Rima Goswami

Romance Tragedy

2.1  

Rima Goswami

Romance Tragedy

কণ্টকপূর্ন অতীত

কণ্টকপূর্ন অতীত

7 mins
268



অতীতের সেই দিনগুলি কি সবসময়ই আকর্ষনীয় আর সুন্দর ? না কখনোই তা নয় , অতীতের পেড়িয়ে আসা দিনগুলো কখনো সুন্দর ,কখনো আবার বেদনা বিধুর । আমাদের কৈশোর জীবনে অবসর আলহাদ ছিল বড়দের সঙ্গে সময় কাটানো তাদের সাথে তাদের অতীতের দিন গুলোর গল্প শোনা । কারণ আমাদের হাতে তখন ছিলনা মুঠোফোন । মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবার পর আমাদের হাতে এসেছিল নোকিয়ার এগারোসো মডেলের মুঠোফোন । সেই মুঠোফোনে না ছিল ইন্টারনেট , না ছিল টিকটক , না ছিল নিজস্বী তোলার ( সেলফি ) ব্যবস্থা । আমাদের ল্যাভিস সময় পার হয়ে যেত গল্পের আসরে । আমার দাদু ছিলেন আমাদের গল্প বলার একজন প্রধান নায়ক । অবসর সময়ে আমরা ছুটতাম দাদুর কাছে । উনি ছিলেন লম্বা , চওড়া একজন ডাকাবুকো মানুষ । ওনাকে দেখেই বোঝা যেত যৌবনে উনি ছিলেন ভীষণ সুপুরুষ । উনি মাঝে মাঝেই ওনার অতীতের ঝাঁপি খুলে বসতেন আমাদের কাছে , সেই সব অতীতের গল্পে একটা গল্প আজও আমাকে ইমোশনাল করে দেয় । দাদুর দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন আমার ঠাকুমা । ওনার প্রথমা স্ত্রী কে উনি বড্ড ভালোবাসতেন , সেটা আমরা বহু বছর পরও অনুভব করতে পারতাম । ওনার প্রথম বিবাহ ছিল প্রেমজ বিবাহ । ওনার প্রথমা স্ত্রীর নাম ছিল ভবানী । ভালোই চলছিল দাদুর সংসার জীবন তবে কোন সুখই চিরস্থায়ী নয় । ওনাদের সুখের সংসার ও চিরস্থায়ী হলো না । বিয়ের পর বহুদিন কেটে যাবার পরও যখন সন্তান হলো না ওদের চিকিৎসা করে জানা যায় ভবানীর কোনদিনই সন্তান ধারণ করা সম্ভব হবে না । তখনকার দিনে চিকিৎসা বিদ্যা এত উন্নত মানের হয়নি । তখন কোথায় আই ভি এফ ? কোথায় সারোগেসি ? তখন স্ত্রীর সন্তান না হলে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে নিত । আইনত কোন বাধা ছিল না দুই স্ত্রী নিয়ে ঘর করতে । সতীন নিয়ে ঘর করতে হত প্রথম স্ত্রীকে অথবা সে তার বাপের বাড়ি ফিরে যেত ।


সন্তান হবে না জেনে ভবানী কেঁদে কেঁদে ভাসালেন কিন্তু দাদু ছিলেন আধুনিক মনের মানুষ । দাদু তার স্ত্রীকে বোঝালেন ওনার কোন অসুবিধা নেই যদি ওনাদের সন্তান না হয় । তাছাড়া ওনার বড়দার মেয়ে কদম ছিল তার ভবানী কাকীর বড্ড নেওটা । দাদু সিধান্ত নিলেন কদমকে তিনি বড়দার কাছ থেকে এনে নিজের কাছে রাখবেন আর ওকে মানুষ করে নিজ দায়িত্বে ওর বিয়ে দেবেন । ভবানী কিন্ত কিন্ত করে মেনে নিলেন কারণ কদমকে তিনি নিজের খুকি বলেই মানতেন । স্বামী ভালো হলেই কি সব ? সমাজ কি ভালো ? সমাজ ইনিয়ে বিনিয়ে ভবানী কে খোটা দিতে লাগলো । তার জন্য নাকি দাদুর বংশ নির্বংস হতে চলেছে । তার জন্য পরবর্তী সময়ে দাদুর বংশে বাতি দেবার কেউ রইবে না । কত লোকেই সতীন নিয়ে ঘর করে তারই বা আপত্তি টা কোথায় ? ভবানী ভাবলো ঠিকই তো ? তার দোষে তার স্বামী দোষী কেন হবেন ? তিনি স্বামীর সঙ্গে অশান্তির শুরু করলেন । নিত্য দিন তিনি খেতেন না , মুখ গোমড়া করে বসে থাকতেন । ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে যায় ভবানী । শেষপর্যন্ত রণে ভঙ্গ দিতে হয় দাদুকে , তিনি রাজি হয়ে যান দ্বিতীয় দার পরিগ্রহন করতে । তবে বারবার তিনি সাবধান করে দেন স্ত্রীকে । তিনি বলেন বাপ মায়ের দুলালী তুমি ভবানী , এ সংসারের কর্তি । তুমি নিজের সবটা ভাগ করে নিতে পারবে তো সতীনের সাথে ? যাদের সতীনের সাথে বনিবনা হয়না তারা বাপের বাড়ি গিয়ে থাকে আর তোমার মা ভিন্ন কেউ নেই সেখানে । তাই বলছি তুমি আবারো ভেবে দেখ । ভাবা তো হয়ে গেছিল ভবানীর , তিনি বলেন আমি তো আছি গো , আমি এমনই থাকবো । তুমি জারে আনবে তারে আমি সই করে রাখবো সতীন না । ঘরে খোকা আসবে , আমার ঘর পূর্ণ হবে । আমার কর্তি হয়ে ছড়ি ঘোরানোটাই সব হলো গো ? তুমি বিলম্ব করো না , একটা ব্যবস্থা করো । দাদুর বাবা মা বা আর তিন দাদার মত ছিল না । তারা চাইনি সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হোক । দাদু খুঁজছিল এমন একটা মেয়ে যে হবে সহজ সরল । যার জন্য ভবানীর মনে কোন দুঃখের সঞ্চার না হয় । ভবানী বাপ মায়ের এক মাত্র সন্তান , আদরে আদরিণী সে । তার কখনোই কোন ঝগড়াটে মুখরা মেয়ের সঙ্গে বনবে না । মুখে সে কোন অভিযোগ করবে না ঠিকই তবে সে কষ্ট পাবে । দাদু খুঁজছিল এমন একটা মেয়ে যে সংসরের কর্তৃত্ব দাবি করবে না কোনদিন । অবশেষে পাওয়াও গেল এমন মেয়ে । খাজুটি গ্রামের ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বাড়ির মেয়ে কল্যাণী । তার বাপের বড় সংসার আর জমিদারী তলানিতে এসে ঠেকেছে । মেয়ের বয়স তেরো তবে স্বভাবে আচরণে সে বালিকা মাত্র । সাত বছরের ভাইঝি কদমের মতনই কল্যাণী । রূপে সে থিয়েটারের নায়িকা সুচিত্রা সেনের মত অবিকল । মেয়ে দেখে এসে দাদু জানালো ভবানী কে । সব শুনে ভবানী সম্মতি দিয়ে পাকা দেখা করে দিন স্থির করতে বললো । কিন্তু কথাতেই আছে নারী মন বোঝা ভার । সেটাই হলো ভবানীর সাথেও , দাদু এই ভেবে সম্বন্ধ স্থির করেছিল যাতে ভবানীর কোনদিন কোন অসুবিধা না হয় আর ভবানী ভাবলো স্বামী তার থেকে সুন্দরী ছেলে মানুষ বউ আনছে ঘরে । তার মানে স্বামীর মনে তার আর কোন ঠাঁই হবে না । মনে মনে এসব ভাবলেও সেটার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো না । এই সব গল্প বলতে বলতে দাদু বহুযুগ পড়েও আপসোস করতেন যদি সেদিন আমি ওর মন পড়তে পারতাম ? দাদুর চোখের কোনে জল জমত । পাকা দেখা করতে যাবার আগে দাদু আবার সতর্ক করেন স্ত্রীকে , দেখ এখনো সময় আছে বউ ? তুমি না করে দাও । আমি এ বিয়ে করবো না ।

ভবানী কষ্টটা গিয়ে এক গাল হেসে স্বামীর স্বামীর মুখে এক খিলি পান গুঁজে দিয়ে বললে যাও দিকি দিন স্থির করে এসো গা বাপু দুগ্গা দুগ্গা করে । নিরুপায় হয়ে দাদু এগিয়ে যায় খাজুটি গ্রামের দিকে , পিছনে ফেলে আসে তার প্রেম ভবানীকে । দিন স্থির করে বাড়ি ফিরে এসে দাদু দেখে সর্বনাশ হয়ে গেছে । ভবানী গায়ে আগুন দিয়ে পুড়ে মরেছে , তার সোনার বরণ জ্বলে অঙ্গার হয়ে গেছে । দাদু সেদিন বেরিয়ে যাবার পর ভবানীর মনে হয় তার এই সংসারে কি কাজ ? না সে পারবে না কারো সাথে তার স্বামী কে ভাগ করে নিতে । এই বিয়ে হলে ঘরে শুধুমাত্র খোকা খুকি আসবে তাই না সঙ্গে সতীন ও তো আসবে । সে যদি ভবানী কে তাচ্ছিল্য করে ? বাড়ির লোকজন পাড়ার সকলে এসে আগুন নিভিয়ে ফেলে কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে । ভবানী তার আদিদেব কে ছেড়ে একরাশ অভিমান নিয়ে চলে গেছে অনেক দূরে । দাদু ভেঙে পড়ে ভীষন ভাবে , বাড়ির সবাই ভবানীর মৃত্যুর জন্য তাকেই দায়ী করে । সেদিনের কথা গুলো দাদু বলতে ভীষণ কষ্ট পেতে তবু কোন নেশায় বার বার সেই দিনে ফিরেও যেতে চাইত । দাদু বলেন তার সামনে পড়ে আছে জ্বলে কালো কয়লা হয়ে যাওয়া একটা লাশ ! কোথায় তার ভবানী ? যার কথায় হাজার অনিচ্ছা নিয়ে সে বিয়ের দিন করতে গেছিলো ? ওভাবে জ্বলে যাওয়া দেহকে

শ্মশান পর্যন্ত নিয়ে যেতেও কেউ সাহায্য করতে চাইনি , বাড়ির লোকজন ও মুখ ফিরিয়ে নেয় । ভবানীর মা এসে জামাইকে তার মেয়ের মৃত্যুর জন্য দোষারোপ করতে থাকেন , অভিসম্পাত দিতে থাকেন । কোন জবাবদিহি করার অবস্থা দাদুর সেদিন ছিল না । তিনি নিজের কাঁধে তুলে নেন তার প্রিয়তমার প্রাণহীন দেহটি আর এগিয়ে যান শ্মশানভূমির দিকে । সেদিন গ্রামের মানুষ নিজের চোখে দেখছিলো পুরানে বর্ণিত সেই সতির দেহত্যাগের পর যেমন শিব তাকে কাঁধে নিয়ে তান্ডব করেছিল তেমনি আদিদেব তার ভবানী কে কাঁধে তুলে এগিয়ে যাচ্ছে চির প্রশস্তির দিকে । ভবানী কে একাই দাহ করে ফিরে আসে দাদু । আচমকাই এই বিপত্তি তাকে শুধুমাত্র বিপত্নীক ই করেনি তিনি যেন এই পৃথিবীতে একদম একা হয়ে গেছেন । এর মধ্যেই আর এক বিপদ ঘটে যায় । কদম তার কাকিমার ওভাবে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারে না । কয়দিন জ্বরে ভুগে তার ও মৃত্যু হয় । যে চিতা সাতদিন আগেই ভবানী কে নিয়ে জ্বলে উঠেছিল সেই চিতা আবারও জ্বলে ওঠে কদমকে নিয়ে । আবার স্বজন হারানোর বেদনা দাদুকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয় । দাদু বলতেন জানিস রে আমার দাদার বলা কথা গুলো আজও আমার বুকে বিঁধে যায় । বড়দা সন্তান হারিয়ে যন্ত্রনা নিয়ে আমার কাছে এসে আমায় বলেছিল আদি তুই নিজের বউকে তো খেলি এবার আমার মেয়েটাকেও ?

দাদু বলত সেদিনও আমার কাছে দেওয়ার মত উত্তর ছিল না , আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পরও নেই রে । আমি চুপ করে সব শুনে গেছিলাম কোন জবাব দিতে পারিনি । সব মিটে যাবার পর শুধুমাত্র স্ত্রীকে দেওয়া কথা রাখার জন্য দাদু কল্যাণীকে বিয়ে করেন । এর জন্যে দাদুকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় , সবাই বলে বৌয়ের চিতা ঠান্ডা হবার আগেই কেউ এটা কি করে করতে পারে ? দাদুকে পারতে হয়েছিল , কারণ এটাই তার ভবানীর শেষ ইচ্ছা ছিল । ভালোবাসার মানুষটাকে ভাগ করে নিতে হবে এই কষ্ট তাকে দিয়ে একটা অনর্থ ঘটিয়ে ফেললেও তার শেষ ইচ্ছা ছিল সন্তান সন্তনতি নিয়ে একটা সংসার । দ্বিতীয় বিবাহের পর দাদুর ঘরে আসে চার পুত্র দুই কন্যা । এর পরও বাকি ছিল তিক্ত অভিজ্ঞতার রেশ । হটাৎ করে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে দাদুর দ্বিতীয়া স্ত্রী আমার ঠাকুরমা কল্যাণী । এর পর এত গুলি সন্তান , শিশুর মত স্ত্রীকে দেখাশোনা করতে করতে অতিবাহিত হয়ে যায় দাদুর যৌবনের দিন গুলো । অতীতের দিনগুলো কখনো হয় সুন্দর রঙিন আবার কখনো আবার কণ্টকপূর্ণ । তবু প্রতিদিন দিনদিন আমাদের নিজেদের বর্তমানকে বাঁচতে হয় , বর্তমান গুলোই আবার সময়ের ধুলো মেখে হয়ে যায় অতীত । তবু আমাদের বাঁচতে হয় , এগিয়ে যেতে হয় । পিছনে রয়ে যায় কিছু দীর্ঘ নিঃশ্বাস কিছু না পাওয়া ।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance