শোণিত
শোণিত
নিজের গলাটা চেপে ধরে অপূর্বা হতভম্বের চোখে ওর দিকে তাকাল। "তুমি করতে পারলে এটা?" গলা দিয়ে তখন উপচে পড়ছে রক্ত। ঠিক কণ্ঠনালীর নিচে সোজাসুজি ঢুকে আছে একটা কাঁটাচামচ। অনিতা ওকে ধরতে গেল, কিন্তু পারলনা, মেঝেতে পড়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। ক্রমশ ঝাপসা হতে থাকা দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে দেখল ওর কষবেয়ে গড়িয়ে পরা টাটকা গরম রক্ত আঙ্গুলে তুলে
আমি পুলিশ অফিসার সৌমেন রায়। ডিউটি শেষ করে বাড়ির পথে রওনা দেব বলে এগিয়েছি হটাৎ একটা ভারী কন্ঠস্বর ভেসে এলো, "স্যার, আমি একটা খুন করেছি স্যার, প্লিজ আমায় অ্যারেস্ট করুন"- কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে হাপাতে লাগলো আগন্তুক।
আমি এখন একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে। বিশ্বাসই করতে পারছিনা, একজন ভদ্র পোশাক পরা লোক এত রাতে পুলিশ স্টেশনে এসে বলছে আমি খুন করেছি!
-"প্লিজ স্যার" আগন্তক আবার কাকুতি করল- "আমায় অ্যারেস্ট করুন নয় তো আবার আমি কাউকে খুন করে ফেলব।"
আমি ওর দিকে একটা জলের গ্লাস বাড়িয়ে দিল। কাঁপাকাঁপা হাতে একঢোক জল খেল। ওর সারা শরীর ঘামে চপচপ করছে।
-"কাকে খুন করেছেন আপনি?"- টেবিলের উপর রাখা পেপারওয়েট কে ঘোরাতে ঘোরাতে সেটার দিকে তাকিয়েই প্রশ্নটা করলাম ।
-"ওয়াইফ কে।"
-"আচ্ছা? কি করে মারলেন?"
আগুন্তক ঢোক গিলল। "কা- কাঁটাচামচ দিয়ে......গলার ভিতর......"। পেপারওয়েট ঘোরানো থামিয়ে ওর দিকে তাকালাম। আমি কিছু বলছিনা বলে আবার মরিয়া হয়ে বলে উঠল- "আর - আর বডিটা ওই আমাদের পিছনের বাগানে পুঁতে দিয়েছি।"
আমি আবার পেপারওয়েটে মন দিলাম। ওর কথা বিশ্বাস করতে পারছি না ? মনে মনে ভাবলাম পাগল হয়তো, তাই প্রলাপ বকছে।
-"স্যার প্লিজ, আমায় অ্যারেস্ট করুন"- প্রায় কান্নার স্বরে বলে উঠল।
এবার আমি সোজা হয়ে বসলাম। পেপারওয়েট টা সরিয়ে রেখে সামনে এগিয়ে এসে বললাম - "অ্যারেস্ট করুন বললেই তো আর করা যায় না। খুন যে করেছেন সেটার তো প্রমান লাগে।"
- "নিশ্চয়ই স্যার। আমার নাম দীপেন মিত্র, কিছুদূরেই আমার বাড়ি, বাড়ি গেলেই আপনি......" (কথাটা শুনেই চমকে গেলাম আর দীপেন কে কথা শেষ করতে না দিয়েই বললাম - " আপনার স্ত্রী গত দুদিন ধরে নিখোঁজ।"
-"মানে?"- দীপেন হতবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
-"মানে গত দুদিন ধরে যে মানুষটা নিখোঁজ তাকে আপনি আজ খুন করেছেন, হুম?"
দীপেনের এবার সব গুলিয়ে গেল। ও বিভ্রান্ত হয়ে প্রশ্ন করল- "কি - কি বলছেন আপনি? আপনাকে এসব কে বলল?" আমি ঠাণ্ডা চোখে দীপেনের দিকে তাকিয়ে বললাম - "আপনি নিজে।"
-"আমি নিজে!?" বিস্মিত দীপেন কথাটা যেন বিশ্বাস করতে পারল না।
আর বসে থাকতে পারলাম না, একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বললাম - "আপনি নিজে গত পরশু থানায় এসে আপনার স্ত্রীর নামে মিসিং ডায়রি করে গেছেন।"
দীপেন দু-হাত দিয়ে নিজের মাথা চেপে ধরল।
"বিশ্বাস হচ্ছে না, এ দেখুন"- বলে আমি ডায়রির পাতাটা সায়নের দিকে বাড়িয়ে দিল। "আপনি এও বলেছেন একটা নাম্বার থেকে নাকি আপনার স্ত্রীকে খুন করার হুমকি আসছে আপনার কাছে।"
"নাইন-ওয়ান-টুও-সিক্স ...... একি"- দীপেন প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। "এটা যে আমারই নাম্বার। আমার নাম্বার থেকেই আমার স্ত্রীর কাছে ফোন আসবে কি করে?"
দীপেন এবার আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন তারপর মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো। তাকে হতাশ ভাবে বসে থাকতে দেখে বললাম,
-"দীপেন বাবু আপনি বাড়ি যান, কাল সকালে বাড়ি থাকবেন, আমি যাচ্ছি।"
- "কিন্তু স্যার;"
- "উহু, কোন কিন্তু নয়।কাল যাব। এখন বাড়ি যান।"
এরপর আর কোন কথা চলে না। দীপেন চেয়ার ছেড়ে উঠে বেরোতে গেল।
- "শুনুন।"
দীপেন ঘুরে দাঁড়াল। "আপনি কোন সাইক্রিয়াটিস্ট কে দেখান যেন?"
"পোস্টমর্টেম রিপোর্টা পেয়েছো প্রশান্ত " , চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে প্রশ্নটা করলাম ইনভেস্টিগেশন অফিসার প্রশান্ত লাহিড়ী ।
- "স্যার, চামচের কাঁটা গুলো পুরো গলার লেরিংস এর মধ্যে ঢুকে গেছিল। ফলে নিজের গলার রক্ত নিজের শ্বাসনালীতে ঢুকেই মৃত্যু হয়েছে।"
- "আর চামচের ফিঙ্গারপ্রিন্ট?"
- "মিলেছে স্যার।"
- "হুমম।"
সেদিন রাতে দীপেন আসার পরের দিনই আমি আর প্রশান্ত দুজনে বাড়িতে গেছিলাম। দরজা খুলেছিল ওর মেয়ে। ওরা দুজনেই সিভিক ড্রেসে ছিল বলে মেয়েটা ভয় পায়নি।
"তোমার বাবা বাড়িতে নেই?"- আমি প্রশ্ন করেছিল।
"বাবা তো একটু বেরিয়েছে। আপনারা আসুন।" মেয়েটা দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল।"বাবা এখুনি চলে আসবে।"
আমি চোখের ইশারায় প্রশান্তকে আসতে বলে ভিতরে ঢুকলাম।
- "তোমার নাম কি?"
- "রুচিতা"
বেশ মিষ্টি চেহারা মেয়েটার। বয়স খুব বেশী হলে বারো কি তেরো হবে।
- "তুমি খাচ্ছিলে?" রুচিতা উপর নিচে মাথা নাড়ল।
- "যাও খেয়ে নেও, আমরা এখানে বসছি।"
রুচিতা আবার ডাইনিং টেবিলে চলে গেল। চেয়ারের উপর বসে কাঁটাচামচ দিয়ে অর্ধেক খাওয়া ন্যুডুলস টা খেতে লাগলো। মেয়েটার কাছে গিয়ে সামনের চেয়ারটা বসলাম। ওর চোখটা কি বড় বড়, মায়ায় ভরা। রুচিতা আমার দিকে একবারও তাকাল না, নির্লিপ্ত মনে খেতে লাগলো।
"তুমি বাবাকে খুব ভালবাস না?"- আমি ওর পিঠে হাত দিয়ে নরম গলায় জিজ্ঞাস করলাম । "হ্যাঁ..." রুচিতা বড় করে ঘাড় নাড়ল।
"আর মা কে?" রুচিতা ন্যুডুলস মুখে তুলতে যাচ্ছিল, হটাৎ থেমে গেল। "আর মা কে ভালবাস না? হ্যাঁ সূচক ঘাড় নেড়ে আবার খেতে আরাম্ভ করল।
"তোমার মা কে তো অনেকদিন হল পাওয়া যাচ্ছে না।" কোন উত্তর নেই।
"তুমি জানো তোমার মা কোথায়?" এবার রুচিতা উপর নিচে ঘাড় নাড়ল।
"তুমি জানো... ?" অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম । এতটুকু মেয়ে, দুদিন হল মাকে পাওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু কি ভাবলেশহীন মুখ। ছোট বলেই কি কিছু বুঝতে পারছে না?
- "শেষ যখন মাকে দেখেছিলে তুমি তখন কোথায় ছিলে?"
- "এখানে।"
- "আর মা?"
- "রান্নাঘরে।" রুচিতা এখন কাঁটাচামচ টা নিয়ে খেলতে আরাম্ভ করে দিয়েছে।
- "রান্নাঘরে গিয়ে কি দেখলে?"
রুচিতা এবার স্থির দৃষ্টিতে কাঁটাচামচটার দিকে তাকাল।- "রক্ত।"
- "কোথায়?"
- "গলায়।"
- "আর বাবা?"
- "পাশে বসে।"
এরপরই দীপেন চলে আসাতে কথোপকথন আর বেশী দূর এগোয়নি। বাগান খুঁড়ে সত্যিই বডিটা পাওয়া গেছিল। তারসাথে যে কাঁটাচামচটা দিয়ে খুন করা হয়েছে সেটাও। দীপেন কে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। তবুও কোথায় যেন একটা গণ্ডগোল থেকে গেছে। একজন নিজের স্ত্রীকে খুন করে মাটিতে পুঁতে দিয়েছে, আরেকজন বাবাকে পুলিশ অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাচ্ছে দেখেও শান্ত হয়ে বসে আছে........ যেন এগুলো সব হওয়ারই ছিল। পুরো পরিবার টাই কি পাগল নাকি?
"স্যার।" প্রশান্তর ডাকে হুশ ফিরল।
"না হে" চেয়ারে উঠে বসতে বসতে বললাম। "কিছু একটা গোলমাল আছে। দীপেনের অফিসের লোক কি বলছে?"
"বলছে ওই সময়টায় নাকি দীপেন অফিসেই ছিল। পরে একটা ফোন আসাতে বেরিয়ে যায়। মিথ্যা বলছে নিশ্চয়ই।"
"সেতো বলছেই। একটা লোক একই সময় তো আর দু জায়গায় থাকতে পারে না। আচ্ছা, মেয়েটা এখন কোথায়?"
- "ওর এক পিসির কাছে। ভদ্রমহিলা বিয়ে করেনি। মনে হয় ওকে অ্যাডাপ্ট করবে।"
- "বুঝলাম। বলছি ওই বাড়ি থেকে যে সাইক্রিয়াটিস্ট এর প্রেস্কিপশন আর ফাইলগুলো নিয়ে আসা হয়েছিল না সেগুলো একবার দেও তো।"
- "স্যার একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছেন, ফাইলে কিন্তু পেশেন্টের নাম দীপেন মিত্র নেই।"
"হোয়াট?" আমি চমকে উঠল।
"দেখুন।" ফাইলটা প্রশান্ত আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।
বিস্ময়ের সাথে দেখলাম ফাইলে পেশেন্টের জায়গায় নাম আছে- অপূর্বা মিত্র।
প্রায় তখন মাঝরাত আমি দীপেনের সেলে গেলাম । আমাকে দেখেও না দেখার ভান করলো দীপেন।
আমি বললাম - "সাইক্রিয়াটিক পেসেন্ট টা তো আপনি নন্ না?"
এবার দীপেন মুখ খুলল। কান্নায় ভেঙে যাওয়া গলায় মেঝের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বলল - "আমার আর অপুর এর সেই কলেজ লাইফ থেকে ভালোবাসা ছিল জানেন। বাড়ি থেকে মেনে নেয়নি তাই পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম। যখন রুচিতা আমাদের কোলে এলো - " দীপেন আমার দিকে মুখ তুলে তাকাল তার চোখদুটো ছলছল করছে। "তখন- তখন আমার মনে হয়েছিল আর কিছু চাই না। এই দুজনকে নিয়েই সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারব।"
দীপেন বলে চলল- "রুচিতা যখন ছোট তখন ওর রোগ টা ঠিক ধরতে পারিনি। যত বড় হল তত রোগটা প্রকট হতে লাগলো। ও রক্ত দেখলে নিজেকে সামলাতে পারে না স্যার। একবার একটা ব্লেড দিয়ে নিজের পা কেটে রক্ত ঠোঁটে আর জিভে মাখাচ্ছিল। তাই দেখে আমরা খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম।"
দীপেন চোখটা মুছে বলল- "অনেক সাইক্রিয়াটিস্ট, কাউন্সিলার-কে দেখিয়েছি জানেন। কিছুতেই কিছু হয় নি। ওষুধ পরলে ঠিক থাকে নয়তো আবার যে কে সেই।"
আমি দীপেনকে প্রশ্ন করলাম - "তার মানে অফিসের লোক ঠিকই বলছে। খুনের সময় আপনি অফিসেই ছিলেন। ফোনটা কে করেছিল, মেয়ে?"
দীপেন মাথা নাড়ল। "ওর মা, বলছিল মেয়ে আবার বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। খেতে চাইছে না। গিয়ে কি দেখি জানেন? সব শেষ। গলায় কাঁটাচামচ নিয়ে রান্নাঘরে নিথর দেহে পরে রয়েছে অপু । আর নিজের মায়ের রক্তে মাখানো আঙ্গুল তৃপ্তি সহকারে চাটছে রুচিতা । দীপেন দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল।
আমি হতভম্ব হয়ে জিগ্যশা করলাম "তাই বলে আপনি নিজের মেয়ের করা খুন নিজের......"
"স্যার" আমার কথা শেষ করতে দিল না দীপেন । "সারা জীবন কিচ্ছু পাই নি। শুধু এই দুজন মানুষকেই ভালবেসে গেছি। একজন কে হারিয়েছি। আরেকজন কে হারাতে চাই না।"
- "কিন্তু ও তো বাচ্চা। ওর হয়তো বেশী শাস্তি ও......"
- "না স্যার, সেটা হয় না। পুলিসের হাতে তুলে দিলে আমার মেয়েটা মরে যাবে স্যার। রুচিতার মধ্যেই তো আমার অপুও বেঁচে আছে। তার থেকে এই ভালো। শুনেছিলাম ওর পিসি আমেরিকায় চলে যাবে, ওর ওখানে ট্রিটমেন্ট করালে ও সুস্থ হয়ে যাবে স্যার। ও ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে।"
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। খালি অবাক বিস্ময়ে দীপেনের দিকে তাকিয়ে রইলাম ।
দীপেন নিজের মনেই বলতে লাগলো- "আমার মেয়ে সুস্থ হয়ে যাবে স্যার। ও ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে।"
আমি আর কিছু বললাম না, উঠে দাঁড়ালাম সব প্রশ্নের উত্তর থাকে না।
আমি সেলের ভিতরে দেখতে পেলাম একটা ভাঙ্গাচোরা হেরে যাওয়া মানুষ নিজেকে সেলের অন্ধকারের সাথে ক্রমশ মিশিয়ে দিচ্ছে। মনে একটা খটকা থেকেই গেলো "সত্যিই কি হেরে যাওয়া? নাকি হেরেও জিতে যাওয়া? কে জানে?"
