হৃদয় আঁখি
হৃদয় আঁখি
-- কাল হয়তো এইসময় তুই তোর বরের সাথে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবি আর কিছুদিন পর বিদেশে। তারপর আমাকে ভুলে যাবি, তাই না?
-- দীর্ঘ এগারো বছরের সম্পর্ক এত সহজে ভোলা যায়? তুমি ভুলতে পারবে সাম্যদা?
চোখের জল মুছে হাসিমুখে সাম্য বলল...
-- তুই তো আমার হৃদয় রে পাগলী! আর তোর নিঃশ্বাস হল আমার স্পন্দন। যতদিন তুই বেঁচে থাকবি আমিও তোর মধ্যেই থাকব ততদিন।
অহনার চোখের জল মুছিয়ে সাম্য বলে...
-- কাঁদিস না, অহনা। তোর কান্নায় আমি নরকযন্ত্রণা অনুভব করি। বরের সাথে সুখের ঘর বাঁধিস আর বেশি ঝগড়া করিস না তার সাথে। তোর যা মেজাজ!
বিয়ের আগেরদিন বিকেলে শেষবারের মতো পুরোনো মন্দিরের পিছনে দেখা করতে আসে সাম্য আর অহনা। একই পাড়াতে থাকত তারা। পরস্পরের প্রতি ভালোলাগার টান থেকে শুরু হয় ভালোবাসা; তখন দু'জনেরই অল্পবয়স। কিন্তু তাদের এই সম্পর্কের কথা দু'জনের পরিবারের কেউই জানত না। হয়তো জানলেও সাম্যর মতো একজন নিম্ন চাকুরীজীবীকে জামাই হিসেবে মেনে নিত না অহনার পরিবার। অহনার বাড়ি থেকে এক বিত্তশালী ব্যবসায়ীয়ের সাথে তার বিবাহ স্থির করা হয়। পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে অহনা মেনে নিয়েছিল তাদের এই সিদ্ধান্তকে। বিয়ের দিন পনেরো পর অহনা গৌরবের সঙ্গে চলে গেল ফিলাডেলফিয়াতে।
মাস ছয়েক পর একদিন বিকেলে অহনার কাছে সাম্যর ফোন আসে। গৌরব তখন অফিসে আর অহনা সোফায় শুয়ে টিভি দেখছিল। টিভির ভলিউম মিউট করে সে ফোনটি রিসিভ করে।
-- হ্যালো!
-- কেমন আছিস পাগলী?
-- কে বলছেন আপনি?
-- এই ক'দিনের মধ্যে আমার নাম্বারটাও ভুলে গেছিস! বাঃ বেশ ভালো।
গলার স্বর বুঝতে পেরে অহনা জবাব দেয়...
-- সাম্যদা! আসলে কি হয়েছে জানো, ফোনটা চেঞ্জ করায় সমস্ত নাম্বার ডিলিট হয়ে গেছে। তুমি প্লিস কিছু মনে কোরোনা সাম্যদা।
-- আমার মনে করায় তোর কি এসে যায়?
-- এসে যায় তো! আচ্ছা, ছাড়ো সেসব। এবার বলো তো, কেমন আছ তুমি? আর এতদিন আমায় ফোন করোনি কেন?
-- আমার কথা ছাড়। তুই কেমন আছিস বল?
-- ওই আছি একরকম।
-- আচ্ছা শোন, এবার থেকে রোজ এই টাইমে আমি তোকে ফোন করব। ঠিক আছে? আজ তবে রাখি?
-- ঠিক আছে সাম্যদা। আমি তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকব।
তারপর থেকে প্রতিদিন একই সময়ে ফোন আসতে থাকে সাম্যর। অন্যসময় বহুবার চেষ্টা করেও সাম্যকে ফোনে পাওয়া যায় না। প্রতিদিন ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক বিকেল সাড়ে পাঁচটায়; সাম্যর ফোনের আশায় অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করে অহনা। বিয়ের দীর্ঘ দু'বছর পর অহনা ফিরল তার বাপের বাড়ি। সাম্যকে চমক দেবে বলে ফোনে তাকে কিছুই জানাল না সে। বিকেলবেলা সকলে যখন গৌরবকে নিয়ে আলাপচারিতায় ব্যস্ত; অহনা তখন চুপিচুপি গেল সাম্যর বাড়ির পথে। বাড়ির সামনে গিয়ে সাম্যকে ডাকতে লাগল সে। দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন সাম্যর মা। তারপর তাঁর মুখ থেকে অহনা যেটা শুনল; সেটা শোনার পর অহনার হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গেল কিছু মুহূর্তের জন্য। সাম্যর মা বলেছিল, "প্রায় বছর দেড়েক আগে একটা অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু হয় সাম্যর।" তাহলে এতদিন ধরে তাকে কে ফোন করত? কার ফোনের অপেক্ষায় সে দুপুরে ঘুমের অভ্যাস ত্যাগ করেছিল? -- চক্রের ন্যায় প্রশ্নগুলি প্রদক্ষিণ করতে থাকে অহনার মস্তিষ্কে। দিশাহারা অহনা চোখের জল মুছতে মুছতে এগোলো পুরোনো মন্দিরের পেছন দিকটায়। পোড়া দেওয়ালের গায়ে ইটের টুকরো দিয়ে লেখা নামদুটো আজও উজ্জ্বল রয়েছে। সমস্ত নির্জন, নিস্তব্ধতাকে ভেদ করেও কে যেন হাওয়ার স্বরে বলছে, "আমি আজও তোর মধ্যেই বেঁচে আছি অহনা। যতদিন তুই আমাকে মনে রাখবি, ততদিন আমার অস্তিত্বকেও অনুভব করতে পারবি তুই। একদিন না একদিন তো আমাদের ঠিক দেখা হবে। সেইদিনেরই অপেক্ষা করে আমি থাকব তোর অনুভূতির মধ্যে।"