Rima Goswami

Drama Tragedy Classics

3  

Rima Goswami

Drama Tragedy Classics

ইরাবান ও ইরাবতী

ইরাবান ও ইরাবতী

5 mins
168


তামিলনাড়ুর বেড়াতে গিয়ে আচমকা প্ল্যান হলো কুভুগম নামক স্থানে অভিযান চালাবার । ওখানকার  "কুঠাভাণ্ডার" উৎসবে যোগদান করাটাই মূল উদ্দেশ্য । তখনো এই কোয়ারেনটাইন বা লোকডাউন আমাদের বশীভূত করতে পারেনি । এই উৎসবে এক রাতের জন্য বিয়ে হয় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বা হিজড়েদের, এখানে দেবতা হলেন মহাভারতের তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের পুত্র ইরাবান।

উৎসবের আচার অনুযায়ী মন্দিরে জড়ো হন হিজড়েরা । দেবতা ইরাবানের পুজোর পরে এই হিজড়েদের বিয়ে করেন মন্দিরের পুরোহিত তবে মাত্র একরাতের জন্য। পুরোহিত হিজড়েদের গলায় পরিয়ে দেন বিবাহের চিহ্ন হিসেবে মঙ্গলসূত্র। অনুষ্ঠান দেখার আগ্রহ নিয়ে গিয়ে শেষমেষ সেখানে ঢোকার অনুমতি না পেলে আমরা ওখানকার লোকাল মানুষদের কাছ থেকে জেনেই সন্তুষ্ট হয়ে ছিলাম যে কেন এই প্রথা চালু হয়েছে ? এর নেপথ্যে কী ? জানলাম যে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী দেখে বিষণ্ন পড়লেন শ্রীকৃষ্ণ। সর্বজ্ঞ শ্রীকৃষ্ণ খুব ভালো করেই জানতেন আগামীদিনের যুদ্ধের ভয়াবহ ফল নিয়ে। তবে সুরাজনীতিবীদ দ্বারকাধিস চাইলেন যুদ্ধে জয়ী হোক পাণ্ডবরা। কুরুক্ষেত্রে জয়ী হতে হলে মা কালীর কাছে নরবলি দিতে হবে। যে পক্ষ আগে উপযুক্ত যোদ্ধাকে বলি দেবে‚ সে জিতবে।

সে ক্ষেত্রে অর্জুন হলো সব থেকে উপযুক্ত । তাকে ছাড়া আর কাউকে নরবলির জন্য উপযুক্ত মনে হল না কৃষ্ণের। কিন্তু কোনওভাবেই নিজের ভগ্নিপতিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে বোন সুভদ্রাকে বিধবা করতে রাজি ছিলেন না তিনি। পঞ্চপাণ্ডব মানে হাতের পাঁচটা আঙ্গুল তাই কোন পাণ্ডবকেই হারানো সম্ভব ছিল না । সেক্ষেত্রে অভিমন্যুকেও মৃত্যুর দিকে ঠেলা সম্ভব ছিল না মামা কৃষ্ণের পক্ষে । নাগরাজ কন্যা উলুপি ও তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের পুত্র ইরাবান ছিলেন অর্জুনের মতোই দক্ষ যোদ্ধা। অনেক ভেবে কৃষ্ণ ভাবলেন একবার ইরাবানকে জিজ্ঞাসা করেই দেখা যাক । সে যদি স্বেচ্ছায় বলি যেতে রাজি হয় । সদা পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত ইরাবান পিতার হয়ে কিছু করার সুযোগ পেয়ে মরতেও রাজি হয়ে যায় । তখন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে জানালেন তারই সুপুত্র ইরাবান পিতার সাফল্যের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে চান। অর্জুন খুশি হলেন পুত্রের ত্যাগ দেখে । তার পিতৃত্ব একবার হলেও জাগ্রত হলো না , যেটা হয়ত অভিমন্যুর ক্ষেত্রে হলে অবশ্যই হত ।

ইরাবান ও তার মা উলুপি ঠিক বুঝেছিলেন , তাঁর জন্য জন্মদাতা অর্জুনের মনে কোনও স্নেহ-মায়া নেই। এরপর কৃষ্ণ ইরাবানের কাছে শেষ ইচ্ছা জানতে চাইলে ইরাবান বলেন, তাঁর বিবাহ হয়নি তাই মৃত্যুর পর তার জন্য শোক বিলাপ করার কেউ নেই। ইরাবান এক রাতের জন্য বিয়ে করে দাম্পত্য বুঝতে চাইলেন । ইরাবান চাইলেন স্ত্রী যেন তার মৃত্যুর পর বিলাপ করেন।

একরাতের জন্য কোন নারীর সাথে ইরাবানকে বিয়ে দিয়ে তাকে আজন্ম বৈধব্য দেওয়াটা সমীচীন মনে হয়নি শ্রীকৃষ্ণর । তাই অমৃত বন্টনের সময় যেমন তিনি মোহিনী রূপ ধারণ করে রাক্ষসদের সাথে ছলনা করেছিলেন এবার ও কৃষ্ণ মোহিনীর রূপ ধারন করে বিয়ে করলেন ইরাবানকে। দুজনে কাটালেন দাম্পত্যের রাত।

সকালে ইরাবানের সম্মতিতে তাঁর মাথা কেটে ফেলা হয় মহাকালীর বলির উদ্দেশ্য । মৃত্যুর আগে ইরাবান তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী শুনতে পেয়েছিল তাঁর জন্য বিলাপ করে কাঁদছেন মোহিনী রূপী শ্রীকৃষ্ণ । পরের দিন সকালে শুরু হল কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ যা চললো আঠেরো দিন ব্যাপী । কৃষ্ণ ইরাবানকে তার বিচ্ছিন্ন মুণ্ডের চোখ দিয়ে মহাভারত যুদ্ধের গোটা সময়কাল প্রত্যক্ষ করতে অনুমতি দেন। 

সেই লৌকিক আচারকে মেনে মন্দিরে পরের দিন সকালে ইরাবানের মূর্তি কেটে ফেলা হয়। তখন ওই হিজড়েরা খুব জোরে জোরে শোক-বিলাপ করতে থাকেন। তাঁদের বিশ্বাস‚ তাঁরা আসলে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের এক রূপ। তাঁদের মধ্যে দিয়েই মোহিনী রূপ ধারন করেন কৃষ্ণ।

কাহিনী শুনতে শুনতে ভাবলাম অতীত বারবার ফিরে ফিরে আসে । হয়ত বা অন্য নামে , হয়ত বা অন্য রূপে । নতুন আঙ্গিকে শুরু হওয়া কাহিনী আসলে আগেও ঘটেছে , ঘটনার রদবদল হয়ত আছে । আমি একজন সাধারণ নারী । আমার কোন রাজপরিচয় নেই , গুন নেই । তবুও আমি আর ইরাবান কোথাও গিয়ে যেন এক । সেও ত্যাগ করে এসেছে আর আমিও ত্যাগ করেই আসছি । তাকেও ধর্মের যুদ্ধে সর্বাগ্রে যোগদান করে , শহীদ হয়েও অবমাননা পেতে হয়েছে । আমাকেও সর্বদা জীবনের লড়াইয়ে আগে থেকেও অবমাননা পেতে হয়েছে । বিয়ে করে এখন স্বাধীন ঘুরছি , এসেছি তামিলনাড়ু বেড়াতে তবুও আমি আর ইরাবান রিলেটেড । আমার নাম ইরাবতী , পেশায় একজন শিক্ষিকা । ছাত্র ছাত্রীর মধ্যে শিক্ষা বিতরণ করা আমার পেশা ও ভালোলাগার একটি কাজ । সমাজ আমাকে বরাবরই একটু বাঁকা চোখে দেখে এসেছে । আমি বাবার দ্বিতীয় বিবাহের সন্তান । বাবা বরাবরই তার প্রথম পক্ষের উচ্চ ঘরানার মায়ের সুন্দর কন্যাকে নিজের আদরের মেয়ের স্থান দিয়ে এসেছেন । আমার মা নিচু জাতির মেয়ে । বাবা অবশ্য মাকে নিজেই দেখেশুনে বিয়ে করেছিলেন । এমন নয় যে আমার মা বাবার গলায় ঝুলে পড়েছিল । তো একে তো আমি নিচ কূলের মায়ের সন্তান , তাও দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান তাই একটু অচ্ছেদা নিয়েই বেড়ে উঠেছিলাম । তবে দিদির মধ্যে বাবার গুন বিকশিত হতে পারেনি । সে সুন্দরী কিন্তু একটু চঞ্চলা । আমি বাবার মতো শান্ত , পড়াশোনাতে তুখোড় । স্বাভাবিক ভাবেই তাড়াতাড়ি নিজের যোগ্যতাতে কলেজে চাকরি জুটিয়ে , প্রফেসর বাবার যোগ্য মেয়ে প্রমান করেছিলাম নিজেকে । দিদি কিন্তু কোন ভাবে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে পড়াশোনাতে ছেদ দিয়ে বসে ছিল ।


এরপর এলো সেই দিন যখন ইরাবানের মত আমাকেও নিজেকে বলি দিতে হয়েছিল বাবার সন্মান রক্ষার্থে । দিদির অসংখ্য প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাবার পর শেষমেষ ও বাবার পছন্দের পাত্রের সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে রাজি হয়ে যায় । আমি ও কলেজে পড়াতে পড়াতে মন দিয়ে বসেছি আরেক অধ্যাপক মশাইকে । ইচ্ছা দিদির বিয়ের পর নিজের জন্য ভাববো । বিয়ের দিন দুম করে দিদি তার পূর্ব কোন প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গেল কাউকে কিছু না জানিয়ে । যখন ব্যাপারটা জানা গেল এদিকে বরযাত্রী ও ঢুকে গেছে । বাবা যিনি আমাকে কোনদিন সোজা চোখে দেখেননি , এলেন আমার কাছে । আমাকে হাত জোড় করে বললেন ওনার সন্মান রক্ষার্থে আমাকে বিয়েটা করতে হবে । পাত্র পক্ষর কাছে উনি অনুরোধ করায় তারা রাজি হয়েছে সুন্দরী পাত্রীর বদলে তার কালো খেদা বোনকে স্বীকার করতে । চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমার পছন্দের পুরুষ । বাবা বলেন আমার কাছে এটাই তার প্রথম ও শেষ দাবি , পিতৃত্বের দাবি । পিতার জন্য প্রেমকে ঠকিয়ে নিজেকে বলি দিয়েছিলাম সেদিন । বসেছিলাম বিয়ের পিঁড়িতে । পরে অবশ্য আমার জামাইবাবু হতে হতে স্বামী হয়ে যাওয়া ভদ্রলোক হাসিমুখেই জানিয়ে ছিলেন যে পাত্রী চলে যাওয়াতে ভালোই হয়েছিল । কারণ বিয়ের পর তার ইরাবতীকেই শ্রেষ্ঠ জীবন সঙ্গী মনে হয়েছে ।

যাইহোক ইরাবান যেমন অর্জুনের সুযোগ্য পুত্র হয়েও কোনদিন সেই সন্মান পায়নি যা অভিমন্যু পেয়ে এসেছে কারণ সে কৃষ্ণ ভগিনী সুভদ্রার সন্তান ছিল আর ইরাবান নাগরাজ কন্যা উলুপির সন্তান । তেমন আমি বাবার দ্বিতীয় নিচু জাতির স্ত্রীর সন্তান হওয়ায় বাবার মত যোগ্য হওয়ার পরও সেই আদর পাইনি যা আমার প্রাপ্য ছিল ।

ইরাবানকে যেমন সম্মানের যুদ্ধে বিজয় পাবার জন্য বলি স্বীকার করতে হয়েছিল তেমন আমাকেও বাবার সন্মান রক্ষায় নিজের আবেগ ও প্রেম ত্যাগ করে দিতে হয়েছিল। এখন বাবার কাছে তার দ্বিতীয় মেয়ে সবথেকে বেশি ভালো হলেই বা কি আসে যায় , ইরাবতী তো বলি হয়ে গেছে ঠিক মহাভারতের যুগের ইরাবানের মত ।।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama