STORYMIRROR

Sharmistha Mukherjee

Romance Tragedy

3  

Sharmistha Mukherjee

Romance Tragedy

ঝিলম

ঝিলম

6 mins
268


আচমকা সজোরে জানলা বন্ধ হওয়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ঝিলমের। "কিসের শব্দ? ও বাইরে ঝড় উঠেছে, বৃষ্টিও হচ্ছে খুব "। সাগরের গায়ের চাদরটা টেনে ভালো করে গায়ে দিয়ে দিল। সাগর তখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে । সাগর ঝিলমের স্বামী। পেশায় ছিল সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার । দেখতে খুব সুন্দর, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, বেশ লম্বা । খুব ভালো কথা বলতে পারতো তাই বন্ধুমহলে বেশ হাঁকডাক ছিল সাগরের । গেল বছর ১৪ই বৈশাখ বাবার পছন্দ করা পাত্রী ঝিলমকে সে কিছুটা বাধ্য হয়েই বিয়ে করেছিল । কিন্তু বলে সে কোনোদিনও ঝিলমকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। ফুলসজ্জার রাতেই সে কথা স্পষ্ট জানিয়ে দেয় সে। ঝিলম একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। কৃষ্ণবর্ণা , পটলচেরা দুটি চোখ, পাতলা ঠোঁট, কোমড় পর্যন্ত বিস্তৃত ঘন কালো কুঞ্চিত কেশরাশি । যাকে এক কথায় বলা চলে অপরূপা । কবিগুরুর ভাষায় " কৃষ্ণকলি " ।


দোষ বলুন আর খুঁত বলুন সেটা একটাই গায়ের রং খুব কালো । ফুলসজ্জার ঘরে সাগরের মুখে শোনা কতোগুলো কথা সে আজও ভুলতে পারেনি। সাগর বলেছিল, " Listen ঝিলম, বাবার কথায় আমি তোমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি কিন্তু আমি তোমাকে কোনোদিনও আমার স্ত্রীর মর্যাদা বা ভালোবাসা কোনোটাই দিতে পারবো না। আমার বন্ধু-বান্ধবের স্ত্রীরা কতো সুন্দর, তোমাকে নিয়ে তাদের সামনে গেলে আমার সন্মান থাকবে না। আর হ্যাঁ আরেকটা কথা, তোমার সাথে আমি এক বিছানা শেয়ার করতে পারবো না। So please........ " ।


এইসব কথা শুনে ঝিলম অবাক দৃষ্টিতে সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বালিশ নিয়ে সোজা চলে যায় সোফার দিকে। সেদিন কোনো প্রতিবাদ করেনি সে, আজ ও সে মুখ খোলে না । দেখতে দেখতে দাম্পত্য জীবনের এক বছর সাত মাস কেটে গেছে । বিবাহিত জীবনটা যেন ঘন কুয়াশাবৃত, ধীরে ধীরে হচ্ছে ঘূণপোকার শিকার । কিন্তু ঝিলম চাইলেও এই বিবাহ-বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না কারণ কখন যেন একটু একটু করে সে সাগরকে ভালোবেসে ফেলেছে । ভালোবাসা কি অদ্ভুত তাই না ? যে সাগর ঝিলমকে এতো অবহেলা করে, ঝিলম নাকি তার জীবনের কালিমা, ঝিলমের জন্য নাকি বন্ধুমহলে তার সম্মান নষ্ট হয়ে যাবে আর সেই সাগরকেই ঝিলম ভালোবেসে ফেললো । 


আর সাগর যার একসময় এতো অহংকার ছিল, যে ঝিলমকে ঘৃণা করতো আজ সে ঝিলমকে ছাড়া কিছু বোঝেনা । এখন ওর জীবনে ঝিলমের গুরুত্ব অনেক বেশি । 


কি অবাক হচ্ছেন তাইতো ? অবাক হওয়াই স্বাভাবিক । গত ছয় মাস ধরে সাগরকে আর ঝিলমের কালো চেহারা বা কালো মুখটি দেখতে হয় না । নাঃ থুড়ি ! দেখতে হয় না বললে ভুল হবে, বরং বলা ভালো দেখতে পায় না । আজ সে অন্ধত্বের চির অন্ধকারের শিকার । এই অন্ধত্বই আজ ঝিলমের কাছাকাছি এনে দিয়েছে সাগরকে । 

বিয়ের ঠিক চার মাসের মাথায় এক বন্ধুর Reception Party- তে হঠাৎ মেঘার সাথে আলাপ হয় সাগরের। মেঘাকে একবার দেখেই সাগর প্রেমে পড়ে যায়। যাকে বলে " Love at first sight " । আলাপ ও বেশ জমে ওঠে। কয়েকদিন পর মেঘাকে propose করে, তারপর থেকে চুটিয়ে প্রেম। আর সেই প্রেম শুধু মনেই আবদ্ধ ছিল না তাতে দৈহিক চাহিদাও ছিল বেশ পরিতৃপ্ত । সাগর ভেবেছিল এবার সে ঝিলমকে সব জানিয়ে দেবে । যা ভাবা তাই কাজ। মেঘার সাথে সম্পর্ক তখন প্রায় ছয় মাস । ইতিমধ্যে মেঘাও বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে । সাগর ঠিক করে এবার ঝিলমকে সব জানিয়ে ডিভোর্সের কথা বলবে। কিন্তু ঝিলমের ঐ মায়াময় চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে আর কিছুতেই বলে উঠতে পারছিলো না । এদিকে মেঘা প্রচন্ডভাবে চাপ দিতে থাকে বিয়ের জন্য। আজকাল প্রায়শই ওদের মধ্যে বিয়ে নিয়ে অশান্তি লেগেই থাকতো । একদিন তো মেঘা বলেই ফেললো, " দ্যাখো সাগর, আমার পক্ষে বিয়ে না করে এভাবে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা just impossible । আমার বাবা-মা ও এবার আমার সম্বন্ধ দেখছে । তুমি যা করার তাড়াতাড়ি করো " । সেদিন সাগর ঠিক করে আজ যাই হোক, সে আজ ঝিলমকে সব বলে দেবে। যথারীতি বাড়িতে ফিরে সবকিছু বলে দেয়। ঝিলম খুব ভেঙে পড়েছিল সেদিন । খুব অপমানে মরে যেতে ইচ্ছে করছিল তার । তাও কোনো প্রতিবাদ করেনি সে। শুধু বলেছিল, " তুমি যদি সুখী হও, ভালো থাকো, তাহলেই আমি খুশি। ঠিক আছে ডিভোর্স পেপার এনে বোলো কোথায় সই করে দিলে তুমি চির মুক্ত হবে ? আমি সই করে দেবো । আমার জন্য তোমাকে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না " ।


এই বলে সে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল । সাগর আজ ভীষণ ভীষণ খুশি । মনে মনে বললো," যাক্ এতোদিনে এই কালো কলঙ্কের হাত থেকে আমার জীবন মুক্ত হবে । নিজের পছন্দের পাত্রী, নিজের ভালোবাসার পাত্রী মেঘাকে বিয়ে করে সুখী হবো । এই ভেবে মেঘাকে ফোন করে সব জানালো । কবে বিয়ে করবে ? কোথায় যাবে মধুচন্দ্রিমায় ? বিয়ের আগেই ঘরগুলোকে renovate করাবে এই সব পরিকল্পনাও করে ফেললো মেঘার সাথে । ফোন কেটে দিয়ে ভাবলো ," কালকেই কোনো ভালো উকিলের সাথে কথা বলতে হবে " । 


কিন্তু বিধি বাম । পরের দিন অফিস ফেরত বন্ধুদের সাথে মজলিস বসে । মেঘাকে বিয়ে করছে এই আনন্দে একটু বেশিই মদ্যপান করে ফেলে সেদিন । বন্ধুদের বারণ উপেক্ষা করে গাড়ি নিয়ে রওয়ানা হোলো বাড়ির উদ্দেশ্যে । আজ সে এতো বেশি মদ্যপান করে ফেলে কিছুতেই ভালো করে ড্রাইভ করতে পারছিল না । হঠাৎ চোখ বুজে আসলো সাগরের । রাত ১২:৩০ নাগাদ বাড়ির ফোন বেজে উঠলো । ঝিলম ফোন উঠিয়ে বললো, " হ্যালো " । অপরদিক থেকে কন্ঠস্বর শোনা গেল, " আমি থানা থেকে বলছি, মিস্টার সাগর সেন হাইওয়ের ধারে অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন । ওনাকে গুরুতর আহত অবস্থায় এক বেসরকারি নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়েছে " । কথাগুলো শুনতে শুনতে হাত থেকে রিসিভারটা মাটিতে পড়ে যায়। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে ঝিলম ।


কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে বাবা আর ভাইকে ফোন করে সব জানিয়ে, তাড়াতাড়ি Uber বুক করে চলে যায় নার্সিংহোমে । ঝিলমের বাবা ও ভাই যথারীতি পৌঁছে যায় । ঝিলম ডাক্তারকে বলে, " ডাক্তারবাবু , আমি, আমি ওনার স্ত্রী। এখন কেমন আছেন উনি?" ডক্টর জানায় , " দেখুন জ্ঞান না ফিরলে কিছুই বলা যাবে না তবে.......... " এই বলে ডক্টর চুপ করে যান । ঝিলম আকুল কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে, " তবে কী ডাক্তারবাবু ? বলুন তবে কী ? " ডক্টর বলেন, " আপনাদের কোনো ইস্যু আছে ? " ঝিলম এই প্রশ্নে খুব অবাক হয়ে যায় । সে ডক্টরকে বলে, " হঠাৎ এইরকম প্রশ্ন ? এর সাথে আমার স্বামীর অ্যাক্সিডেন্টের কি সম্পর্ক ? " ডক্টর জানায় " আপনার স্বামী পিতৃত্বের ক্ষমতা হারিয়েছেন এবং আমার বলতে খুব খারাপ লাগছে যে, উনি আর কোনোদিনও দেখতে পারবেন না ।


মিস্টার সেন দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন । I'm sorry Mrs Sen. " বলে ডক্টর চলে যান । সেদিন যেন পুরো আকাশটাই ভেঙে পড়ে ঝিলমের মাথায় । এতো যন্ত্রনা সে সাগরের অন্য সম্পর্ক বা ডিভোর্সের কথাতেও পায় নি । প্রায় একমাস মৃত্যুর সাথে লড়াই করে এখন অনেকটাই সুস্থ সাগর । ঝিলম সাগরকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনে । প্রত্যেক মুহুর্তে অনেক সেবা করে সম্পূর্ণ সারিয়ে তোলে । একদিন সাগর ঝিলমকে ডেকে হাত দুটি ধরে বলে, " আমি আজ সত্যিই অনুতপ্ত । তোমাকে এতো চূড়ান্ত অপমানের শাস্তিস্বরূপ আমার এই অন্ধত্ব আর বন্ধ্যাত্ব । পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও । যদিও আমি তোমার ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নই । " এই বলে বুকে জড়িয়ে ধরে ঝিলমকে । দুজনেই কান্নায় ভেঙে পড়ে । 


আজ সাগর ঝিলম ছাড়া কিছু বোঝেনা । এক পাও চলার ক্ষমতা নেই ঝিলমের সাহায্য ছাড়া । আর সেই প্রেমিকাটি মেঘা , অ্যাক্সিডেন্টের ঘটনার পর থেকে কোনোরকম খোঁজখবর তো দুরস্ত কোনো যোগাযোগ -ই রাখে নি । আজ ঝিলম ও সাগর অনেক সুখী । কিন্তু ঝিলমের মনে আজও আক্ষেপ রয়ে গেছে, সে সাগরকে চেয়েছিলো , সাগরের ভালোবাসা - আদর - সোহাগ পেতে চেয়েছিলো । মাতৃত্ব না হয় নাই পেলো কিন্তু স্বপ্নেও সাগরের জীবনে এই অন্ধত্বের অভিশাপ সে কোনোদিনও চায় নি । 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance