Titas Roy

Romance Tragedy

3  

Titas Roy

Romance Tragedy

হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো

হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো

8 mins
239


আর্য এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে| তাদের চার ছোট পরিবার -- মা, বাবা , বোন আর সে| তাদের সংসারে অভাব ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী| মাত্র তেরো বছর বয়সে পিতৃহারা হয় আর্য| বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের ভার তাকেই কাঁধে তুলে নিতে হয়| পড়াশোনার পাশাপাশি একটা ছোট হোটেল এ কাজ করা শুরু করে সে | সকালে স্কুল আর রাতে হোটেলের কাজ| এভাবেই কেটে যায় কয়েয়টা বছর| পড়াশোনা শেষ করে একটা ছোটো সরকারী সংস্থা ই চাকরি করে এখন সে | তাদের পরিবারের অবস্থা এখন অনেটাই ভালো | ছোটবেলা থেকেই তার অভিনয় করার খুব শখ ছিল | সে কথা মনে এলেও , বাড়িতে অভাবের কারণে মুখ ফুটে তার মনের ইচ্ছাটি কাওকে বলে উঠতে পারেনি সে কখনো | কিন্তু এখন তাদের পরিবারের অবস্থা অনেক টাই ভালো | তাই মা কে গিয়ে সে তার ইচ্ছার কথা জানালো | মা শুনে প্রথম টা একটু ভই পেয়ে গেছিল| অভিনয় করার ইচ্ছা বা শখ তো অনেকেরই থাকে , কিন্তু অভিনয় জগতে গিয়ে টিকে থাকা টা যে খুব কঠিন | আর , তাছাড়া একটা সরকারি চাকরি যদি হঠাৎ এভাবে ছেড়ে দেয় আর তারপর অভিনয় এও সেরকম নাম না করতে পারে , তাহলে যে তারা আবার পথে চলে আসবে | তবুও ছেলের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আর তাকে "না" বলতে পারলেন না | ভাবলেন , ছেলেটা যখন একবার চেষ্টা করতে চাইছে অভিনয় এ তখন একবার চেষ্টা করেই দেখুক | পরে যা হবে দেখা যাবে| তার পরের দিনই আর্য তার চার বন্ধুকে নিয়ে তাদের ছোটো গ্রাম ছেড়ে কলকাতা শহরের উদ্দেশ্য রওনা হলো | কলকাতাই তার এক বন্ধুর মামার একটা ফাঁকা ফ্ল্যাট আছে , সেখানেই তাদের থাকার ব্যবস্থা হলো | তার বন্ধুর মামাটি বেশ ভালো লোক | সবসময় হাসি হাসি মুখ , তাদের তার ফ্ল্যাটে থাকতে দেওয়ার জন্য তাদের কাছ থেকে পয়সা ও নিল না কোনো | তার সেই বন্ধুর মামা একজন টিভি সিরিয়াল এর পরিচালক কেও চিনতেন |


পরের দিন সকালেই সেই টিভি সিরিয়াল এর সেট এ গিয়ে সেই সিরিয়াল এর পরিচালক এর সাথে আর্য র পরিচয় করিয়ে দিলেন | তিনি সেই পরিচালক কে আর্য র ছোটো বেলা থেকেই অভিনয় করার কত ইচ্ছা, কিন্তু সংসারে অভাবের কারণে তা কখনই হোয়ে ওঠেনি , সে কথাও জানান | সেই পরিচালক তখন সব কথা শুনে আর্য র একটি ছবি জমা রেখে যেতে বলে | তিনি বলেন যদি তার সিরিয়াল এ বা অন্য কোনো সিরিয়াল এ কখনো কোনো ছোটো চরিত্র আর্য র জন্য তার কাছে থাকে , তিনি আর্য কে অবশ্যই ডাকবেন | আর্যকে তখন সেই চরিত্রটির জন্যে অডিশন দিতে হবে| তারপর কয়েক মাস পেরিয়ে গেছে| আর্য র কাছে এখনো কোনো ডাক আসেনি কোনো ছোটো চরিত্রর জন্যে | তার বন্ধুরাও তখন একে একে সবাই বাড়ি ফিরে গেছে | কলকাতা শহরে থাকার , খাওয়ার খরচও ত প্রচুর | এভাবে আর কতদিন থাকবে সে| জা টাকা পয়সা সঙ্গে এনেছিল তাও প্রায় ফুরিয়ে এসছে | এমনি সময় হঠাৎ একদিন একটা ফোন | তাকে একটা সিরিয়াল এ একটা খুব ছোটো চরিত্রর জন্য পছন্দ করেছেন এক সিরিয়াল এর পরিচালক | সেই সিরিয়াল এর গিয়ে তাকে অডিশন দিয়ে আসতে হবে | অডিশন ভালো হলে তাকে সেই চরিত্র টির জন্য নির্বাচন করা হবে | নির্দিষ্ট দিনে অডিশন দেই সে এবং তার কিছু দিন পর তাকে সেই চরিত্র টির জন্য নির্বাচন করা হয় | এই খবরটি সিরিয়াল এর পরিচালক তাকে ফোন করে জানাই এবং বলেন পরের দিন থেকেই শ্যুটিং শুরু , সে যেন সময় মত সেট এ পৌঁছে যায় | তাকে নির্বাচন করা হইছে তা শুনে সে তো আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় | প্রথম এই মা কে ফোন করে জানায় খবরটা , তারপর একে একে তার বন্ধুদের | পরের দিন খুব সকালে মন্দিরে পুজো দিয়ে শ্যুটিং এর উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ে সে | এরপর রোজই তার শ্যুটিং চলতে থাকে | সেই ছোট্ট চরিত্রটিতে অভিনয় করে টাকা যা আয় হতো , তাতে তার মোটামুটি চলে যেত | এভাবেই দিন কাটতে থাকে | দর্শক দের তার অভিনয় ভালো লেগে যাওয়া ই , সেই ছোটো চরিত্রটি এখন সিরিয়াল এর ম্যুখ্য চরিত্র হোয় গেছে |


আরো ২ তো সিরিয়াল এ মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছে সে | বেশ ভালই কাটছিল দিনগুলো | কিন্তু শ্যুটিং এর চাপে আর্য আর তার গ্রামের বাড়িতে যেতে পারত না| কলকাতাতেই থাকতো | কিন্তু প্রতি মাসের শুরু তেই তার বেতন এর অর্ধেক টা টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দিত তার বোনের পড়াশোনা, সংসার এর খরচ , তার মা এর ওষুধ পত্র এসব এর জন্য | এমনি একদিন হঠাৎ ই তার কাছে তার মা এর মৃত্যুর খবর আসে | খবরটা শুনে সে খুব ভেঙে পড়ে | কোয়েক দিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে যায় সে | বাড়িটা যেনো কেমন খুব ফাঁকা লাগছে | তার মায়ের মৃত্যুতে তার বোন ও খুব ভেঙ্গে পড়েছে | মায়ের শ্রাদ্ধ শান্তি শেষ করে সে বোন কে নিয়ে কলকাতায় চলে আসে | তাদের গ্রামের বাড়িটা বিক্রি করে দেয় সে | এভাবেই দিন কাটতে থাকে | মা মারা গেছে প্রায় ২ বছর হর গেছে | এখন সে তার বোন কে নিয়ে কলকাতায় বেশ ভালোই আছে | হঠাতই একদিন তার পরিচয় হয় রাই এর সাথে | রাই ছিল আর্য র সিরিয়াল এর এক সহ অভিনেতা র বন্ধুর বোন | সেই সহ অভিনেতার জন্মদিনে নিমন্ত্রিত ছিল আর্য আর সেখানেই নিমন্ত্রিত ছিল রাই আর তার দাদা | সেই প্রথম আর্য রাই কে দেখে| খুব মিষ্টি, প্রাণোচ্ছল একটা মেয়ে | সেদিনই কয় এক ঘন্টার মধ্যে তাদের মধ্যে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায় | ফোন নম্বর দেওয়া নেওয়া ও হয় দুজনের মধ্যে | এরপর প্রায়ই আর্য র সাথে ফোনে কথা হতো রাই এর | এমনিতে সবার সাথে মিশতে খুব একটা পছন্দ না করলেও , রাই এর সাথে সময় কাটাতে, কথা বলতে বেশ ভালোই লাগতো আর্য র |


তাদের কাছাকাছি বয়স, তাই বন্ধুত্ব টাও খুব তাড়াতাড়ি হোয় গেছিল তাদের মধ্যে | আর্য যেন এতদিন পর একটা মনের মত বন্ধু পেয়েছিল, যার কাছে সে তার মনের সব কথা, ব্যথা বলতে পারতো | তার গ্রামের বন্ধুরাও তার ভালো বন্ধু ছিল কিন্তু রায় যেন সবার থেকে আলাদা , একদম অন্যরকম | মা বেঁচে থাকা অবধি আর্য শুধু মাত্র তার মা কেই তার সব মনের কষ্ট, ব্যথা গুলো বলতে পারত | তার চুপচাপ , গম্ভীর, কম কথা বলা স্বভাবের আস্তরণের ভিতরে যে একটা খুব নরম, কোমল মন আছে সেটা শুধু তার মা ই জানত এতদিন | আর কাউকে কোনোদিন নিজের কোমল নরম মনটা দেখানোর বা জানানোর যোগ্য মনে হইনি তার | কিন্তু আবার কতদিন পর রাই এর সামনে সে তার কঠিন আস্তরণ টা থেকে বেরিয়ে প্রাণ খুলে মনের সব কথা বলতে পারে | সে কিন্তু দেখেছে সব মেয়ে এমন হয় না | তার সিরিয়াল এই যারা তার সহ অভিনেত্রী তাদের আলাদায় অহংকার , সিরিয়াল এর সেট এ না থাকলেও মেকআপ ছাড়া তারা বের হইনা বাড়ি থেকে কখনো |


সেট এর ছোটো ছোটো পদে কর্মরত ছেলেগুলোর সাথে ঠিক করে কথা বলে না, খারাপ ব্যবহার করে| সিরিয়াল এর মুখ্য চরিত্র আর্য কেও তারা খুব একটা পাত্তা দেয় না, যেহেতু সে একটা ছোটো গ্রাম থেকে এসছে | রাই কিন্তু ওরকম নই| খুব একটা মেকাপ বা সাজগোজ করতে সে পছন্দ করে না| আর্থিকভাবে রাই দের পরিবারের অবস্থা আর্য র থেকে অনেক ভালো ছিল, কিন্তু সে নিয়ে রাই কখনো আর্য কে নীচু চোখে দেখেনি | রাই এর মনে অত প্যাঁচ ছিল না, মুখের উপর সত্যি কথা বলতে ভই পেত না সে |খুব সরল আর মিষ্টি ছিল রাই| আর্য বুঝেছিল এই মেয়েটা আগলে রাখতে জানে, বুঝতে পেরেছিল যে রাই কে তার মনের ব্যথা, কষ্ট গুলোর কথা বললেও সে তা নিয়ে আর্য কে আঘাত করবে না কখনো | রাই এর সাথে কথা বলতে পছন্দই করত সে | এতদিন পর যেন একটা মনের মত বন্ধু পেয়েছিলো সে , যাকে বলা যেত মনের সব কথা| রাই এর একটা ফোনের জন্য সারা দিন অপেক্ষা করে থাকতো সে | ইতিমধ্যে , আর্য একটা সিনেমায় মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছ এ | তার বোন কে লেখাপড়া শেষ করিয, তাকে সুপাত্রস্থ করেছে সে| রাই আর আর্য র বন্ধুত্ব গভীর হতে হতে ক্রমে ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে| কিছুটা টাকা জমিয়ে কলকাতা শহরের বুকে একটা ছোটো বাংলো কিনেছে সে | আর্য মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল কিছুদিন তার প্রথম সিনেমা হিট করলে সে রাইকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে | আর্য র প্রথম সিনেমা বক্স অফিসে বিশাল হিট হলো | তার কিছুদিন পর আর্য রাই কে বিয়ের প্রস্তাব দিতেই , রাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়| কিছুদিনের মধ্যেই রাই আর আর্য র খুব ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে যায়| রায় এখন আর্য র সাথে আর্য র বাংলো তেই থাকে | দেখতে দেখতে বেশ কয়েক বছর পেরিয়ে গেছে | আর্য এখন বিশাল বড় তারকা, জনপ্রিয় অভিনেতা, অভিনয় জগতে সবার মুখে এখন শুধু তারই নাম | এই কয়েক্ বছরে তার অনেক গুলো ছবি হিট হয়েছে | আর্য এখন একটা আরো বড় বাংলো কিনেছে , আর একটা দামী গাড়ি | সাফল্যের উচ্চশিখরে সে এখন , শহরের খ্যাতনামা লোকেদের সাথে তার ওঠা বসা | এত ব্যস্ততার মাঝে আর্য এখন আর রাই কে সময় দিতে পারে না| নিজের অভিনয় নিয়েই সে ব্যতো এখন | যে আর্য আগে চুপচাপ,শান্ত ছিল, কারোর সাথে খুব একটা বেশী মিশত না , সেই এখন শহরের সব বড়ো বড়ো পার্টিতে যায়| সঙ্গে রাই ও যায়, কিন্তু ঐটুকুই | রাই এর জন্য আলাদা করে আর কোনো সময় নেই আর্য র কাছে , যে সময় শুধু তাদের দুজনের একান্ত সময়, যার মাঝে তারা দুজন ছাড়া আর কেও নেই | আর্য এখন অনেক স্মার্ট, হ্যান্ডসাম , রীতিমত সুপুরুষ, সব যুবতী দের স্বপ্নের পুরুষ সে | এখন অনেক নাম করা অভিনেত্রী দের সাথে আর্য র বন্ধুত্ব, তার জীবন এখন আর শুধু রাই কে নিয়ে চলে না | দু এক জন সহ অভিনেত্রী র সাথে আর্য র নাম ও জড়িয়েছে মিডিয়া তে কয়েকবার | রাই আর এগুলো মেনে নিতে পারে না , কষ্ট হয় তার, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলে না | বলবেই বা কাকে , আর্য র কাছে তো রাই এর জন্যে সময় ই থাকে না | যে আর্য রাই এর একটা ফোনের জন্য সারাদিন অপেক্ষা করে থাকতো, সে এখন বাড়ি ফিরেও রাই এর খোঁজ করে না, নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে| যে আর্য রাই এর সাথে কথা বলতে আগে অত ভালবাসত, সেই আর্য কে এখন রাই কথা বলার জন্যে অনুরোধ করলেও , তার কাছে আর সোময় থাকে না কথা বলার মত| ধীরে ধীরে রাই মানসিক ভাবে অবসাদগ্রস্ত হোয় যায় | সে শুধু একটাই কথা ভাবে এখন , কবে সে তার পুরনো আর্য কে ফিরে পাবে , সেই চুপচাপ, শান্ত, ছেলেমানুষী করা ছেলেটা, যে রাই এর সাথে একটু কথা বলার জন্যে সারাদিন অপেক্ষা করে থাকত , সেই কোমল, নরম মনের ছেলেটা, যার মনের সব কথা শুধু জানত রাই | আর কি কখনো ফিরে পাবে না রাই সেই পুরনো আর্য কে, সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো কে ??.......


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance