Unmask a web of secrets & mystery with our new release, "The Heel" which stands at 7th place on Amazon's Hot new Releases! Grab your copy NOW!
Unmask a web of secrets & mystery with our new release, "The Heel" which stands at 7th place on Amazon's Hot new Releases! Grab your copy NOW!

Sudip Hazra

Drama Classics Inspirational

3  

Sudip Hazra

Drama Classics Inspirational

পত্রমোচন

পত্রমোচন

10 mins
195


খোকা ঘুমোলো পাড়া জুড়োলো


বর্গি এল দেশে...


বুলবুলিতে ধান খেয়েছে


খাজনা দেব কিসে...


দীর্ঘ ২৯বছর পরেও অম্বিকা দেবীর মনে পড়ে যায় সেই রাত গুলোর কথা। কত রাত এইভাবেই গান গেয়ে তিনি ছেলেদের ঘুম পাড়িয়েছিলেন। নিজে সেই রাতগুলোতেও দুচোখের পাতা এক করতে পারেন নি; আর আজও পারছেন না। হঠাৎ কে যেন দরজায় কড়া নেড়ে বলল...



-- অম্বিকা! জেগে আছিস?



নিঃশব্দে দরজা খুলে দাদাকে দেখতে পেয়ে তিনি বললেন...



-- একি দাদা! তুমি এখনও ঘুমোওনি?



-- তোর ওই অপদার্থ ছেলেগুলো ঘুমোতে দিলে তো ঘুমোবো।



একটু বিরক্তির ভাব ফুটে উঠল বিকাশবাবুর মুখে; যেন ভীষণ রেগে আছেন তিনি। কাঁদো কাঁদো স্বরে অম্বিকা দেবী জিজ্ঞেস করেন...



-- কেন দাদা? কি করেছে ওরা?



-- কি করেনি তাই বল। প্রায় পনেরো-কুড়িবার ধরে টেলিফোন করে সমানে বিরক্ত করে যাচ্ছে। নিজের ভাগ্নে মনে করি বলে এখনও চুপ করে রয়েছি। নাহলে..



রেগে গর্জে কথাগুলো বলছিলেন বিকাশবাবু। অম্বিকা দেবী তাকে থামিয়ে বলেন...



-- না দাদা, অমন বোলো না। ওরা নিতান্তই ছেলেমানুষ। নিশ্চয়ই ওদের আমার জন্য মন খারাপ করছে। আর তুমি তো জানি আমি ছাড়া ওদের কেউ নেই। সাত বছর আগে উনি গত হয়েছেন। তারপর থেকে আমিই তো ওদের মানুষ করেছি নিজের মতন করে। ওরাই তো আমার একমাত্র আশা ভরসা।



-- বা! বেশ বললি বোন। ওরাই তোর সবকিছু আর আমি কেউ না। ছোটোবেলার সব কথাগুলো ভুলে গেছিস দেখছি। তোকে কাঁধে চাপিয়ে এ বাগান, সে বাগান ঘুরে বেড়াতাম; গাছে উঠে এই ফুলটা, ওই ফলটা পেড়ে আনতাম -- সব ভুলে গেছিস!



-- আরে না, না গো দাদা। সেইসব দিন কি আর ভোলা যায় কখনও? তুমি আমার কোনো ইচ্ছে অপূর্ণ রাখোনি। একবার পদ্মপুকুরে নেমে আমার জন্য পদ্মফুল নিয়ে এসেছিলে; সে বার তোমায় সাপে দংশন করেছিল। কত যন্ত্রণা হয়েছিল তোমার! আমার এখনও মনে আছে তুমি তোমার টিফিনের টাকা জমিয়ে আমার জন্য এটা-সেটা কত কি কিনে আনতে! কিছুই ভুলিনি গো দাদা।



-- থাক রে সেসব কথা। আজ আর সেদিন নেই, সময়ের অনেক বদল ঘটেছে। যাই হোক, নীচে গিয়ে টেলিফোনটা ধর। তোর ছেলেদের বলে দে, বারবার যেন আমাকে বিরক্ত না করে।



অম্বিকা দেবী প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে নীচে চলে যান ফোন ধরতে। বোনের সেই কথাটায় কিঞ্চিৎ আঘাত পেয়ে বিকাশবাবু চোখ মুছতে মুছতে নীচে নামেন। অম্বিকা দেবী টেলিফোনটি কানে ধরে বললেন...



-- হ্যাঁ বাবা বল, কেমন আছিস তোরা?



ফোনের ওপার থেকে কাঁদো কাঁদো স্বরে উত্তর আসে...



-- তোমাকে ছাড়া আমরা একটুও ভালো নেই মা। তুমি আমাদের ক্ষমা করে দেও মা। বাড়িতে ফিরে এসো।



-- না রে বাবা। আমি তোদের ওপর একটুও রাগ করিনি।



-- তাহলে মামার বাড়িতে চলে গেলে কেন?



-- আমি দেখতে চাইছিলাম রে, আমাকে ছাড়া তোরা কেমন থাকিস।



মধুর হাসি ফুটে উঠল অম্বিকা দেবীর মুখে। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন...



-- বাবা অরুণ, এত রাতে তোরা জেগে আছিস কেন? খাওয়া হয়ে গেছে তোদের?



ফোনের ওপার থেকে কোনো জবাব এল না এবার। অম্বিকা দেবী বললেন...



-- কি রে। চুপ করে আছিস কেন, বল?



-- না গো মা, এই দুদিন আমরা ঠিকমতো খাইনি। কে রান্না করে দেবে বলো? সকালে ভাত রান্না করতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছি। সেই পোড়া ভাতই আমরা তিনজনে খেলাম। বরুণটা তো ঠিকমতো খেলোই না।



কাঁদতে কাঁদতে ফোনের ওপার থেকে কথাগুলো বলে অরুণ। অম্বিকা দেবীর দুচোখ জলে ভরে যায়। তিনিও কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন...



-- আহা রে! আমার সোনা বাবারা। তোরা খাওয়া-দাওয়া করতে পারছিস না ঠিকমতো। আমি এত বড়ো অন্যায় কি করে করলাম তোদের প্রতি? আমার তো নরকেও ঠাঁই জুটবে না। ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ!



একটু দূর থেকে দাঁড়িয়ে বিকাশবাবু দেখছিলেন সবকিছু। ঠোঁটের ফাঁকে লেগে রয়েছে তার মৃদু হাসির ফলক। কিন্তু সেটা কি বোনের কান্না দেখে; না কি অন্য কোনো ব্যাপার আন্দাজ করে -- তা তিনিই জানেন।



অরুণের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বরুণ এবার বলল...



-- ও মা, মা। তুমি ফিরে এসো না আমাদের কাছে। তোমাকে ছাড়া আমরা একটুও ভালো নেই গো।



তারপর তরুণ ফোনটা নিয়ে বলল...



-- আমাদের কাছে ফিরে এসো মা।



-- হ্যাঁ বাবা।



কাঁদো কাঁদো গলায় কোমল স্বরে জবাব দিলেন অম্বিকা দেবী। মায়ের এই জবাব পেয়ে একটু খুশি হয়ে তরুণ বলল...



-- তাহলে কাল আমরা তোমায় আনতে যাচ্ছি মা। রেডি হয়ে থেকো। সকাল-সকালই চলে যাবো।



-- হুম্। (কোমল স্বরে উত্তর দিলেন তিনি)



-- আচ্ছা মা! কাল সকাল হওয়ার অপেক্ষায় আছি। কখন তুমি আসবে আর কখন তোমার হাতের সুস্বাদু রান্না খাবো! এবার রাখলাম গো মা। মনটা অনেক হালকা হয়ে গেল।



অম্বিকা দেবীর চোখ বেয়ে টসটস করে জল পড়তে থাকে তখনও। ফোনটা আলতো করে রেখে ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে ওপরের ঘরে যান তিনি। বিকাশবাবুও যান তার পিছন পিছন। দরজার বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে তিনি দেখেন, অম্বিকা দেবী তার ব্যাগে সমস্ত শাড়ি গুছিয়ে রাখছেন। বিকাশবাবু এবার ঘরে ঢুকে বললেন...



-- কি রে বোন, ব্যাগ গুছোচ্ছিস কেন?



-- দাদা! আসলে কাল সকালে আমি ফিরে যাবো। আমি অকারণেই ওদের প্রতি অন্যায় করে ফেলেছি। তুমি জানো, ওরা এই দুদিন ধরে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছে না। ভালো নেই ওরা, দাদা..



একটুও বিস্মিত না হয়েই বিকাশবাবু বললেন...



-- তোকে ওরা এইসব কথা বলেছে বুঝি? শোন অম্বিকা, ওরা কিন্তু নাটক করছে। তুই আবার ফিরলে ওদের আসল স্বরূপ দেখতে পাবি। তোর ওই তিন ছেলেই অসভ্য, বেয়াদপ.



-- না দাদা। অমন করে বোলো না। আমার অরুণ, বরুণ, তরুণ একটু ছেলেমানুষ হতে পারে। কিন্তু ওরা আমায় খুব ভালোবাসে। দেখো না, দুদিন আমি নেই; ওরা কেমন পাগলের মতো বারবার ফোন করছে।



-- দেখ বোন, আমার যা বলার আমি বললাম। এবার বাকি সিদ্ধান্ত তুই নে।



বলে বিকাশবাবু বোনের প্রতি একটা হালকা অভিমান নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। অন্যদিকে, ফোন রেখে তিন ভাই যেন আনন্দে লাফিয়ে উঠল। একে অপরের হাতে করতালি করে তারা বলতে লাগল...



তরুণ: সাবাস দাদা! কি অ্যাক্টিংটাই না করলি তোরা।



বরুণ: তুই আবার কম যাস কিসে ভাই? দাদা কেমন খাবারের নাটকটা করল। এদিকে কেউ জানেই না যে, আমরা রেস্তোরা থেকে খাবার আনিয়ে খাচ্ছি।



অরুণ: আ! চুপ কর তোরা। এইসব খাবার যা পড়ে আছে এক্ষুণি পরিষ্কার করে ফেল; মা আসার আগেই। আর হ্যাঁ শোন, মা চলে যাওয়ায় কিন্তু আমাদের লস হয়েছে অনেক। এই দুদিনে রেস্তোরার অনেক বিল হয়েছে। মা ফিরলে সই করিয়ে পেনশনের টাকাটা তুলে সব পেমেন্ট করতে হবে।



বরুণ: হ্যাঁ রে দাদা। সে তো বটেই। আর এইসব হয়েছে ওই বুড়ো মামাটার জন্যই।



তরুণ: ঠিক বলেছিস। ওই বুড়োটাই যত নষ্টের গোড়া। ওটাই তো মাকে নিয়ে গেছিল এখান থেকে।



অরুণ: নিয়ে গিয়ে তো ভুল কিছু করেনি। তোরা একটা মানুষকে এত অপমান করবি আর তার দাদা সেটা মুখ বুজে সয়ে নেবে? শোন, আজ থেকে তোরা পালটে যা। মায়ের সামনে এমন নাটক কর, যাতে মা মনে করে আমরা আর আগের মতো নেই। আখেরে আমাদেরই লাভ হবে। ওই বুড়োটা তো বিয়ে করেনি। ও ব্যাটা মরলে ওর সম্পত্তি আমরাই পাবো। আর আমরা মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করলে পাজিটা সবকিছু দান করে দিতে পারে। তাই আজকের পর থেকে দুজনকে একটু তোষামোদ করে চলতে হবে আমাদের।



তরুণ: ওরে! তুই সত্যিই জিনিয়াস দাদা! আমাদের থেকেও এককাঠি ওপরে।



অরুণ: চুপ! আমি যা বলছি, তা আমাদের তিনজনেরই লাভের কথা ভেবে বলছি।



বরুণ: হ্যাঁ রে দাদা। এটাই ঠিক হবে যে, আজ থেকে আমরা একটা নতুন নাটক করে যাব; যতদিন না সব সম্পত্তি পাচ্ছি।



অরুণ: গুড। আর আজ কেউ ঘুমোবি না। কারণ কাল মাকে দেখাতে হবে যে, খিদের জ্বালায় আমরা সারারাত ঘুমোতে পারিনি।



বরুণ: ওকে দাদা!



তিনজনে সারারাত ধরে এইসব শলা-পরামর্শ করছিল। পরদিন সকাল হতেই তিনজনে মিলে মাকে আনতে গিয়ে মায়ের পায়ের কাছে একেবারে লুটিয়ে পড়ল। বিকাশবাবু খুব বিচক্ষণ মানুষ, তিনি সহজেই ওদের নাটক ধরে ফেলেন। তাই তিনি আবারও অম্বিকা দেবীকে সাবধান করে বললেন...



-- দ্যাখ বোন। শেষবারের জন্য বলছি, ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নে।



দাদার পায়ে প্রণাম করে তিনি বলেন...



-- দাদা, আমি যা করছি তা ভেবেই করছি। আমার ছেলেদের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব তো আমারই, বলো।



বিকাশবাবু খুব রেগে গেলেন। ভাগ্নেদের প্রতি রাগটা তিনি তার বোনের ওপরই দেখালেন।অম্বিকা দেবীকে তিনি বললেন...



-- তবে শুনে রাখ অম্বিকা। আজকের পর থেকে আর কখনও আসবি না আমার বাড়িতে। আমার এই বাড়ির দরজা চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে গেল তোর জন্য।



মনে ভীষণ আঘাত পেলেন অম্বিকা দেবী। তবে মুচকি হেসেই তিনি জবাব দিলেন...



-- তুমি চিন্তা কোরো না গো দাদা। সেই পরিস্থিতি আর তৈরিই হবে না কখনো। আমার অরুণ, বরুণ, তরুণ ওদের ভুল বুঝতে পেরেছে। ওরা আর কখনো ওদের মাকে অসম্মান করবে না। তুমি ভালো থেকো দাদা।



এরপর অম্বিকা দেবী তার ছেলেদের সঙ্গে চলে গেলেন সেখান থেকে। অরুণ, বরুণ আর তরুণ তাদের নতুন নাটক চালিয়ে যেতে থাকল। তারা যে তাদের মামার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হল; এই কারণে কিঞ্চিত হতাশ হয়েছিল তারা। তবে মায়ের ভাগের সবকিছু যে পাবে; সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত ছিল। অম্বিকা দেবীর সম্পত্তি কিছু কম ছিল না!




পরপর সাত বছর ধরে এই নাটকই চলতে থাকল। অরুণ, বরুণ, তরুণ -- তিন জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। তরুণের বিয়ের কিছু মাস পর থেকে তিন বউয়ের মধ্যে খুব অশান্তি হতো। তাদের একটাই দাবি যে, সম্পত্তি ভাগাভাগি করে সংসার আলাদা করতে হবে। এই নিয়ে দিনের পর দিন ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকত। মাঝে মাঝে ভাইদের মধ্যেও হাতাহাতি হতো। বাধ্য হয়ে অম্বিকা দেবী সম্পত্তির ভাগ করলেন; এমনকি নিজের ভাগেও কিছু না রেখে সবকিছু ছেলে-বউদের দিয়ে দিলেন। সরল অম্বিকা দেবী বুঝতেই পারেন নি যে, এটা পুরোটাই তার তিন ছেলের পরিকল্পনা। সম্পত্তি ভাগ করার জন্য তারাই এই নাটক করে গেছে। অম্বিকা দেবী কার ভাগে থাকবে - এই নিয়ে কথা তোলে অরুণ। তরুণ বলল...



-- আমার তো নতুন চাকরী। তার মধ্যে বিয়েতে অনেকের কাছে ধার-দেনা হয়ে গেছে আমার।



বরুণ বলল...



-- আমার আগের কাজটা থাকলে মা-কে আমিই রাখতাম। কিন্তু এখন তো...



এবার অরুণ বলল...



-- তোরা তো জানিস ভাই আমার অবস্থা। দিন আনি দিন খাই আর তোদের বৌদিও তো গর্ভবতী। এরপর আরেক জনের দায়িত্ব বাড়বে সংসারে। তার মধ্যে মায়ের দায়িত্ব; একা আমি আর কত কি চালাবো?



অম্বিকা দেবী চোখের জল মুছতে মুছতে সেখান থেকে চলে গেল। ঠাকুর ঘরে গিয়ে দ্বার আঁটলো। কেঁদে কেঁদে ঠাকুরের আসনে মাথা ঠুকে বলতে লাগল...



-- হায় ভগবান! এই দিন দেখার জন্য তুমি বাঁচিয়ে রেখেছ আমায়? আমার নিজের পেটের ছেলেরা আজ আমার দায় নিতে অস্বীকার করছে; যাদের জন্য আমি নাকি আমার সারা জীবনের সুখ বিসর্জন দিয়ে এসেছিলাম একদিন।



অম্বিকা দেবী ঠিক করলেন, তিনি আর সেখানে থাকবেন না। দাদার বাড়িতেও আর ফিরে যাবেন না। নিয়তি তাকে যে পথে নিয়ে যাবে, সেই পথের উদ্দেশ্যেই তিনি যাবেন বলে মনস্থির করলেন। রাত্রে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে; তখন তিনি একটি সাদা কাগজ নিয়ে অন্তরে জমে থাকা কিছু কথা লিখলেন...



-- তোদের আমার দায়িত্ব নিতে হবে নারে বাবা। তোরা তোদের ভালো-মন্দ নিয়েই সুখে থাক। যখন তোদের দরকার ছিল, ডেকেছিলিস তখন আমায়; এখন তোদের সব হয়েছে, তাই বাড়তি করেছিস আমায়। সে যাই হোক না কেন বাবা, তোরা তোদের বউ-বাচ্চা নিয়ে সুখে থাক। আমি তোদের আমার দায়িত্ব নেওয়া থেকে মুক্ত করে দিলাম।



কাগজখানি বালিশের নীচে রেখে অম্বিকা দেবী অজানা নিয়তির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। বেরোতে গিয়ে অন্ধকারে কিছুতে একটা হোঁচট খেয়ে পড়ে যান তিনি। দেখতে পেলেন খাটের নীচে ধুলোমাখা সেই বাক্সটা। সেটা খুলতেই মনে পড়ে যায় তার দীর্ঘ জীবনের সমস্ত কথা। মনে পড়ে যায় বিয়ের কথা, স্বামীর কথা, প্রথম সন্তান হওয়ার আনন্দ -- এইসব আরও কত কী! মনে মনেই ভাবতে থাকেন তিনি...



-- সেই বাইশ বৎসর বয়সে স্বামীর হাত ধরে প্রথম এই বাড়ির চৌকাঠে পা রেখেছি। আজ তিন-কুড়ি পেরিয়ে গেল; সেই চৌকাঠ ডিঙিয়েই আমায় চলে যেতে হচ্ছে।



কিছুক্ষণ স্মৃতিগুলো আঁকড়ে থাকার পর, সেগুলোকে আবার বাক্সচাপা দিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন এক-কাপড়ে। চলতে চলতে কোনো এক অদৃশ্য বাঁধন যেন বারংবার তার পথ রুদ্ধ করে চলেছে; যেতে বাঁধা দান করছে। অম্বিকা দেবী তবুও সেই বাঁধনকে উপেক্ষা করে ধীর পায়ে চলতে থাকলেন। চারিপাশ যেন অমাবস্যার অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে আর তিনি সেই অন্ধকারের পথেই ধেয়ে চলেছেন। হঠাৎই একটা শক্ত কিছুতে হোঁচট খেয়ে তিনি পড়ে গেলেন এবং অনেক চেষ্টা করেও উঠে দাঁড়াতে পারলেন না।



পরদিন সকালে অম্বিকা দেবী চোখ খুলে দেখলেন, তার ছোটো ছেলে তরুণের বয়সী এক যুবকের কোলে মাথা রেখে তিনি শুয়ে আছেন। মৃদু শব্দে জিজ্ঞেস করলেন...



-- কে বাবা, তুমি?



যুবকটি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল...



-- এক মায়ের হতভাগ্য ছেলে আমি মা। আমার মা আমাকে ছেড়ে সেইখানে চলে গেছে, যেখানে আমার মতো পাপীদের স্থান মেলে না। নিশ্চয়ই এ আমার কোনো জন্মের পাপের ফল। এই তোমার মতোই বয়সেরই ছিল আমার মা। তাই তো তোমাকে দেখে মাতৃপ্রেমের সুখ অনুভব করলাম মা। তোমার কি হয়েছিল? এখানে এভাবে পড়ে আছ কেন?



অম্বিকা দেবী নিশ্চুপ হয়ে যুবকটির মুখের দিকে চেয়ে রইলেন আর মনে মনে বলতে লাগলেন...



-- হায় ঈশ্বর! এ তোমার কেমন বিচার? দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম যে বোঝে, তুমি তার থেকে সেটাই ছিনিয়ে নিলে?



মনে মনেই তিনি ভাবতে লাগলেন, এই অচেনা যুবকটির সাথে তার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। তবুও সে কেমন তাকে এক নিমেষেই আপন করে নিয়েছে। আর যাদের সাথে তার রক্তের সম্পর্ক তারাই পর করে তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।



অম্বিকা দেবীর কোনো উত্তর না পেয়ে যুবকটি বলে...



-- কোথায় বাড়ি তোমার মা? আমায় বলো, আমি তোমায় পৌঁছে দেবো?



অম্বিকা দেবী ধীরে ধীরে উঠে বসল এবং বলল...



-- জানিস বাবা! এক সময় আমার বাড়ি ছিল, পরিজনও ছিল। কিন্তু আজ বাড়ি বলে বস্তুটা আমার কাছে সত্যিই অচেনা হয়ে উঠেছে। আমি ঠিকানাহীন, এক অসহায় বৃদ্ধা। আমার পরিজনদের নয়নের কাঁটা আমি। তাই নিজে থেকেই সরে দাঁড়িয়েছি ওদের পথ থেকে।



অম্বিকা দেবীর কথাগুলো এমন শোনালো, যেন সমগ্র জগতের বেদনার তিনি একাই অংশীদার। যুবকটি বুঝল অম্বিকা দেবীর মনের বেদনা; একটা মানুষ কতটা আঘাত পেলে এইরূপ কথা বলতে পারে। যুবকটি তখন কাঁদো কাঁদো গলাতেই বলল...



-- কে বলেছে তোমার বাড়ি নেই? চলো মা, আজ থেকে আমার ঠিকানাই হল তোমার ঠিকানা। আমার সাথে আমার বাড়ি চলো মা।



অম্বিকা দেবীর কোমল হাতদুটো ধরে যুবকটি তার বাড়িতে নিয়ে যায়। অম্বিকা দেবীর চোখদুটো জলে ঝাপসা হয়ে গেল। তিনি বললেন...



-- তুই আমারই ছেলে বাবা। তোর এই অসাধারণ মাতৃপ্রেমের স্বরূপ যেন বিশ্বের সমস্ত সন্তানের মনে জাগ্রত হোক - এই আশীর্বাদ করলাম তোকে। আজ থেকে তোকে আমি 'অক্ষয়' বলে ডাকবো।



-- বেশ মা। তোমার যেটা ইচ্ছে। কত দিন, কত রাত যে ঘুম হয়নি আমার! আজ তুমি আমাকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দাও না মা।



-- আয় বাবা। আমার কোলে মাথা রেখে চুপটি করে শুয়ে পড়তো দেখি!




খোকা ঘুমোলো.. পাড়া জুড়োলো..


খোকা ঘুমোলো পাড়া জুড়োলো


বর্গি এলো দেশে...


বুলবুলিতে ধান খেয়েছে


খাজনা দেব কিসে...


খাজনা দেব কিসে.. খাজনা দেব কিসে..



ধান ফুরোলো.. পান ফুরোলো..


ধান ফুরোলো পান ফুরোলো


খাজনার উপায় কি


খাজনার উপায় কি...


আর কটা দিন সবুর করো


রসুন বুনেছি.. রসুন বুনেছি..



খোকা আমারই সোনা..


চার পুকুরের কণা..


স্যাকড়া ডেকে মোহর কেটে


গড়িয়ে দেব দানা...


তোমরা কেউ কোরো না মানা


কেউ কোরো না মানা.. কেউ কোরো না মানা..



খোকা ঘুমোলো পাড়া জুড়োলো


বর্গি এলো দেশে...


বুলবুলিতে ধান খেয়েছে


খাজনা দেব কিসে...


ও.. খাজনা দেব কিসে...


খাজনা দেব কিসে...



Rate this content
Log in