SHUBHAMOY MONDAL

Drama Crime Thriller

3  

SHUBHAMOY MONDAL

Drama Crime Thriller

হীরক দ্যুতি

হীরক দ্যুতি

7 mins
241



।প্রাক কথন।


গ্রামটি বর্তমান পূর্ব বর্ধমানের বেশ বর্ধিষ্ণু এক গ্রাম। অনেক জাতির মানুষের বাস - তবে মূলত চাষী, মজুর, ব্রাহ্মণ, কামার, কুমোর, তেলি, মুচি এই সব আর কি।

গ্রামের মানুষদের একতা ছিল দর্শনীয়। আর সেই বেচিত্রের মধ্যে ঐক্যের অন্যতম কারণ - গ্রামের ঠিক মাঝখানে অধিষ্ঠাত্রী রক্ষাকালী মা।

কোন এক প্রাচীন কালে, গ্রামের মড়ক রোধের নিমিত্ত সমস্ত গ্রামবাসীর মিলিত প্রচেষ্টায় মায়ের পূজা আরম্ভ হয় ঐ গ্রামে। অনেক নিষ্ঠা ভরে, নানা আচার বিচার মেনে দেবীর আরাধনা শুরু হয়।

তারপর সত্যিই নাকি তাঁর আশীর্বাদে গ্রামে সেই মড়কও থেমেছিলো। দেবীর মাহাত্ম্য এবং গ্রামের সমস্ত মানুষের মনে তাঁর ওপর অগাধ আস্থা ও ভক্তির কথা শুনে, সেই ইংরেজ আমলেই বর্ধমানরাজ নিষ্কর জমি দান করেছিলেন দেবীর থান গড়ার জন্য।

যাই হোক সারা বছর গ্রামে কারোর বিয়ে থা হলে বা কোন মঙ্গল অনুষ্ঠান হলে, মায়ের থানে যে যার সাধ্যমত দান করতো। পূজাবিধি মেনে দেবীর পূজার বেদীর ওপর ছাউনি করার রীতি স্বীকৃত হয়নি, তাই খোলা বেদীর সামনেই একটা কাঠের প্রণামী বাক্স রাখা থাকতো বরাবর।

সারা বছর গ্রামের মানুষের বা ভিনগ্রামের মানুষদেরও দেওয়া প্রণামীতে ভরে উঠতো বাক্স। দেবীর কাছে মানত করে নাকি কেউ বিফল হয় নি। আর আসপাশের প্রায় সব গ্রামের মানুষই সে কথা জানে এবং মানেও।

কথিত আছে - একবার মায়ের থানকে ওপর থেকে ঢেকে রাখা, এক বিরাট বটবৃক্ষের কিছু পাতা ছিঁড়েছিলো কোন এক ঘুগনি বিক্রেতা। সন্ধ্যাবেলা মায়ের থানের ঐ গাছের পাতা না ছেঁড়ার জন্য, গ্রামের মানুষের নিষেধ অগ্রাহ্য করেছিলো সে।

পরের দিন সকাল থেকে রক্তবমি শুরু হয় তার। ডাক্তার বদ্যি কারোর কোন ওষুধেই কাজ হচ্ছিল না। সারাদিন বারংবার রক্তবমি করে প্রায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে রইলো সে। রাতে মায়ের স্বপ্নাদেশ পেলো ঐ পাপের ফল তাকে ভুগতে হবে বলে।

পরদিন মায়ের থানে গিয়ে, জোড়া পাঁঠা জোড়া ঢাক দিয়ে মায়ের পূজা করার মানত করে, তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে তবে সুস্থ হয় সে। তো দেবীর ক্রোধকে সমীহ করেই চলে সবাই।


। মূল ঘটনার সূত্রপাত।


এই ঘটনার সূত্রপাত সেই রক্ষাকালী মায়েরই প্রণামী বাক্সটা চুরি যাওয়া নিয়ে। গ্রামেরই ছেলে হীরক সেন ওরফে হীরু সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখে পাড়ার সবার মুখ ভার। একটা থমথমে ভাব গোটা গ্রাম জুড়ে।

মায়ের প্রণামী বাক্স চুরি গেছে। না জানি, এবার কি প্রকোপ পরে গ্রামে - মায়ের ক্রোধ সামলাবে কে? বিষয়টা বাকি সবার মতই হীরুকেও বেশ চিন্তিত করে তুললো।

তখন সবে মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করে, চুটিয়ে গল্পের বই পড়ে সময় কাটাচ্ছিলো সে। ফেলুদা, ব্যোমকেশ, কিকিরা, মিস মারপল, পোয়ারো, শার্লক হোমস, বণ্ড কে নেই তার ঘর জুড়ে আর হৃদয় জুড়ে?


গ্রামের মানুষের আবেগ আর বিশ্বাস জড়িয়ে আছে, তাই গ্রামবাসীর জন্য এটা একটা বিরাট ঘটনা। কিন্তু পুলিশ কাছারী করার কথা কেউ কেন ভাবেনি সেটা অবশ্য জানা নেই।


যাই হোক, হীরু সিদ্ধান্ত নিলো - সেই চোরকে খুঁজে বের করবে। নিজের এত গোয়েন্দা গল্প পড়ার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাবে সে। কিন্তু তদন্ত শুরু কি ভাবে করা যায়?


ঠিক করলো রক্ষাকালীতলা থেকেই শুরু করবে সে। তাই প্রথম সেখানেই গিয়ে হাজির হলো। প্রণামী বাক্সের জায়গাটা খালি - বাক্স সমেত উঠিয়ে নিয়ে গেছে চোরটা।


হীরু ঐ জায়গাটার দিকে একভাবে তাকিয়ে ভাবতে থাকে - এত সাহস গ্রামে কার হতে পারে? ভিনগ্রামের লোকের এত সাহস হবে না যে, এই গ্রামের মাঝখানে এসে মায়ের থান থেকে প্রণামী বাক্স চুরি করবে!


বাক্সটা মাটিতে কিছুটা গেড়ে রাখা ছিলো, তাই সহজে তো তাকে তুলতে পারারও কথা না! কথাটা মনে আসতেই হীরু ভালো করে মাটির পানে চেয়ে দেখলো।


গতকাল সন্ধ্যায় বেশ জোর একপশলা বৃষ্টি হয়েছিলো, তাই মাটি ভিজে ছিলো। চোর সহজেই তাই ঐ ভেজা মাটি থেকে উপরে তুলে নিতে পেরেছিলো বাক্সটা।


ভালো করে তাকিয়ে লক্ষ্য করতে, এখন শুকিয়ে যাওয়া মাটির ওপর, রাতের সেই চোরের পায়ের পাতার ছাপটা ধরতে পারলো সে। বেশ লম্বা তার পায়ের পাতার ছাপ দেখে, অনুমান করতে পারলো সে - চোর যথেষ্ট উচ্চতা সম্পন্ন লোক।


ভালো করে খুঁটিয়ে খেয়াল করে, সে দেখতে পেলো - ঐ পায়ের ছাপগুলো সামনের রাস্তা ধরে গ্রামের বাইরের দিকে এগিয়ে গেছে। রাতে সদ্য বৃষ্টিতে ভেজা মাটির রাস্তায় পরা তার পায়ের ছাপগুলো সকাল হতে হতে শুকিয়ে গিয়েছিলো।


ছাপগুলো লক্ষ্য করে সেখান থেকে প্রায় আধ কিলোমিটার চলার পর ঢালাই রাস্তা শুরু হলো। পায়ের ছাপ দেখে আর সামনে যাওয়ার আশা রইলো না তার।


একটু চারপাশে ভালো করে তাকালো - গ্রামের ভিতরের বসতি ঐখানেই শেষ, আরো আধ কিলোমিটার ফাঁকা মাঠ, খামার, পুকুর, দিঘি পার হয়ে তবে মুচি, বাগদী, হাড়ি প্রভৃতি মজুর শ্রেণীর লোকেদের বসতি।

আস পাশে এদিক ওদিক একটু ঘোরা ফেরা করে, অবশেষে বিফল মনোরথে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হলো হীরু। কিন্তু বিষয়টা তার মনে একটা খচখচানি রেখেই গেলো।


।ঘটনায় নতুন মোড়।


এর সপ্তাহ খানেক পর একদিন সকালে ব্যাপক হৈ চৈ পড়লো - সেই প্রণামী বাক্সটা নাকি খালি অবস্থায় পাওয়া গেছে গ্রামেরই একটা ডোবার পাঁকে পড়ে থাকা অবস্থায়!

খবরটা শুনেই হীরু দৌড়ালো সেখানে। সেই ঢালাই রাস্তার কাছে, বামদিকের একটা ডোবার পাড়ে তখনও লোক জড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। হীরু ভালো করে লক্ষ্য করলো পুকুরের পাঁকে, যে জায়গায় পাওয়া গিয়েছিল বাক্সটা সে'দিকে।

বাক্সটা ওখানে বেশ গভীর গর্ত সৃষ্টি করে পড়েছিলো। পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে, অত শক্তি দিয়ে ওখানে বাক্সটাকে ফেলা কারোর পক্ষে সম্ভব নয় বলেই মনে হলো তার। তাহলে ঐভাবে ওখানে বাক্সটাকে ফেললো কে?

ঐদিকের পাড়ের গাছগুলোর দিকে ভালো করে লক্ষ্য করতেই, দেখতে পেলো বাক্সটা ওখানে পাঁকে এসে আছড়ে পড়ায় কাদা ছিটকে গাছ গাছড়ায় যা লেগেছে তা বেশ উঁচুতে। এর অর্থ একটাই হতে পারে - বাক্সটাকে অনেক উঁচু থেকে ওখানে ছোড়া হয়েছিলো।

পুকুর পাড়ের কোনো গাছ থেকে যে সেই কাজটা করা হয়নি তা' তো বলাই বাহল্য। তাহলে? আসপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখে হীরু বুঝলো - কাছে থাকা দুটো বাড়ির ছাদ থেকে বাক্সটা ওখানে ছুড়ে ফেললে অমন হতে পারে।

একটা শশধর পণ্ডিতের বাড়ি। কিন্তু তার বাড়ির ছাদ থেকে ওখানে বাক্সটাকে ছুড়ে পাঠানো বেশ অসুবিধাজনক। কারণ পুকুর পাড়ের তেঁতুল গাছটা মাঝে পড়ায়, তার ডালেই আটকে যাবার কথা।

অন্য বাড়িটা মদন গোস্বামীর। লোকটা একটি আদ্যোপান্ত মাতাল, খেয়েফুরো লোক। বলতে গেলে বংশের কুলাঙ্গার আর কি? চিলেকোঠার ঘরে নিজের পানশালা বানিয়ে রেখেছে।

সেখান থেকে ছুড়ে ফেললে বাক্সটার ওখানে ঐভাবে এসে পড়াটা ভীষণ ভাবেই সম্ভব এবং হীরু তো প্রায় নিশ্চিত - ওটা ওখান থেকেই ফেলা হয়েছে।

মদনের উচ্চতা প্রায় ছ' ফুটের সামান্য বেশী। তার রোগাটে চেহারার জন্যই মাটিতে ঐ পায়ের ছাপগুলো বেশ অগভীর মনে হয়েছিলো সেদিন হীরুর। দু'য়ে দু'য়ে চার করতে তার মনে মনে অসুবিধা হলো না।

কিন্তু প্রমাণও তো চাই - সে যে সঠিক অনুসন্ধান করে বের করে ফেলেছে চোরকে, তা প্রমাণের জন্য। সেইমতো নিজের পরবর্তী তদন্ত পদ্ধতি নিয়ে ভাবতে থাকলো হীরু।

প্রণামী বাক্সে মদন পেলো কি - খুচরো টাকা, কিছু বড় নোট কিন্তু বেশীর ভাগই তো কয়েন। সে সেই টাকা নিশ্চয়ই খরচ করবে শীঘ্রই। তার মত হাভাতে ডোকলা খেয়েফুরো লোকের পক্ষে তো বেশি দিন ঐ চুরির টাকা খরচ না করে থাকা সম্ভবই নয়।

তাই সে ঠিক করলো তার গতিবিধি, কেনা বেচার দিকে তাকে নজর রাখতে হবে। গ্রামে মদনের বাড়ির কাছাকাছি বেশ বড় দু' দুটো মুদিখানা দোকান ছিলো। মদন বা তার স্ত্রী বা মেয়ে যে কেউ দোকানে এলেই হীরুও গিয়ে হাজির হতে শুরু করলো সেখানে।

যথারীতি তাদের খরচের বহর আর ব্যয় করা খুচরো পয়সার সংখ্যা দেখে তার বুঝতে বাকি রইলো না যে, তার কথাই ঠিক, মদনই চুরিটা করেছে। এমনকি, দোকানদার দুজনও ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বলেই ফেললো এত রেজকি কোথা থেকে আনছে তারা, কে জানে?

বাড়িতে ওর বাবাকে এসে কথাগুলো বলবে ঠিক করলো হীরু। কিন্তু সেদিন বাড়িতে এসে দেখে - কলকাতা থেকে তার বাবার বন্ধু, কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার ইম্সপেক্টর, কাশীনাথ বাবু এসেছেন। বাবা তাঁকে ঐ বাক্সচুরির কথাই বলছিলেন।

হীরু সেই সুযোগটা হাতছাড়া করলো না। নিজের পুরো তদন্তের বিষয়টা দুজনের সামনে খুলে বললো। আর মদন গোস্বামীকেই চোর বলে তার সিদ্ধান্তটাও জানিয়ে দিলো।

ওর বাবার আশৈশব বন্ধুর দাদা মদন। তাঁদের বাড়ির সাথে বিশেষ সখ্যতাও ছিলো একসময়। তাই হীরুর মুখে তাকে চোর বলা শুনে বাবা বিষয়টা ঠিক মানতে পারলো না। তাঁর মতে হীরুর কোথাও ভুল হচ্ছে, তার অকাট্য যুক্তি এবং প্রমাণ সব অগ্রাহ্য করলেন তিনি।

অগত্যা কাশীকাকুর সাহায্যপ্রার্থী হতে বাধ্য হলো হীরু। তিনি অবশ্য ওর বাবার মত পুরো বিষয়টাকে উড়িয়ে দিলেন না। বরং তার খুঁজে বের করা দিকগুলোর প্রশংসা করলেন। কিন্তু একই সাথে তাকে আপাতত বিষয়টা সম্পর্কে চুপ থাকতে বললেন।

মদনের অবস্থা এখন যতই খারাপ হোক এক সময় তারা বিরাট ধনী ও প্রভুত সম্পদশালী এই এস্টেটের মালিক ছিলো। তাই শতকরা একশত ভাগ নিশ্চিত না হয়ে তাকে কালীমালিপ্ত করা ঠিক হবে না।

ঐ দেবীর পূজার মূল উদ্যোক্তা, পূজার স্থপতি ছিলেন মদনের পূর্বপুরুষই। তাই সাফল্য পেয়েও আপাতত হীরুকে চুপ থাকতে হলো। কিন্তু বেশিদিন না, কয়েক মাসেই তার তদন্ত যে কতটা সঠিক ছিলো তার প্রমাণ পাওয়া গেলো।

এবার রক্ষাকালী পূজার দিনে, মদনের হঠাৎ ভক্তি গদগদ চিত্তে পূজাকর্মে জড়িত হয়ে পড়া দেখে অবাক হয়েছিলো সবাই, শুধু হীরু ছাড়া। কারণ, একমাত্র সেইই উপলব্ধি করতে পারছিলো তার এই চারিত্রিক পরিবর্তনের কারণটা।

সেইরাতে দেবীর প্রতিমা নিরঞ্জনের পর, বাড়ি ফেরার পথেই মুখ থুবড়ে পড়ে জ্ঞান হারালো মদন। হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে জেলার সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। যকৃত পুরোই নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো তার, কোন খাদ্যই গ্রহণ করতে পারছিলো না সে।

প্রচণ্ড যন্ত্রণা সহ্য করার থেকে মরে যাওয়া তার শ্রেয় মনে হচ্ছিলো। কারণ ধীরে ধীরে পচনের গ্রাসে পড়ছিলো তার শরীরের এক একটা অঙ্গ। কোন চিকিৎসাতেই তাকে বাঁচানোর আর কোন উপায় ছিলো না।

এত কষ্ট সত্ত্বেও মৃত্যু হলো না তার। মাসের পর মাস যন্ত্রণায় ছটপট করার পর তার চেতনা হলো কি কারণে। স্ত্রীকে ডেকে উপস্থিত সকলের সামনে নিজের অপরাধ স্বীকার করে দেবীর চরণামৃত পান করানোর কথা বললো।

আশ্চর্যের ঘটনা হলো - সেই চানজল যেই পান করলো, সত্যিই মৃত্যু হলো তার। সকলেই জানতে পারলো দেবীর মাহাত্ম্য, মদনের অপকর্মের কথা। কিন্তু কেউই জানতে পারলো না, কিশোর হীরুর সেই অব্যর্থ তদন্তের কথা - শুধু দুজন, তার বাবা আর সেই পুলিশ কাকু ছাড়া।

।সমাপ্ত।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama