বলার বলে ফেলা দরকার,আর দেরি করা ঠিক নয়,কারণ 'সময় বহিয়া যায়,নদীর স্রোতের প্রায়',এরপর বেবী বাড়ি ফিরতে চাইবে। পাশে বসা বেবীর হাতের ওপর হাত রাখে রাজীব আস্তে করে ,ওর স্পর্শে কি যেন ছিল,কেঁপে উঠল বেবী,ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তুলে তাকাল, রাজীব আর কালক্ষেপ না করে ওকে প্রপোজ করে,"ভালবাসি তোমায়,ফিরিও না আমায়"। আরও বলে,"তুমি যদি আমার পাশে থাকো,I'll go to the top, আর যদি না বল,তোমার সামনে আর আসবো না,কলেজ ছেড়ে চলে যাবো"। বেবীর প্রত্যাখ্যান করার কারণ ও ক্ষমতা কোনোটাই ছিল না। বাস্তবিক বেবী তখন মনে মনে এই দিনটার অপেক্ষাতেই ছিল,এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল রাজীবের প্রতি। মুখে কিছু বলে নি ও, কেবল রাজীবের হাতের ওপর নিজের হাতটা রেখেছিল,সম্মতি বুঝিয়ে দিয়েছিল। রাজীব ওর চোখে চোখ রেখে মৃদু হেসেছিল,খুশিতে ওর মুখের প্রতিটি অংশ হেসে উঠেছিল সেদিন ,বেবী লজ্জায় মাথা নিচু করে নিয়েছিল। রাজীব ওর হাতটা নিজের কোলের মধ্যে টেনে নিয়েছিল,অখন্ড নীরবতা নিজেদের মাঝে ,শুধু অনুভব। দুজনেরই ওদের দুজনকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না,মধুর ক্ষণটুকু দীর্ঘ হোক,এই ছিল মনোবাসনা। সেই শুরু হল ওদের প্রেমের পথচলা। চলতে লাগলো বাড়ী থেকে নানারকম অজুহাতে বেরিয়ে দেখা করা। দু'জনে ভাসতে লাগলো প্রেমের জোয়ারে।