হৃদয়ে দেশভাগ (ধারাবাহিক) ১
হৃদয়ে দেশভাগ (ধারাবাহিক) ১
হৃদয়ে দেশভাগ (ধারাবাহিক) ১
১
গোপাল আর গোবিন্দ এনআরসি অফিসের সামনের অস্থায়ী ক্যাম্পে লাইন দিয়ে বসে আছে আগের রাত থেকে। সঙ্গে নব্বই পার করা অশক্ত বৃদ্ধা দিদিমা ইন্দুবালা সূত্রধর। স্বর্গীয় মদনমোহন সূত্রধর ওরফে মনা মিস্তিরির বিধবা। আগেরবারের তালিকায় নাম এই পরিবারের ছিলো কি ছিলো না, এই নিয়ে ভারী বিতর্ক। কোনো সহযোগিতা পায় নি এই পরিবার এখনো তেমনভাবে। ইন্দুবালার স্বামী বা মেয়েরা ও জামাইরা কেউ আর ইহজগতে নেই। থাকার মধ্যে বৃদ্ধার এই দুই নাতি ভিন্ন আর কেউ নেই সাতকুলে। আজ এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা বের হবে শুরু থেকেই তো বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে এনআরসি৷ পাড়ার চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বাড়ির অন্দরমহল, সবজায়গায় আলোচনার বিষয়বস্তু।
ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স অর্থাৎ এনআরসি, একটি দেশের জাতীয় নাগরিক পঞ্জীকরণ। ভয়ানক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কিন্তু ঘরছাড়া, ভিটেমাটিছাড়া ছিন্নমূল উদ্বাস্তু পরিবারগুলির অনেকেই তো এই যে নাগরিক পঞ্জীকরণের প্রয়োজনীয়তা বোঝে নি অতশত তত গভীরভাবে, যত গভীর ভাবে অনুভব করেছিলো ক্ষিদের তাড়না, মাথার উপর একখণ্ড আচ্ছাদনের তাড়না, লজ্জা নিবারণের তাড়না। কাজেই আরো অগণিত হতভাগ্য পরিবারের মতোই হওয়া হয়ে ওঠে নি হয়তো এনআরসি তালিকায় নাম অন্তর্ভূক্তিকরণ, মনা ওরফে মদনমোহন সূত্রধরের পরিবারেরও হয়ে ওঠে নি ভারতের পঞ্জীকৃত নাগরিক হয়ে ওঠা। শুধু যে দু'বেলা দু'মুঠো ভাত জুটে গেছে মনার পরিবারের মুখে এই না কত!
খসড়া তালিকায় বাদ পড়াদের গ্রাস করেছে আতঙ্ক। এনআরসি-ছুটদের মধ্যেকার বড়সড় যে অংশ চূড়ান্ত উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছে, মনা মিস্তিরির পরিবারের অবশিষ্ট তিনটি প্রাণীও তাদের দলেই। বৃদ্ধা ইন্দুবালার কাছে আগেরবার খসড়া তালিকা তৈরীর সময় তরুণ সরকারি কর্মীবাবুটি জানতে চেয়েছিলো, "এদেশে কতকাল?" বৃদ্ধার মুখের রেখায় রেখায় নড়নচড়ন। ঘোলাটে দৃষ্টি মেলা অনির্দিষ্টের দিকে। কোটরাগত চোখের কোলে ঝুলে আছে দু'ফোঁটা অশ্রুবিন্দু। পরনের শতচ্ছিন্ন কাপড়ের আঁচলের খুঁটে চোখ মুছে কাঁপা কাঁপা গলায় বৃদ্ধা ইন্দুবালা বলেছে গোপাল গোবিন্দর দিকে শীর্ণ অঙ্গুলি নির্দেশ করে, "হেয়া তো কইতে পারুম না বাপ। তয় ইয়াগোর মায় তহনে আমার প্যাটে আসিলো, তহনই আইয়া পড়লাম দ্যাশ ছাইড়্যা... হেই কুনকালে!" হতদরিদ্রা বৃদ্ধার মুখের বলিরেখায় যেন লেখা হয়ে রয়েছে সেই করুণ ইতিহাস। তিরতির করে কাঁপছে বৃদ্ধা, বহুদূর থেকে ভেসে আসছে বৃদ্ধার কম্পিত গলার স্বর। তরুণ সরকারি কর্মীবাবুটিও যেন হারিয়ে গেছে ইন্দুবালার সুদূর অতীতের জীবন খাতার পাতায় পাতায়।
******
"মনা, অ মনা, আরে ওই ছ্যামড়া, হুনোস
না কি কই? তর কি আক্কল পসন্দ কুনোকালে অইবো না রে? এমুন ক্যা রে তুই? দ্যাখ গা, হগ্গলতে কেমুন কাম-কাজ কইরা চলতে আসে, আর হক্কাল থন তুই কুন কামডায় লাগস্, ক তো দেহি?"
বত্রিশ পাটি দাঁত দেখিয়ে পিসিকে এতক্ষণ বলতে দিলো মনা..... মানে মদনমোহন। এবার মুখ খুললো মনা, "পিসি, এইডা তুমি কি কইল্যা কও দেহি? ক্যারা কইসে তুমারে, আমি কাম-কাজ কিস্যু করি না? হক্কাল থন গোলা পিডান, নৌকা বাইচ, মাছ ধরন্, গুড়ি উড়ান্, ঘুড়ায় সড়া.... ইগলি বুঝি কুনো কাম না?"
পিসি অপলক চেয়ে থাকে মনার সুঠাম দেহের দিকে, মনার বাবড়ি চুলের দিকে, মনার পেটানো ছাতি আর গুলি বার করা বাহুর দিকে। পিসির চোখ দিয়ে স্নেহরূপী স্নেহ গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা হয়ে। মনাকে মনার নিঃসন্তান বিধবা পিসিই মানুষ করেছে। সেই যখন মনার মা আঁতুড়ঘরেই সূতিকাজ্বরে, তার নাড়ীছেঁড়া ধন মনার মায়ার বাঁধনেও সংসার আঁকড়ে থাকতে না পেরে ইহসংসার ছাড়লো, তখন থেকেই। মনার দেবকী মা জন্ম দিয়ে ক'দিনের মাথাতেই তো তার মদনমোহন গোপালকে পিসির রূপে যশোদা মায়ের হাতে সঁপে দিয়ে সব মায়া কাটালো। মনার জন্মের মাস চারেক আগেই মনার বাবা নিজের ভরা সংসার রেখেই সংসারের মায়া কাটিয়েছিলো। হয়তো নিয়তির নির্ধারিতই হবে। নাহলে যে মানুষ পনেরো ষোলো বছর বয়স থেকেই নিজের হাতে তৈরী করা নৌকা নিজেই ধলেশ্বরীর বুকে ভাসিয়ে আসছে নির্বিঘ্নে, সেই কিনা নৌকা ভাসাতে গিয়ে বেকায়দায় পড়ে ধলেশ্বরীতেই তলিয়ে যায়? পিসির বুক চিরে এক গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
মনার বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী যখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা তখনই ঘটেছিলো এই দুর্ঘটনা। মনার মা দ্বিতীয় সন্তান মনার জন্মের আগেই বিধবা হোলো। মনার বাবার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর ঘরের চারটি ছেলে আর দুটি মেয়ে। তারা তাদের ছোটমাকে ফেললো না। নিজেরা মাতৃহারা হয়েছিলো যখন, তখনই বিয়ে হয়ে ছয় ছেলেমেয়ের মা হয়ে চোদ্দো বছর বয়সে মনার মা..... মানে ছোটমা এসেছিলো এ সংসারে। সকলকে বুকে করে আগলে রেখেছিলো। কখনো বুঝতে দেয় নি তাদের মায়ের অভাব। তারপর অনেক বছর পেরিয়ে মেয়েদের বিয়ে হয়েছে, ছেলেরাও বাবার সঙ্গে নৌকা তৈরীর ব্যবসা এবং তাদের জাতব্যবসা কাঠের কাজে যোগ দিয়েছে। সবাই ধরেই নিয়েছে ছোটমা বাঁজা বুঝি, নাহলে বয়স ঢলতে বসেছে এখনো ছেলেপুলে হোলো না! প্রায় বছর বত্রিশ বয়সে মনার মা প্রথমবার সন্তানসম্ভবা হোলো। জন্ম দিলো একটি ছেলের। তারপর বছর না ঘুরতেই আবার দ্বিতীয়বার গর্ভধারণ করলো মনার মা। তবে বিধিলিপি কে আর কবে খণ্ডাতে পারে? মনার মা স্বামীকে হারালো দেড় বছরের ছেলে কোলে আর পাঁচ মাসের ভ্রূণ মনাকে পেটে নিয়ে। স্বামী মারা যাবার কারণে জন্মের আগেই মনার মায়ের দ্বিতীয় সন্তান মনার কপালে অপয়া অলক্ষুনের সিলমোহর ছেপে বসে গেলো।
******