Debdutta Banerjee

Romance

3.4  

Debdutta Banerjee

Romance

কথা দিয়েছিল

কথা দিয়েছিল

5 mins
16.7K


ট্রেনটা প্রায় চার ঘন্টা লেটে পৌঁছালো। নেমেই কথা ছুটে স্টেশনের বাইরে আসে। একটা ওলা নিয়ে ছুটে চলে ফাঁকা রাস্তায়, হাতে সময় খুব কম। সন্ধ‍্যা ছ'টায় পৌঁছানোর কথা ছিল এখন আটটা বাজে। মনের মধ‍্যে অনিশ্চয়তা ভিড় করে,আসবে তো অরীন? এতক্ষণ দাঁড়াবে কি?

আজ যে ভ‍্যালেনটাইন ডে,তাই এত রাতে মিলেনিয়াম পার্কের গেটে লোকের ভিড়। টিকিট কেটে একা ঢুকতে কেমন যেন লাগে কথার। একটা অজানা ভয়..কিন্তু মন বলে অরীণ আসবেই...

এমন একটা উদ্ভট খেয়াল কথার মাথাতেই এসেছিল পাঁচ বছর আগে।

কলেজে ঢুকেই অরীণের সাথে পরিচয় হয়েছিল,পড়াশোনায় ভাল অরীণ যে কোন মেয়েকেই সহজে পটিয়ে ফেলতো। আর ঘন ঘন প্রেমিকা বদলানো ওর একধরনের শখের মধ‍্যে পড়তো। দেখতেও ছিল খুব সুন্দর আর দারুণ গান গাইতো ছেলেটা। সাধারণ দেখতে রূপকথা রায়কে বন্ধু ছাড়া আর কিছু ভাবেইনি কোনদিন!

কথা ওর স্বভাব জানত,ভাল বন্ধু ছিল দুজন। অনেকবার কথা ওকে বলেছে যে কেন ও এভাবে মেয়েদের ইমোশন নিয়ে খেলে ? হেসে এড়িয়ে গেছে অরীণ।

কেউ বিপদে পরলে অরীণ খুব সাহায‍্য করতো।

কলেজ ম‍্যাগাজিনের দায়িত্বে ছিল ওরা দুজনেই,একটা প্রেমের কবিতা লিখেছিল আহেলী,অরীণ ওর প্রেমে পড়লো। কথা ওকে বুঝিয়েছিল যে আহেলী খুব নরম মনের মেয়ে,এই ভাবে ওকে ঠকানো উচিৎ না। কিন্তু অরীণের যা স্বভাব,বাধ‍্য হয়ে আহেলীকেও সাবধান করেছিল কথা।

তবুও আহেলী অরীণের দিকেই ঝুঁকে ছিল। আর নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কথাও ওদের সাথে জড়িয়ে গেছিল। এভাবেই সব ঠিকঠাক চলছিল। কিছুদিন পর অরীণ যথারীতি আহেলীকে এড়িয়ে যেতে শুরু করলো,আহেলী অনেক চেষ্টা করেছিল ওকে আটকানোর।

কথা অনেক বুঝিয়ে ছিল অরীণকে, কিন্তু অরীণের চঞ্চল মন যে ক্ষণস্থায়ী।

আহেলী হঠাৎ করে পরদিন কলেজে সবার সামনে কথাকেই দায়ী করে বসেছিলো এই ঘটনার জন‍্য। সবার সামনে কথাকে অপমান করেছিল নোংরা কথা বলে। কথা নাকি অরীণের প্রেমে পড়েছে আর তাই কেউ অরীণের জীবনে এলে বন্ধু সেজে ঢুকে সম্পর্ক নষ্ট করে। আহেলী আর কি কি বলেছিল শুনতেই পায়নি কথা। দেখতে সাধারণ হলেও আত্মসন্মান বোধ প্রবল ছিল রূপকথার।

এমন মিথ‍্যা অপমানে চোখে জল এসে গেছিল। ছুটে পালিয়েছিল কলেজ থেকে।

এদিকে অরীণ ঘটনাটা জানতে পেরে আহেলীকে ধরেছিল কলেজে। আহেলী ওকে কিছু বলতে যেতেই সপাটে থাপ্পড় মেরেছিল ও। আহেলী ভাবতেই পারেনি এমন হতে পারে। এরপর সোজা অরীণ চলে গেছিল রূপকথার বাড়ী।

আজ ও মনে আছে কথার ,বাড়ীতে সেদিন আর কেউ ছিল না,অরীণ এসে ওর ঘরে বসে ছিল চুপ করে, এত গম্ভীর ওকে কোনদিন দেখেনি কথা। যেমন হঠাৎ এসে ছিল কিছুক্ষণ পর হঠাৎই চলে গেল। কথা ওর পিছন পিছন বেরিয়ে এসেছিল। ভয় পেয়েছিল অরীণের ঐ চুপ করে যাওয়া দেখে। গঙ্গার ঘাটে এসে বসে ছিল অরীণ। কথা ওর পাশে এসে বসেছিল।

কিছুক্ষণ পর অরীণ বলে

-'কথা, তুই জানিস আমার বাবা মা নেই। দাদুর কাছেই মানুষ। আমার বাবা মার মধ‍্যে ছাড়াছাড়ি হয়েছিল আমি যখন মাত্র দশ বছরের। যে যার পছন্দ মত বন্ধুর হাত ধরে চলে গেছিল,আমাকে কেউ নিতে চায়নি। আমি ছিলাম ওদের নতুন জীবনের পথের কাঁটা। দাদু আমায় আঁকড়ে ধরে ছিল সেদিন। কিন্তু আমার ঐ বয়সেই জানা হয়ে গেছিল যে ভালবাসা বলে কিছু নেই। ও সব দুদিনের মোহ। আমিও সেই খেলাতেই মেতে ছিলাম। কোন মেয়েকেই ভালবাসিনি কোনদিন। আর সব জেনেও মেয়েগুলো আমার পেছনেই ঘুরতো। আমার জীবনে বন্ধু যদি কেউ থাকে সে তুই। তাই আমাকে ছেড়ে যাস না।" 

কথা প্রথম বার একটা এত বড় ছেলেকে একটা শিশুর মতো কাঁদতে দেখেছিল।

এরপর অরীণ বদলে গেছিল। আর কোন মেয়েকে প্রপোজ করেনি। চুপচাপ হয়ে গেছিল খুব,কথার সাথেই যা একটু মিশতো। দেখতে দেখতে কলেজ শেষ হলো।

কথার বাবা বাইরে বদলি হয়ে গেছিল,কথাদের যাওয়ার দিন এসে গেছিল।

অরীণ সেদিন কথাকে নিয়ে এই মিলেনিয়াম পার্কে এসেছিল, অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিল। শেষে অরীণ বলেছিল

-"তুইও আমায় ছেড়ে চলে যাচ্ছিস?" কথা বলেছিল

-"তোকে ছেড়ে যাচ্ছি কে বলল! বাবা বদলী হল বলে একটু দূরে যাচ্ছি।"

অরীণ বলেছিল

-"কথা, আমি আজ বুঝতে পারছি ভালবাসা আছে। আমার মনেও লুকিয়ে আছে, আমি যে তোকে ছাড়া বাঁচব না।"

কথা আস্তে আস্তে শক্ত হয়। অরীণ এসব কথা বহু মেয়েকে বলেছিল আগে। কিন্তু আজ ওর গলায় এমন কিছু ছিল কথার মনে হয় ও সত‍্যিই মন থেকে বলছে। তবুও কথা বলে

-"তুই আমার ভাল বন্ধু,যেখানেই থাকি আমরা বন্ধুই থাকবো কথা দিচ্ছি।" অরীণ এবার ওর হাত ধরে বলে

-"বন্ধুর থেকেও বেশী তোকে সারা জীবনের জন‍্য নিজের করে পেতে চাই রে‌। আমি বদলে গেছি,আজ বুঝতে পারছি তোকেই ভালবাসি।" কথা উঠে দাঁড়ায়। বলে

-"তুই বোধহয় আবার ভুল করছিস। আমি ঐ মেয়েদের মতো না।" 

-"তুই আলাদা,আর তাই তোকেই এতো ভালবাসি। বিশ্বাস কর,এবার আমি তোকে আমার মনের সত‍্যিটা বললাম" বলে অরীণ।

কথা কেঁপে ওঠে,ও নিজেও যে অরীণকে ভালবাসে উপলব্ধি করে। ইচ্ছা করে চিৎকার করে বলতে "ভালবাসি" কিন্তু মুখে বলে অন‍্য কথা। বলে

-"অরীণ, ভালবাসা একটা বিশ্বাস, একটা উপলব্ধি,যদি সত‍্যি আমায় ভালবাসিস আমি চোখের আড়াল হলেও তোর কাছেই থাকবো। তুই আমাকে অনুভব করবি,এই দূরটাকে দুরত্ব মনে হবে না।"

-"তাহলে কথা দে যে তুই সারাজীবন আমারই থাকবি? অপেক্ষা করবি আমার জন‍্য!"

অরীণের গলায় আকুতি ঝরে পড়েছিল।

-"আমার একটা শর্ত আছে। আগামী কাল ১৪ই ফেব্রয়ারি। ভ্যালেন্টাইন্স ডে। আমি কাল ভোরে চলে যাব। ঠিক পাঁচ বছর পর এই দিন সন্ধ‍্যায় আমরা এখানে আসবো। আর সেই দিন থেকে কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না। কিন্তু এই পাঁচ বছর আমাদের মধ্যে কোন যোগাযোগ থাকবে না। যদি দেখাও হয় আমরা শুধু বন্ধু মনে রাখবি। আর ২০১৭র ১৪ই ফেব্রয়ারি যদি একজন আসি অন‍্যজন না আসি কেউ কাউকে খুঁজবো না। ভবিষ‍্যতে দেখা হলেও বন্ধু থাকবো। এ নিয়ে কেউ কাউকে প্রশ্ন করবো না।" কথা বলেছিল সেদিন।

কথার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে অরীণ বলেছিল

-"তুই আসবি শুধু এই প্রমিস কর। আমি পাঁচ কেন পাঁচশো বছর ও অপেক্ষা করবো। তোর কথাই থাক। আমার রূপকথা এভাবেই আমার সাথে থাকিস সারাজীবন।"

-"ম‍্যাডাম,পার্ক বন্ধ হবে। জায়গাটা ভাল না। আপনি কি একা?আর বসবেন না তাহলে।" গার্ডের ডাকে বাস্তবে ফেরে কথা। ঘড়িতে দেখে সাড়ে নটা। উঠে দাঁড়ায়। ভাবে অরীণ আগে এসে চলে যায়নি তো?

আবার ভাবে অরীণের মতো ছেলে তার অপেক্ষায় পাঁচ বছর বসে থাকবে এ হতেই পারে না!এভাবে তার আসাই উচিৎ হয়নি। আসলে মনের কোণায় একটা ক্ষীণ আশা ছিল ,নিজের ভালবাসার প্রতি একটা বিশ্বাস ছিল। এই উদ্ভট ইচ্ছাটা তো তার মাথাতেই এসেছিল। পায়ে পায়ে গেটের বাইরে চলে আসে। আবার মনে হয় অরীণ কি এসে ফিরে গেল তার দেরী দেখে! রাত বাড়তে থাকে, ফাঁকা রাস্তায় কোনো ট্যাক্সি নেই। নেটটাও কাজ করছে না যে ওলা ডাকবে।

অসহায় রূপকথা কি করবে ভেবে পায় না!

কিছুতেই অরীণকে অবিশ্বাস করতে মন চায় না।

দাদুর কাজ শেষ করতেই সন্ধ‍্যা হয়ে গেছিল। দাদু ছাড়া আর কেউ ছিল না অরীণের। দাদুও তাকে ছেড়ে গেল। আত্মীয় বন্ধুদের কোনরকমে বিদায় করে গাড়ী নিয়ে ছুটল অরীণ। আজ যে তার পাঁচ বছরের প্রতীক্ষার অবসান।

কলকাতার রাস্তায় জ‍্যাম এতো রাতেও কমেনি।কিন্তু অরীণের বিশ্বাস রূপকথা ঠিক বসে থাকবে। কথা ওকে বলেছিল ভালবাসা মানে বিশ্বাস,তাই ও বিশ্বাস হারায় না।

একটা গাড়ী খুব জোরে এসে ব্রেক কষে কথার সামনে। এতো রাতে ভয় পেয়ে যায় কথা। পাঞ্জাবি পরা নেড়া মাথা ছেলেটাকে প্রথমে চিনতেই পারেনি সে। দাদুর ছেলের কাজ করেছে বলে চুল ফেলেছে অরীণ। কথা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। অরীণ ওর হাতটা ধরে বলে

-"কথা দিয়েছিলাম যে...... ."

-সমাপ্ত-


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance