উত্তীয় চ্যাটার্জ্জী

Horror Tragedy Others

4  

উত্তীয় চ্যাটার্জ্জী

Horror Tragedy Others

বেহেশত

বেহেশত

12 mins
356



"There are more things in heaven and earth, Horatio,

Than are dreamt of in your philosophy."

~William Shakespeare (Hamlet)

একে গল্প বলা ঠিক হবে কিনা জানি না, কারণ যে ঘটনার কথা বলতে চলেছি তার বেশীরভাগটা জুড়েই রয়েছে ধ্রুব সত্যের ছায়া। যে সত্য এখনো মাঝেমাঝেই আমার অবচেতনে বারবার ধাক্কা দিয়ে যায়, যে সত্য সব যুক্তি ভেঙে রেখে যায় সেইসব প্রশ্ন, সহজ নিয়মে যাদের উত্তর মেলে না।

।।১।।

বাবার বদলির চাকরির দরুন তখন আমরা কলকাতা ছেড়ে সবে শিফট করেছি বিক্রমপুরে একটা বাড়িতে। জায়গাটা মূলত মফস্বল, একটু নিরিবিলি গোছের, আর বাড়িটাও বেশ ছিমছাম, দোতলা,পাঁচিল ঘেরা, চারপাশ গাছপালায় ঢাকা। মোটের ওপর সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও একটা জিনিস আমাদের সবার মধ্যেই একটা অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি করল। 'অন্যরকম' বলছি কারণ অনেকসময় কিছু কিছু অনুভূতি এমন‌ও হয় যাদের ঠিক ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। ঠিক যেমনটা হলো আমাদের যখন বারান্দা থেকে আমাদের চোখে ধরা দিল বাঁশঝাড়ে ঘেরা প্রকান্ড কবরস্থানটা, বাড়ির পিছনদিকে একটু দূরেই ছিল সেটা, আর বারান্দা থেকে সেটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। মা তো একসময় বলেই উঠল, "তুমি আর জায়গা পেলে না, এইরকম একটা বাড়িতে আমি থাকতে পারবো না! তুমি তো সারাদিন অফিসেই থাকবে আর আমি পিহু আর কুহু'কে নিয়ে এদিকে পুরো একা, যদি কিছু...", মা কথাটা শেষ করতে পারলো না

"বাজে কথা বোলো না তো! ছেলেমেয়ে কি শিখবে? যতসব কুসংস্কার!"

"বাবা, ওটা তো graveyard ওখানে তো ghost থাকে আমি জানি, টিভিতে দেখেছি", বোন‌ বললো

"না কুহু ওসব কিচ্ছু হয় না...কিচ্ছু হয়-না" কথাটা বলতে গিয়ে বাবার গলাটাও কেঁপে উঠলো, সত্যি কবরস্থানটা একবার দেখলেই কেমন যেন গা ছমছম করে ওঠে, গোটা জায়গাটাই যেন আদিম নৈঃশব্দ্য দিয়ে মোড়া, হয়তো ধারের কাছে বাঁশঝাড় থেকে পাতা পড়লেও যেন তার শব্দ শোনা যাবে।

এরপর, মা-বাবার মধ্যে অনেক কথা কাটাকাটি হ‌ওয়ার পর অবশেষে মা রাজি হল এখানে থাকতে

কিন্তু আমাদের কে বলা হল আমরা যেন ভুল করেও বাড়ির পিছনদিকে কখনো না যাই, এমনকি সন্ধ্যের পর বারান্দায় আর ছাদে যেতেও জারি হল নিষেধাজ্ঞা।

এভাবেই এরপর কেটে গেল বেশ কয়েকটা দিন আমি আর বোন নতুন স্কুলে ভর্তি হলাম, বাবার‌ও শুরু হলো অফিস আর মা‌ও বাড়ির সবটা গুছিয়ে নিলো, মা'র সারাদিন হাতে হাতে কাজ করে দেওয়ার জন্য রেবা চাচিকেও পাওয়া গেল সহজেই, সারাদিন থাকতো আর বিকেলে চলে যেত। এভাবেই বেশ কাটছিল আমাদের দিনগুলো।

প্রথম ঘটনাটা ঘটে একদিন রাতে। রাত তখন কত হবে আমি জানিনা আচমকাই একটা বিকট শব্দে আমার ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল, বুঝতে পারলাম শব্দটা আসছে বাড়ির পিছনদিক থেকে, খুব চিৎকার করে কেউ কাঁদছে, বুকের ভিতরটা কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠলো। দেখলাম মা-বাবাও উঠে বসেছে

"তোমাকে আগেই বলেছিলাম এখানে আমি থাকবো না, আজ রেবা‌ও বলছিলো এই বলছিলো এই বাড়িটায় সমস্যা আছে, বেশীদিন কেউ থাকতে পারে না...এখন ভালোয় ভালোয় রাতটা কাটলে হয়..." মা'র মুখে তখন আতঙ্কের ছাপ

এর উত্তরে বাবার ঠিক কি বলবে সেটা বুঝতে পারলো না, "আচ্ছা দাঁড়াও আমি একবার বারান্দায় গিয়ে দেখি কি ব্যাপার"

"না বাবা, তোমার আর গিয়ে কাজ নেই, রক্ষে করো!"

"এই দিদি দ্যাখ ঘোস্ট টা কাঁদছে, ওর মনে হয় খুব কষ্ট হয়েছে , আমি তো দেখেছি আজকে ওকে..."বোনের কথা শুনে আমরা তখন অবাক

বাবা বললো,"তুই দেখেছিস মানে...কাকে?"

"কেনো ওই ঘোস্টটাকে, আজ দুপুরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখনই তো দেখলাম ঘোস্ট'টা নিচে দাঁড়িয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল, কেমন একটা যেন দেখতে,খুব ডার্টি...ঠিক ঘোস্টের মতো...আমি জিজ্ঞেস করলাম হু আর ইউ...কিন্তু কিচ্ছু বললোই না শুধু হাসতে লাগল..."

এরপর আমরা আর কেউ কিছু বললাম না, বাকি রাতটা প্রায় জেগেই কাটলো।

এরপর থেকে প্রায়শ‌ই রাতে কান্নার শব্দ শুনতে পাওয়া বাড়ির পিছনদিক থেকে। কিছুটা মায়ের জোরাজুরিতেই হোক বা নিজের তাগিদেই, বাবা‌ও চেষ্টা করছিলো নতুন একটা বাড়ি দেখার। পাড়ায় আমাদের যাদের সাথে আলাপ ছিল, তারাও বলাবলি করতো যে ওই কবরস্থানটায় রাতের বেলায় সব অলৌকিক কান্ড-কারখানা চলে, যারা সাহস করে ওখানে রাতের বেলা গিয়েছিল তাদের প্রত্যেকের সাথেই কিছু না কিছু হয়েছে...হয় নিজের সাথে নয়তো পরিবারের লোকজনের সাথে... ওদের কথায় ওখানে নাকি একটা আলোর পিন্ডকে পুরো জায়গাটা জুড়ে পাক খেতে দেখা যায় আর তার সাথে সেই বিকট কান্নার আওয়াজ।

এরপর একদিনের কথা, সেদিন আমাদের স্কুল ছুটি ছিল, আমি স্নান সেরে সামনের বাগানে পায়চারি করছিলাম,মা রান্না করছিলো আর রেবা চাচি মাকে হাতে হাতে সাহায্য করছিলো।এমনসময় দোতলা থেকে কুহু'র প্রচন্ড চিৎকার শুনতে পেলাম। আমরা হন্তদন্ত হয়ে ওপরে গিয়ে দেখি কুহু বারান্দায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।

বেশ অনেকক্ষণ ধরে চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দেওয়ার পর জ্ঞান ফিরতেই ও মা'কে জড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো। কি হয়েছিলো জিজ্ঞেস করাতে ও যা বললো, সেটা শুনে আমাদের সবার মুখেই আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠলো, ও বললো, "হোম‌ওয়ার্ক শেষ করে ব‌ই-খাতা গোছাচ্ছিলাম, হঠাৎ বারান্দা থেকে কেমন একটা শব্দ আসতে লাগলো, প্রথমটায় বুঝতে পারি নি কিন্তু পরে যেন সাউন্ডটা বাড়তে লাগলো"

এইসময় মা বললো, "আমরা তো শব্দ পাই নি, পিহু তুই শুনেছিলি?"

আমি বললাম,"ক‌ই না তো?"

কুহু আবার বলতে শুরু করল,"বারান্দায় যেই আসলাম অমনি আওয়াজ কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ এদিক-‌ওদিক দেখে ঘরে ফিরে আসতে যাবো এমনসময় দেখি ওই ঘোস্ট টা, আমার থেকে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে, কি বীভৎস দেখতে, কিন্তু চোখদুটো যেন জ্বলজ্বল করছিলো,ঠিক ফায়ারের মতো...হাসতে হাসতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো...তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।"

(ক্রমশ)

।।২।।

কথায় বলে 'ইঙ্গিত বুঝলে মন, কাজ হতে কতক্ষণ', কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা আসন্ন ঘটনার ইঙ্গিতটুকু‌ও বুঝতে পারি নি। কুহু'র অজ্ঞান হ‌ওয়ার পর থেকে বাড়ির পরিস্থিতি যেন ক্রমাগত‌ খারাপ থেকে খারাপতর হতে থাকে। মা আর বাবার প্রায় রোজ‌ই বাড়ি নিয়ে ঝগড়া লেগেই থাকতো, আর‌ও কুহুও দু-তিন দিন যেতে না যেতেই অসুস্থ হয়ে পড়তো। রেবা চাচি বলতো সব‌ই নাকি এই বাড়ির দোষ, এই বাড়ি নাকি অভিশপ্ত, অশুভ শক্তির নজর আছে এই বাড়িটায়। স্কুলেও তাইজন্য সবাই আমাদের এড়িয়ে চলতো, সবাই বলতো আমাদের সাথে কথা বললে ইভিল স্পিরিট ওদের মেরে ফেলবে। বাড়িতে ঘটতে থাকা অদ্ভুত সব ঘটনা, রাতবিরেতের ওই বীভৎস কান্না, রোজকার অশান্তি, স্কুলের বন্ধুদের কমেন্টস-- আসতে আসতে দমবন্ধ হয়ে আসছিলো আমার! মাকে, বাবাকে রোজ‌ই বলতাম হয় এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলো, নয়তো কলকাতায় ফিরে চলো। এসবের মধ্যে কুহুর শরীর আর‌ও খারাপ হতে শুরু করে, বলতে গেলে বিছানার সঙ্গে যেন একেবারে মিশে যাচ্ছিলো মেয়েটা, তাই অবস্থার উন্নতির জন্য বাবা ওকে কলকাতায় জেঠু-জেঠিমার কাছে রেখে আসে।

সবটা যেন হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল, কিছুতেই কোনো সমাধান হচ্ছিল না। এরপর একদিন যা ঘটলো সেটা বলতে এখনো আমার রীতিমত গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আমি জানি না সেটা আমার মনের ভুল ছিলো, না অন্যকিছু...

মনে আছে সেদিন রাতে আমি দোতলার ঘরে পড়াশুনা করছিলাম। যদিও মা-বাবা অনেকবার বারণ করছিলো তবুও আমি একপ্রকার জোর করেই ওদের রাজি করালাম, আসলে এতদিন ধরে যা যা ঘটছিলো, তাতে আমার মনে ভয় ছাড়া‌ও যেন একটা কৌতুহল‌ও জাগিয়ে তুলেছিল, আমি এর একটা শেষ দেখতে চাইছিলাম। মা-বাবা আমাকে বারবার বারণ করেছিলো যেন কোনোভাবেই আমি বারান্দার দরজা না খুলি, এমনকি ঘরের জানালাগুলোও বন্ধ রাখতে বলেছিলো।

রাত তখন কত হবে ঠিক মনে নেই, আমি ম্যাথস প্রজেক্টের কাজ করছিলাম, এমনসময় হঠাত‌ই শুনতে পেলাম সেই পরিচিত কান্নার আওয়াজটা যার থেকে এই সবকিছুর সূত্রপাত। কান্নার ক্ষীণ আওয়াজটা থেকে ক্রমশ বাড়তে লাগলো, আমি প্রমাদ গুনলাম, আজ হয় এস্পার নয় ওস্পার...

বারান্দার দরজাটা খুলতেই ঠান্ডা বাতাসের সাথেই একরাশ জমাট অন্ধকার যেন আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, আর সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের ভিতরের আলোটা দপদপ করতে নিভে গেল। এলোপাতাড়ি হাতড়েও সুইচবোর্ডটা খুঁজে পেলাম না,আর মা-বাবা চিৎকার করে যে ডাকবো, সেই চিৎকারটা‌ও যেন গলার কাছে এসে আর বেরোতে পারলো না, শুধু দুহাতে এই অন্ধকারের দেওয়ালটা সরানোর প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলাম, আমি যত এগোতে লাগলাম, সেই অন্ধকারটা যেন আর‌ও গাঢ় হতে লাগলো,আর সেই কান্নার আওয়াজটা যেন আর‌ও বাড়তে লাগলো। একসময় দেখলাম দূরে সেই অন্ধকারের বুকে দপ করে একটা ফ্যাকাশে আলোর পিন্ড জ্বলে উঠলো, কিন্তু সেই আলোয় চারপাশ আলোকিত হলো না, বরং সমস্ত অন্ধকার যেন সেই আলোর পিন্ডকে ঘিরে আর‌ও গাঢ় হয়ে উঠল। আলোর পিন্ডটা কিছুটা ওপরে উঠে প্রথমে এলোমেলো ভাবে পাক খেতে লাগলো, তারপর এক জায়গায় এসে স্থির হল। আমি মোহগ্রস্তের মতো যেন সবটা দেখে যাচ্ছিলাম, কান্নার আওয়াজ, অন্ধকার সবটাই যেন আমার মাথা থেকে উড়ে গিয়েছিলো।

এমনসময় সেই আলোর পিন্ডটা বড় হতে হতে ঠিক যেন একটা মানুষের আকার নিল। আমার‌ও হঠাৎ করেই যেন সেই মোহগ্রস্ত অবস্থাটা কেটে গেল। দেখতে পেলাম সেই মানুষের আকার নেওয়া আলোকপিন্ডটা ভাসতে ভাসতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ দেখলাম সেই মূর্তির ঠিক চোখ বরাবর দুটো আগুনের পিন্ড দপ করে জ্বলে উঠলো, আমার শিরদাঁড়া বেয়ে যেন সরীসৃপের মতো ঠান্ডা স্রোত নামতে লাগলো।আর সেই কান্নার আওয়াজটা ততক্ষণে থেমে গিয়ে তার পরিবর্তে হিংস্র গলায় ভেসে আসতে লাগলো,

"আমার বেহেশত চাই...বেহেশত চাই আমার... বে-হে-শ-ত...মুক্তি দে আমাকে... মুক্তি! ‌এই জাহান্নুমে আমি আর কয়েদ থাকবো না...মুক্তি চাই আ-মা-র!"

আর সঙ্গে সঙ্গেই হিংস্র হাসিতে চারপাশ ভরে উঠলো। সবটা আমার কাছে আবছা হয়ে আসছিলো, শেষটায় মনে হলো যেন সেই মূর্তিটা হাতের মতো অংশদুটো দিয়ে যেন আমার গলা টিপে ধরেছে... আমার দ-ম-ব-ন্-ধ হয়ে আসতে লাগলো। সেই হিংস্র আওয়া‌জ‌ও ক্রমে ক্ষীণ হয়ে এলো, তারপর, স-ব অন্ধকার।

(ক্রমশ)

।।৩।।

পরে যখন আমার জ্ঞান ফিরেছিলো আমি তখন হসপিটালে, জ্ঞান ফিরতেই মা আমাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে, সবাই বলাবলি করছিলো আমি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ফিরে এসেছি। ডাক্তারবাবু বলেছিল ইটস্ আ মিরাকল্...

এর পরের যে যে ঘটনাগুলো বলছি সেগুলো সবটাই মা আর বাবার মুখে শোনা, কারণ এরপরে আমার সাথে যা যা ঘটেছিল তা আমার কিচ্ছু মনে নেই।

সেই রাতের পরদিন সকালে বাড়িতে খোঁজাখুঁজি করেও যখন আমাকে পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন বাবার সন্দেহ হওয়ায় বাড়িতে পিছনে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ কবরস্থানের সামনে আমাকে মাথা নিচু করে হাত পা ছড়িয়ে বসে থাকতে দেখতে পায়, অথচ আমি নিজেও বুঝতে পারি নি আমি কখন কীভাবে ওখানে গেলাম।পুরো ব্যাপারটা শোনার পর আমার কাছে অসম্ভবের মত লাগছিল।

বাবার কথা অনুযায়ী আমি তারপর থেকে খুব অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করি। স্কুলে যেতে চাইতাম, সারাক্ষণ নিজের ঘরেই থাকতাম, সবকিছুতেই আমার অনীহা দেখা দিচ্ছিল। এরমধ্যেই একদিন রেবা চাচি আমার ঘরে এসে দেখতে পায় আমি নাকি ঘরের দেওয়ালে হামাগুড়ি দিচ্ছিলাম ঠিক যেন টিকটিকির মতো, আর আমার চোখ দুটো নাকি আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছিলো। রেবা চাচি সবটা দেখে ঊর্ধ্বশ্বাসে মা'র কাছে গিয়ে সবটা জানায়, কিন্তু মা আমার ঘরে এসে দেখে আমি আমার মতোই পড়াশুনা করছিলাম।


বাড়ির মধ্যে এইরকম‌ই নানা অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করে আমাকে। প্রতিবেশীরা প্রায়‌ই এসে বলতো আমাকে নাকি ওই কবরস্থানে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে। অনেকে আবার বলতো রাতের দিকে আমাদের বাড়ি ছাদে নাকি আলোর পিন্ড দেখা যায়, ঠিক ওই কবরস্থানটায় যেমন দেখা যেত।


মা বলেছিল এইসব ঘটনায় ওদের অবস্থা দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল, রোজ‌ই কিছু না কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটছিলো, আর আশ্চর্যভাবে ওই রাতের কান্নার আওয়াজটাও নাকি হঠাৎ করেই থেমে গিয়েছিলো।


এরপর একরাতের ঘটনা, হঠাৎ করেই কান্নার আওয়াজটা আবার শুরু হয়, আর মা-বাবার ঘুমটাও ভেঙে যায়, ওরা দেখে আমি ওদের মাঝখানে ছিলাম না। ওদের এবার ভয় করতে শুরু করে, কারণ এবার আওয়াজটা বাড়ির পিছন থেকে আসছিল না, আসছিল দোতলার ঘর থেকে। প্রচন্ড ভয়ে বাবা-মা ওপরে উঠে আসে এবং দেখে ঘরের কোণ থেকে সেই কান্নার আওয়াজটা আসছে, যেন ঘরের কোণে কেউ বসে কাঁদছে, তারপর ওরা চেষ্টা করে ঘরের আলো জ্বালাতে কিন্তু ঘরের কোনো আলোই জ্বলল না। অতঃপর সেই আলো-আঁধারিতেই ওরা এগোতে থাকে আন্দাজে আন্দাজে। ঘরের মাঝ বরাবর আসতেই ওরা দেখতে পায় দুটোর আগুনের পিন্ড দপ করে জ্বলে ওঠে ওদের সামনে, ওরা অন্ধকারের মধ্যেও বুঝতে পারে একটা প্রকান্ড ছায়ামূর্তি ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, আর তার সঙ্গেই শুরু হয় প্রচন্ড চিৎকার। যেন একটা ঝড় উঠেছিলো ঘরের ভিতর, সব এলোমেলো করে দিচ্ছিল সেই ঝড়টা, আর তার সঙ্গে সেই চিৎকার, "আমার মুক্তি না হলে কেউ বাঁচবেন... কেউ না... আমার বেহেশত চাই", ঠিক আমি সেরাতে যেমনটা শুনেছিলাম। মা-বাবা বুঝতে পারছিল না কি করবে। বাবা আমার নাম ধরে চিৎকার করতে থাকে,মা ঠাকুরের নাম করতে থাকে। এভাবেই একসময় সবটা থেমে গিয়ে আলো জ্বলে উঠলো আর তারপরেই মা-বাবা দেখল আমি রক্তাক্ত অবস্থায় ঘরের কোণে পড়ে আছি। ওরা ‌তখনই ওরা কোনোরকমে আমায় হসপিটালে ভর্তি করে।


প্রথম প্রথম ডাক্তার তো প্রায় আশা ছেড়েই দিয়েছিলো, অনেক ব্লিডিং হয়েছিল।কিন্তু পরে জেনেছিলাম রেবা চাচি নাকি কোন এক পীর পয়গম্বরের কাছ থেকে তাবিজ নিয়ে আমাকে পরিয়ে দিয়েছিল। আমি ঠিক জানি না আমি কীভাবে সুস্থ হয়ে উঠলাম, ডাক্তারদের চিকিৎসায় নাকি.....


সেরে ওঠার রেবা চাচির সঙ্গে শেষ যেবার দেখা হয়েছিল সেদিন ও বলেছিল আসল গল্পটা।


(ক্রমশ)

।।৪।।

"ঘটনাটা আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগের। সদ্য বাড়ির অমতে শাদি করার পর বিক্রমপুরের এই জায়গায় থাকতে আসে মকবুল আর শবনম। ভালোবেসেই শাদি করেছিল ওরা দুজন। মকবুল স্বভাবে ভীষণ দিলখোলা মানুষ শবনম ছিল একটু মুখচোরা, কিন্তু ওকে দেখতে ছিল একেবারে ডানা-কাটা পরী'র মতো, নূরের আলো‌ও যেন হার মেনে যেত ওর কাছে। ভালোবাসায় পরিপূর্ণ ছিল ওদের সংসার, অভাব থাকলেও সংসারে শান্তি ছিল। কিন্তু ওদের পরিনতি যে এমনটা তা স্বয়ং ঈশ্বর‌ও হয়তো বুঝতে পারেন নি।


থাকার ছোট্ট জায়গাটা ওরা একসময় নিজেদের পরিশ্রমে আর ভালবাসা দিয়ে বড় করে তোলে, গড়ে ওঠে ওদের দোতলা বাড়িটা। কিন্তু এরপরেই ঘটতে শুরু করে বদল। আসতে আসতে মকবুল কেমন যেন পাল্টে যেতে শুরু করে। আগের সেই দিলখোলা হাসিখুশি মানুষটা হঠাৎ করেই বদমেজাজি আর রগচটা হয়ে ওঠে, অকারণেই সন্দেহ করতে থাকে শবনমকে। শবনম কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, উপরন্তু রাতদিন‌ই ওদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকত।প্রতিরাতেই ওদের বাড়ি থেকে চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসত। পাড়ার লোকেরা সব বলাবলি করত মকবুল নাকি বদসঙ্গে পড়েছে। মকবুল প্রতিরাতে মদ্যপ অবস্থায় ঘরে এসে অত্যাচার করত শবনমের ওপর, এমনকি ওর চরিত্র তুলে কটূক্তি করতে পর্যন্ত ছাড়েনি। শবনম কিছুতেই বুঝতে পারছিল না যে কি করবে, ফিরে যাওয়ার সব পথ যে ও বন্ধ করে এসেছে। মকবুলকে ও অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে, কিন্তু কোনো কিছুতেই কিছু লাভ হল না, উল্টে সমস্যা যেন বাড়তেই লাগল। প্রতিবেশীদের কথায় তাবিজ, মাদুলি ঝাড়ফুঁক, সবকিছু‌ই করানো হল, কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হলো না। অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে‌ও শবনম মনে মনে এই আশাতেই বাঁচত যে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।

এরপর একরাতের ঘটনা। মকবুল সেদিন রোজকার মতোই নেশায় চুর হয়ে বাড়ি ফিরেছিল, আর ফিরেই শুরু হল অকথ্য অত্যাচার। শবনম সেদিন আর মেনে নিতে পারে নি, বিনা দোষে কেন‌ই বা সে এত অত্যাচার সহ্য করবে, তা‌ও আবার তার কাছ থেকে যার সঙ্গে ও ভালোবেসে ঘর বেঁধেছিল। শবনম বলেছিল ও আর মকবুলের সঙ্গে থাকবেনা, আর এভাবে পড়ে পড়ে অত্যাচার সহ্য করবে না, দরকার পড়লে ও থানায় যাবে। ব্যাস, তাতেই যেন আগুনে ঘি পড়ল, মকবুলের মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল, ও শবনমকে মারতে মারতে আধমরা করে দিয়েছিল। তারপর শেষে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।

সেই আগুনের সাথেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় শবনমের সবটুকু ভালোবাসা আর বিশ্বাস। শেষটায় ও বলেছিল, "যা আমার হলো না, তা তোমার‌ও হবে না, তুমি কোনোদিন‌ও বেহেশত পাবে না, জ্বলে মরবে তুমি, মৃত্যুর পরেও সেই জ্বালার অন্ত্ হবে না..."

তারপর মকবুল পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলেও পরে কোনোভাবে ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল। এলাকার কেউই ওর সাথে কথা বলতো না। মকবুল এরপর ভীষণ অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করে, নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, ময়লা জামাকাপড়, বড় বড় চুল, দাড়ি, আর সবসময় শুধু এক‌ই কথা, "আমাকে বাঁচাও, ন‌ইলে ও আমায় মেরে ফেলবে... "। দিনদিন ওর পাগলামি যেন বেড়েই যাচ্ছিল, রাতের দিকে প্রায়‌ই ওর বাড়ি থেকে প্রচন্ড চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ পাওয়া যেত, ঠিক আগের মতো।

এর বেশ কিছুদিন পরেই ওই বাড়ি থেকে মকবুলের জ্বলন্ত লাশ পাওয়া যায়, ঠিক যেমনটা শবনমের পাওয়া গিয়েছিলো। তারপর সমস্ত তদন্তের পর অবশেষে শবনমের মতো ওকেও বাড়ির পিছনদিকের কবরস্থানে গোর দেওয়া হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল ওই কান্নার আওয়াজটা যেটা তারপরও প্রতিরাতে শোনা যেত। লোকজন ওই জায়গাটা একরকম এড়িয়েই চলতো। বাড়িটায় তো শুনশান হয়ে পড়েছিল। তারপর একসময় এখানে লোক এসে থাকতে শুরু করে, কিন্তু কেউ‌ই এখানে বেশীদিন থাকতে পারত না, কারণ...

তারপর তো তোমরা সবটা জানোই", এই বলে রেবা চাচি থেমেছিল।

আমি বললাম, "কিন্তু চাচি তুমি এতকিছু জানলে কি করে?"

"সব সাওয়ালের জবাব হয় না পিহু বেটি, তুমি জানতে চাইলে তাই আমি বললাম, কিন্তু ইয়ে মাত পুছ...", রেবা চাচির অনুরোধে আমি আর কথা বাড়াই নি।

এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর, আমরা বড় হয়ে গেছি অনেকটা, তবে আমরা আর ওখানে ফিরে‌ও যাইনি, ফেলে আসা সময়ের গায়ে ধুলোর প্রলেপ পড়লেও, সেই ঘটনাগুলো আজ‌ও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। মনে হয় যেন ওই বাড়িটাই যেন আস্ত একটা অভিশাপ, যা আজ‌ও বেহেশত পাওয়ার আশায় রয়ে গেছে অপেক্ষায়। আমি ভীষণভাবে ভুলতে চাই সবটা, কিন্তু পারিনা।

এই যেমন আজ অফিস থেকে ফেরার সময় বাড়ির সামনের রাস্তায় দেখি একটা লোক রাস্তার ওপারে ঠিক আমার দিকেই তাকিয়ে, ময়লা জামাকাপড়, বড় বড় চুল, দাড়ি... ঠিক যেমনটা রেবা চাচি বলেছিল...

(সমাপ্ত)



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror