কুট্টুন ৪
কুট্টুন ৪
“ তাহলে আমরা কি একদম বিকালেই আসবো? মা বাবার সাথে।” জিজ্ঞাসা করলো নির্মলা।
“ হ্যাঁ হ্যাঁ , এই বিকাল পাঁচটা নাগাদ চলে এসো। লোকজন সব তার পরেই আসবে। একটু বাবাকে ফোন টা দাও।“ বলল শেখর।
অবনী বাবু এসে ফোনটা ধরলেন,“ হ্যালো... বল বাবা।“
“বাবা , আপনি আর মা আজ রাত্রে আমাদের এখানে ডিনার করবেন কেমন।“
“ সে ঠিক আছে। কিন্তু কি ব্যাপার কোন অনুষ্ঠান আছে নাকি?”
“ আজ বিকালে এ বাড়ীতে মা একটা গেট টু-গেদার করছেন। আমরা তো পরশু চলে যাচ্ছি। এতো অল্প সময়ে সব আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব নয় আর ওরা সবাই কুট্টুন কে দেখতে চায়। বাবা পরে আপনাকে ফোন করবেন।“
“ না না তার কোন দরকার নেই। তুমি বলেছ তাতেই হবে।“
“আচ্ছা তাহলে বিকালে তাড়াতাড়ি চলে আসবেন কিন্তু............” ফোন রেখে দিলো শেখর ।
“কি ব্যাপার রে?” স্বাতিলেখা জিজ্ঞাসা করলেন নির্মলা কে।
“ কিছুই না সবাইয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য একটা ...”
“তাহলে তো একটা কিছু দিতে হয়। দাঁড়া আমি আর তোর বাবা বরং দুপুরে গিয়ে কিছু কিনে আনি। তুই গেলে ভালো হয়। তুই সাইজটা দেখে পছন্দ করে নিবি নাহয়।“ বললেন স্বাতিলেখা। অবনী বাবু মাথা নেড়ে সায় দিলে।
“আবার দেওয়ার কি আছে। জন্মদিন তো নয়। এমনি একটা গেট টু-গেদার। “
“ দেখবি না সবাই কিছু না কিছু হাতে করে নিয়ে আসবে। আর আমরা কিছু না নিয়ে গেলে কি ভালো দেখায়? হাজার হোক আমরা দাদু দিদা।“
“তোমাদের কোলকাতায় দেওয়া থোয়া এতো বেশি... এদিক দিয়ে আমরা ভালো আছি। কেউ বাড়ীতে এলে, পানি পুছো, আর বিয়ে বাড়ীতে একটা খামে ২৫১ টাকা। ব্যাস।“
“ও তোমাদের ওখানে চলে কোলকাতায় চলে না। তার ওপর বেয়ান বাড়ী...” বলে ওখানেই প্রসঙ্গের ইতি টানলেন স্বাতিলেখা।
বিকালবেলায় ,” দিদুন আমাকে থাদিয়ে দেবে”, বলে জামাকাপড় নিয়ে স্বাতিলেখার ঘরে চলে গেলো কুট্টুন। আসার পর থেকেই নির্মলা দেখছে কুট্টুন ওর দিদুনের সাথে কিছু একটা নিয়ে গোপন আলোচনায় ব্যস্ত। কেউ সামনে গেলেই ওদের ওই আলোচনা থেমে যায়। হবে কিছু, পাত্তা দেয় না নির্মলা। কুট্টুন একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত আছে , ও একটু বিশ্রাম পাচ্ছে, এতেই ও খুশি। ফিরে গিয়েই তো আবার শুরু।
বিকালবেলায় সেজে গুজে সবাই মিলে সমীরণদের বাড়ী পৌঁছলো ওরা। বাড়িটা খুব সুন্দর করে বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে। ক্যাটারিং সার্ভিস এর লোকেরা ঠাণ্ডা পানীয় আর মুখরোচক স্ন্যাক্স পরিবেশন করছে। হাল্কা সানাই বাজছে মিউজিক সিস্টেমে। বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব।
নমিতা দেবী আর কমল বাবু ওদের খুব আদর করে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। কুশল বিনিময় চলছিল এমন সময় শেখরের সেজ মামা এলেন,” কই আমাদের কুট্টুন সোনা কই?”
“ এই তো এখানেই ছিল। বউমা দেখত!”
নির্মলা খুঁজতে যাবে এমন সময় হুড়মুড় ......দড়াম করে বিশাল একটা আওয়াজ এলো আর তার পরেই কুট্টুনের কান্নার আওয়াজ পাওয়া গেলো ,” মা......ম্মা...”
আর সঙ্গে সঙ্গে সকলে পড়ি কি মরি করে ছুটল ভিতরে। ঠাকুর ঘরের সিঁড়ির সামনে মেঝেতে কুট্টুন চিতপাত হয়ে পড়ে আছে মাটিতে, আর তার পাশে নমিতা দেবীর গঙ্গা জলের ছোট ঘড়াটা গড়াগড়ি যাচ্ছে। চারিদিক জলে জলময়। নির্মলা তাড়াতাড়ি কুট্টুনকে কোলে তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,” কি করে পড়লি?”
কুট্টুন কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিলো, “ শিপকালি। “
“ আবার তুই ঠাকুর দেবতার নাম নিচ্ছিস? শিব কালি আবার কি?” ধমকে উঠলেন নমিতা দেবী।
“মা ও ছিপকলি বলছে। ও বোধহয় টিকটিকি দেখেছে। “ বলল নির্মলা।
“ তা ও আবার ঠাকুর ঘরে ঢুকেছিলো কেন?”
“ আমি তো থাকুল কে সলি বলতে গিয়াছিলাম......” ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল কুট্টুন।
“দেখি তুই আবার কি করলি ঠাকুর ঘরে......” বলতে বলতে নমিতা দেবী ঢুকলেন ঠাকুর ঘরে। পিছনে পিছ
নে কুট্টুনকে কোলে নিয়ে নির্মলা। দেখা গেলো ঠাকুরের আসনের সামনে একটা কাগজের টুকরো তাতে নানা রঙের আঁকিবুঁকি কাটা আর মাঝখানে কাচা হাতের লেখায় লেখা রয়েছে “ SORRY”. আর সেটার ওপর পেপার ওয়েট করে রাখা রয়েছে নমিতা দেবীর শালগ্রাম শিলা।
“উউউউউফফফফফ.........” বলে উঠলেন নমিতা দেবী।
“ শিপকালিতা ওই আথন তার তলায় থাকে। আমাকে একটু হলেই কাম্লে দিত্থিল।“ বলল কুট্টুন।
“তা তোমাকে এই বুদ্ধিটা কে দিলো?” জিজ্ঞাসা করলেন নমিতা দেবী।
“দিদুন।“
“ও...... তাই বলি।“
“ মা ......!!!!” বলে স্বাতিলেখা দেবীর দিকে তাকালো নির্মলা।
“ আসলে ও আমাকে জিজ্ঞাসা করলো ঠাকুরকে সরি কি করে বলবে। তা আমি বললাম তুমি স্কুলে টিচারকে যে ভাবে বল। ও বলল সরি কার্ড বানাই? আমি ভাবলাম। ভালই তো ও কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে...... তাই। তা ও যে শালগ্রাম শিলা......” আমতা আমতা করে জবাব দিলেন স্বাতিলেখা দেবী।
“ কি কলব, কাল্ড তা উলে দাচ্ছিল তো......।“ কুট্টুন বলে উঠলো।
“ তুমি একদম ঠিক করেছ দাদু। আর ঠাকুর তোমার সরি শুনেওছেন। শিশুর মধ্যেই ভগবানের বাস। তাই তো উনি তোমার কার্ডের ওপর গিয়ে বসেছেন। চলুন সবাই বাইরের ঘরে গিয়ে বসা যাক।“ বলে কমল বাবু সকলকে নিয়ে বাইরের ঘরের দিকে এগোলেন। যেতে যেতে নির্মলা কে বললেন, “বউমা কাউকে দিয়ে জলটা মুছিয়ে দাও। নইলে কেউ পা হড়কে পড়ে যেতে পারে।“
সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ সব অতিথিরা আস্তে শুরু করলেন। সবার হাতেই রঙিন কাগজে মোড়া উপহার। কুট্টুনের আহ্লাদ আর ধরে না। যেই কেউ আসে কুট্টুন তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়,” ওরে বাবারে! কুট্টুন সোনা। কত বড় হয়ে গেছিস...”, বলে ওকে আদর করে, তারপর ওর হাতে উপহারটা দেয়। কুট্টুন ওমনি সেটা নিয়ে গিয়ে ওর ঘরের এক কোণে জমা করে রেখে আসে।
শেখরের বড় মাসি হাতে একটা খাম নিয়ে এলেন। উনি নমিতা দেবীর চেয়ে বয়সে অনেক বড়। কুট্টুনের হাতে খামটা দিয়ে নমিতা দেবী কে বললে,” আমি আর কিছু কিনে উঠতে পারিনি রে, তুই বউমাকে বলিস যেন ওর জন্য কিছু কিনে দেয়।“
“ আরে বাবা ঠিক আছে। তুমি এসেছ এইটাই বড় কথা...” বলে নমিতা দেবী ওনাকে নিয়ে সোফাতে বসাতে গেলেন।
কুট্টুন খামটা উল্টে পাল্টে দেখে, সেটা ছুটে গিয়ে শেখরকে দিয়ে দিলো। তারপর আবার ছুটে গিয়ে ওর বড় ঠাম্মির সামনে হাত পেতে দাঁড়িয়ে বলল,” আমাল গিফট?”
নমিতা দেবী ভীষণ লজ্জা পেয়ে চোখ গোল গোল করে বলে উঠলেন, “ অ্যাই অসভ্য......”
“তুই থাম না নমিতা... ওকে বকছিস কেন? ও কি বোঝে টাকা পয়সার। ভুলটা তো আমারই। এসো দাদু আমার কোলে এসো। আমি না এবার তোমার জন্য কোনো গিফট কিনতে পারিনি । তুমি পরের বার যখন আসবে তখন আমি তোমায় দুটো গিফট দেবো, কেমন?”
কুট্টুন একগাল হেসে ঘাড় নেড়ে ছুট্টে চলে গেলো পরের গেস্টকে দেখতে।
ডিনার শেষ করে সবার যেতে যেতে প্রায় রাত এগারোটা হয়ে গেলো। যাবার সময় সকলেই কুট্টুনের খুব প্রশংসা করে গেলো,” কি মিষ্টি ছেলে! সব সময় হাসছে। আবার আমাদের বলল আসুন , বসুন। ওইটুকু ছেলে কি সুন্দর শিখেছে!”
কুট্টুন বাবার কোলে চড়ে সবাইকে টাটা করলো।
শেখর কুট্টুন কে বলল,” কুট্টুন তোর তো আজ ‘দি ডে’। কত গিফট পেয়েছিস। খেলনা, বই, জামা, রঙ পেনসিল আর কি চাই তোর?”
কুট্টুন বাবার কাঁধে মুখ গুঁজে চুপ করে রইল।
“ কি রে কিছু বল? আর কি চাই তোর?”
“ একতা নতুন গাল তাই......।“ দু হাতে নিজের গাল দুটো ঢেকে বলে উঠলো কুট্টুন।
“কি বললি?”, শেখর চমকে উঠলো।
“কই দেখি দেখি” বলে নির্মলা কুটুনকে টেনে নিয়ে ঘরে চলে গেলো। ঘরে গিয়ে বিছানাতে শুতেই অগাধে ঘুমিয়ে পড়ল কুটুন। ওর গালটা লাল হয়ে আছে। সবাই গাল টিপেই কেন আদর করে ? মনে মনে ভাবল নির্মলা। আহারে ছোট্ট শিশু কত লেগেছে । দুরন্ত বাচ্চা তাই কাঁদে কম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আস্তে আস্তে গালে ক্রিম লাগিয়ে দিতে লাগলো নির্মলা।