জীবন যন্ত্রণা(সপ্তম পর্ব)
জীবন যন্ত্রণা(সপ্তম পর্ব)
আপনাদের আশ্রমের প্রধান কে ! বাবাজী না নবীন মহারাজ! সুবর্নার আজব প্রশ্নের উত্তরে রতন দা বলল,
বাবাজী আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা, উনার নামেই এই আশ্রম তবে যা কিছুই সব নবীন ভাই নির্ভর, উনি ছাড়া আশ্রম কানা।
সুবর্না রসীকতার ছলে বলল,বুঝলাম আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রীর মত।
রতন এসব বোঝে না তাই বলল,ওসব বুঝি না,তবে বাবাজীর এখনও বেশ সুস্থ শক্তপোক্ত বয়স পঁচাশি ছিয়াশি কেউ বলবে না,কিন্তু উনি আশ্রমের বাইরে যান না।আবাসিক ছাড়া অন্য কোন মানুষের কাছে সাক্ষাৎকার দেন না,সব নবীন ভাই।
এখন বাবাজীর চোখের একটু সমস্যার জন্য লেখা লিখি করেন না ,তবে উনার দুটো ধর্ম বিষয়ে বই লিখেছেন, ছাপা হয়েছে।আশ্রমের তার কপি আছে, অনেকেই কিনে নিয়ে যায়। উনি বলেন সব ফ্রি কিন্তু বই নায্য দাম ছাড়া বিনা পয়সায় দেবো না তা হলে মানুষ পড়বে না,নোংরা আবর্জনার মত ফেলে রাখবে। আগ্রহ করে দাম দিয়ে কিনলে অন্তত পড়বেন, আর আমার ঈশ্বরের সত্যানুসন্ধান কিছু তো উপলব্ধি করবেন তাতেই আমার শ্রম সার্থক। একজন পাঠক পড়ে তাও ভালো তবে অনেক বই বিক্রি হয়,আবার ছাপাতে হয়।
এত বকা সুবর্নার ভালো লাগছিল না বলল,আপনি বরং একটু আশ্রমটা দেখান।
রতন তাকে সঙ্গে করে সমস্ত আশ্রম ঘুরাচ্ছিল। অনাথ শিশুদের জন্য ঘরটি একটু শক্তপোক্ত, রতন জানালো এই আশ্রমে এখন সাতজন স্বেচ্ছাসেবক আছে,তিন জন মহিলা, এদের সব থাকা খাওয়া ভরোন পোষন আশ্রমের খরচ,ওরা খুব সামান্য হাত খরচ নেয় । ওরাও একপ্রকার সন্ন্যাসীদের মতই ত্যাগ সেবা করছে।
একটা বড় গোশালা রতন জানাল এখন চল্লিশটা গাভী আছে।
এত দুধ কী হয়! বিক্রি করেন!
না,সব দুধ আশ্রমের আবাসিক অনাথ শিশু, স্বেচ্ছাসেবক আর ছাত্র ছাত্রীদের, নানা ভাবে, খাওয়ার কাজে লাগে।শিশুদের দুধ,একটু বড়দের রান্নার পনীর,দই ঘী থেকে কী কাজে লেগে যায় না!
সুবর্নার দেখছিল বিরাট এলাকায় আশ্রমের প্রাচীর ঘেরা,সৌর প্রান্ট, পুকুর আর বিস্তীর্ণ সবুজ ক্ষেত, আর বড় বড় বৃক্ষ শীতল সুন্দর মনোরম পরিবেশ। ভাবছিল এত ভালো পরিবেশ, আর হাজার কাজে ব্যস্ত নানা ভবিষ্যত পরিকল্পনা নবীন মহারাজ আর কি তার একমাত্র বাবা! তাকে আর মাকে তার ভুলে যাওয়া তো স্বাভাবিক।
কী পরিস্থিতির পরিপেক্ষিতে তার এই গৃহ ত্যাগ ও আশ্রমের জীবন আমি জানি না ,এত রাগ অভিমান তার কতটা যুক্তিযুক্ত! নিজের মনেই প্রশ্ন হচ্ছিল।
রতন বলল,এবার আজ চলো তোমাদের খেতে হবে, ড্রাইভারকেও খেতে দিতে হবে,নবীন ভাইয়ের এবার হয়ত চলে আসার সময় হল।
রতন নবীন আর বাবাজী আজও হবিশ্যির মত আহার করলেও আবাসিক স্বেচ্ছাসেবক আর অনাথ শিশুদের জন্য নিরামিষ খাবার, ভাত তরকারি, রাতেও নিরামিষ স্বাভাবিক খাবার ভাত রুটি,এখন নবীন বাবাজীকে বোঝাতে পেরেছে, পুকুরে মাছ হলে,অন্তত অনাথ শিশুদের একটু মাছ খেলে পুষ্টি পেতো।তবে যারা, স্বেচ্ছাসেবকরা নিরামিষ খাবে।আর শিশুদের বড় হলে তারা নিজেদের সিদ্ধান্তে নিরামষাসী হতেই পারে,এখন তাদের আমিষ মাছটা অন্তত খাক! তাই এবার প্রথম পুকুরে ধানি পোনার চারা মাছ ফেলা হয়।
সুবর্না আর ড্রাইভারকে অফিসের আলাদা করে মেঝে খাবার আয়োজন করল।রতন পঁচাত্তর বছরের বয়সে এখনও যেন সমান ছটফটে মানুষ। রতন তাদের খাবার পরিবেশন করল। ভাত কলমী শাক, ডাল ,উচ্ছে ভাজা,পনীর তরকারি আর কাঁচা আমের চাটনী।
খিদে ভালো ছিল তাই সুবর্না আর তার ড্রাইভার গোগ্রাসে খেল।খেয়ে সুবর্নার একটু যেন ঘুম ঘুম আসছিল। রতন তাকে ডেকে বলল,নবীন ভাই এসেছেন। তুমি কী এখন দেখা করবে!
উনি খেয়েছেন!
না, এইমাত্র ফিরলেন। তোমার কথা শুনে তোমার সাথে এখনই দেখা করতে চাইলেন, উনার ঘর নিলিবিলি, ওখানে তা হলে চলো!
সুবর্না ভাবলো বেশী কথা বলব না।আমার সাথে যাবার কথা বলব,তারপর দেখি কি বলে! খুব সাধারণ ঘর,সাধারণ তক্তাপোসের উপর সেই পুরোন ধরনের বিছানা,তবে এটা একক ঘরে নবীন থাকত, রতনের সাথে এককক্ষে শয়ন, একবছরে মধ্যেই ছেড়েছিল।
সুবর্নাকে ঘরে ঢুকতে দেখে নবীন বলল,
"এসো মা সুবর্না,তুমি তো মা অনেক বড় হয়ে গেছো! আর ঠিক মায়ের মতই সুন্দরী হয়েছ!"
সুবর্নার খুব রাগ অভিমান ছিল, কিন্তু বাবা কথা শুনে একটু হেসে ফেলল,বলে
"আমি কার মত জানি না, মা বলে বাবার মত ,আর আপনি বলছেন মায়ের মত, তবে আমি মনে করি আমি আমার মত।"
"ঠিক বলেছ মা,একশ শতাংশ কেউ কারোর মত হয় না, কিছু মিল থাকে।তা মা তুমি অনেকক্ষণ এসেছ রতন দা বলল,আমি একটু বাইরে ছিলাম, তুমি এ আশ্রমে এসেছ শুনে খুব খুশী হলাম, মা কেমন আছেন!"
"মায়ের শরীর ভালো নেই,একবার আপনাকে দেখতে চায়।তাই আমার আসা,আমি গাড়ী নিয়ে এসেছি।"
"সব বুঝলাম মা,আমি যে খুব ব্যস্ত, কাল ডি এম অফিস থেকে একটা প্রজেক্ট ব্যপারে ইন্সপেক্শন হবে, আমকে থাকতেই হবে।পরে একদিন সময় করে যাব।তোমরা কী মামার বাড়িতেই আছো!"
"না, মা বলে আপনার গৃহ ত্যাগের ক মাসের মধ্যেই মা নিজের কর্মস্থল বদলি করেছিল, মামা বাড়িও ছেড়েছিল, আপনার গ্রামের বাড়ির নিকট মাধবপুর হাসপাতালে বদলী নেয়,ওখানে কোয়ার্টার আমাকে নিয়ে মা নিয়ে বাস করেছিল পাঁচ বছর। খুব আশা ছিল যদি আপনি গ্রামের বাড়ি যান, এমন আশা মা অনেক দিন করেছিল। কত খোঁজ নিত,
তারপর মা সব আশাই ছেড়ে দেয়, আপনি বেঁচে আছে কীনা জানত না,মা আপনার আগের মেস, আপনার মা সবার কাছেই আপনার যদি খোঁজ পায় সেই আশায় ছুটে যায়,যদিও আপনার খোঁজ পায়নি।
নবীনের চোখে জল,বলল,
"তোমার মায়ের এত যে ঘন ঘন মনের পরিবর্তন ভগবানের জানা অসাধ্য ,আমি কোন ছাড়! তোমাকে সব বলব না,তবে আমি আর আশাকরি নেই ,আমাকে তোমার মায়ের কোনদিন দরকার হবে।এত ছোটাছুটি করবে,তোমার কথা শুনে আমার অবিশ্বাস্য লাগছে।সত্যিই মানুষের মন বোঝা দায়!
মা পেপারে অনেক বার আপনার ছবি দিয়ে খোঁজ সন্ধান করেছিল। আজও মা আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে।পাঁচ বছর আগে আপনার একটা টিভির সাক্ষাৎকার দেখে,আপনি বেঁচে আছেন এই আনন্দে মা সেই দিন হাউ হাউ করে কাঁদছিল। আপনার আশ্রমের নাম ঠিকানা আমি ভুলে গেছি মায়ের ঠিক মনে আছে।"
নবীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ,
"দেখ মা আমি তো সে রাতে জীবনের প্রতি ঘৃনায় পাগলের মত উদ্দেশ্য হীন ভাবে দামোদর ধার ধরে হাঁটছিলাম,ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ত না খেয়ে অনাহারে কোথাও পড়ে মরেই যেতাম, বাবাজীর নজরে এলাম,ঈশ্বরের দুতের মত আমাকে আশ্রম দিলেন এত স্নেহ ভালোবাসা আর বিশ্বাস! কি বলব! আজ যা কিছুই সব ওর কৃপা।"
"আপনার বাবাজীর দেখা পাবো!"
নবীন পাশের বাবাজীর ঘরে সুবর্নাকে নিয়ে গেল। বয়স্ক শক্তপোক্ত হলেও বাবাজী চোখে এখন একটু কম দেখেন, পড়াশোনার এত আগ্রহ, এত সব বই ম্যাগাজিন এখন আর ব্যবহার হয় না।
সুবর্না বাবাজীর পা ছুয়ে প্রনাম করতেই বাবাজী বললেন,
"কে মা তুমি ,আশ্রমের নিশ্চয় নয়, তা হলে প্রনাম করতে না!
সুবর্না বিষ্ময়ে নবীনের দিকে তাকাল,নবীন হেসে বলে ,
"এই আশ্রমে পা ছুঁয়ে প্রনামের চল নেই , জোর হাত বুকে রেখে মাথা হেঁট করে বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা প্রনাম জানানোর রীতি।সুবর্না ঐ ভাবেই নবীনকে প্রনাম করে বলে,
"আমি আপনার মেয়ে বাবাজীকে বলতে পারি?"
"কেন নয়!"
"বাবাজীর কানে কথা গুলো গেছিল, সুবর্নাকে কাছে ডেকে মাথায় হাত রেখে বলে,
" মা তোমার বাবাকে আমরা ধার নিয়েছি।তুমি পিতৃস্নেহ পাও নি ,এজন্য এই আশ্রম দায়ী।"
সুবর্না বলে,
"বাবা বললেন আপনি না থাকলে উনি তো প্রানেই বাঁচতেন না। অনাহারে দামোদর কোন নির্জন স্থানে মরে পড়ে থাকতেন।"
"এসবই ঈশ্বরের লীলা,আমি কে!"
"আমার মা তাই বলে ,বাবাকে সেই রাতে মা চুড়ান্ত লাঞ্ছিত অপমানিত করেছিল, তাই বাবা গৃহ ত্যাগ করেছেন। না হলে মিষ্টির দোকানী হয়ে ঘর জামাই হয়ে,আজীবন নরক জীবন মায়ের অবহেলা আর উপেক্ষা পেতেন। বাবা গৃহ ত্যাগ বা নিখোঁজ হবার পর,বাবার মুল্য মা সেদিন বুঝেছিল। মায়ের চরম অনুতপ্ত জীবন , আমি কিছুটা বুঝি বাকীটা মায়ের অন্তরে পাথরের মত জমে আছে।পাঁচ বছর আগে এক টিভির সাক্ষাৎকারে বাবাকে দেখে মায়ের কি আনন্দ, আবার শাখা সিঁদুর নতুন করে পরতে লেগেছিল। মা অসুস্থ বাবাকে দেখতে চায় ,তাই আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি ,বাবা যদি যায়।"
বাবাজী বলে তোমার বাবা আজ শুধুই সন্নাসী নয়! সমাজসেবী একটা অনাথ আশ্রম চালায়,তোমার সঙ্গেই আজ যেতে পারবে কী! কী বলো নবীন! "
"আমি যাব বলেছি তবে এখন ভীষণ চাপ,একটু হালকা হলেই যাব।"
"মা অনেক আশা করে থাকবে।ঠিক আছে আমি আর কিছু বলব,মা অসুস্থ আপানাকে শুধুমাত্র একবার দেখতে চায়, এবার আপনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন। একটা আপনার ছবি দেবেন। মায়ের সন্দেহ আপনি আজও মাকে ক্ষমা করেন নি। তাই মায়ের কাছে যাবেন না, তাই একটা আপনার ছবি চেয়েছিল, এটাও কী পাবো!"
বাবাজী বললেন,
"নিশ্চয়ই পাবে মা।নবীন তোমার একটা রিসেন্ট ফটো তোমার মেয়েকে দাও,যেটা গতবারে তোমার কৃতী ছাত্রছাত্রীরা তোমাকে নিয়ে সখ করে গ্রুপ ছবি তুলেছিল।জানো এ আশ্রমের ছাত্র ছাত্রীরা কত ভালো ভালো পদে আছে!"
"বাবাজী এসব কথা থাক,ওর এসব ভালো লাগবে কী ! আমি বরং ওকে ঐ গ্রপ ছবি দিচ্ছি,তুমি মা, স্টুডিও তে আমার আলাদা ছবি যদি চাও, বলে করে নেবে।আমার একক ছবি নেই।অনেক রাস্তা তুমি যাবে, মা বলছ অসুস্থ, আর দেরী করো না। আর আমি সময় পেলেই তোমার ঠিকানা লিখে রাখছি নিশ্চয়ই যাব।"
সুবর্না আর দেরী করেনি খানিক ব্যর্থ মনে মায়ের কোয়ার্টারে ফিরতে সন্ধ্যার আধাঁর নেমেছিল।
তপতী বাস্তব বাদী জানত ব্যস্ত মানুষ নবীন কন্যার সাথে আসা সম্ভব নয়।সুবর্নার মুখ চোখে ক্ষোভ অভিমান,বলে,
" আর কোন দিন যাব না।তোমার নবীন সন্ন্যাসী অনেক বড় মানুষ, ডি এম সাথে মিটিং করেন এক এ ডিএম নাকি ছাত্র, কত অনাথ শিশুদের জন্য আশ্রম!আবার বেকার ছেলেমেয়েদের কর্ম সংস্থান জন্য কত চিন্তা,আমি তুমি ঐ ব্যস্ত মানুষের কাছে কেন গুরুত্ব পাবো!"
"কী বলল তোকে,চিনল !"
"হ্যাঁ তা চিনল, আমি নাকি তোমার মত সুন্দরী! সুবর্না মা বলে সম্বোধন করল,খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছিল ওদের আশ্রমের রতনদা।"
"তোর নামটা আমি রেখেছি, ওর ঠিক পছন্দ ছিল না ,বলেছিল তিলোত্তমা রাখত, যাক তোর নাম মনে রেখেছে এই ব্যস্ততার মধ্যেও এতদিন পর!"
আবার আমার মত সুন্দরী! মনে মনে ভাবছিল, মানুষটা একদিন কত যে আমাকে ভালোবাসত! আজ ও সন্ন্যাসী ,আমার কলেজের স্মৃতি মনে রেখেছে! মুখে সুবর্নাকে বলল,
"আজ আমি সুন্দরী বললে লোকে হাসবে। তোর বাবা শরীর কেমন আছে!"
"কে বলবে তোমার বয়স এক সাথে কলেজে পড়তে! যেন যুবকদের হার মানাবে।তোমার মত তো ফালতু ভাবে না! সুখের জীবন।"
"পাগল মেয়ে ,অত বড় আশ্রমের এত সব দ্বায়িত্ব কি কম ভাবছিস!"
"তবু তোমার মত মেয়ে মেয়ে,আর স্বামীর চিন্তা করে তো শরীর নষ্ট করে না,ভালোই করে, তোমার ঐ বাজে চিন্তায় আমাদের কোন লাভ নেই, নিজের শরীর নষ্ট। চালাক নবীন সন্ন্যাসী নিজের শরীরকে যত্ন করে ভালো বাসে।"
তপতী রেগে বলে,
" নবীন সন্নাসী কী! বাবা বলতে কষ্ট হচ্ছে! এটা তোর অসভ্যতা আমাকেও আড়ালে তাহলে তপতী নার্স বলবি!"
সুবর্না বুঝতে পারে বাবাকে এভাবে বলা মায়ের পছন্দ নয়,সে বাবাকে এ ভাবে ছোট করা, মায়ের মনে কষ্ট হচ্ছে।
তাই ক্ষোভে বলে,
"তোমার শরীর খারাপ শুনে একটু মন খারাপ ভান করল, কিন্তু আসার কথা বললে কত সব কাজ হাজার ব্যস্ততা!পরে সময় করে যাব, কত দয়া!যেন একদিন এসে ধন্য করবে।"
"দেখ সুবর্না তোর এখনও বুদ্ধি হয়নি।বাচ্চার মত।আমার শরীর খারাপ শুনে কী কাঁদবে! না সব কাজ কর্ম ছেড়ে ভবঘুরের মত দৌড়ে আসবে! কত সরকারী কর্মী জানিস বাবা মা মরলে বাড়ী যেতে পারে না, অশৌচ পোষাক পড়ে ডিউটি করে,আর ওর আশ্রমে কত দ্বায়িত্ব অনাথ শিশুদের দেখভাল তাদের অসুখ বিসুখ। তুই তোর বাবার কাজকে ছোট ভাবিস না।"
"কে ভাবছে! বাবাজীর নামে আশ্রম আর তোমার স্বামীর সব দ্বায়িত্ব। কিন্তু তুমি অসুস্থ বা আমার কথা ভাবার একদিন সময় নেই।বড় সন্ন্যাসী তো! আবার সমাজসেবক ঐ গর্বে থাকো।"
"হ্যাঁ তাই থাকব,"বলে তপতী চুপ করে গেল।
সুবর্না বলল, "তোমার একটা কথা উনি দয়া করে রেখেছেন!
"কী কথা!"
"উনার একটা ছবি,তাও একক নয়,একক ছবি নাকি নেই,গ্রুপ ছবি,সফল ছাত্রদের সাথে গতবছর ঐসব ছাত্রদের ঝোঁকে তোলা হয়। ঐ গ্রুপ ছবি থেকে উনার ছবিটা স্টুডিও থেকে আলাদা করার পরামর্শ দিলেন।"
তপতী চরম আবেগে বলে,
"তুই এতক্ষণ না বাজে বকে এটা আমাকে বললি না! কয় দে দেখি।"
সুবর্নার কাছ থেকে এই গ্রুপ ছবি একরকম ছিনিয়ে নিয়ে তপতীর আর দেখে দেখে আশা মেটে না। পাশের ছাত্রীদের উপর তার নজর ছিল না।
বলল,
" কালকেই তোর বাবার ছবিটা আলাদা করে একটা বড় ফটো বাঁধিয়ে আনবি ।কী সুন্দর লাগছে! এই না হলে সন্নাসী! কী সৌম্য রূপ!দেখলেই শ্রদ্ধা সম্মান আসে।"
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তপতী বলে,
" আমি অন্ধ, হীরে ফেলে পাথরের মোহে ছিলাম। আর ওর সংসার যোগ্য জায়গা নয়। ঈশ্বর ঠিক মানুষ কে সঠিক স্থানে পাঠায়, দুঃখ অভিমান করে কী করবি!"
"ঈশ্বর কীনা জানি না,বাবাজীর সাক্ষাৎ না পেলে উনার বক্তব্য হয়ত অনাহারে দামোদরের গাবায় বালিচরে মরে পড়ে থাকতেন।সেদিন এত ক্লান্ত বিধ্বস্ত ছিলেন।"
তপতীর মুখ চোখ কেমন দুঃখ আর অপরাধবোধ স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল। তার পর বলল
"ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই বাবাজীর সাক্ষাৎ তোর বাবা সেদিন পেয়েছিল, না হলে বল দামোদর ধারে এমন আশ্রম থাকবে কেন! কেন ই বা তোর বাবা দামোদর ধার দিয়ে হাটবে ! আর ঠিক সময়েই বাবাজীর দেখা পাবে! আমিই বা কী কুক্ষনে তোর বাবাকে রাতে ধাক্কাধাক্কির করে বের করে দেবো! পুলিশের ভয় দেখাব!পুলিশ আমার পরিচিত কী করব দেখবি! এসব বলব কেন! সব পাকচক্র!"
সুবর্না যেন নতুন কিছু শুনল বলল ,
"রাতে ঘর থেকে বের করে দিয়ে আবার পুলিশের ভয় কী দেখালে?"
"মরন দশা, রাগলে ঐ সময় আমার জ্ঞান থাকত না, বলেছিলাম আবার আমার ঘরে এলে বধূ নির্যাতন দায়ে তোকে জেলে ভরব।হয়ত ভয়ে তাই পালিয়েছিল। আমার রাগতো এসব ঘটনার পর কমল, বুঝলাম রাগ মানুষের বড় শত্রু ,আমি এখন আর সহজে রাগি না।আর খুব রাগ হলে চুপ করে যাই।"
সুবর্না যেন বুঝেছিল কী কঠিন করুন পরিস্থিতির জন্য বাবা গৃহ ত্যাগ। সামান্য লাঞ্ছনা অপমান নয়!যথেষ্ট ভয় ভীতি, আর পুলিশের হুমকী!
দিন চার পর,সেদিন সুবর্না কলেজ গেছিল, ক্লাস শেষ হয়েছিল। ফাইনাল বর্ষের পরীক্ষা সামনেই। পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড আনতে গেছিল। বেলা তখন বারোটা অসুস্থ তপতী মেডিক্যাল লিভে,তার কোয়ার্টারে ছিল। একটা প্রাইভেট কার তার কোয়ার্টারে সামনে এসে দাঁড়াল। তপতী মনে ক্ষীণ আশাছিল হয়ত নবীন তাকে ক্ষমা করে দেখতে এসেছে! ঘর থেকে বের হয়ে দেখে এক সুদর্শন যুবা তাকে জিজ্ঞেস করে,
"তপতী ম্যামের এটাই কী কোয়ার্টার!"
বিস্মিত তপতী বলে,
" হ্যাঁ, আপনাকে ঠিক চিনলাম না!"
"আপনি মাতৃতুল্য আমায় তুমি করে বলুন। আমাকে আশ্রমের মহারাজ আপনার ঠিকানা দিয়ে আসতে বলেছেন, আমি উনার ছাত্র,আশ্রমের অনেক আর্থিক সাহায্য পেয়েছি, আমি কলকাতার এক নামী নার্সিংহোমে আছি।আমি ডাক্তার, আমার যিনি সিনিয়র নাম করা,চিনবেন হয়ত,ডক্টর হরিনাথ ,উনিও বাবাজীর আশ্রমে অনেকবারই এসেছেন। আপনার যা চিকিৎসার আমরা করব।"
এতো ক্ষণে তপতী বুঝল বলল,ও তুমি কী নবীন মহারাজের ছাত্র! ডাক্তার, বিষ্ময়ে বলে
" আমার চিকিৎসার জন্য তোমাকে পাঠিয়েছেন!"
"ঠিক তাই ,উনার আজ আমার সাথেই আসার কথা ,কিন্তু জরুরী কাজে আটকে গেছেন।"
"কিন্তু বাবা আমার চিকিৎসা কী করবে! আমি তো নিজে নার্স, আর হাসপাতালের সেরা সেরা ডাক্তার বাবু আমায় ভরসা দেয়নি , আমি আর বেশীদিন নেই।মেয়েকে বলি নেই, ও ভেঙ্গে পড়বে।"
"কী বলছেন ডাক্তার!"
"আমার হাই ব্লাড সুগার ,প্রেসার হাই,আর ব্রেন টিউমার রিসেন্ট ডিটেক্ট হয়েছে, অপারেশন করলে রিস্ক, মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত এটা আমার অনুমান, আমি চব্বিশ বছর নার্সের কাজ করছি, একটা অভিজ্ঞতা আছে।আমি তাই অপারেশন করব না।যতদিন আছি! মেয়েটার জন্য বড় চিন্তা হয়।"
একটা অসহায়ভাব তপতীর মুখে ফুটে উঠেছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
"এসো বাবা ঘর দিয়ে এসো।অনেক কথা আছে।"
যুবক ঘরে ঢুকল, একটা চেয়ারে তপতী তাকে বসতে বলল,নাম জিজ্ঞেস করল।
যুবক বলল,
"আমার নাম বিবেক রায়, দরিদ্র ঘরের সন্তান, নবীন মহারাজ আর বাবাজীর সাহায্য ছাড়া কিছুই করতে পারতাম না। নবীন মহারাকে আমি বাবার মত সম্মান করি।উনার কাছে ক্লাস ফাইভ থেকেই পডেছি,আশ্রমের আর্থিক সাহায্যে বই পেয়ে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির পরও উনাদের সাহায্য পাই, পরে সরকারের কিছু অনুদান, এডুকেশন লোন নিয়ে আজ একটা পজিশনে আছি।মহারাজ বললেন তুমি যদি পারো,আমার মেয়ে এসেছিল, ওর মা অসুস্থ বলল,পাঁচ বছর আমার সন্ধান পেলেও , আজ এসেছে মানে ওর মা নিশ্চয়ই বেশ অসুস্থ, অজ গ্রামের হাসপাতাল সু চিকিৎসার যদি একটু ব্যবস্থা করো,আমি তো মেয়ের কোন দায় নি নেই, মায়ের কাছেই বড়। ওর মায়ের যেন কোন চিকিৎসার ঘাটতি না হয়।উনার আদেশ আমার গর্বের। জীবনে কোনদিন কোন ছাত্র ছাত্রীদের কাছে কোন আবেদন করেন নি, হয়ত আপনার আর মেয়ের জন্য এমন করে বললেন। আমার সিনিয়র স্যার বললেন তুমি যাও ,আপনার যতটা সম্ভব আমরা চিকিৎসা করব।"
"তারপর ভগবানের হাত ঠিক তো!"
"বিবেক বলে,আপনি এ বৃত্তিতে অনেক অভিজ্ঞ আর কী বলব!"
"তোমাকে অনেক ধন্যবাদ বাবা, আর তোমার মহারাজ, বাবাজী ,সিনিয়র, যারা আমার কথা ভাবছেন এটাই আমার মত তুচ্ছ মানুষের যথেষ্ট ভাগ্য।"
"আপনি কী আমার সাথেই যাবেন! সঙ্গে আপনার মেয়ে যেতে পারে থাকার ব্যবস্থা সব হয়ে যাবে।"
আমি নিজেকে,আর তোমাদের সবাইকে হায়রানী করাব না।আমি সুখী নই,আমার বাঁচার সম্ভবনা খুব কম, যার জন্য আমার মরতে কোন দুঃখ ক্ষোভ নেই।শুধুমাত্র মেয়ের জন্য চিন্তা। আমার আত্মীয়স্বজন থাকতেও নেই, আমার অবর্তমানে ওর কি হবে! এই তো সমাজের অবস্থা। মেয়েকে তোমাদের আশ্রমে পাঠালাম, বিপদের দিনে আশ্রয় পেতে পারে।আমার চাকরীটা হয়ত আমি না থাকলে সরকারী নিয়মে পেতে পারে ,কিন্তু ওর সখ,মাষ্টার ডিগ্রির পর রিসার্চ বা বি এড,স্কুল বা কলেজে পড়ানো।আমাদের কাজ বড় ঝক্কীর সে তুলনায় শিক্ষকতা বড় আরামের কাজ। জানি না কী হবে ।কদিন আর বাঁচব,ওর জন্যই চিন্তা।"
তপতীর দুচোখ জলে ভরে গেছিল চোখ মুছতে মুছতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
"বিবেক বলে এতটা ভেঙ্গে পড়ার কিছু নেই মা! আমার তরফে কিছু করার থাকলে আদেশ করতে পারেন।"
তপতীর চোখ কেমন আশায় চকচক করে ওঠে বলে,
" তুমি তো বাবা নবীন মহারাজকে বাবার মত ভক্তি করো!
"হ্যাঁ করি ।"
"যদি তুমি এখন একক থাকো ,বা অন্য কোথাও তুমি এনগেজ্ না হও ,নবীন মহারাজের মেয়েকে তুমি নিজের করে নিতে পারবে! এর চেয়ে আমার বড় চিকিৎসা নেই।"
"বিবেক একটু চুপ থাকে।
তপতী বলে ,
"তোমার যদি কেউ থাকে আমার কথা কিছু মনে করো না বাবা!তোমায় দেখে ভালো লাগল নবীন মহারাজের ছাত্র তাই ভরসা হল,এক অসহায মা হিসাবে বললাম, হয়ত ঠিক হল না।"
"না মা,আপনি কোন ভুল করেন নি।আমি একক আমার কোন প্রেমিকা বা বান্ধবী নেই, তবে এই মুহূর্তেই বিয়ের পরিকল্পনা ছিল না,তবু ভাবব, বাড়িতে বলব আর মহারাজকে বলব।"
"তোমার একটু আশ্বাস এটাই যথেষ্ট"
"আমি সাধ্য মত আপনার প্রস্তাব ভাবব।"
"হঠাৎই বাইরে থেকে সুবর্নার আওয়াজ শুনে উদ্বেগে তপতী বলে,
" মেয়ে কলেজ থেকে ফিরল।"
"বাইরে কার গাড়ী মা!"
বলতে বলতে ঘরে ঢুকে বিবেক কে দেখে একটু হতচকিত হয়ে সুবর্না বিবেকের দিকে তাকায়।
তপতী বলে ,
"উনি ডাক্তার বাবু কলকাতার নামী নার্সিংহোমের ডাক্তার, তোর বাবার ছাত্র, তোর বাবার কথামত আমার চিকিৎসার জন্য এসেছেন। আজেই উনার গাড়িতে নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিচ্ছিল।"
বিষ্ময় প্রকাশ করে সুবর্না বলে , "তুমি রাজি!"
"না আমার চিকিৎসার প্রয়োজন হবে না।"
"কেন !একবার তো কলকাতার ভালো ডাক্তারের চিকিৎসার করাতে পারতে ! কত আর খরচ হবে?"
"ওরা কোন খরচ নেবে না,তোর বাবাকে নিজের বাবার মত সম্মান করে।"
"এবার সুবর্না বিবেকের দিকে কৌতুহল চোখে তাকায় কোন উত্তর দেয় না,শুধু বলল ,
" আমি পোষাক বদল করে আসি মা।"
তপতী বলে ,
"একটু সরবৎ কর,তোর আর বিবেক দুজনের জন্যই করবি।"
সুবর্নার রূপ সৌন্দর্যে বিবেক যেন পাগল। বলে "আপনার মেয়ে কী পড়াশোনা করে!"
"ও এবার ইংলিশ অনার্স ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষা দেবে , আজ অ্যাডমিট কার্ড আনতে গেছিল।"
বিবেক একটু চুপচাপ ,মনে মনে ভাবে আপনার মেয়ের যা রূপ! যেন আগুন। মুখে বলে ,
"আমার কোন এনগেজমেন্ট নেই ,আপনার মেয়ের তো থাকতে পারে! আপনি নিশ্চিত! ওকে আমি কথা দিলে ও মানবে!"
তপতী মলিন হাসে বলে,
"মেয়ের প্রেম বিষয়ে চরম বিরক্তি, নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, কারণ আমাদের বিয়ে প্রেমে, আর দীর্ঘ দিন প্রেমের পর বিয়ে করে আমাদের দাম্পত্য জীবনে ব্যর্থ, তোমার নবীন মহারাজ সন্নাসী ,আর আমি একক নরক জীবন বাস করছি। এসব দেখে ও আমার সম্বন্ধ বা ঠিক করা পাত্র ছাড়া বিয়েই করবে না প্রতিজ্ঞা করেছে।আমার অভিজ্ঞতা বেশী সামাজিক বিয়ে, দুটো সংসার দুটো জীবনকে আশীর্বাদ করবে, তার মুল্য নাকী আলাদা! কী বলব বাবা,সামাজিক বিয়েতে কত অশান্তি,বিচ্ছেদ হত্যা আত্মহত্যা কতই হয়।ও কিছুতেই বুঝবে না।"
"ওর আমাকে পছন্দ হলে আমার আপত্তি নেই। আমি রাজী ।" এক নিশ্বাসে বিবেক কথা গুলো বলে যেন হালকা হল। সুবর্নাকে দেখার পর তার মোহে মনের আবেগ তাড়িত চাপ আর যেন সে নিতে পারছিল না।
সুবর্না দুহাতে সরবৎ নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কানে কিছু কথা গেছিল। একটি সরবৎ গ্লাস বিবেকের হাতে ধরিয়ে,অপর সরবৎ গ্লাস হাতে মায়ের কাছে খাটে বসে বলল,
"কি যেন সব কানে এল মা!"
"কী সব কথা!"
"তোমার চিকিৎসার জন্য উনি এসেছিলেন এখন কী সব ঘটকালী ! আমার পছন্দ হলে উনি রাজী! আমি ঠিক বুঝলাম না।"
তারপর রসীকতার করে বিবেককে বলে,
"ডাক্তার বাবু ,মায়ের শরীর কী এসব শুনে সুস্থ হবে! মায়ের সুখের জন্য আমি কিন্তু সবেতেই রাজী।"
বিবেক কোন উত্তর দিল না ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি ,সরবৎ পান করে বলল,
"মা আজ আমি এবার উঠব।"
তপতী বলল,
"তুমি বাবা, আমার মেয়ের উত্তর নিশ্চয় পেয়ে গেছ ! এবার তোমার কোটে বল।আমায় যত তাড়াতাড়ি পারো চিন্তা মুক্ত করো।"
সমাপ্ত