পরিশেষ
পরিশেষ
১১ জানুয়ারি , ২০০৪
আজ আবার আমাকে যেতে হল হাসপাতালে।মাঝে মাঝে রোগটা এমন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তখন আর ডাক্তারের কাছে না গেলেই নয়।ডাক্তার যাই বলুক আমি জানি আমার অবস্থাটা কি।আসলে আমি স্কিৎজোফেনিয়ায় ভুগছি।এই রোগটা সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই তাদের বলে রাখি এটি একটি মারাত্মক মানসিক ব্যাধি যা চিন্তাধারা এবং অনুভূতি প্রকাশের মধ্যে কোনো সঙ্গতি থাকে না।তবে এটা মারাত্মক কিছু না,ডাক্তারের কথা অনুযায়ী ওষুধ আর মেডিটেশন করলে আস্তে আস্তে সুস্থ হওয়ার সম্ভবনাও আছে। তবে এটা আমার বরাবরের রোগ না, এটা দেখা দিয়েছে সেই দুই মাস আগের ঘটনার পর। নভেন্বরের রাত , আমার এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে বেশ আনন্দ করতে করতে বাড়ি ফিরছিলাম, আমরা বলতে আমি , আমার স্ত্রী আর আমার মেয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে তুমুল বেগে বৃষ্টি নেমে এলো, বৃষ্টির বেগ এতটাই যে সামনের কিছুই দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না, গাড়ি খুব আস্তেই চালাচ্ছিলাম,কিন্তু হটাৎ সামনের ট্রাকটাকে ওভারটেক করতে গেলাম, আর তারপরেই..........। সেদিন আমার একটু ভুলের জন্য আমাদের ফুলের মত ছোট্ট মেয়ে দিয়াকে হারালাম।আর তার সাথে প্রায় আধমরা হয়ে গেলো আমার স্ত্রী অপর্ণা। সেই ঘটনার পর মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছিলাম যে বেঁচে থাকার কোন ইচ্ছেই ছিল না আমার।এই অসুখের জন্মও মনে হয় সেখান থেকেই।
আজ বাড়ি ঢুকেই যখন দেখলাম ডাইনিং টেবিলে দিয়া বসে আছে, তখনই বুঝতে বাকি রইল না যে ডাক্তার যাই বলুক, আমার পক্ষে সুস্থ হওয়া আর হবে না। আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে , শিরদাঁড়া দিয়ে যেন শিহরণ খেলে গেল। তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলাম।শোবার ঘরে ঢোকার আগে একবার উঁকি মেরে দেখলাম, ও সেই একই ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
ঘরে ঢুকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম আমার স্ত্রীর বিছানাটা দিকে।পাশে রাখা চেয়ারটা টেনে বসলাম। মাথার পাশে রাখা মনিটারটা জানান দিচ্ছে ওর হৃদস্পন্দন।সেদিন প্রাণে বেঁচে ফিরলেও ওর কোমরের নীচ থেকে প্যারালাইজড। আর পেটেও চোট লেগেছিল গুরুতর।
স্যালাইনের বোতলটা চেঞ্জ করে দিতে গিয়ে দেখলাম অপর্ণার ঘুম ভেঙে গেছে।কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল কখন এসেছি।
বললাম, “এই কিছুক্ষণ আগে।” ও বললো, “এখন ঠিক আছো?”
বললাম, “হ্যাঁ।”
বললাম না যে এই উপরে আসার সময়ও বুঝতে পেরেছি যে আমি পুরোপুরি ঠিক নেই।
একটা ব্যাপার প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছি যে মিথ্যে কথা বললে অপর্ণা ঠিক ধরে ফেলে। সামান্য হেসে বলল, “আবার দেখতে পেয়েছো তাই না ?”
মাথা নিচু করে বললাম, “হ্যা।”
ও আর কিছু বললো না শুধু দেখলাম ওর চোখ দিয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ সব চুপ চাপ। তারপর অপর্ণা ধরা গলায় বলল, “আমাদের মেয়ে আর বেঁচে নেই।” বলে আবার শুরু হল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। আমার চোখের সামনেটাও কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। আজ এখানেই থাক ।
১২ জানুয়ারি , ২০০৪
আজ আর বেশি লিখতে পারব না সারাদিন অপর্ণার কাছেই থাকতে হয়েছিল তাই খুব ক্লান্ত। ওর শরীরটা বেশ ভালো ছিল না । ওকে খাইয়ে সব শেষে ‘গুড নাইট’ বলে শুতে যাওয়ার সময় অপর্ণা বলল, “তোমায় খুব কষ্ট দিচ্ছি না? আমিও মরে গেলে ভালো হত, তাই না।”
বললাম, “কি যাতা বলছ ? আমার জীবনে তুমি ছাড়া আর কি আছে বল? তুমিও যদি চলে যাও তাহলে তো…”
দরজার বাইরে পায়ের শব্দ শুনে আমি কথা থামিয়ে দরজার দিকে তাকালাম।দেখলাম দিয়া দরজার পাশ দিয়ে উঁকি মেরে আমাদের দেখছে।সেই ঘোলাটে দৃষ্টি।সব নিস্তব্ধ।কেটে গেল আরও মিনিট পাঁচেক।তারপর অপর্ণার গলা শুনে চমকে উঠলাম।
“কি দেখছো ওই দিকে?”
“না, কিছু না,” বললাম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
ও আমার হাতের উপর হাত রেখে বলল, “তুমি নিজের মনকে বোঝানোর চেষ্টা কর না, এই ভাবে কতদিন চলবে?”
“কি বঝাবো ? আমাদের মেয়ে আজ আমার জন্যই…”
“তুমি নিজেকে দোষারোপ করা যতদিন না বন্ধ করবে, ততদিন এই অসুখ তোমার পিছন ছাড়বে না।”
আমি মাথা নিচু করে বসে থাকলাম।আমি নিজেও যে সেটা বুঝি না, তা নয়।কিন্তু যতবার বোঝানোর চেষ্টা করি, ততবার কে যেন মাথার মধ্যে এসে চিন্তাগুলো জড়িয়ে দিয়ে চলে যায়।
১৩ জানুয়ারি , ২০০৪
একে তো মন ভালো নেই, তার উপর যতক্ষণ অফিসের কাজ করছিলাম সোফায় বসে,ততক্ষন আমার পিছনে বসে রইল দিয়া।কিন্তু কোন কথা বলল না। প্রথম প্রথম কিন্তু বলত।তারপর আস্তে আস্তে বলা বন্ধ করে দিল। শুধু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। আমি মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে উঠি। কিন্তু ওরা নিশ্চুপ। অপর্ণাকে গিয়ে সব বললাম, ও বলল , “তোমার মনের ভুল ওই সব। তুমি আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠছ তাই কথা শুনতে পাচ্ছ না। এরপর দেখবে, আস্তে আস্তে ওদের দেখতেও পাবে না।”
আমিও সেই দিনের আশায় আছি। যেদিন ওদের আর দেখব না, সেদিন বুঝব আমি পুরোপুরি সুস্থ।
১৪ জানুয়ারি , ২০০৪
আজও সকাল থেকেই মনটা ভালো নেই। যেমন ভাবছিলাম যে আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠছি, সেটা ভুল। কাল রাতে লেখা শেষ করে সবে শুয়েছি এমন সময় ‘বাপি’ ডাক শুনে চমকে উঠলাম। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে দেখি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে দিয়া । আমাকে উঠে বসতে দেখে দিয়া বলল, “বাপি খুব ভয় লাগছে। তোমার কাছে শোব?”
নিজেকে কেমন পাগল পাগল মনে হতে লাগল। এত ওষুধ এত মেডিটেশন সব ব্যর্থ। সুস্থ আর হতে পারছি কোথায়? কাল অবধি ঠিক ছিল আজ আবার সেই একই জায়গায় ফিয়ে এলাম। পাশের টেবিলে রাখা ফুলদানিটা তুলে ছুঁড়ে দিলাম ওদের উদ্দেশ্যে। মুহূর্তে দরজার পিছন দিয়ে মিলিয়ে গেল।
আজ সকালে উঠেও দেখি দিয়া সামনের ঘরের সোফায় বসে আছে। আমি পাত্তা দিলাম না। বেশি পাত্তা দিলেই আমার মাথা আরও খারাপ হয়ে যাবে।
শোবার ঘরে গিয়ে দেখি অপর্ণার ঘুম ভেঙে গেছে। আর দেখে মনে হল কষ্টটাও যেন একটু কম।
“আজকে ভালো লাগছে?”
কাল রাতের কথাটা ওকে বলতে অপর্ণা বলল, “তুমি একটা কথা বল তো? বাইরে গেলে দেখতে পাও ওকে ?”
“না,” সংক্ষেপে উত্তর দিলাম।
“আর হাসপাতালে?”
“না।”
“তার মানে তুমি ওদের শুধু এই বাড়িতেই দেখতে পাও। তাই তো?”
এই কথাটা আমি কখনও ভেবে দেখিনি। সত্যিই তো। বাড়ির বাইরে গেলে তো কখনও দিয়াকে দেখতে পাই না। তার মানে কি এই বাড়িতে ওদের সব ব্যবহৃত জিনিষগুলোর সাথে আমার অসুখের যোগাযোগ আছে? তাহলে এই বাড়ি যদি ছেড়ে দিই তবে আমি কি সুস্থ হয়ে উঠব?
“কি ভাবছো?” চটক ভাঙল অপর্ণার প্রশ্নে।
বললাম, “তুমি যা ভাবছ, তাই।”
“তাহলে আমায় কথা দাও যে আমি মরে গেলে তুমি এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে।”
“বারবার মরার কথাটা উঠছে কেন বুঝতে পারছি না,” একটু বিরক্ত হয়ে বললাম। “আর অন্য কোথায় যাব? টাকা কোথায়?”
অপর্ণা সামান্য হেসে বলল, “কেন মনে নেই এই বাড়ির ফায়ার ইন্সিওরেন্স করা আছে।আমার যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে তুমি বরং বাড়িটায় আগুন ধরিয়ে দিও।তাতে লাভ দুটো।প্রথম হল ইন্সিওরেন্সের টাকাটা পেয়ে যাবে, আর দ্বিতীয় হল তোমার অসুখের থেকেও হয়তো মুক্তি পেয়ে যাবে।” আমি আর কিছু বললাম না।
১৮ জানুয়ারি , ২০০৪
গত তিনদিন লেখার একটুও সময় পাইনি।অপর্ণার অবস্থা দিনদিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।সারাদিন কষ্টে ছটপট করছে ও।আমি আর ওকে এইভাবে দেখতে পারছি না।মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি ওকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য।কিন্তু ঈশ্বর আবার কবে আমার কথা শুনেছে যে আজ শুনবে?
অপর্ণার কষ্টের ফলে আমিও যেন একটু বেশিই উদবিঘ্ন হয়ে আছে। আর তার ফল স্বরূপ ঘন ঘন দেখতে পাচ্ছি দিয়াকে। দরজার দিকে তাকালেই দেখছি ওরা দাঁড়িয়ে আছে।
একবার মনে হল তাড়াতাড়ি ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাই,কিন্ত পর মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল সেইবার হাসপাতালে নিয়ে যেতে গিয়ে সে কি কাণ্ড।সবে আর্টিফিশিয়াল ভাইব্রেটরটা বন্ধ করতেই অপর্ণা প্রায় মরেই যাচ্ছিল।তাই এবার আর সেই ভুল করলাম না।কি করব কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না , চোখগুলো আবার ঝাপসা হয়ে এলো ।
২২ জানুয়ারি , ২০০৪
শেষমেষ আজ দুপুরে ঠিক করে ফেলেছি, ওর কষ্টটা শুধু আমিই লাঘব করতে পারি। আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী। আজ রাতেই ওকে ওর জীবনের সেরা গিফটটা দেব। ওকে মুক্তি দেব ওর কষ্ট থেকে।
এখন রাত সাড়ে বারোটা বাজে। আজ বিকেলে গিয়ে পেট্রল পাম্প থেকে ছয় লিটার পেট্রোল কিনে এনেছি। মিনিট পাঁচেক আগে অপর্ণার ঘরে যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম দিয়া ওর শোবার ঘরে শুয়ে আছে। আমি আস্তে করে ওদের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিলাম। তারপর গেলাম অপর্ণার ঘরে। অঘরে ঘুমচ্ছে ও।এই ঘুম আর ভাঙবে না আজ কারণ যে ঘুমের ওষুধের ডোজটা প্রায় চারগুন করে দিয়েছি। তারপর উঠে গিয়ে বন্ধ করে দিলাম আর্টিফিশিয়াল ভাইব্রেটরটা। হঠাৎ যেন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে , বারবার মুখটা হা করে বাতাস নিতে চাইছে ও। আমি এই দৃশ্য আর দেখতে পারলাম না। চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কতক্ষন এইভাবে বসে ছিলাম জানি না। চোখ যখন খুললাম, তখন দেখিঅপর্ণার দেহে কোন সাড় নেই। দুহাতে করে বুকে জড়িয়ে নিলাম ওকে, শেষ বারের মত। তারপর আলতো করে শুইয়ে দিলাম।
পাশে রাখা পেট্রোলের ক্যানটা থেকে ভালো করে পেট্রোল ছড়িয়ে দিলাম সারা বাড়িময়। পেট্রোলের উগ্র গন্ধে মাথা ঝিমঝিম করছিল আমার। বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলাম। তারপর পকেট থেকে দেশলাই বের করে আগুন ধরিয়ে দিলাম। ভেবেছিলাম ইন্সিওরেন্সের টাকাটা নিয়ে পালাবো, কিন্তু বাড়িটা দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখে মত পাল্টালাম।
তারপর এক মিনিটও না দাঁড়িয়ে সোজা চলে এসেছি থানায়। অপর্ণাকে আমি মুক্তি দিয়েছি ঠিকই তবে মানুষ মারার সাজা আমায় পেতেই হবে। না হলে মরে গিয়ে যে ওদের দুজনকে আমি মুখ দেখাতে পারব না!
না এবার লেখা বন্ধ করি, ইন্সপেক্টর সাহেব ডাকছেন।
ডাইরিটা পড়া শেষ করে ডাক্তার বসু তাকাল ইন্সপেক্টার বর্মনের দিকে আর বললেন, “বুঝলাম। লোকটার মানসিক ভারসাম্যও মোটেও ঠিক নেই । কিন্তু লোকটা এখনও পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে যায়নি বুঝলেন। যদি তাই হত, তাহলে কি আর সারেন্ডার করত? ”
ইন্সপেক্টার বর্মন বললেন, “আমিও সেটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু…” এই বলে উনি ডাঃ বসুর সামনে একটা পুরনো খবরের কাগজের কাটিং রেখে দিলেন। খবরটা ২২শে নভেম্বর ২০০৩ সালের।
ডাঃ বসু কাটিংটা তুলে নিয়ে পড়তে লাগলেন।
“গতকাল রাত সাড়ে এগারোটার সময় বেনেপাড়া রোডে ট্রাক ওভারটেক করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সামনের একটা ভাঙা বাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগে । ভাঙা বাড়ির রড গুলো গাড়ির উইন্ডশিল্ডে ভেঙে ভিতরে ঢুকে যায় । গাড়ির চালক অংশুমান রায় (৩২ ) গুরুতর আহত হয়েছেন। চোট লেগেছে মাথায়। পিছনের সিটে বসা ওনার কন্যা দিয়া রায় (৮) চোট পেলেও সেটা গুরুতর নয়। কিন্তু সংঘর্ষের ফলে মৃত্যু হয়েছে ওনার স্ত্রী অপর্ণা রায়ের (২৮)।”
