খেয়ালী আভোগ
খেয়ালী আভোগ
।।১।।
গ্র্যাজুয়েশনের প্রায় পাঁচ বছর পর আভোগের আবার দেখা হল ওর বন্ধুদের সঙ্গে। কলেজ শেষ করার পর যদিও সবাই বলেছিল যোগাযোগ রাখবে, কিন্তু পরে কেউ চলে যায় হায়ার স্টাডিজ করতে, আবার কেউ ঢুকে পড়ে চাকরি করতে, সব মিলিয়ে নানান ব্যস্ততায় আর রাখা হয়নি যোগাযোগ। কিন্তু আজ কলেজের রিইউনিয়নে সবাইকে পেয়ে আবার যেন সবাই ফিরে গেল, ফেলে আসা কলেজ জীবনে, সেই ক্লাস বাঙ্ক করে সিনেমা দেখতে যাওয়া, ক্যাম্পাসের প্রাণখোলা আড্ডা, গল্প, গান, কনফারেন্স কলে ঘন্টার পর ঘণ্টা গুজগুজ...ভীষণ নস্টালজিক হয়ে পড়ল সবাই।
'তারপর কি চলছে মি. আভোগ? তোমার নাম তো লোকের মুখে, গল্প, কবিতা সাহিত্য সম্মান, তা বলি আজ একটা অটোগ্রাফ মিলবে তো? ' মজার ছলেই প্রশ্ন করে অভিজিৎ
'আর কি করব বল ভাই, আমার তো আর তোদের মতো হায়ার স্টাডিজ করা হলো না, আর এমনই কপাল যে একটা চাকরিও জুটল না, তাই একরকম মনের দুঃখেই...'
'লুক হু'জ টকিং, আরে ভাই আমাদের কলেজ টপার যদি এরম বলে তাহলে আমরা কোথায় যাবো! এই বাই দ্য ওয়ে, খেয়ালীর কোনো খবর জানিস?' জিজ্ঞেস করে বিপাশা,
'ও তো আসেও নি, গ্র্যাজুয়েশনের পরও তো ওর কোনো খবরই পাইনি, তারপর আমিও বাইরে চলে গেলাম তাই আর যোগাযোগ হয়েই ওঠেনি'
আভোগের চোখজোড়াও যেন অলক্ষ্যে খুঁজছিল খেয়ালীকেই, বিপাশার প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গেই ও বলে উঠল, 'আমিও তো কতবার চেষ্টা করেছি ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার, ও যেই লেডিজ হোস্টেলে থাকতো সেখানেও খোঁজ নিয়েছি বাট কোনো লাভ হয়নি, আত্মীয় পরিজন বলতেও কেউ ছিল না।কোনো ঠিকানাও পাওয়া যায় নি, এমনকি ওর যে ফোন নম্বরটা ছিল সেটাও পর্যন্ত নট রিচেবল বলেছে...' দীর্ঘশ্বাস ফেলে আভোগ
...খেয়ালী দাস, আভোগের কলেজ জীবনের সাথেই গভীরভাবে জড়িয়েছিল এই নামটা। ওদের সম্পর্কটা গড়িয়েছিল অনেকদূর, ওদের জুটিটাকে সবাই বলতো ম্যাড ফর ইচ আদার, কিন্তু তারপর...কলেজ শেষ হওয়ার পর খেয়ালী যেন হঠাৎ করেই হারিয়ে যায় আভোগের জীবন থেকে, টের পায়নি আভোগ নিজেও। তারপর কেটে গেছে পাঁচ পাঁচটা বছর...
ওদের দলের বাকি যারা যারা ছিল তারাও সবাই বলল কিছু জানে না। 'তবে আমি মাঝখানে শুনেছিলাম ওর নাকি বিয়ে হয়ে গেছে, তারপর আর কিছু জানি না', বলল সৌপ্তিক
পরে এটা-ওটা নানান আলোচনায় খেয়ালীর কথা প্রায় ভুলেই গেল সবাই, মশগুল হয়ে গেল আনন্দে। ভুলল না শুধু আভোগ, হঠাৎ করে যেমন ঘুমিয়ে থাকা পুরনো কোনো চিনচিনে ব্যাথা ধাক্কা দেয়, খেয়ালীর নামটাও ঠিক তেমনি বুকের বাঁদিকে বাজতে লাগলো আভোগের।
অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেলো আভোগের। অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার সময়ই বুঝতে দেখতে পেল স্ট্রিটল্যাম্পগুলো নিভে গেছে, অবশ্য ওর একার জীবন একার যাপন, বাবা মারা গিয়েছিলেন ছেলেবেলাতেই, মাও চলে যান কলেজে পড়তে পড়তেই। রুজি রোজগার বলতে ছাত্র পড়ানো আর লেখালেখি। লেখার শখ ছিল ওর ছোট থেকেই, ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়ই ও প্রথম কবিতা লিখে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল বাড়ির সবাইকে।
ইদানীং ওর লেখার বেশ নামডাকও হয়েছে, প্রতিমাসেই নামকরা পত্রিকা থেকে আসতে থাকে লেখার তাগাদা। লেখা নিয়েই আভোগ ব্যস্ত থাকে সারাদিন। তবে আজ বাড়ি ফিরে সাদা কাগজের গায়ে একটুও আঁচড় চালাতে পারল না আভোগের কলম। খেয়ালীর ভাবনাই যেন ঘিরে ধরেছে ওর সবটা। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে স্টাডি টেবিলে বসে ও ভাবতে থাকে খেয়ালীর কথা, হঠাৎ মনে হয় যেন খেয়ালীর মুখটাই ভেসে উঠছে সাদা কাগজের পাতায়...হাঁপিয়ে ওঠে আভোগ, শীতের এই রাত্রেও ওর সারা শরীর ঘেমে উঠেছে। তাই অগত্যা একটা সিগারেট ধরিয়ে চেষ্টা করে কাজে মন দেওয়ার। কিন্তু যে কে সেই, আর আজ যেন কিছুতেই মন বসছে না, নতুন শুরু করা ভ্যালেন্টাইন সিরিজের গল্পটা যেন আর কিছুতেই এগোচ্ছে না। এমনি করেই আরও দুটো সিগারেট ছাইয়ে পরিনত হয়। চার নম্বর সিগারেট টা ধরিয়ে ফোন ঘাঁটতে থাকে আভোগ, ঘড়িতে তখন বাজছে রাত দুটো।
ঠিক এমন সময়েই ওকে চমকে দিয়ে ওয়াটসঅ্যাপে মেসেজ ঢোকে অচেনা নম্বর থেকে...তাতে লেখা,
'তোমার কাছেই রাখা স্মৃতির বালিঘড়ি
ভালোবাসার রঙে বয়ে যায় কত সময়
আমার বসন্ত বাঁধা আছে তোমার কাছেই
পার কি চিনে নিতে সেই আমায়?'
এতরাতে মেসেজটা পেয়ে ভীষণ আশ্চর্যই হয় আভোগ, আবার লেখাগুলো পড়ে বেশ ভালোই লাগলো, তাই একটু ভেবেই ও রিপ্লাই করল, 'হু আর ইউ? '
কিন্তু এর উত্তরে কোনো রিপ্লাই এলো না, তাই অগত্যা নম্বরটা "আননোন" বলে সেভ করে আভোগ, ঘড়িতে তখন বাজছে রাত দেড়টা। ওয়াটসঅ্যাপ খুলে আভোগ সেই অচেনা নম্বরের প্রোফাইল দেখতে লাগলো। প্রোফাইল পিকচারটা একটা ফুলের, ফুলটার বাইরের দিকটা সাদা, তবে তলার দিকে নানান রঙের ছিটে মেশানো, পাপড়িগুলো যেন বাইরে বের করা জিভের মতো, আর মাঝখানে রয়েছে শুঁড়ের মতো কতগুলি অংশ।
ছবির থেকেও অদ্ভুত লাগলো অ্যাবাউট অংশের লেখাগুলো,
" বন্ধু আমি নরম আলো অসময়ের গোলাপ
ভাঙ আমায় যতই তুমি রেখে যাব তবু ছাপ"
লেখাগুলো পড়ে কেমন যেন বিদ্যুৎ খেলে যায় আভোগের শরীরে। রাতের এই অচেনা অতিথি যেন পরতে পরতেই জাগিয়ে তুলছে নতুন শিহরণ।তাই শেষমেষ একপ্রকার কৌতুহল মেটাতেই নম্বরটা স্ক্যান করে কলার আইডিতে। নামটা দেখতে পেয়ে একরকম চমকেই ওঠে আভোগ, কারণ স্ক্রিনের ওপর ভেসে উঠেছে সেই পরিচিত নামটা... খেয়ালী দাস"
।।২।।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতে একটু দেরিই হয়ে গেল আভোগের, ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই দেখল তখন বাজছে সোয়া নটা।তড়িঘড়ি ফোনটা অন করে ওয়াটসঅ্যাপ খোলে আভোগ। না, কোনো মেসেজ আসে নি, তাও আভোগ একবার গতরাতের সেই আগন্তুকের ওয়াটসঅ্যাপ প্রোফাইল খুলল। প্রোফাইল পিকচারটায়
চোখ পড়তে সেখানে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা গেল। গতরাতে ফুলটার পাপড়িগুলো সাদা বলে মনে হলেও আজ চোখে পড়ল সাদা রঙের উপর হালকা লাল রঙের ছিটে, তলার দিকেও নানা রঙের ছিটের মধ্যে কিছুটা কালচে লাল রঙের প্রাধান্যই দেখা গেল, অন্যদিকে শুঁড়ের মতো অংশগুলিও যেন আরওবেড়ে উঠেছে বলে মনে হল....পরক্ষণেই ফোনটা বেজে উঠতেই চমক ভাঙে আভোগের, অভিজিতের ফোন
-"কিরে, ঘুমোচ্ছিলি নাকি?"
-"ওই আর কি, বল"
-"শোন, বলছিলাম খেয়ালীর একটা খোঁজ পাওয়া গেছে..."
-"মা-মানে? কি করে পেলি?", বিস্ময়ে কথা জড়িয়ে যায় আভোগের
-"সেরম কিছু না, আসলে খেয়ালীর যে রুমমেট ছিল মেধা, ওর সাথে হঠাতই সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগ হয় কাল, কথায় কথায় খেয়ালীর প্রসঙ্গ ওঠে আর সেখান থেকেই..."
-"কিন্তু আমি তো ওদের লেডিজ হোস্টেলে গিয়েছিলাম কিন্তু সেখানে তো কোনো খোঁজই পাইনি... আর তাছাড়া কাল রাতে a strange thing happened..."
-"সেকি রে, খুব সিরিয়াস কিছু নাকি?"
-"ফোনে বলা যাবেনা, তুই ফ্রি আছিস আজ?"
-"আমি তো এখন ছুটিতেই আছি"
-"ঠিক আছে তাহলে বিকেল পাঁচটায় চিড়িয়ামোড়ে, ব্লু বেরি কফিশপ..."
-"ওকে বস"
।।৩।।
সমস্ত ঘটনাটা শুনে প্রায় অবাকই হয়ে যায় অভিজিৎ,
-"তার মানে তুই বলছিস মাঝরাতে খেয়ালী তোকে এইসব আজগুবি মেসেজ পাঠাচ্ছে, এটা আদৌ সম্ভব!"
-"তা না হলে তোকে বলছি কি, আমি নিজে নাম্বারটা স্ক্যান করেছি, খেয়ালীর নাম দেখিয়েছে, তুই দ্যাখ...", ফোনটা খুলে অভিজিতকে দেখায় আভোগ
-"Very strange! এখানেতো লোকেশন দেখাচ্ছে আমাদেরই কাছাকাছি এলাকার মধ্যেই..."
-"কি বলছিস! কাছাকাছি এ-এলাকা..."
-"কেন তুই কাল লোকেশন দেখিস নি?"
-"না আ-আসলে নামটা দেখেই এত...মানে আর দেখা হয়নি"
-"বুঝেছি, আচ্ছা যদি পুলিশে একবার"
-"থানা পুলিশ করার এখন দরকার নেই, আগে আরেকটু দেখি..."
-"ঠিক আছে"
-"ছাড় বাদ দে, তুই সকালে ফোনে বললি খেয়ালীর কি ঠিকানা পাওয়া গেছে..."
-"হ্যাঁ মেধা যে ঠিকানাটা দিয়েছে সেটা হল 15/B গাজীবাড়ী লেন, রঙ্গপুর...ও বলছিল খেয়ালীই নাকি ওকে দিয়ে গিয়েছিলো ঠিকানাটা"
-"ব্যাপারটা কিরকম আশ্চর্য না, হোস্টেলে গিয়ে কোনো ঠিকানা ফোন নম্বর পাওয়া গেলো না, এদিকে সেই হোস্টেলেরই রুমমেট তোকে ঠিকানা দিল... "
-"যেভাবেই হোক ফাইনালি পাওয়া তো গেছে, এবার বল তো জায়গাটা চিনিস কি না?"
-"মনে তো হচ্ছে বারাসত লাইনে হবে", ঠিকানাটা দেখে ভাবতে থাকে আভোগ
-"ঠিক আছে তো মিশন খেয়ালীর ঠিকানা, কাল সকাল নটা", কফিতে চুমুক দিয়ে বলে ওঠে অভিজিৎ
-"তুই তো আমার মনের কথা ছিনিয়ে নিলি, ঠিক আছে তো কাল সকাল নটা... ফাইনাল"
।।৪।।
পাবলিশারদের সাথে কথাবার্তা,ও টুকটাক নানা কাজে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেল আভোগের। রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে স্টাডি টেবিলে বসে ভ্যালেন্টাইন সিরিজের শেষ না হওয়া গল্পটায় মন দেয়...নায়ক আর নায়িকার দশ বছর পর হঠাৎ দেখা রাতের নিস্তব্ধ ট্রেনের কামরায়... তারপর... না, আজও গল্পটা আর এগোচ্ছে না, তার জায়গায় শুধু খেয়ালীর ভাবনাই যেন পাথরের মতো চেপে বসেছে মনে...
-"জলজ্যান্ত মেয়েটা এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল,
...অথচ রুমমেটের কাছ থেকে ঠিকানা পাওয়া গেল", নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকে আভোগ, ঠিক তখনই ওয়াটসঅ্যাপে মেসেজে ঢোকে আগের দিনের মতো।
ইচ্ছে করেই ফোনের ইন্টারনেট অন করে রেখেছিলো আভোগ, এই ভেবে যদি কোনো উত্তর আসে সেই খেয়ালীর কাছ থেকে... উত্তর এসেছে, আর তাতে লেখা,
" নিয়ন আলোয় খুঁজতে চেওনা রসাতল
মুখোশ আর মুখের যত মিথ্যে ছল
অন্ধকারেরও শরীর জেগে ওঠে তৃষ্ণায়
এখনো আছি আমি শেষের অপেক্ষায়"
শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নামে আভোগের, বুকের মধ্যে দুরমুশ বাজতে থাকে, মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে, বাজছে ঠিক রাত দুটো....
-"আপনি কে বলুন তো? কি চাই আপনার?" রিপ্লাই করে আভোগ, কিন্তু আর কোনো উত্তর আসে না...
অগত্যা ফোন অফ করে শুতে চলে যায় আভোগ।ঘুমের মধ্যে দেখতে পায় এক নারীমূর্তি ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে...পরনে লাল বেনারসী, মাথায় ঘোমটা। আভোগের খুব কাছে এসে ঘোমটা সরায় সেই নারীমূর্তি, আর সঙ্গে সঙ্গেই দেখা যায় আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত একটা মুখ, সারা মুখ গলা বেয়ে নামছে রক্তের ধারা, আর তার সাথেই সেই মুখে ফুটে উঠল বিভৎস পৈশাচিক হাসি...
আর সহ্য করতে পারলনা আভোগ, শীতের রাতেও সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে, বাকি রাত একরকম ভয়ে আতঙ্কে জেগেই কাটিয়ে দেয়...
।।৫।।
-"আই থিঙ্ক তুই একটু বেশিই জড়িয়ে পড়েছিস ব্যাপারটার মধ্যে... কিন্তু আমার সাথে অভিজিতের এইতো দিনতিনেক আগেই কথা হল,ও তো কিছুই বলল না...এদিকে এত ব্যপার ঘটে গেছে...", বিপাশা এতক্ষণ আভোগের মুখ থেকেই শুনছিল সবটা, রিইউনিয়নের পর থেকে যা যা ঘটছে
-"আমিই বারণ করেছিলাম ওকে ব্যাপারটা কাউকে জানাতে", থমথমে গলায় বলে আভোগ, "ব্যাপারটা থেকে আমি যতই বেরিয়ে আসতে চাইছি ব্যাপারটা ততই মাথার মধ্যে জাঁকিয়ে বসছে, এর জন্য আমি লাস্ট একসপ্তাহ ধরে কিচ্ছু লিখতে পারিনি, not a single sentence!", চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে আভোগের
-"Calm down আভোগ, তুই এমন করছিস যেন তোর নিজের কেউ...",বলতে বলতে থেমে যায় সৌপ্তিক,"নিজের কি হাল করেছিস দেখেছিস একবার আয়নায়, মরিচীকার পিছনে ছুটে কি লাভ বলতে পারিস?"
-"কি-কিন্তু ওই ওয়াটসঅ্যাপ মে-মেসেজগুলো..এখনো রো-রোজ আসে রাতে... এইতো তোরা দ্যাখ" মেসেজগুলো ওদের দেখায় আভোগ
"শূণ্য থেকে শূন্যে মিশে
পুণ্য ভরেছে পাপের বিশে
আলো শুষে নেয় অন্ধকার
চারপাশে মৃত্যুর সংসার
যেখানে ব্যর্থ সব জীবনের যুক্তি
সেই আঁধারেই হোক আমার মুক্তি", মেসেজগুলো পড়ে ওরা দুজনে
-"কি আশ্চর্য! তুই বলছিস এটা খেয়ালীর নম্বর, ইম্পসিবল!",বলে ওঠে বিপাশা,"যে মেয়েটা কলেজে বাংলা ঠিক করে লিখতেই পারত না সে কিরে তোকে এত ভালো বাংলা লিখে পাঠাবে, তাও আবার কবিতায়"
-"মানে,কি বলছিস তুই?",জিজ্ঞেস করে সৌপ্তিক
-"কেন তুই জানিস না, সেই ওকে একবার বাংলায় কলেজের ফ্রেসার্স ইনভিটেশন লেটার লিখতে বলা হয়েছিল, কিন্তু ম্যাডাম তো ইংলিশ মিডিয়াম, লিখতে গিয়ে তথৈবচ অবস্থা...অগত্যা আভোগই শেষে হেল্প করল...আমরা তো এই নিয়ে মাঝেমাঝে হাসাহাসিও করতাম 'বাঙালী বাবু ইংলিশ মেম' বলে...অভিজিতও এই পয়েন্ট টা এড়িয়ে গেল কি করে...আর সবচেয়ে বড় কথা তুইও কি করে মেনে নিলি যে এটা খেয়ালী...স্ক্যানারেও তো ফল্ট থাকতে পারে"
-"তাহলে এগুলো কে পাঠাচ্ছে?" গলা ধরে আসে আভোগের
-"I think we should go to police station নাহলে it'll be too late", সৌপ্তিক বলে ওঠে,"আর বাই দ্যা ওয়ে, তোরা ওই রঙ্গপুর না কোথায় গিয়েছিলি?"
-" না আসলে অভিজিত বলেছিল...তারপর তো ওর সাথে আর কোনো যোগাযোগই...", ভীষণ খাপছাড়া লাগল আভোগের কথাগুলো
-"ঠিক আছে, তুই অ্যাড্রেসটা আমাকে দে, আমি এর মধ্যেই গিয়ে খোঁজ নেব, কিন্তু এই মেধাকে তো কলেজে কোনোদিন দেখেছি বলে মনে পড়ছে না, নামও তো শুনি নি", খটকা লাগে সৌপ্তিকের
-"Same here, আমিও...ছাড় বাদ দে ঠিকানাটা যখন পাওয়া গেছে তখন গিয়েই দ্যাখ একবার ...আফটার অল উই ওয়ান্ট আওয়ার আভোগ ব্যাক", আভোগের কাঁধে হাত রেখে হেসে ওঠে বিপাশা
-"আমিও যাব তোর সাথে..."
-"না তোর যাওয়ার দরকার নেই, তুই বরং বাড়িতেই রেস্ট নে, খাওয়া দাওয়া কর আর সেরম হলে একজন ভালো দেখাশোনার লোক রাখ, ঘরের হালটাও তো নিজের মতোই করেছিস", আভোগের পিঠ চাপড়ে বলে ওঠে সৌপ্তিক
-"ভালো থাকিস আভোগ, চিন্তা করিস না, আমরা তো আছি সব ঠিক হয়ে যাবে"
এরপর ওরা দুজনেই বিদায় নেয় আভোগের ফ্ল্যাট থেকে...
।।৬।।
-"হ্যালো অভিজিৎ, বিপাশা বলছি, তোর কি খবর বলতো, সেই লাস্ট যা ফোনে কথা হল, তারপর নো পাত্তা, আর খেয়ালীর ব্যাপারটাও বেমালুম চেপে গেলি", বাড়ি ফিরে এসে অভিজিতকে ফোন করে বিপাশা
-"কোন ব্যাপার? কিসের কথা বলছিস তুই?"
-"এই শোন, আর ঢাক ঢাক গুড় গুড় করিস না তো, আভোগের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম, ও সব বলেছে আমাদের..."
-"আমি না সিম্পলি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না, আর এর মধ্যে আভোগই বা কোত্থেকে এল?"
-"দিস ইজ নট ডান অভিজিৎ, আভোগ আমাদের সব বলেছে...",পুরো ঘটনাটা বলতে থাকে বিপাশা,"...এরপরেও তুই জিজ্ঞেস করবি তো যে কোন ব্যাপার..."
-"বিশ্বাস কর বিপাশা আমি এসবের বিন্দুবিসর্গও জানিনা, ওর সাথে দেখা হওয়া তো কোন ছাড়, ফোনে পর্যন্ত কথা হয়নি আমার,সেই লাস্ট যা রিইউনিয়নে দেখা হল..."
-"কি বলছিস তুই অভিজিত! তার মানে তুই বলতে চাস আভোগ আমাদের বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলেছে!"
-"may be তাই, দেখ হয়তো তোদের সাথে কোনো ট্রিক করেছে...দ্যাখ হয়তো পাবলিশার পায়নি তাই গল্প বানানোর নতুন পন্থা...শুনেছিলাম ওর লাস্ট দু তিনটে বই নাকি ফ্লপ করেছে...কিন্তু আমাকে হঠাৎ কেন জড়ালো...?"
-"কি বলছিস বুঝতে পারছিস অভিজিৎ...আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি ছেলেটাকে, সৌপ্তিকও ছিল...ছেলেটা ভেঙে পড়েছে একেবারে, আর তুই বলছিস তুই কিছু জানিস না সব মিথ্যে, is it possible!"
-"আমিও বা খামোখা তোকে মিথ্যে বলতে যাব কেন, আমার কি স্বার্থ,আর এমনিতেও কাল সকালের ফ্লাইটে আমি চলে যাচ্ছি, আর তুইও আর এসবের মধ্যে জড়াস না...!", ফোনটা কেটে দেয় অভিজিত, এদিকে ফোন হাতে নিয়ে বিছানায় পাথরের মতো বসে থাকে বিপাশা, "Something is terribly going wrong..."
।।৭।।
অভিজিতের ফোনের পর কেটে গেছে অনেকদিন,সৌপ্তিকেরও কোনো খবর নেই, আদৌ খেয়ালীর কোনো খোঁজ পেল কি না,আভোগই কেমন আছে...ডিনার শেষ করে এইকথাগুলোই ভাবছিল বিপাশা
এমন সময় কলিংবেলের শব্দে চমক ভাঙে, দরজা খুলে দেখে সৌপ্তিক,
- "একি তুই এত রাতে, কি খবর, ভিতরে আয়"
তারপর ঘরে এসে বিপাশার দেওয়া একগ্লাস দেওয়া জল শেষ করে বলতে শুরু করে সৌপ্তিক,
-"সাংঘাতিক ব্যাপার বিপাশা, আভোগ যেই ঠিকানাটা দিয়েছিল, ওটার কোনো অস্তিত্বই নেই!"
-"মানে?"
-"হ্যাঁ রে, আমি তন্নতন্ন করে খুঁজেছি ওই নামের কোনো জায়গাই নেই, আর তার ওপরেও বড় ব্যাপার এই যে..."
-"কি হল থামলি কেন বল..."
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আবার বলতে শুরু করে সৌপ্তিক
-"আমরা খেয়ালীকে নিয়ে এত আলোচনা করেছি অথচ একবার ভেবেও দেখিনি যে কলেজে গেলেই ওর ঠিকানা পাওয়া যেতে পারে...আমি গিয়েছিলাম কলেজে, ঠিকানাও পেয়ে যাই, আর সেখানে গিয়েই জানতে পারি...খেয়ালী মারা গেছে... দু'বছর আগে...এক্সপ্রেস ওয়ের পাশের ভেরীটায় ওকে কারা খুন করে ফেলে দিয়ে গেছিল..."
-"ওয়াট!"
-"আর সবচেয়ে বড় কথাটা কি জানিস, ওর এই খুনে প্রাইম সাসপেক্ট ছিল ওয়ান অ্যান্ড ওনলি আভোগ...ওর বাড়ি থেকে যতটা জেনেছি গ্র্যাজুয়েশনের পর ঠিক হয়েছিল খেয়ালী হায়ার স্টাডিজ করতে যাবে চেন্নাইতে, কিন্তু হঠাতই একদিন খেয়ালী চিঠি লিখে বেরিয়ে যায় বাড়ির থেকে...পরে ওরা জানতে পেরেছিল খেয়ালী বিয়ে করেছে...আভোগকে...আর তারই বছর দেড়েক পর ওর খুন...ওর বাড়ির লোকেরা কেস করেছিল আভোগের নামে কিন্তু উপযুক্ত প্রমান না থাকায় ছাড়া পেয়ে যায়..."
বিপাশা এতক্ষণ শুনছিল সবটা, ওর মুখ থেকে যেন কথা উড়ে গেল, অন্যদিকে সৌপ্তিক তখনো বলে চলেছে
-"আমি ঠিকই শুনেছিলাম যে খেয়ালীর বিয়ে হয়ে গেছে...শুধু এটাই জানতাম না যে ওই স্কাউনড্রেলটার সাথেই..."
-"তার মানে আভোগ সবটা জানত, আর হোস্টেল থেকে ওই ঠিকানাটা...", বিপাশার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ
-"সব মিথ্যে স-ব...সবটা ওর বানানো...আর আমাদের সামনে কি সুন্দর অভিনয়টা করে গেল...পুরো অস্কার উইনিং অ্যাক্টিং", সৌপ্তিক বলে চলে
-"কিন্তু...তা বলে এতটা...কি মোটিফ থাকতে পারে?...অভিজিতও কি তাহলে...আমার কিরম গুলিয়ে যাচ্ছে সবটা... ধোঁয়াশা লাগছে...", ব্যপারটা বুঝে উঠতে পারে না বিপাশা
-"এই সবকিছুর উত্তর আমাদের সেই দিতে পারবে, যার থেকে এসবের জন্ম...আভোগ...আমার মনে হয় ও ইচ্ছে করে আমাদের বোকা বানাচ্ছে নয়তো...",বলতে বলতে থেমে যায় সৌপ্তিক
এমন সময় ফোন বেজে ওঠে বিপাশার, স্ক্রিনের দিকে চোখ পড়তেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে...স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে আভোগের নাম...
।।৮।।
-"হ্যালো, হ্যালো বিপাশা আ-আমায় বাঁচা প্লিজ, খুব খ-উব ভয়...ও...ও ফিরে এসেছে...ফিরে এসেছে ও...মেরে ফেলবে ও আমাকে..."ফোনের ওপারে শোনা যায় আভোগের বিধ্বস্ত গলা,অন্যদিকে বিপাশাও কি বলবে ভেবে উঠতে পারে না, তাই শেষমেষ সৌপ্তিককেই ফোনটা দিয়ে দেয়,
-"কিচ্ছু হবেনা, আমরা তো আছি...ভয় পাস না...আমরা আসছি",বলে ফোনটা কেটে দেয় সৌপ্তিক
-"আমার না এবার সিরিয়াসলি ব্যাপারটা আর ভালো লাগছে না...এত ব্রিলিয়ান্ট ছেলে...এত ভালো লেখে...হঠাৎ যে কি হল..."
-"আজ এর একটা মীমাংসা করেই ছাড়ব!", উঠে দাঁড়ায় সৌপ্তিক,
-"চল"
-"কিন্ত কোথায়?"
-"আবার কোথায়...আভোগের বাড়ী"
-"কি বলছিস সৌপ্তিক...এত রাতে...মানছি আমি একাই থাকি...তাও...রিস্কি হয়ে যাবে ভীষণ ব্যাপারটা..."
-"সময় নেই বিপাশা, যা করার আজ রাতেই করতে হবে নয়তো খুব দেরি হয়ে যাবে..."
এরপর ওরা দুজন বেরিয়ে পড়ে আভোগের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে...
।।৯।।
ফ্ল্যাটের সামনের রাস্তায় গাড়ী থামাতেই ওরা বুঝতে পারল এলাকায় লোডশেডিং, এদিকে হঠাৎ করেই বৃষ্টিও শুরু হয়েছে অসময়ে... গাড়ী থেকে নামার আগে দুজনেরই চোখ চলে যায় রাস্তার ওপারে ফ্ল্যাটের দিকে। মেঘ-বৃষ্টি ও আলো-আঁধারির এই পরিবেশে ফ্ল্যাটটার তাকিয়ে একটু হলেও গা ছমছম করে ওঠে দুজনের...
-"আমার কিন্তু ব্যাপারটা একদম সুবিধার বলে মনে হচ্ছে না...চল না ফিরে যাই...", বিপাশার গলায় উদ্বেগের ছাপ
-"বলছি না চল...যা হওয়ার আজকেই হবে..."এরপর ওরা দুজনেই ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে এগিয়ে যায় আভোগের ফ্ল্যাটের দিকে, দোতলায় উঠে দরজার কাছে এসে টোকা মারে সৌপ্তিক, কিন্তু...
-"দরজাটাতো খোলা... এই লোডশেডিং এর মধ্যেও...আভোগ...", দরজাটা ঠেলা মারতেই খুলে ফেলে সৌপ্তিক, আভোগকে ডেকেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়না, ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে এগোতে থাকে ওরা
-"এখান থেকে বেরিয়ে যাই চল সৌপ্তিক...আমার ভাল্লাগছেনা ব্যাপারটা, দুই দেখছিস ঘরটার কি অবস্থা...আর আভোগই বা...", কথাটা শেষ করতে পারেনা বিপাশা, তার আগেই ওদের দুজনকে চমকে দিয়ে সশব্দে বন্ধ হয়ে যায় বাইরের দরজাটা...
পিছনে ফিরে দরজার দিকে আলো ফেলতেই ঠান্ডা স্রোত নামে ওদের শিরদাঁড়া বেয়ে...ওরা দেখতে পায় ওদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর কেউ নয়... স্বয়ং আভোগ...আলুথালু চুল, ময়লা জামাকাপড়, আর হাতে চকচক করছে একটা ছুরি...
-"মৃত্যু জেগেছে আজকে আবার স্তব্ধ অমানিশায়,
রক্তলোলুপ চাঁদ উন্মুখ আদিম পিপাসায়
ভেঙেচুরে যায় সব বালিঘড়ি
রসাতলে মেশে নিয়নের বাড়ি
ভুলের মাসুল চোকাতে হবে মরণের পরিভাষায়
মৃত্যু জেগেছে আজকে আবার স্তব্ধ অমানিশায়....
.....আজ তোদের মৃত্যু", পৈশাচিক হাসি ফুটে ওঠে আভোগের মুখে... ও এগোতে থাকে বিপাশা আর সৌপ্তিকের দিকে...
-"আভোগ তুই এটা করতে পারিস না, what's wrong with you আভোগ!", চিৎকার করে ওঠে সৌপ্তিক
-"আমাদের ছেড়ে দে... আমরা কি করেছি...", কেঁদে ফেলে বিপাশা
-"কোনো ক্ষতি করতে পারবি তোরা...খালি ভয় দেখানো না...শেষ করে ফেলব তোদের আজ... শে-ষ!..." ছুরি নিয়ে এগোতে এগোতে দাঁত চিবিয়ে বলতে থাকে আভোগ
-"কি আবোল-তাবোল বলছিস আভোগ...আমরা তোর বন্ধু...আমি সৌপ্তিক আর ও বিপাশা...আমরা কেন ক্ষতি করবো তোর"
-"সো-সৌপ্তিক...বিপাশা...",কিছুক্ষণ থামে আভোগ, বিপাশা আর সোপ্তিকও এগিয়ে আসে আভোগের হাত থেকে ছুরিটা নিতে,
-"না... তোরা আমার বন্ধু হতে পারিস না... কিছুতেই না...বিশ্বাসঘাতক!...তোদের দুজনকেই শেষ করব আজ..খালি ভয় দেখানো... আমার খেয়ালী...আমার খেয়ালীকে কেড়ে নেওয়া না... কাউকে ছাড়ব না... শেষ করে ফেলব...", অন্ধকারের মধ্যে এলোপাতাড়ি ছুরি চালাতে থাকে আভোগ,"বল খেয়ালী কোথায়...ও বলেছে ও তোদের কাছেই আছে....ফিরিয়ে দে ওকে...ফিরিয়ে দে... "
-"খেয়ালী মারা গেছে...", আভোগকে ঠেলে ফেলে দেয় সৌপ্তিক..."আর তুই সব জানিস, তাহলে কেন এসব নাটক করছিস...আমি, বিপাশা কেউই এখানে ছিলাম না...খামোখা এসবের মানে কি?"
মেঝেতে পড়ে থাকা অবস্থায় কান্নায় ভেঙে পড়ে আভোগ... "ওকে আমি ফিরিয়ে আনতে পারলাম না...বাঁচাতে পারলাম না...মেরে ফেলল ওকে..."
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার পর আবার আগের মতই হিংস্র ভাব ফুটে ওঠে আভোগের চোখে...উঠে দাঁড়িয়ে আবার আগের মতো এলোপাতাড়ি ছুরি চালাতে থাকে,
-"তোরা সৌপ্তিক আর বিপাশা হতেই পারিস না...বল তোদের কে পাঠিয়েছে... ছদ্মবেশী!...ফিরিয়ে দে, ফিরিয়ে দে ওকে...না হলে শেষ করে ফেলব..." পিছিয়ে যেতে যেতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় বিপাশা আর সৌপ্তিকের, আলো-আঁধারিতে ওরা দেখতে পায় আভোগ এগিয়ে আসছে ওদের খুব কাছে... ওর চোখ মুখে পাশবিক হিংস্রতা...হাতে চকচক করছে ছুরি...দুজনের কাছে এটাই হয়তো শেষ সময়...
এমন সময় প্রকান্ড আওয়াজ...ভীষণ শব্দে ছুরিটা হাত থেকে পড়ে যায় আভোগের...আর এই সুযোগেই এক ঘুসিতেই ওকে কাবু করে ফেলে সৌপ্তিক...
দেখা যায় দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে এসে পুলিশ আর তাদের পিছন পিছন ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীরাও... বিপাশা আর সহ্য করতে পারেনি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়তে যাচ্ছিল, কিন্তু সৌপ্তিক ধরে ফেলে...এ যাত্রায় বেঁচে যায় ওরা দুজন..."
।।১০।।
-"কি বলব মশাই, রোগটাই আসলে এমন, চেনা মানুষও অচেনা হয়ে যায়...পরম বন্ধুকেও শত্রু বলে মনে হয়... মৃত মানুষকেও মনে হয় জীবিত, আবার জীবিত মানুষও মৃত হয়ে যায় একমুহূর্তে...ওই মনস্তত্ত্বের ভাষায় যাকে বলে 'ক্যাপগ্রাস সিনড্রোম'... এই রোগ বড় ভয়ংকর...", অ্যাসাইলেমের কেবিনে দাঁড়িয়েই সৌপ্তিক আর বিপাশার সাথে কথা বলছিলেন সাইকোলজিস্ট ডঃ আনন্দ মিত্র,"...ওর স্ত্রী যখন খুন হন,সে কি বলব, কেসটার কোনো কিনারাই হল না শেষ পর্যন্ত....তখন থেকেই আমি ওকে দেখছি...সে কি অবস্থা...কাউকেই কাছে ঘেঁষতে দিত না...সবাই যেন ওর শত্রু, তার ওপর পুলিশের জেরা...আর শুধু একটাই কথা... 'খেয়ালীকে ফিরিয়ে দাও'..."
-"কিন্তু এই ঘটনা গুলোর কি কারণ? " প্রশ্ন করে বিপাশা
-" ও তারপর বেশ কিছু মাস আমাদের এখানে ছিল... সুস্থও হয়ে উঠছিল আস্তে আস্তে...তারপর তো ওকে আমরা ছেড়ে দিই। ভালো হয়ে গিয়েছিল ও, তারপর তো আপনারাও জানেন ওর প্রথম বেস্ট সেলার বই 'অসমাপ্ত'...সাহিত্য সম্মান.....
কোত্থেকে যে কি হয়ে গেল.....আসলে সবটাই তো মনের ব্যাপার না.... আমার মনে হয় রিইউনিয়নের দিন থেকেই ওর মনে আবার সেইসব স্মৃতি স্ট্রাইক করে, আর সেখান থেকেই হতাশা, আর হতাশা থেকেই এইসব সিম্পটমের সূত্রপাত... " দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ডঃ আনন্দ মিত্র
-"কিন্তু ওই ওয়াটসঅ্যাপ মেসেজগুলো...সেটারও তো কোনো কূলকিনারা হল না...", প্রশ্ন করে সৌপ্তিক
-"সবটা শুনে যা বুঝলাম...আমার মনে হয় এটাও অভিজিতের গল্পটার মতো... আভোগের নিজেরই তৈরী... দুটো সম্ভাবনা হতে পারে... হয় অন্যকেউ খেয়ালীর নাম করে ওকে পাঠিয়েছে... নয়তো ও নিজেই অন্য কোনো ফোন থেকে নিজেকেই পাঠিয়েছে...পরে ওটা আপনাদের খেয়ালীর মেসেজ বলে দেখিয়েছে... এক্ষেত্রে আমার দ্বিতীয় সম্ভাবনাটাই ঠিক বলে মনে হচ্ছে....দেখুন কি হয় পুলিশও তো ইনভেস্টিগেট করছে নাম্বারটা..."
-"ও যেন তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে ওঠে...আবার যেন নতুন করে শুরু করতে পারে...", একটুর জন্য হলেও বিপাশা আর সৌপ্তিকের মুখে হাসি ফুটে ওঠে... আকাশে তখন সব মেঘ সরে ছড়িয়ে পড়েছে নতুন দিনের আলো...
©সমাপ্ত

