কাশীপুর আর টিয়ার গল্প
কাশীপুর আর টিয়ার গল্প


কাশীপুর ঘাট। উত্তর কোলকাতার বনেদি অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম। এখানে যেমন সকালে গঙ্গা স্নান শরীর মনকে জুড়িয়ে দেয়, তেমনই বিকালে সূর্যাস্তের দৃশ্য ততোটাই অপরূপ। যখন গঙ্গার বুকে লাল রঙা গোল সূর্য অস্ত যায়, তখন সত্যিই তা এক মন মাতানো দৃশ্য সৃষ্টি করে। নদীতে ভেসে চলে ফেরী , কিছুটা দূরেই বিবেকানন্দ ব্রিজ আর নিবেদিতা সেতু। উত্তর কোলকাতার নামী বরানগর বাজারও এখান থেকে খুব একটা দূরে নয়। সকালে বেলা একটু গড়ালেই ফেরিওয়ালা আর বিক্রেতাদের হাঁকডাকে মুখরিত হয়ে ওঠে চারদিক। কাছেই বিটি রোড , যার সাথে জড়িয়ে আছে আমার জীবনের নানা স্মৃতি। এমনিতেই বাড়ি সোদপুরে,বিটি রোডের কাছে। সেদিক থেকে তো বুঝতেই পারছেন। আরেকটা ব্যাপার, পাইকপাড়া তে এই বিটি রোডের ধারেই আমার সিভিল সার্ভিসের প্রিলিমিনারির সিট পড়েছিল। কোনো টিউশন না নিয়ে শুধু সেল্ফ স্টাডি করে এক চান্সেই ক্র্যাক করি সেটা। সুতরাং,জায়গাটার সাথে যে আলাদা ভালোলাগা তৈরি হবে,সেটাই স্বাভাবিক।
এছাড়াও ,সিঁথির মোড়ে আছে আমার অন্যতম প্রিয় গায়ক কুমার শানুর আদি বাড়ি। এই জায়গাটাও অন্য এক ভালোলাগা তৈরি করে আমার মনে।
যাই হোক,কি বলতে গিয়ে কি বলছিলাম,সত্যিই এখানকার ঘিঞ্জি রাস্তাঘাট,পথঘাটে ফেরিওয়ালার হাঁক,পুরনো বনেদি বাড়ি আর কর্পোরেশন বিল্ডিং,বরাহনগর বাজার,হাতে টানা রিক্সা,কাশীপুরে গঙ্গার ঘাট,কাছেই শ্মশান-কি যে ভালোলাগার সৃষ্টি করে বোঝানো যাবে না। মনে সত্যিই এক অন্যরকম অনন্য অনুভূতি জন্ম দিয়ে যায়।
ছোটবেলা এই কাশীপুরেই মলয়দাদুর বাড়িতে যেতাম। কর্পোরেশন বিল্ডিং এ থাকতেন ওনারা,তারপর ফ্ল্যাট নিয়েছিলেন। ছোটবেলায় স্কুল আর ঘরবন্দি জীবনে মলয়দাদুর বাড়ি যাওয়া আমার মনে একরাশ ভালো লাগার জন্ম দিয়ে যেত,বলতে গেলে এটাই ছিল আমার সবচেয়ে বড়ো রিফ্রেশমেন্ট। মলয়দাদুর বাড়ি যাওয়া মানেই চার-পাঁচদিনের জন্য পড়া বন্ধ,রাতদিন হইহুল্লোড়, সকালে কচুরি,দুপুরে খাসির মাংস আর রাত্রে ঝাল ঝাল পনির কোপ্তা। তারপর কর্পোরেশন বিল্ডিং হোক বা ফ্ল্যাট,ছাদ থেকে পুরো গঙ্গা দেখা যেত। সেটা ছিল বাড়তি আকর্ষণ। কাছেই দক্ষিণেশ্বর। তো মাঝে মাঝে ওখান থেকেও ঘুরে আসা যেত। স্বপ্নের মতো রঙিন ছিল সেই শৈশবের দিনগুলি। তারপর আমি মাধ্যমিক দেবার সময় মলয়দাদু মারা যান। মনে আঘাত পেয়েছিলাম,মলয়দাদু আমার দাদুর বন্ধু হলেও রক্তের সম্পর্কে কেউ ছিলেন না,কিন্তু তিনি ছিলেন আপন। মনের একজন কাছের লোকের মৃত্যু হয়েছিল। তারপর অনেকদিন আর কাশীপুরের দিকে যাওয়া হয় নি।
এরপর সাত বছর পরে আবার যেতে হল কাশীপুরে। এখান থেকে শুরু হল আমাদের গল্প।কলেজের থার্ড ইয়ারের পরীক্ষার ফলাফল বেরিয়েছে,সবেমাত্র ব্যাচেলার ডিগ্রি লাভ করেছি। এবার চাকরির পরীক্ষার সিট পড়ল কাশীপুরে আর সেখানে গিয়েই আমি প্রেমে পড়লাম উদ্ভিন্নযৌবনা তরুণী টিয়ার।
আজও মনে আছে সেদিনের ঘটনা। জানুয়ারী মাসের শেষদিক। পি এস সির সিট পড়ল কাশীপুরে। আর সেখানে পরীক্ষা দিতে গিয়ে যেমন মুখোমুখি হলাম অনেকদিন আগে ফেলে রাখা স্মৃতির যা এক লহমায় মনকে একরাশ ভালো লাগা দিয়ে যায়,তেমনি নিয়তির অদ্ভূত খেয়ালে প্রেমে পড়লাম টিয়ার।
আজও মনে আছে সেই দিনের কথা। কাশীপুরে যাওয়ার জন্য দমদম থেকে বাস ধরেছি। পরীক্ষার টেনশনই হোক বা দীর্ঘদিন পরে কাশীপুর যাবার উত্তেজনাই হোক,কিছুটা তন্ময় হয়ে আছি , এইসময় পাশ থেকে আওয়াজ এল ,"এক্সকিউজ মি,আপনার কি কাশীপুর গার্লস হাই স্কুলে সিট পড়েছে!" পাশ ফিরে বিভোর হয়ে গেলাম। সত্যিই স্বপ্নের রাজকন্যা। ভালো নাম অপরাজিতা। ওও যাচ্ছিল পরীক্ষা দিতে। বাসে অনেক কথা হল ওর সাথে। ওর কোকিলকন্ঠী গলার প্রত্যেকটা শব্দশ্রবণে বুকের মধ্যে বেজে উঠছিল এক অজানা রাগরাগিণী। সত্যিই স্বর্গে ভাসছিলাম। আর তারপর পরীক্ষার হলে প্রবেশ করবার আগে সেই চরম মুহূর্তের টেনশনের সময় ও যখন 'বেস্ট অব লাক' উইশ করার জন্য হাত মেলাল,সারা শরীরে খেলে গেল বিদ্যুৎ। এক অজানা অনুভূতি,এক অচেনা পজিটিভনেস এ ভরে গেল মন। মনের থেকে সরে গেল ভীতির কালো মেঘপুঞ্জ,সেখানে জন্ম নিল সাহস,জন্ম নিল প্রেরণা,জন্ম নিল জেদ।
সেদিনই রাতে ফেসবুকে খুঁজে ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম টিয়াকে আর ও অ্যাকসেপ্ট করেছিল। তারপর শুরু হল বাতালাপ। টিয়াকে জানিয়েছিলাম মনের গভীর অনুভূতির কথা। কিন্তু ও মৌন ছিল। হয়তো মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ!
দু বছর কেটে গেছে। গঙ্গায় অনেক জল গড়িয়েছে। আজ আবার যাচ্ছি কাশীপুর। যাচ্ছি টিয়ার সাথে দেখা করতে,টিয়াকে প্রপোজ করতে। জানি না টিয়া আমার প্রপোজাল অ্যাকসেপ্ট করবে কিনা,তবে আমি টিয়াকে নিজের মনের কথা বলবই। এটুকু সাহস তো আমার আছে। আর আছে সেই বিখ্যাত জেদ।
ক্ষণিকের অতিথি হয়ে যে এসেছিল জীবনে,আজ রচিতই হোক না তার সাথে এক দীর্ঘকালের সুদৃঢ় বন্ধন। এই মহানগরের বুকে রচিতই হোক না এক দুষ্টু মিষ্টি প্রেমকাহিনী।
"ইন বড়ে বড়ে শহরো ম্যায় তো ছোটি ছোটি বাত আখসর হোতি রেহতি হ্যায়!"