dark horror

Horror Classics Thriller

4.7  

dark horror

Horror Classics Thriller

কুহক

কুহক

15 mins
618


বাইরে কিসের একটা আওয়াজে ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ল দীপক । খানিকটা দূর থেকে আসছে শব্দটা। একে তো মশার কামড়ের চোটে ঘুম আসছিলোই না তারপর এই আওয়াজের জ্বালা, ঘুমের ধফারফা করে দিলো । দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রায় রাত তিনটে। 


দীপক - "ব্যাপারটা কি? এত রাত্রে মাটি কোপায় কে?"


 টর্চটা হাতে নিয়ে ঘুমজোড়া চোখে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল দীপক । টর্চটা জ্বালিয়ে আওয়াজটা লক্ষ করে ধীর পদক্ষেপে এগোতে থাকল সে। প্রায় ছয় বছর হতে চলল গোরস্থানে পাহারাদারির কাজ করছে। আজ পর্যন্ত কোনও রাত্রেই কোনও অস্বাভাবিক কিছু ঘটনা হয়নি। আর কি ভাবেই হবে এতো শহরের গোরস্থান নয় ,পাড়াগাঁয়ের গোরস্থান, তাই রাতপাহারাটা নিছকই নিয়ম রক্ষার্থে। একের পর এক গোর গুলোকে পেছনে ফেলে , আওয়াজটার প্রায় কাছে চলে এলো দীপকের । ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা, খুব সাবধানে পা ফেললেও ঝামেলা পাকালো শুকনো পাতাগুলো। পায়ের চাপে তারা খস খস শব্দে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করল। সেই মুহুর্তেই বেইমানি করল টর্চের ব্যাটারিটা। খানিকক্ষণ দপ দপ করে হঠাত কাজে বন্ধ হল টর্চটা।


ঠিক সেই সময়েই আওয়াজটা বন্ধ হয়ে গেল। তাও দীপক কিন্তু থামল না পা টিপে টিপে এগোতে থাকল সে। এমন সময় আরেকটা তীব্র আলো উল্টোদিক থেকে এসে চোখ ধাঁধিয়ে দিল তার। মুহূর্তের মধ্যে একটা দীর্ঘাঙ্গ ছায়ামুর্তি একটা ভারী কিছু ধাতব জিনিষের সাহাজ্যে আঘাত করল দীপকের মাথায়। যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে । জ্ঞান হারানোর আগের মুহুর্তে সে অনুভব করল কিছু লোক গোরস্থান ছেড়ে দ্রুত গতিতে ছুটছে। ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে তাদের পায়ের শব্দ। পাচিল টপকে তারা লাফিয়ে পালালো বাইরে ,স্টার্ট দিলো মোটরগাড়িতে আর আস্তে আস্তে মোটরগাড়ির শব্দটা মিলিয়ে গেল নিঝুম রাতের অন্ধকারে। পুরোটা বুঝতে পারলেও দীপক অসহায় ধীরে ধীরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো । 



জ্ঞান ফিরল ভোর হওয়ার খানিকটা আগে। পাখির কলতান ঘুমন্ত পৃথিবীটার দেহে ঘটাচ্ছে প্রাণের সঞ্চার। মাথার যন্ত্রণাটা খানিকটা কম কিন্তু দেহের দুর্বলতা রয়েছে পুরোদস্তুর। ভাগ্যিস আঘাতটা ব্রহ্মতালুতে লাগেনি! তাহলে আর ........... । শরীরে খানিকটা বল সঞ্চয় করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল দীপক। কিন্তু সামনে যা দেখল তাতে তাজ্জব বনে গেলো সে । পর্বতের মত ভিজে মাটির একটা স্তূপ। বেশ বোঝা যাচ্ছে একটা গোর খোঁড়া হয়েছে। কিন্তু তার ভেতর কফিন সমেত শায়িত দেহটি উধাও! দুদিন আগেই তো এই মানুষটিকে এখানে গোর দেওয়া হয়। পাথরের ফলকে মৃতের নাম লেখা রয়েছে “ TO THE SACRED MEMORY OF MICHEL NARAYAN BISWAS , OBT 29TH FEBUARY, 2016 , AET 69 ”।

আর কবরের ভেতর থেকে দেহ উধাও !!! মহিমতলার গোরস্থানের ইতিহাসে এই প্রথম এরকম কোনও ঘটনা ঘটে গেলো । 


----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------


 গ্রামের লেখা পড়ার ভাগ শেষ করে আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে আসি শহরে । প্রথম প্রথম যখন ঢুকেছিলাম তখন ভিজে বেড়াল হয়ে থাকতাম , গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে শহরের ছেলেরা ওতো বেশি মিশত না, হাসা হাসি ইয়ার্কি ঠাট্টা সবসময় লেগেই থাকতো , আবার তার সঙ্গে সিনিয়রদের অত্যাচার । তাই প্রথম বর্ষটা বিষন্নতার সঙ্গে কাটলেও দ্বিতীয বর্ষে পা দেয়ার সঙ্গে ধীরে ধীরে যখন কিছু বন্ধু জুটলো আর আমাদের একটা দল গঠিত হল তারপর প্রতিবাদ করেছি, কখনও কলমের দ্বারা, কখনও বা গায়ের জোরে। এর ফলে জনপ্রিয়ও হয়েছি অন্যান্য ছাত্রদের মাঝে। এর পর থেকে আর কেউ ইচ্ছা করে আর কেউ ঝামেলা করতে আসতো না ,এমনকি সিনিয়াররাও আমাদের বেশ সমীহ করে চলতো । 



সেদিন কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে সন্ধ্যাবেলায় আমি পরের দিনের এসাইনমেন্ট গুলো সেরে নিচ্চিলাম । শহরের প্রায় শেষ প্রান্তে একটা নির্জন পাড়ায় একটা ঘর ভাড়া করে আমি আছি । বড় রাস্তার থেকে পাড়াটা যেহেতু অনেকটা ভেতরে, কোলাহলের কোনও রেশ এই অবধি এসে পৌঁছয় না। এলাকাটাও শান্তিপূর্ণ আর বাড়িওয়ালাও অত্যন্ত আমায়িক একজন ব্যাক্তি। আমাকে নিজের ছেলের মত স্নেহ করেন। সুতরাং এই এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে থাকবার কথা আমাদের ভাবতে হয়না।



ঘড়ির কাঁটা তখন সাতটা পেরিয়ে আটটা বাজবে । হঠাত একটা গাড়ির শব্দ কানে এল, জানলা খুলে উঁকি মেরে দেখলাম, উল্টোদিকের বাড়িটার সামনে একটা গাড়ি এসে থেমেছে। ভেতর থেকে একজন ছেলে নামল তার মালপত্র সাথে করে নিয়ে। যে বাড়ীটার সামনে গাড়িটা দাঁড়িয়ে, তার মালিক হলেন ভূষণ লাহিড়ী । ভদ্রলোক একা দোতলায় থাকেন আর নিচটা ভাড়া দেওয়ার পরিকল্পনায় খালি পড়ে ছিল , এতোদিনে বোধহয় অবশেষে কেউ এল। যে পরিমাণ মালপত্র এনেছে তাতে তাকে ভাড়াটে ছাড়া আর কিছুই মনে করা যাচ্ছে না। রাস্তার আলোগুলো খুব একটা জোরালো নয়,তাই মুখ ভালো করে না দেখতে পেলাম না। ইতিমধ্যে ওপর থেকে লাহিড়ী বাবুও নেমে এসেছেন তাঁর নতুন ভাড়াটেকে স্বাগত জানানোর জন্য। খানিকক্ষণ দু’জনের মধ্যে চাপা গলায় কথোপকথন চলল। ব্যাপারটা এমন কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাড়িতে নতুন ভাড়াটে এসেছে এ আর অস্বাভাবিক কি? জানালায় দাঁড়িয়ে অহেতুক সময় ব্যায় না করে আবার আমি নিজের কাজে ব্যাস্ত হলাম।

কিন্তু একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল সেদিন রাত্রে। খাওয়াদাওয়া সেরে ঘরের বাতি বন্ধ করে ঘুমাতে যাবো, হটাৎ কানে এল একটা বীনার শব্দ। বেশ একটু অদ্ভুত সুর তুলছে বাদ্যজন্ত্রটা। মোবাইলে দেখি সময় এখন প্রায় ১২টা । বেশ অনেকদিনই হলো এই এলাকাতে বাস করছি এর আগে এরকম আগে শুনিনি । 


আমি, “এত রাত্রে বীনা বাজায় কে?”


 জানলাটা খুলে বাইরে তাকিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে থাকি, খানিকক্ষণ পর বুঝতে পারলাম, আওয়াজটা আসছে ওই পাশের বাড়ির থেকে যেখানে আজ নতুন ভাড়াটে এসেছে ।


(মনে মনে ভাবলাম) “ নতুন ভাড়াটে তাহলে বীনা বাজায় ? কিন্তু এতো রাতে ?”


সুরটা খুবই মিঠে কিন্তু একটা অদ্ভুত বেদনা রয়েছে তার ভেতর। গোটা এলাকাটায় যেন একটা ঘুমের চাদর বিছিয়ে দিচ্ছে সেই সুর। আমারও চোখের পাতা ভারী হয়ে এল। প্রায় মিনিট দশেক ধরে চলল সেই বাজনা। তারপর মিলিয়ে এলো সেই সুর, কিন্তু তারপর যা ঘটল তাতে বিস্মিত হয়ে পড়লাম । বাজনা থামার কিছুক্ষণের মধ্যে শুনতে পেলাম ঘরটার ভেতর থেকে চাপা স্বরে কথাবার্তার আওয়াজ আসছে। একটা কণ্ঠস্বর আমাদেরই বয়েসি ছেলের , আর আরেকটি কণ্ঠস্বর একজন বৃদ্ধের। 


আমি, “কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় শুধু একজনকে আস্তে দেখেছি তাহলে দ্বিতীয় ব্যাক্তিটি কখন এল ? কে তিনি ? এত রাত্রে কি হচ্ছে ঘরটাতে ?”


ভালো করে কান পাতলাম কি কথাবার্তা হচ্ছে শুনি কিন্তু কোনো লাভ হলো না । কিন্তু কথোপকথন চলতেই থাকল। একসময় আর জানলার কাছে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না , জানলা বন্ধ করে স্বপ্নের দেশে পাড়ি দিলাম।


পরেরদিন আমি কলেজ সেরে একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছিলাম। মেস্‌বাড়ির প্রায় সামনে চলে এসেছি। হঠাত দেখলাম পাশের বাড়ি থেকে আমারই বয়েসি একটি ছেলে হাটতে বেরিয়েছে । তাকে এদিকে আসতে দেখে জিয্য়াস করলাম “কালকে তুমি এই ভাড়াবাড়িতে উঠে এসেছো ”। হাসতে হাসতে আমার দিকে এগিয়ে এসে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল, “ হ্যা, আমি ভূষণ লাহিড়ীর বাড়িতে এসেছি। আমার নাম প্রমোদ, প্রমোদ সেন ”। তারপর আমিও নিজের পরিচয় দিলাম আর জানতে পারলাম যে সেও অন্য একটি কলেজে পড়তে শহরে এসেছে আর ভূষণ লাহিড়ী নাকি তার দূরসম্পর্কের মামা, তাই ভাগ্নের জন্য একতলাটা পুরো ছেড়ে দিয়েছেন।কাল রাতে ঠিক বুঝতে পারিনি কিন্তু আজ ছেলেটির চেহারার বিবরণ না দিলেই নয় । অসম্ভব রোগা, চুলগুলো উস্কোখুস্কো সঙ্গে গালে অনেকদিনের না কামানো দাড়িগোঁফ। কথাবার্তাগুলোও একটু গম্ভীর ধরনের । কিছুক্ষন কথাবার্তার পর আমি বলেই ফেললাম , “ কাল রাতে তোমার ঘর থেকে বীনার আওয়াজ শুনতে পেলাম, নিশ্চয় তুমিই বাজিয়েছিলে , বেশ বাজাও তো বীনাটা। একদিন আমাকে আমন্ত্রণ করো তাহলে একদিন তোমার বাড়ি এসে জমিয়ে বাজনা শোনা যাবে।”


আমার কথাটা শুনে কেন জানিনা প্রমোদের মুখের হাসিটা মিলিন হয়ে গেলো । কঠিন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে দু পা এগিয়ে এসে আমার মুখের কাছে মুখ এনে চোখ গুলোকে গোল গোল করে পাকিয়ে, ক্রুর হাসি হেসে বলল,


“আমার বাজনা তোমার জন্য নয় অভিরূপ ...তোমাদের কারুর জন্য নয়...এ বাজনা শুনে তিনি আসেন .......অনেক দূর থেকে......।”


আমি মনে মনে ভাবলাম - “ছেলেটা কি পাগল? এরকম প্রলাপ বকছে কেন?”


বিকেলের পড়ন্ত রোদে জনবিরল গলিটাতে প্রমোদের সান্নিধ্য আমার একেবারেই ভালো লাগছিল না। অবিলম্বে সেই স্থান ত্যাগ করে নিজের বাড়িতে ঢুকে পড়লাম।


এরপরেও অনেকবার দেখা হয়েছে প্রমোদের সঙ্গে। প্রতিবারই একটা শুকনো হাসি হেসে ভদ্রতা পালন করেছে সে। কিন্তু আর কখনও দাঁড়িয়ে ভালো করে কথা বলেনি। বেশ বুঝতাম কিছু একটা গোপন করছে ও। তবে আশ্চর্জের ব্যাপার হল এই যে রোজ রাত্রে বীনার মোলায়েম সুরের কোনও ব্যাঘাত ঘটে না। যেদিন থেকে ছেলেটি এই পাড়াতে এসেছে সেইদিন থেকে প্রতিটি মধ্যরাত্রে অদ্ভুত সুর তুলে কেঁদে ওঠে তার বীনা। চলে ওই মিনিট কুড়ি আর তারপরেই থেমে যায় যার পর শুরু হয় কোনও এক অপরিচিতের সাথে তার কথোপকথন। কলেজে দিনে দুপুরে দাপিয়ে বেড়াই ঠিকই কিন্তু বলতে বাঁধা নেই, রাত দুপুরে ওই বীনার অপার্থিব সুর শুনে সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে ওঠে।


কি এর রহস্য? কি আছে ওই সুরটাতে? কে আসে প্রমোদের কাছে রোজ রাত্রে? মনের মধ্যে জটলা বাঁধতে থাকে অনেক প্রশ্ন, অনেক রহস্য। 


আসল ঘটনা ঘটল কয়েকদিন পর। কলেজে পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ায় কিছুদিন জন্য ছুটি কাটাতে বাড়ি ফিরছিলাম, কিন্তু যাওয়ার পথে ট্রেনের কামরায় অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখা হল আমার এক পুরোনো বন্ধু অয়নের সাথে। আমরা একসাথে স্কুলে পড়তাম , সেই সূত্রেই পরিচয়। কিন্তু কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে কারণ ও ভর্তি হয় অন্য একটা কলেজে। এতদিন পর অয়নের সাথে দেখা হওয়াতে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। স্কুলে পড়ার সময় বেশ বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল অয়নের সাথে।


অয়ন বলল, “ তুই ও বাড়ি ফিরছিস, বেশ বেশ অনেকদিন পর আবার জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে।” 


আমি বললাম, “ নিশ্চয় রে , কতদিন পরে দেখা হল বলতো, কেমন আছিস তুই ?”


অয়ন, “ ভালো আছি, আর তুই ? আর তোর পরীক্ষা কেমন গেলো ? ”


আমি , “বেশ ভালো, তোর ?"


অয়ন, “ভালোই হয়েছে। তবে এবার একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হয়েছে জানিস!”


 “ কি হয়েছে?” উৎসুক কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম আমি। 


কিন্তু অয়নের কিছু বলতে যাওয়ার আগেই ট্রেনটা আমাদের গন্তব্যে এসে পৌছালো । তাই ঠিক করলাম সন্ধ্যায় পাড়ার মোড়ে দেখা করবো , তারপর আমরা নিজেদের বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। 


বাড়ি ফিরে দুপুরে খাওয়া শেষ করে, বিকেলে পেরিয়ে সন্ধ্যা নামতেই বেরিয়ে পড়লাম ঘুরতে । কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলাম পাড়ার একটা দোকানের বেঞ্চিটা বসে বসে চা পান করছে, আমিও তার সঙ্গে যোগদান করলাম । 


গরম চায়ে চুমুক দিয়ে অয়ন কে বললাম , “এবার বল তো তখন কি বলছিলি, কি যেন ইন্টারেস্টিং ব্যাপার ঘটেছে । "


অয়ন, “এবারের পরীক্ষায় আমি কিছু প্রশ্নের ব্যাপারে আগে থেকেই জানতে পারি আমার ক্লাশের এক ছোকরার কাছ থেকে”।


আমি , “তাই নাকি? কিভাবে?”


অয়ন, “ আমাদের কলেজে একটা খুব অদ্ভুত ছেলে আছে । ও অন্য কলেজ থেকে বদলি নিয়ে উঠে এসেছে আমাদের কলেজে । কেমন একটা হাবভাব ওর সবসময়। আমরা তো ওর পেছনে লেগে ওকে বিরক্ত করে তুলি। কিন্তু এবার এমন একটা ঘটনা হল যে ওকে আর হালকা ভাবে নেওয়া যাচ্ছে না”।


আমি, “তাই ! কি ঘটল?”


অয়ন , “পরীক্ষার দিন সাতেক আগে আমরা কয়েকজন বন্ধুরা মিলে এক স্যারের বাড়িতে পড়তে গেছিলাম, পড়া শেষ হয়ে গিয়েছিলো , তাই সবাই মিলে আলোচনা করছিলাম পরীক্ষায় কি আসতে পারে ,না পারে , সাথে ওই ছেলেটিও উপস্থিত। বেশ জোরের সাথে ও কয়েকটা প্রশ্নের উল্লেখ করল যেগুলো নাকি এবারের পরীক্ষায় আসবেই। আমরা ব্যাপারটা একেবারেই উড়িয়ে দিই ব্যাঙ্গের সাথে। কিন্তু ওকে জিজ্ঞাসা করলাম যে এমন তথ্য ও পেল কোত্থেকে। উত্তরে ও বলল যে ওর বহু পুরনো একজন শিক্ষক আছেন যিনি এগুলো বলেছেন ওকে”।


“বলিস কি রে?” বিস্ময়ের সাথে বললাম আমি।


অয়ন , “হ্যাঁ। এবার শোন। ছেলেটা শহরের নয়। ওর বাড়ি মহিমতলার কোন এক অঞ্চলে।শহরে কোথাও একটা বাড়ি ভাড়া করে ও একা থাকে। কিন্তু ও বলে যে ওর মাস্টারমশায় নাকি অনেক দূর থেকে ওকে পড়াতে আসেন আর গোটা ব্যাপারটা নাকি রাত্তির বারোটার পর হয়.....অর্থাৎ মধ্যরাতে। যতসব পাগলের প্রলাপ বুঝলি ”।


আমি, “থামিস না। বলে যা...তারপর কি হল বল”।


অয়ন , “প্রথমটা আমরা একেবারেই গুরুত্ব দিলাম না। কিন্তু পরীক্ষার দিন দেখলাম ও যতটুকু বলেছে, সব অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর যখন ক্যান্টিনে ওর সাথে দেখা হল, তখন আর বিদ্রুপ করতে পারলাম না। আমরা ওর ওপর ক্রমাগত চাপ দিতে লাগলাম...উদ্দেশ্য হল সেই স্যারের খোঁজ বের করা যিনি এরকম অব্যার্থ সাজেশন দেন। কিন্তু কি ধড়িবাজ ছেলে কি বলব তোকে...কিছুতেই সেই স্যারের নম্বর, ঠিকানা দিল না!...


খালি বলে গেল, “আমার স্যার তোদের কাউকে পড়াবেন না...তোরা মিথ্যে অনুরোধ করিস না...” আসলে সব ভাউতা বুঝলি...ও চায়না যে আমরা ওনার কাছে পড়ি...প্রত্যেকবার পরীক্ষার আগে আমাদের ওর হাতে পায়ে ধরতে হবে প্রশ্নের জন্য...ওর এটাতেই আনন্দ। সেদিন তো আমাদেরই এক বন্ধুর সাথে ওর প্রায় হাতাহাতি হওয়ার জোগাড়”।


আমার কেমন যেন খটকা লাগলো পুরোটা শুনে। ভয়ার্ত কণ্ঠে অয়নকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ছেলেটার নামটা কি রে?”


অয়ন , “কেন তুই চিনিস নাকি?...তোর কি কোনও ব্যাপারে সন্দেহ হচ্ছে?”


আমি, “তুই আগে নামটা বল”।


আমাকে চমকে দিয়ে অয়ন বলল, “ছেলেটার নাম প্রমোদ সেন ”।


নিজেকে কোনোমতে সামলে নিলাম। মাথাটা কেমন যেন ঘুরতে থাকলো অয়নের কথা শুনে। বুঝলাম প্রমোদ ছেলেটি স্বাভাবিক নয়। ওর ঘর থেকে রাত্তিরে যে কথোপকথন ভেসে আসে সেটির মধ্যেও কোনও এক অপার্থিব রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র...কোনোদিনও অলৌকিক ব্যাপারে বিশ্বাস করিনি...এবারেও করতাম না যদি না নিজের কানে প্রমোদের ঘরে ওই কথাবার্তার শব্দ শুনতে পেতাম। অয়নকে সবটা খুলে বললাম। সব শুনে ও চোখ প্রায় কপালে তুলে বলল, “বলিস কি অভি...এ তো পুরো ভৌতিক ব্যাপার রে”।



আমি অয়নের কথায় সায় দিয়ে বললাম, “হ্যাঁ। তা না হলে আর বলছি কি? পরীক্ষায় ওর বলা সমস্ত প্রশ্ন মিলে যাওয়া...ব্যাপারটা একেবারেই সরল নয়। শোন অয়ন ...কাউকে কিচ্ছু বলবার দরকার নেই...যা করার আমাদের করতে হবে। আমাদের কালকেই ফিরতে হবে, কাল তোর কোনো কাজ আছে ?”


পরেরদিন বেরিয়ে পড়লাম শহরের উদেশ্যে, বাড়িতে থেকে যেতে বারণ করা সত্বেও বেরিয়ে পড়লাম , কারণ তখন মাথায় ঘুরছে শুধুমাত্র প্রমোদের কথা । 


যখন ফিরলাম তখন বিকেল ছয়টা, মেসের কাছে এসে পৌছেছি দেখলাম লাহিড়ীবাবু কোথায় যেন বেরিয়ে গেলেন, কিছু মালপত্র ছিল তার সঙ্গে মনে মনে ভাবলাম আজকে হয়তো আর ফিরবে না ,কপাল ভালো যে প্রমোদ বাড়িতেই থেকে গেলো। আমরা পরিকল্পনা করেছি যে আজ রাত্রে যে কোনও প্রকারে প্রমোদের রহস্য ভেদ করবো। তখন রাত প্রায় নয়টা ,অয়ন আমার মেসে এসে পৌঁছল। নানান বিষয়ে আড্ডা মারতে মারতে সময় কাটতে লাগলো।


অবশেষে এল সেই ক্ষণ। এখন রাত পৌনে ১২টা । আর মাত্র ক্ষনিকের অপেক্ষা। আমরা ঘরের সমস্ত আলো নিভিয়ে দিলাম, আর আমরা মেসের দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে পড়লাম। দু পা হাটলেই লাহিড়ী বাবুর বাড়ি। দূর থেকে দেখতে পেলাম প্রমোদের ঘরের সমস্ত জানলা দরজা এমনকি বাড়িটার মেইন গেট ও বন্ধ। পাঁচিল টপকানো ছাড়া কোনও উপায় নেই। তবে আমাদের কাছে এগুলো জলভাত। পাঁচিল টপকে বাড়ির গণ্ডীর ভেতর প্রবেশ করলাম আমরা। পা টিপে টিপে বাগান পেরিয়ে চলে এলাম সেই ঘরটার কাছে যেখান থেকে প্রতি রাতে সুর ভেসে আসে , কিন্তু ঘরের দরজা জানলা সব বন্ধ। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না.....পুরোনো আমলের বাড়ি তাই জানলা গুলোতে খড়খড়ি লাগানো। সেগুলোকে হালকা করে একটু উঠিয়ে নিলেই ভেতরে কি ঘটছে তা অনায়াসেই দেখতে পারবো আমরা।


(ঘড়ির আওয়াজ ) এতক্ষণে বারোটা বাজল। দম বন্ধ করে আমরা নজর রাখছি ঘরটার ভেতর। প্রমোদ বাথরুম থেকে বেরোল। দেখলে বেশ বোঝা যাচ্ছে যে সে স্নান করেছে। একটা গামছা দিয়ে মাথা মুছে কিছুক্ষণের মধ্যে ধোপদোরস্ত জামাকাপড় পরে নিজেকে সুসজ্জিত করে তুলল। তারপর এক গোছা ধুপকাঠি জ্বালিয়ে, ধুপদানিতে গুঁজে সেটিকে রাখল মেঝের ওপর। ঘরের ভেতরটা একটা বিমর্ষ হলদে আলোর দ্বারা আলোকিত। ধুপকাঠি থেকে কুণ্ডলি পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। তার সামনে এবার বাবু হয়ে বসে প্রমোদ খাটের তলা থেকে বের করল একটা লম্বা কাঠের বাক্স! যত্নসহকারে বাক্সের ডালাটি খোলা হল। অধির অপেক্ষায় চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি ও অয়ন । প্রমোদ খানিকক্ষণ চুপচাপ চেয়ে রইল খোলা বাক্সের ভেতর। তারপর হাতে নিল তার অতি প্রিয় বাদ্যজন্ত্রটা আর বাজাতে শুরু করল সেই সুর। আমার বুকের ভেতর যেন অজস্র হাতুড়ি আঘাত করছে। কি হতে চলেছে এর পর?

বাজনা চলল তার নিয়মমত। একসময় সেটিকে থামিয়ে দিয়ে প্রমোদ দুহাতে তার চোখ ঢেকে হাপুস নয়নে কাঁদতে শুরু করল। হঠাত একটা বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর কানে আসাতে আমরা চমকে উঠলাম।


“প্রমোদ ...এই প্রমোদ ...এই...আবার কাঁদে পাগল ছেলে আমার...কাঁদে না বাবা...কাঁদে না...এই দেখ আমি এসে গেছি...এসে গেছি...”।


কণ্ঠস্বরটা আসছে বাক্সের ভেতর থেকে। প্রমোদ তার কান্না থামিয়েছে। তার মুখে এবার প্রস্ফুটিত হচ্ছে একটা প্রসন্নতার ছাপ। হঠাত সে অপরিণত শিশুর মত খিল খিল করে হেঁসে উঠে করতালি দিতে দিতে বলল, “মাস্টারমশায়...এসেছেন ? আপনি এসেছেন ?”


এবার যা দেখলাম, তা জন্মজন্মান্তরেও ভুলবো না। দেখলাম ওই বাক্সের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে উঠে বসছে একটি শীর্ণকায় বৃদ্ধের দেহ! তোবড়ানো গাল...চোখে আঁটা রয়েছে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা...মুখ ভর্তি দাড়ি গোঁফ...দুচোখের দৃষ্টি ভাবলেশহীন শুষ্ক। বেশ বুঝতে পারলাম, বৃদ্ধের দেহে প্রাণ ছিল না। কোনও এক কৃত্রিম উপায়ে প্রাণের সঞ্চার ঘটানো হয়েছে...আর সেই কাজ করেছে প্রমোদ । বৃদ্ধের পরনে একটা মলিন পাঞ্জাবী ও ধুতি...মাথার চুলগুলো অবিন্যস্ত। সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ দৃশ্য!


এবার সেই বৃদ্ধ কাঠের বাক্স থেকে সশব্দে বেরিয়ে এসে প্রমোদের পাশে বসলেন। ধরা গলায় বললেন, “ধুর বোকা...তুই মিছিমিছি ভয় পাস...ওরে শোন শোন তুই ডাক দিলে আমি না এসে পারি?...তুই যে সুরটা বাজাস, তা তো আমারই শেখানো...ওটা দিয়ে আমিও তো পরপারের সাথে যোগস্থাপন করতাম...মরবার আগে তোকেও শিখিয়ে দিইয়েছি যাতে তুইও আমাকে ডাকতে পারিস”।


“আপনি কেন চলে গেলেন মাস্টারমশায়...কেন?” কাঁদতে কাঁদতে বলল প্রমোদ । 


“ধুর পাগল...আমি তো তোর সাথেই আছি রে...কোত্থাও যাইনি...তবে সেদিন তুই বড্ড ঝুঁকি নিয়েছিস রে প্রমোদ ... এর ফল কিন্তু ভালো হবে না রে ”।


প্রমোদ তার কণ্ঠস্বর কঠিন করে বলল, “হলে হবে...তুমি তো আমার সাথেই আছো আর থাকবেও...তাহলে আর ভাবনা কি? জানো মাস্টারমশায়...তোমার কথা আমি সবাইকে বলেছি...কেউ বিশ্বাস করতে চায়না...সবাই আমাকে নিয়ে বিদ্রুপ করে”।


“হেঁ হেঁ হেঁ...” একটা বিশ্রী হাসি হেসে বৃদ্ধ বললেন, “জানি রে জানি...তোর কথা কেউ বিশ্বাস করতে চায়না...সেই জন্যেই তো তোর দুই বন্ধু এই মুহুর্তে তোর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে নিজেদের চক্ষু সার্থক করছে...প্রমোদ একটিবার গিয়ে দরজাটা খোল বাবা...বেচারারা বাইরে দাঁড়িয়ে বড্ড কষ্ট পাচ্ছে...ওদের ভেতরে আসতে দে”।



আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। আমরা যে বাইরে দাঁড়িয়ে আছি তা জেনে গেছেন বৃদ্ধ। একেই বোধহয় বলে ভৌতিক ক্ষমতা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম দু’জনেই। স্থান ত্যাগ করে পলায়ন করলে হয়তো বাঁচতে পারতাম কিন্তু সেই বুদ্ধি তখন খেললই না মাথাতে। কিছু বলবার বা করবার আগেই সশব্দে দরজাটা খুলে আমাদের সামনে এসে দাড়াল প্রমোদ । নিষ্ঠুর ও নিষ্পলক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে সে বলল, “কি ব্যাপার অভিরূপ!...অন্যের ব্যাপারে নাক গলানো ভালো নয় তা শেখোনি?...আর কি রে অয়ন? ধাওয়া করে একেবারে বাড়ি অবধি চলে এলি ? যাই হোক এলেই যখন, তখন সহজে ছাড়ছি না...আমার মাস্টারমশায়ের সাথে দেখা করে যাও...এস...এস”।

আমরা পালানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু প্রমোদ হাত আমাদের দু’জনকেই ধরে ফেলল। কিন্তু একি! কি অসম্ভব কঠিন সেই হাতের বাঁধন। আমরা শত চেষ্টা করেও সেই বাঁধন ছাড়াতে পারলাম না! সেই হাতদুটো আমাদের দু’জনকেই শূন্যে নিক্ষেপ করল। আমরা যেন হাওয়ায় ভেসে ঘরের ভেতর গিয়ে পড়লাম। দেখলাম প্রমোদের মাস্টারমশায় তার বীভৎস চেহারা নিয়ে আমার আর অয়নের সামনে দাঁড়িয়ে।

মাস্টারমশায় অয়নকে বললেন, “কি হে......শুনলাম তুমি নাকি আমার এই ছাত্রটিকে খুব জ্বালিয়ে মারো...আমার কাছে পড়তে চাও তাই না?...পড়তে চাও?...বেশ তো আমি পড়াবো তোমাকে...হেঁ হেঁ হেঁ...পড়াবো...নিশ্চয় পড়াবো...” ধীরে ধীরে বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। এবার তিনি অয়নের জামার কলার ধরে তাকে তুলে ধরে বিশ্রী একটা পৈশাচিক হাসি হেসে বললেন, “দেখবি বুড়ো হাড়ের ভেল্কি? দেখবি?”


রহস্যময় আলো আঁধারের মধ্যে দেখলাম সেই বৃদ্ধের দেহ থেকে রক্ত মাংস গলে গলে পড়ছে। অল্পক্ষনের মধ্যেই তার গোটা দেহটা একটা অস্থিচর্মসার নরকঙ্কালে পরিণত হল। সমস্ত কিছুর সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে প্রমোদের শিশুসুলভ ফূর্তির বহিঃপ্রকাশ। অয়ন কোনোমতে সেই কঙ্কালের বাধনের থেকে নিজেকে মুক্ত করে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। আমরা দুই বন্ধু আপাতত ধরাশায়ী। ঘর ভর্তি এখন একটা অদ্ভুত আলো। প্রেতলোকে হয়তো এরকমই দীপ্তি বিরাজ করে। সেই আবছা আলোতে দেখলাম নরকঙ্কাল আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে এক পা এক পা করে আর হাসতে হাসতে বলছে, “আয় রে...আয়...পড়বি আমার কাছে? পড়বি?”।

কি অদ্ভুত সম্মোহনী শক্তি সেই নরকঙ্কালের। তার দুচোখের কোটরের মধ্যে থেকে একটা অদ্ভুত আলো বেরোতে শুরু করেছে। আমি সম্মোহিতের মত মোহাচ্ছন্ন হয়ে নিষ্পলক দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে রয়েছি। ঘোর কাটল অয়নের ধমকানিতে। চেঁচিয়ে ও আমার উদ্দেশ্যে বলল, “ওদিকে দেখিস না.....দেখিস না...বাঁচতে হলে পালা...দেরি করিস না অভি পালা...”।

আমার ততক্ষনে মুক্তি ঘটেছে সেই বশীভূত অবস্থার থেকে। বাঁচবার চিন্তা জুগিয়েছে মনের জোর। দেখতে পেলাম অয়ন ঘর থেকে উর্ধশ্বাসে দৌড়ে পালাচ্ছে। আমার শরীরে যেটুকু বল অবশিষ্ট ছিল তার সবটা একত্রিত করে অয়নকে অনুসরণ করতে লাগলাম। বুঝলাম বাড়ির বাইরে চলে এসেছি। মাতালের মত দিশাহীন ভাবে ছুটে চলেছি আমি অয়নের পেছনে। ওই আমার একমাত্র পথপ্রদর্শক। আশেপাশের বাড়িগুলো অদ্ভুত প্রেতমূর্তি ধারন করে যেন আমাদের দুর্দশা উপভোগ করে চলেছে। দূর থেকে এখনও ক্ষীণ ভাবে শোনা যাচ্ছে সেই কণ্ঠ, “পড়বি?...আমার কাছে পড়বি?...হেঁ হেঁ হেঁ...আয়...পড়াবো তোদের...নিশ্চয় পড়াবো...”


এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। আমরাও কাউকে বিশ্বাস করানোর বৃথা চেষ্টা করিনি। কিন্তু সেইদিন রাত্রে দৌড়তে দৌড়তে আমরা স্থানীয় থানায় পৌঁছেছিলাম। অলৌকিক অংশটুকু বাদ দিয়ে শুধু এটুকু বলেছিলাম যে প্রমোদ অন্যায়ভাবে একটি মৃতদেহের মালিকানা বহন করছে। খানাতল্লাশি হয়। প্রমোদের ঘর থেকে উদ্ধার করা হয় একটি বাক্সবন্দী নিথর দেহ। থানার অফিসার অয়নের একজন সহপাঠীর বাবা। সেই কারণে সাহায্য পেতে সুবিধা হয় আমাদের। আজও মনে আছে, প্রমোদের ঘর থেকে যখন কাঠের বাক্সটি বের করে নিয়ে যাওয়া হয়, চিৎকার করে কেঁদেছিল ও। বার বার একটাই কথা বলছিল, “ছেড়ে দাও...আমার মাস্টারমশায়কে তোমরা ছেড়ে দাও...”

কাগজে খবরটা বেরিয়েছিলো একদিন পর। মানসিক ভাবে ভারসাম্যহীন ছিল প্রমোদ । মহিমতলায় ওর বাড়ি। বাড়িতে রয়েছেন বৃদ্ধা মা যিনি গত এক বছর ধরে গেঁটে বাতের কারণে শয্যাশায়ী। খুব অল্পবয়সে সে তার বাবাকে হারায়। একজন স্থানীয় শিক্ষক, নাম নারায়ণ বিশ্বাস, পরে তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করায় তাঁর নাম হয় মাইকেল নারায়ণ বিশ্বাস । তিনি প্রমোদকে পড়াতে আসতেন এবং বাবার মতই স্নেহ করতেন ওকে। ও নিজেও অত্যন্ত ভালোবাসতো মাস্টারমশায়কে। ধীরে ধীরে সেই ভালোবাসা অদ্ভুত আকার ধারন করে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে নারায়ণ বাবু নিজে একজন ছিটগ্রস্ত মানুষ ছিলেন। কি সব প্রেতচর্চা নিয়ে সময় কাটাতেন সবসময়। প্রমোদের ওপর সেই প্রভাবটাই পড়েছে।চলতি মাসেই সেই বৃদ্ধের মৃত্যু হয়। তদন্ত করে পুলিশ জেনেছে যে যেই গোরস্থানে নারায়ণ বাবুকে গোর দেওয়া হয়, সেখানকার নিরাপত্তা কর্মীকে এক রাত্রে, মাথায় আঘাত করে অজ্ঞান করে দিয়ে, কবর খুঁড়ে, নারায়ণ বাবুর কফিনবন্দি দেহ বের করে নিজের কাছেই রাখে প্রমোদ আর সেটিকে নিয়ে আসে শহরে , নিজের মামাবাড়িতে। সযত্নে সেই দেহ সংরক্ষিত ছিল তাই পচনের দুর্গন্ধ এদিক ওদিক ছড়ায়নি। লাহিড়ীবাবু সব জেনেও এরকম একটা অপরাধকে প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন। সেই কারণে পুলিশ তাঁকেও আটক করেছে। খবরের কাগজে আরও অনেক কিছু লিখেছে। কিন্তু আমরা যা দেখেছি সেই রাত্রে সে কথার খবর কে রাখে? একটা মানসিক হাসপাতালে প্রমোদ চিকিৎসাধীন। মানসিক বিকৃতির কারণে সমস্ত আইনকানুনের উর্ধে সে। লাহিড়ী বাবুর বাড়ির একতলাটা আপাতত খালি পড়ে আছে। ভবিষ্যতে সেখানে আর কেউ থাকবেন বলে মনে হয় না। আজও রাত্রে প্রমোদের ঘরের দিকে তাকালে বুকটা কেমন করে ওঠে। বার বার মনে হয়, এই বুঝি শুরু হল বীনার সেই করুণ সুর। শিক্ষক আর ছাত্রের মধ্যে সম্পর্কের যের কোন অবধি পৌছেছিল তা আমরা স্বচক্ষে দেখেছি। এই সম্পর্কের এরকম চরম পরিণতি হতে পারে, এর স্বাভাবিক মীমাংসা হয়তো কোনোদিনও হবে না!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror