Twisha Ghosh

Comedy Crime Thriller

3  

Twisha Ghosh

Comedy Crime Thriller

হাম্পিতে হইচই

হাম্পিতে হইচই

63 mins
241


১)

ট্রেনে উঠে মালপত্র রেখে আবার প্ল্যাটফর্মে নেমে একটু বেড়াতে বেরোনো অখিলেশবাবুর বহুদিনের অভ্যেস। যাত্রার শুরুতে এটা না করলে তাঁর কেমন যেন খালি খালি লাগে পুরো ভ্রমণটা। প্ল্যাটফর্মে নেমে তিনি একবার ট্রেনের এমাথা থেকে ওমাথা একবার জগিং করে নেন, হাত পা ছাড়িয়ে নেন। ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগে তাঁর স্ত্রী রমা ও মেয়ে তিতাসের প্রবল চেঁচামেচিতে তিনি নিতান্ত বাধ্য হয়ে ট্রেনে উঠে পড়েন। তো যাইহোক, এবার অখিলেশবাবু সপরিবারে, হাম্পি ভ্রমণে যাচ্ছেন। জগিং সেরে সাঁতরাগাছি-চেন্নাই এক্সপ্রেসে উঠে তিনি ফেসবুক খুলে বসলেন।


ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। উপরের দুটো মুখোমুখি বার্থে বসে আছে তিতাস এবং টুবলু। টুবলু কানে হেডফোন লাগিয়ে অল্প অল্প মাথা দোলাচ্ছে আর খুব মন দিয়ে চিপস চিবোচ্ছে। তিতাস ব্যাগটা একপাশে রেখে কুপের বাকি যাত্রীদের মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। ওদের কুপেই আর একটি চার সদস্যের বাঙালি ফ্যামিলি উঠেছে ট্রেন ছাড়ার এক মিনিট আগে। ভদ্রলোক একেবারেই গোবেচারা টাইপের দেখতে। বেঁটে খাটো চেহারা, মাথায় পাতলা চুল, ছোট বাটারফ্লাই গোঁফ, এবং কোমরে একটা বেল্ট পাউচ। যাকে বলে, "আনরিমার্কেবল"। ওনার স্ত্রীও সাধারণ দেখতে, চুল সামান্য অগোছালো, বোধহয় দৌড়ে ট্রেনে উঠেছেন বলে। দুটো মেয়ের মধ্যে বড় যে, সে উঠেই ইয়ারফোন গুঁজে মোবাইলে আটকে গেছে। ছোটটি মায়ের কাছে ঘুরঘুর করছে। 


তিতাস এবার নিজের পরিবারের মানুষগুলোর কার্যকলাপের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। দাদার চিপস শেষ, এখন চোখ গোল করে "ইনসেপশন" দেখছে। মা ও বাবা ফেসবুকে সেঁটে আছে। মায়ের ঠিক উল্টোদিকে বাটারফ্লাই-গোঁফ কিন্ডেল পেপারহোয়াইট হাতে বসে আছে এবং খুব মন দিয়ে কিছু একটা পড়ছে। ভদ্রমহিলা কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে চোখ বুজে বসে আছেন, এবং ছোট মেয়েটা 'রাসকিন বন্ড অমনিবাস' খুলে বসেছে। তিতাস নিজের ব্যাগ থেকে আগাথা ক্রিস্টির "মার্ডার অন দি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস" বার করলো।


(২)

পরেরদিন বেলা বারোটায় ট্রেন বিজয়ওয়াড়া স্টেশনে ঢুকলো। 

এক্সিট গেটের দিকে দুটো স্যুটকেস নিয়ে যেতে যেতে তিতাস আর টুবলু দেখলো ওদের সাথে একই কুপে আসা পরিবারটির সবাই পুরো শেড দেওয়া স্টেশন চত্বরে সানগ্লাস পরে হাঁটছে। তিতাস একটা কিছু মন্তব্য করতে যাবে এমন সময় পিছন দিক থেকে শুনতে পেলো, "আপনারা বাঙালি?"

ওরা দুজনেই দাঁড়িয়ে গেল। বাবা বাটারফ্লাই গোঁফকে বলছেন," হ্যাঁ। তা আপনারা কদ্দূর?"

এবার পাশ থেকে ওনার স্ত্রী উত্তর দিলেন, "আমরা যাচ্ছি হাম্পি। আপনারা?" বাবা যেন হাতে চাঁদ পেলেন। সত্যিই, তিতাসের পরীক্ষা শেষ হতেই যা হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়া হলো, প্ল্যান করার কোনো অবকাশ হয়নি। এখন এমন একজন আদর্শ, মানে অখিলেশবাবুর আদর্শ "খাঁটি বাঙালি" ভ্রমণসঙ্গী পাওয়া গেলে ভারমুক্ত লাগবে না কেন!

"আরে! আমরাও তো ওখানেই যাবো! ভালোই হলো, বলুন? সঙ্গী পাওয়া গেলো।"

এর উত্তরে ভদ্রলোক "হেঁ হেঁ, সত্যি, খুব ভালো হলো।" বলে একটা অদ্ভুত মুখভঙ্গি করলেন। তিতাস আর টুবলু মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। লোকটিকে দেখে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে।


উন্ডাভল্লি কেভস ওদের হোটেলের একদম উল্টোদিকে। রাস্তাটাও বেশ লম্বা। যেতে যেতে বাবার কাছ থেকে ভ্রমণসূচিটা ভালো করে জেনে নিলো দুই ভাইবোন। ওরা সন্ধে সাতটায় হসপেটগামী ট্রেনে চাপবে। হসপেট হচ্ছে হাম্পির শহর এলাকা, যেখানে স্টেশন, বাজার পাট ইত্যাদি আছে। হসপেটে চারদিন থেকে সব ঘুরেটুরে ব্যাক। ছিমছাম এক সপ্তাহের 'শান্তিপূর্ণ' ভ্রমণ যাকে বলে।


উন্ডাভল্লি কেভস তৈরি হয়েছিল চালুক্যের রাজত্বকালে। পাহাড়ের গায়ে পাথর কেটে তৈরি এই গুহা একটা তিনতলা প্রাসাদের মতো দেখতে। মাঝের তলায় সবচেয়ে বেশি ভাস্কর্য আছে। ভেতর দিকে থাম আর দেওয়ালের গায়ে বিষ্ণুর দশাবতার, একটা লোহার গেট লাগানো অংশে চতুর্ভূজ বিষ্ণুর পাথরের মূর্তি আর সামনের বারান্দায় কিছু সাধুদের মূর্তি। তিনতলাটা অসমাপ্ত। যেটুকু হয়েছে, সেই দেওয়ালে বড় বড় ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহাদেবের ছবি খোদাই করা আছে। সব মিলিয়ে বিকেলের হলদে আলোয় পাথরের গুহা-মন্দির মন্দ লাগছিলো না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির শোভা দেখছিল তিতাস। এমন সময় দেখে, বাবা আর ট্রেনের সেই ভদ্রলোক লম্বা করিডোরের একদম অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, আর ওদের পাশে ঘুরঘুর করছে দাদা। টুবলুও লক্ষ্য করেছে তিতাসের কৌতূহলী দৃষ্টি। টুবলু এগিয়ে এলো তিতাসের দিকে।

চাপা গলায় বলল, "লোকটার নাম তন্ময় বসাক। আসানসোল গভর্নমেন্ট কলেজে বটানির প্রোফেসর। চোদ্দো বছর চাকরি করছে। সেটা নিয়েই কথা বলছে এখন। এটা বেসিক ইনফরমেশন। এবার ওকে ভালো করে অবসার্ভ কর।"

তিতাস তীক্ষ্ণ চোখে আগাপাশতলা তন্ময়বাবুকে দেখে ফিসফিস করে বললো,"ঢপ দিচ্ছে।"

"রাইট। কি করে বুঝলি?"

"নিজের প্রফেশন সম্পর্কে বলার সময় যে লোক অন্তত পাঁচবার চেক করে কেউ শুনতে পাচ্ছে কিনা, তার পরিচয়ের ডালে কুছ কালা তো আছেই।"

"হুঁ।" বলে টুবলু ফোন বার করে গুগল খুলে খুব দ্রুত কিছু একটা টাইপ করলো। 

"কি সার্চ করছিস?"

"Saccharum officinarum", বলে টুবলু চটপট নীচে নেমে গেল। শব্দটা যে একটা কিছুর সায়েন্টিফিক নেম, সেটা বুঝলেও, কিসের নাম বুঝলো না তিতাস। তবে নামটা মনে মনে মুখস্থ করে নিলো।


(৩)

হসপেট যাওয়ার ট্রেনটা তুলনামূলকভাবে বেশ ফাঁকা। সারাদিন জার্নিতে ক্লান্ত থাকার ফলে সবাই আটটা নাগাদ খেয়ে নিল। তিতাসদের কুপে এবার একজন দক্ষিণী ভদ্রমহিলা ও তাঁর মেয়ে। আর সাইড লোয়ারে একজন কন্নড় ভদ্রলোক। দেখে ব্যবসাদার বলেই মনে হয়। এবং ওদের পাশের কুপেই তন্ময়বাবুরা। তিতাস আর টুবলু উপরের বার্থে উঠে গেল। নিচে দুই ভদ্রমহিলা তখন খেতে বসেছেন। বাবা মা দুজনেরই মিডল বার্থ, অতএব এখন শোয়া চলে না। তাই একটা ওয়েব সিরিজ দেখছে দুজনে। টুবলু আর তিতাস যে যার হেডফোন লাগিয়ে শুয়ে আছে। এত আগে ঘুমোবার অভ্যাস নেই কারোরই। তিতাস সানডে সাসপেন্স এ শার্লক হোমসের "হাউন্ড অফ দ্য বাসকারভিলস" শুনছিলো। হঠাৎই অন্যরকম একটা আওয়াজ পেলো কুপের পার্টিশনের দিক থেকে। ট্রেনের আওয়াজ বাদ দিয়ে যা শোনা গেল তা এইরকম:

" হ্যাঁ হ্যাঁ, এদিকে সব ঠিক আছে। না, কেউ কিছু বুঝতে পারিনি। না না, কেউ চিনতেও পারেনি। আরেকটা ফ্যামিলিও যাচ্ছে হাম্পি, তাদের সাথে দিব্যি আলাপ জমে গেছে। না, আপনারা চিন্তা করবেন না। আমি সব নজর রাখছি। এখনও পর্যন্ত কিছু গন্ডগোল চোখে পড়েনি। আচ্ছা, হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক আছে, গুডনাইট।"


বক্তা তন্ময় বসাক।


খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল তিতাসের। চারপাশে মা বাদে সবাই অঘোরে ঘুমোচ্ছে। মা আধশোয়া হয়ে জানলা দিয়ে বাইরে প্রকৃতি দেখছে। তিতাস হাতঘড়িতে দেখলো, ছটা বাজে। ও দাদাকে তুলে দিল।পনেরো মিনিটের মধ্যে টুবলু বাবাকে তুলে দিল। ওদের এবং তন্ময়বাবুদের যে হাম্পিতে হোটেল ঠিক হয়নি, সেটা শুনেই বাবা চটপট উঠে পড়ল। নাহলে নাক ডাকা শুনে বাঘও লজ্জা পেত। সবাই উঠে মুখ ধুয়ে তন্ময়বাবুদের কুপে গেল। এখানে ওনারা ছাড়া আর কেউ নেই। সবাই আজেবাজে কথা বলছে, এমন সময় টুবলু জানলা দিয়ে বাইরে দ্রুত পেরিয়ে যাওয়া আখের ক্ষেতগুলো দেখিয়ে তন্ময়বাবুকে জিজ্ঞেস করলো, "আখের সায়েন্টিফিক নামটা কি বলুন তো?" 

তন্ময়বাবুর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। চিরতার রস গেলা মুখ করে বললেন, "ইয়ে...মানে… ইয়ে….ওটা হচ্ছে গিয়ে, মানে আরে ওই তো….ওটা তো….আরে দেখো পেটে আসছে মুখে আসছে না..দাঁড়াও, ওটা হচ্ছে ব্ল‍্যাট্টোডিয়া, বুঝলে?… ঠিক আছে, তাও তোমাকে একবার দেখে বলে দেব, কেমন?" টুবলু অতিকষ্টে হাসি চেপে বাধ্য ছেলের মতো ঘাড় নাড়লো।

(৩)

সাইড লোয়ারের কন্নড় ভদ্রলোক, মিস্টার মূর্থী, অত্যন্ত অমায়িক মানুষ। লম্বা-চওড়া, গায়ের রং আবলুস কাঠের, বিশাল একখানা গোঁফ এবং গোল্ড-রিমড চশমা।নিজেই এগিয়ে এসে আলাপ করলেন সবার সাথে। উনি একটা বড় রেস্টুরেন্ট চেইনের মালিক। ব্যবসায় কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে, সেই জন্যে হসপেট যাচ্ছেন। উনি একটা বড় উপকারও করলেন তিতাসদের।বাবা আর তন্ময়বাবু হোটেল ঠিক করতে হিমশিম খাচ্ছিল। নেহাত নিরুপায় হয়ে ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলো উনি হসপেটে কোনো ভালো হোটেলের খোঁজ জানেন কিনা।ওমা, একবার বলামাত্র উনি হোটেল এবং চারদিনের অটো, সব ঠিক করে দিলেন!তৎক্ষণাৎ সব ঠিকঠাক করে দিলেন,"হাঁ রিতেশ? হাঁ, সুনো, স্টেশন অওর কমলাপুর কে বিচোবিচ কোই আচ্ছা হোটেল জানাপহেচনা হ্যায় তুমহারা? ক্যা? শ্যাম রেসিডেন্সি? আচ্ছা হ্যায়? সাফসুতরা? ঠিক হ্যায় ফির, উধার তিন রুমকি বাত করলো। ঠিক হ্যায়", বলে ফোন কেটে দিলেন উনি। সত্যি, উনি একেবারে মুশকিল আসান! নইলে এই সাতসকালে খালিপেটে হোটেল খুঁজতে হলে মাথা খারাপ হয়ে যেত সবার। 

স্টেশন চত্বরে এই সাতসকালেও বেশ ভিড়। অতগুলো স্যুটকেস আর ব্যাগ সামলে হাঁটতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। তিতাস আর টুবলু পাশাপাশি হাঁটছে। টুবলুর এক হাতে স্যুটকেসের হ্যান্ডেল, আর অন্যহাতে ফোন। তাতে ফেসবুক খোলা। তিতাস চিন্তিত মুখে বললো," আচ্ছা, তন্ময়বাবু আখের সাথে আরশোলার সায়েন্টিফিক নেম গুলিয়ে ফেললেন কেন বলতো?" 

টুবলু হাসতে হাসতে বললো, "উনি খুব উঁচুদরের বটানি পড়ান, যেখানে আখ এবং আরশোলা একই জিনিস। তাই বললেন। ওনার হিসেবে ভুল কিছু বলেননি।"

"হুঁ। তা বটে।" তিতাস বোদ্ধার মতো ঘাড় নাড়ে।

একটু পরেই ফোন পকেটে ঢুকিয়ে টুবলু গম্ভীর মুখে বললো,

" তন্ময় বসাক জাল।"

" তার মানে?"

"ভদ্রলোকের নাম আসানসোল গভর্নমেন্ট কলেজের ফ্যাকাল্টি লিস্টে নেই এবং…"

"এবং?"

"ফেসবুকে তন্ময় বসাক নামে বেশ কজন আছেন, কিন্ত একটাও ইনি নন।"

" তাহলে এই লোকটার নামটাও ফলস?"

"হতেই তো পারে।"  

তিতাস এবার সত্যিই চিন্তায় পড়ে গেল। হঠাৎ ইনি এখানে এরকম মিথ্যে পরিচয় নিয়ে এলেন কেন?? বেশিক্ষণ ভাবতে হলো না, কারণ ততক্ষনে স্টেশনের বাইরে এসে অটোয় মালপত্র তুলছে বাবারা। মিঃ মূর্থীও দাঁড়িয়ে আছেন পাশেই। আর একটা পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের ছেলে অটোওলাকে হোটেলের ডিরেকশনটা বুঝিয়ে দিচ্ছে। মূর্থী ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন সবার। ওনার সব কাজের কাজী ছেলেটির নাম রিতেশ, যাকে তিনি ফোনে হোটেলের কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। ওনাদের দুজনের সাথে পরিচয় হয়ে সবারই উপকার হল। এখনও পর্যন্ত তন্ময়বাবু বাদে সব ঠিকঠাক!


(৪)

"নমস্কার মি: বসাক।" সানগ্লাস পড়তে পড়তে পিছনে ঘুরে আগুন্তুককে দেখেই তন্ময়বাবুর মুখ হাসিতে ভরে গেল। এক বছর তিরিশের কেতাদুরস্ত যুবক। মাঝারি হাইট এবং তামাটে রঙ। চোখে পাতলা কাঁচের চশমা। মুখ দাড়ি-গোঁফ বিহীন। চোখদুটো শান্ত কিন্তু বুদ্ধিমান।  তন্ময়বাবু সকলের সাথে তার পরিচয় করিয়ে বললেন, " এ হলো রজত। আমার এক খুব ক্লোজ কলেজফ্রেণ্ডের ভাইপো। এর কাকাই আমাকে বলেছিল এদিকে এলে একবার দেখা করে যেতে। কিন্ত সে-ই এখন ব্যবসার কাজে বাইরে। তাই রজত আমাদের পুরো হাম্পি ঘুরিয়ে দেখাবে। কি, তাই তো?"

রজত একগাল হেসে বললেন, " নিশ্চয়ই। কিন্তু আর দেরী করা যাবে না। নিন, আপনারা উঠে পড়ুন। আমি বাইকে এগোচ্ছি। আপনাদের জন্যে বিরূপাক্ষ মন্দিরের সামনে অপেক্ষা করব।" মনে একটা খচখচ নিয়ে তিতাস ক্যামেরার ব্যাগটা সামলে উঠে পড়ল দাদার পাশে। অবশেষে, আসল বেড়ানো শুরু হলো!


বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল হাম্পি। বিশাল, পাথুরে জমির ওপরে তৈরি একটা পুরো শহর। বাজার, মন্দির, প্রাসাদ, সবই অবশ্য আজ পাথরের স্তূপে পরিণত হয়েছে। কর্ণাটকের সৌন্দর্যে সেই ইতিহাসের দ্বীর্ঘশ্বাস মাখা পাথরের স্তূপও অপূর্ব এক পটভূমি তৈরি করেছে। 

বিরূপাক্ষ মন্দির একটা তিনটে সাংঘাতিক রকমের কারুকার্য করা গপুরম-ওলা বিষ্ণু মন্দির। মন্দিরের ভেতরে সে এক এলাহী ব্যাপার। বিগ্রহকে স্নানে করিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। চারদিকে ফোটো তোলার ধুম। আর তার মধ্যেই তিতাসরা কাগজের প্লেটে পোলাও প্রসাদ খাচ্ছে। অভূতপূর্ব!

তবে টুবলুর মতে মিউজিয়ামের সাথে কারোর তুলনা চলে না। ঢুকেই একটা প্রকান্ড হাম্পির মডেল, তাতে অধিকাংশ জায়গা জুড়ে রাজ আবাস বা রয়্যাল এনক্লোসার। আর ছোট ছোট পাহাড়ের পাদদেশে ছড়িয়ে আছে মন্দিরগুলো। আর মিউজিয়ামের ভেতরে তেত্রিশ কোটি না হোক, অন্তত তেত্রিশ ধরনের দেবদেবী তো আছেনই। বিষ্ণুর দশাবতার থেকে যম, বাদ নেই কেউই। তার সাথে সেই যুগের মুদ্রা, বাসনপত্র, সব মিলিয়ে যেন চার দেওয়ালের মধ্যে একটা অন্য জগৎ, যেখানে সময় থমকে আছে।

রাজ আবাসের মধ্যে আছে রানীর স্নানগার, হাতিশাল, ঘোড়াশাল, মাহুতের ঘর, রঙ্গমঞ্চ, এবং অনেক গুলো স্টেপওয়েল। সেখানে আবহাওয়াটাই আলাদা। মন্দিরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দর্শনীয় বিট্ঠাল মন্দির, বা চ্যারিয়ট টেম্পল, যেখানকার পাথরের রথ ভারতীয় পঞ্চাশ টাকার নোটে ছাপা আছে। মন্দির দেখে চোখ সরাতে পারছে না কেউ। এত সুন্দর! 


হোটেলে ফিরে তন্ময়বাবুদের ঘরে মুড়ি খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছিলো সবাই। রজত একজন আখ ব্যবসায়ী। বিশাল বিশাল আখের খেত থেকে ফ্যাক্টরিতে আখ চালান দেন। বিজনেসম্যান হওয়া সত্বেও আজকে এমন পাকা ট্যুর গাইডের মতো সবজায়গায় ইতিহাস বলেছেন, তা রীতিমতো প্রশংসনীয়। গল্প-আড্ডা চলতে চলতে হঠাৎ রজত বললেন, " তা হলে তন্ময়বাবু, কালকে থেকে আপনাদের কি প্ল্যান?" তন্ময়বাবু একমুখ মুড়ি নিয়ে বললেন," কালকে সেরকম কিছু নেই। সকালের দিকে বাকি ছোট খাটো মন্দিরগুলো ঘুরবো, যা যা আছে, তারপর বিকেলে মার্কেটে বেরোব। পরশু দেখতে যাবো অঞ্জনাদ্রি পাহাড়ে হনুমান মন্দির, যোগনৃসিংহ মন্দির, আর কিষ্কিন্ধ্যা পাহাড়ে দুর্গা মন্দির। তারপর দিন রেস্ট নিয়ে রাতের ট্রেনে ব্যাক।"

রজত গালে হাত দিয়ে কি একটা ভাবলেন, দিয়ে বললেন, "আমি একটা সাজেশন দিই? কালকে সকাল সকাল হনুমান আর দুর্গা মন্দির দেখে 11টার ট্রেনে রওনা দিন কর্ণাটক সীমান্তের কাছে গোকাকে। সেখান গোকাক ফলস , মানে যেটাকে ভারতের নায়াগ্রা বলে, সেটা দেখে রাতের ট্রেনে গোয়া চলে যান। সেখানে দুদিন থেকে গোয়া থেকে ফেরার ট্রেন ধরে নিন। কেমন?" 

রজতের কথার উত্তরে তন্ময়বাবু বললেন," জার্নিটা বড্ড হেকটিক হয়ে যাচ্ছে না রজত?"

"দেখুন, আজকে আপনারা মেইন দ্রষ্টব্য গুলো দেখে নিয়েছেন। শুধু শুধু এখানে আরেকটা গোটা দিন কেন নষ্ট করবেন? কালকে ভোর পাঁচটা নাগাদ বেরিয়ে পড়ুন, হনুমান আর দুর্গা মন্দির দেখে গোকাক চলে যান। ভালো লাগবে। ঠকবেন না। তাছাড়া ছোটকাও ওখানেই আসবে আজ রাতে। ওনার সাথেও দেখা হয়ে যাবে। আমি আজ রাতেই আপনাদের টিকিট পাঠিয়ে দেব।" তন্ময়বাবু আরো খানিকক্ষণ দোনামনা করে শেষমেষ রাজিই হয়ে গেলেন। আর অখিলেশবাবু বা রমাদেবীরও কোনো আপত্তি নেই। অতএব, নতুন প্ল্যান ফাইনাল হলো।


(৫)

ভোর পাঁচটায় উঠে তিরিশ কিলোমিটার দূরে হনুমান মন্দিরে পৌঁছতে পুরো মর্নিং ওয়াক হয়ে গেল। অটো এক কিলোমিটার আগেই থেমে যায়। তারপরে হনটন, এবং শেষমেষ মন্দিরে ঢুকতে পাঁচশো পঞ্চাশটা সিঁড়ি চড়ন। এতেই শেষ নয়, এরপর দুর্গামন্দিরের একশো কুড়িটা সিঁড়ি চড়ার পরে আর পাগুলোর কিছু অবশিষ্ট ছিল না। এখন সবাই ট্রেনের অপেক্ষায় হসপেট স্টেশনে বসে আছে। রজত আর তন্ময়বাবু সবার থেকে দূরে একটা বেঞ্চে বসে কি একটা আলোচনায় ব্যস্ত। টুবলু স্টেশনের ভেতরে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর তিতাস ক্যামেরার গ্যালারিটা স্ক্রুটিনি করছে। একসময় ক্যামেরাটা ঢুকিয়ে দিয়ে তিতাস স্টেশনের পরিবেশের দিকে নজর দিলো। দেখলো, দাদা সে যেখানে বসে আছে, সে দিকে আসতে আসতে হঠাৎই তন্ময়বাবুদের পিছনে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভুরু কুঁচকে গেছে। ওনারা খেয়াল করেননি। টুবলু খানিকক্ষণ নিশ্চল থেকে আবার স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে তিতাসের বেঞ্চে এসে বসলো। 

তিতাস উৎসুক মুখে ব্যাপারটা জানতে চায়। টুবলু বললো যে তন্ময়বাবু আর রজত কিছু একটা বিষয়ে ইনফরমেশন পাওয়ার কথা বলছিলেন। সেটা ভীষণ গোপনীয়। এবং তন্ময়বাবুকে বেশ হতাশই মনে হলো, কারণ যে তথ্যটা দেওয়ার কথা, রজত সেটা জোগাড় করতে পারেননি। এক দুবার "কমলাপুর" আর "কলোনি"  শব্দটাও কানে এসেছে।

কমলাপুর? কোথায় যেন শুনেছে কথাটা? কিছুতেই মনে করতে পারলো না তিতাস। আর কলোনি? কিসের কলোনি? তন্ময়বাবুই বা কিজন্যে মিথ্যে পরিচয়ে এখানে এসেছেন? ওনাদের গোপন ইনফরমেশনটা খারাপ না ভালো? মাথার ভেতরে প্রশ্নবানে জেরবার হচ্ছিল তিতাস। 

ট্রেনের হুইসেল দিয়ে দিয়েছে। সবাই ব্যাগগুলো তুলছে, এমন সময় তিতাস খেয়াল করলো রজত আর তন্ময়বাবুর চিত্রপট পাল্টে গেছে। এখন তন্ময়বাবুর বদলে সেখানে একটা রোগা পাতলা লোক। তন্ময়বাবুরা এবং বাবা, মা, দাদা অনেক এগিয়ে গেছে । তিতাস ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে ছুটতে ছুটতে রজতদের বাক্যালাপের শেষটুকু শুনতে পেল শুধু - উনি বলছেন,"সাচ্চারাম কিতনা দূর গয়া?" লোকটি জবাব দিলো, "তিন কিলো পৌঁছ গয়া হ্যায় স্যার।" রজত বললেন, "বহুত বড়িয়া!" ব্যাস, তারপরেই উনি স্টেশনের এক্সিটের দিকে চলে গেলেন।ব্যাপারটা কি হলো?


গোকাক জায়গাটা এককথায় বিচ্ছিরি। অত্যন্ত বাজে। প্রকৃতি দুরস্থান, একটা হোটেল পর্যন্ত নেই। থাকার মধ্যে আছে একটা যারপরনাই নোংরা লজ। গোয়ার ট্রেন রাত এগারোটায়। ততক্ষণ পর্যন্ত মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে সেই সবেধন নীলমণি "নক্ষত্র লজ"কেই ঠিক করা হল। সবার ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া করে বেরোতে বেরোতেই চারটে বেজে গেল। তারপর অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে একটা তুলনামূলকভাবে বেশি ব্রিটিশ ছোঁয়া লাগা অঞ্চলে গোকাক ফলস। আবার পঞ্চাশটা সিঁড়ি, উফ! 


কিন্তু আসল ঝরনাটা দেখে খুবই হতাশ হতে হল। বিশাল পাথুরে চত্বর, যার ওপর দিয়ে তুমুল স্রোতে জল বয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে কোথাও কোথাও পাথরের ফাঁকে ঝিরঝির করে বয়ে যাওয়া জল দেখা যাচ্ছে। ঝরনাটার একেবারেই করুন অবস্থা। একটা মাত্র জলের স্তম্ভ তৈরি করেছে। কোথায় নায়াগ্রা!

মা আর তন্ময়বাবুর স্ত্রী সুমনা সাংঘাতিক ক্ষেপে গেছেন। সকালবেলায় অত সিঁড়ি চড়ে এমনিতেই পায়ের অবস্থা বেহাল, তারপর এতটা জার্নি করা, একখানা ফোর্থ ক্লাস লজ, আর এখন এই শুকনো ঝর্ণা। তার মধ্যে রাত বারোটায় গোয়ার ট্রেন। এখন মাত্র সাড়ে চারটে বাজে। মাথা গরম হলে দোষ দেওয়া যায় না। টুবলু কি একটা বলতে গিয়েছিল, বেমালুম বকুনি খেয়ে ফিরে এলো। বাবাও খুবই বিব্রত। মোট কথা, একটা যাতা ব্যাপার!

তিতাস পাথরের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছিল। পাশে বকুনি খেয়ে স্তিমিত হয়ে যাওয়া টুবলু। মাথায় অজস্র প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে অস্বস্তিকর যেটা, সেটা তিতাস করেই ফেললো।

"দাদা, তন্ময়বাবু কি আমাদের সন্দেহ করছেন?"

"....কেন বলতো?" টুবলু অবাক।

"উনি এখানে এসে থেকে খুব অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমাদের দেখছেন। চোখ ছোট করে, ভুরু কুঁচকে, মানে, আমার ঠিক লাগছে না ওনাকে।"

"এত ভালো কথা নয়। "

"না। আমার মনে হয় উনি-" তিতাসের কথা শেষ হলো না। আলোচ্য মানুষটি ঠিক ওদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। ভাইবোন কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।

তন্ময়বাবু সামনের কাষ্ঠবৎ অবয়ব দুটোকে দেখে একটু ব্যঙ্গাত্মক হাসলেন। উনি বললেন, "কি, আমাকে দেখেই কথা বন্ধ হয়ে গেল কেন? কি এমন গোপন বিষয়ে কথা হচ্ছিল?" 

দুজনেই স্পিকটি নট। 

তন্ময়বাবু এবার গম্ভীর হয়ে বললেন," বটানির প্রফেসর হলেই যে যেকোনো মুহূর্তে সব গাছের ঠিক সায়েন্টিফিক নেমটা মনে পড়বে, এরকম কোন নিয়ম আছে নাকি টুবলুবাবু?"

টুবলু কথা হারিয়ে ফেলেছে। নিস্পৃহ মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। তিতাসও তাই। তন্ময়বাবু আবার হাসলেন, " আমার পরিচয় সম্মন্ধে তোমাদের এত কৌতূহল কেন? বাবা মার সঙ্গে বেড়াতে এসেছ, তাঁরা আমাকে, আমার পরিবারকে বিশ্বাস করেছেন, তোমরা কি ওনাদের থেকেও ভালো বোঝ?" 

তিতাস আর চুপ করে থাকতে পারলো না। "বাবা মা কয়েকটা ডিটেইল মিস করে গেছেন।"

তন্ময়বাবু জ্বলজ্বলে চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, "মানে?"

টুবলু বোনকে একটা চিমটি কাটলো। তিতাস অবিচল ভাবে বললো, " সব গাছের ঠিক নামটা সবসময় মনে থাকবে, এটা নিয়ম নয় ঠিকই। কিন্তু গাছের সাথে আরশোলার নাম গুলিয়ে ফেলবেন, এটা মানা যায় না। আর একজন সাধারণ লোক নিজের প্রফেশন বলার সময় এটা নিশ্চিত করে না যে কেউ তার কথা শুনতে পাচ্ছে না। এবং আপনি এটাই করছিলেন বিজয়ওয়াড়াতে। আপনি নিজের সম্পর্কে মিথ্যে বলেছেন সবাইকে।"

তন্ময়বাবুর হাসিমুখে,কিন্তু কেটে কেটে বললেন, " আগাথা ক্রিস্টি পড়লেই কেউ এরক্যুল পোয়ারো হয়ে যায় না । নিজের ছোট্ট ধূসর কোষগুলোকে একটু বিশ্রাম দাও। তোমরা অনেক ছোট, এসবের মধ্যে ঢুকতে যেও না। " ওনার হাতটা কি ওনার অজান্তেই বেল্ট পাউচটার দিকে চলে গেল? হবেও বা। কথা শেষ করে তন্ময়বাবু গটগট করে উপরে চলে গেলেন।

টুবলু একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, "লোকটাকে যতটা মাথামোটা ভেবেছিলাম, ততটা নয় দেখছি।"


গোকাক ফলসের গেটের ঠিক উল্টোদিকে একটি "গোকাক ফ্যাক্টরি আউটলেট" নামে জামাকাপড়ের দোকান আছে। সময় কাটাতে না না করেও ঢোকা হল। 

ঢুকে দেখা গেল,জামাকাপড়ের কোয়ালিটি এত ভালো, না ঢুকলে সত্যিই মিস হতো। এতক্ষনে একটা লাভজনক কিছু পেয়ে সকলেরই বিরক্তি ভরা মনটা একটু ফুরফুরে হল। যখন ওখান থেকে বেরোনো হল, তখন বাজে সোয়া পাঁচটা। এখনও অনেক সময় বাকি। কি করা যায়, সেটা যখন আলোচনা হচ্ছে, তখন তন্ময়বাবু একটা ফোন পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে একটু দূরে গিয়ে ভীষণ উত্তেজিত ভাবে কথা বলতে লাগলেন। দু-তিন মিনিট কথা বলেই ভীষণ অস্থির ভাবে এসে সবাইকে তাড়া দিতে লাগলেন ফেরার জন্য। সবাই অবাক। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, "হ্যাঁ, হোটেলে তো ফিরবোই, কিন্তু হঠাৎ এত তাড়া দিচ্ছেন কেন?" 

উনি বললেন,"হোটেলে গিয়ে লাগেজ কালেক্ট করে আমরা হসপেটে ফিরবো।" একথার যে তীব্র প্রতিবাদ আসবে, তা বলাই বাহুল্য। ওনার দুই মেয়ে, আতা আর অঙ্ক তুমুল বিরোধিতা করলো। কিন্তু তন্ময়বাবু একেবারে জেদ ধরে বসে আছেন যে উনি আজকে হসপেটেই ফিরবেন, এবং তার কারণ বলছেন না। আচমকা এই মতবদলে সকলেই বেশ হতচকিত। কিন্তু কিছু করার নেই, একসঙ্গে যখন বেরোনো হয়েছে, তখন একযাত্রায় পৃথক ফল করা যায় না। 

হোটেল থেকে মালপত্র নিয়ে বেরোনো হলো পৌনে ছটা নাগাদ। তন্ময়বাবু ঝড়ের পূর্বাভাসের মতো শান্ত হয়ে বসে আছেন। তিতাস আর টুবলু, মাঝের সিটে ওনার পাশেই বসে আছে। উনি চারবার রজতের নাম্বারে ডায়াল করলেন, একবারও সিগন্যাল পেলেন না। এমত পরিস্থিতিতে চুপ করে থাকা খুব কঠিন। টুবলু চাপা গলায় তন্ময়বাবুকে জিজ্ঞেস করলো যে কি হয়েছে। তন্ময়বাবু বোধহয় জিজ্ঞাসাকারীকে খেয়াল করেননি, তাই বলে ফেললেন, "খুন।" 

"কিছু বললেন তন্ময়দা?", সামনের সিট থেকে বাবা জিজ্ঞেস করলেন।

তন্ময়বাবু ভুলটা বুঝেছেন, কিন্তু বড্ড দেরিতে। ঠিক যাদেরকে উনি ব্যাপারটা জানাতে চাননি, তারাই জানতে পেরে গেছে, সেটা এই দুটো বিচ্ছু ছেলেমেয়ের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। উনি ঝঠিতি সামলে নিয়ে বললেন, "না, কিছু না। একটা গান মনে পড়ল, সেটাই গুনগুন করছিলাম আরকি।"

"গান?" অখিলেশবাবুর গলায় সন্দেহ। কিন্তু উনি সেটা চেপে গেলেন।

তিতাস আর টুবলু মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। কে খুন হল? 


(৬)

সাতটার সময় হসপেটে পৌঁছে গাড়ি এসে থামল শ্যাম রেসিডেন্সির সামনে। বাইরে একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গেটের সামনে দুজন বন্দুকধারী পুলিশ। রিসেপশনের কাউন্টার ফাঁকা। পুলিশ দেখেই সকলের মুখ থমথমে হয়ে গেছে। কি করা উচিত, বুঝতে পারছে না কেউই। তন্ময়বাবু এত হুড়োহুড়ি করে এখানে কেন এলেন সেটাই এইমুহূর্তে সবথেকে বড় প্রশ্ন। উনি হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই একজন মাঝারি হাইটের, কালো, চশমা পরা এবং গোঁফঅলা ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন এবং সকলের হতভম্ভ মুখ দেখে একটু অপ্রস্তুতেই পড়ে গেলেন। নিজের পরিচয় না দিয়ে স্তিমিত গলায় বললেন,"আপনাদের রুম ঠিক করা আছে। থার্ড ফ্লোরে আগেরবার যে ঘরগুলোয় ছিলেন, লাগেজ ওখানেই পৌঁছে দিচ্ছি, আপনারা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন।"

"কেন যাব?", মা কঠিন গলায় দাবি করলেন, "আমরা এখানে এলামই বা কেন? আমাদের তো গোয়া যাওয়ার কথা ছিল। ঠিক কিনা?" 

তন্ময়বাবু বললেন, " ঝামেলা মিটে গেলে আমি আপনাদের সব বুঝিয়ে বলব। এখন প্লিজ কো-অপারেট করুন। এখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক নয়। আপনারা ঘরে যান।" মা বোধহয় আরেকটু ঝগড়া করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু বাবা কানে কানে কিছু একটা বলতে, থেমে গেল। হোটেলের লিফটের অপেক্ষা না করে লাগেজ নিয়ে সিঁড়ি দিয়েই ওপরে উঠে গেল তিতাস আর টুবলু বাদে সবাই। বাবা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকালেও কিছু মন্তব্য করলেন না। চুপচাপ উপরে উঠে গেলেন। তন্ময়বাবু আর ওই ভদ্রলোক একটু অপেক্ষা করে, সবাই চলে গেলে, লিফটে ঢুকলেন। ওনাদের পিছু পিছু তিতাস আর টুবলুও ঢুকলো। তন্ময়বাবু স্পষ্ট বিরক্ত হলেন।  কিন্তু কিছু বললেন না। পাশের ভদ্রোলোকটির সঙ্গে খুব নিচু গলায় কথা বলতে বলতে ফোর্থ ফ্লোরের সুইচ টিপলেন।

ফোর্থ ফ্লোরের করিডোর পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। বাকি বোর্ডাররাও রয়েছে। করিডোরের শেষ প্রান্তে হোটেল মালিক মি: ত্রিলোক সুন্দরমের ঘর। তার ঠিক আগে হলের মতো জায়গাটায় একটা সোফার সামনে ভিড়টা জড়ো হয়েছে। কিন্তু কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।তন্ময় বাবু সেদিকে এগোতে যেতেই দুজন কনস্টেবল এসে তাঁকে আটকায়। পিছনে ফিরে দুই বিচ্ছুকে জ্বলন্ত চোখে দেখে নিয়ে তিনি একজন কনস্টেবলের দিকে তাঁর আইডেন্টিটি কার্ডটি পকেট থেকে বার করে এগিয়ে দেন। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা ওনাকে ছেড়ে দিলো। তিতাস-টুবলুই বা বাদ যায় কেন! তন্ময়বাবুর সাথে দেখে তাদেরকেও ছেড়ে দেওয়া হল। ভিড়ের ভেতর উঁকি মেরেই তিতাসের গা গুলিয়ে উঠল। টুবলু রুমালে মুখ চেপে দাঁড়িয়ে আছে। 


মি: মূর্থী খুন হয়েছেন।


ওনার দেহটা সোফার দুদিকের হ্যান্ডরেস্টের মাঝে কোনাকুনি ভাবে শুইয়ে রাখা হয়েছে। হলের প্রত্যেকটা জিনিস তার নির্দিষ্ট জায়গাতেই আছে। শুধু বেমানান রক্তাক্ত মৃতদেহটি। সবচেয়ে লক্ষণীয় যেটা, সেটা হল,মিঃ মূর্থীর মুখমণ্ডল ঘৃণায় বিকৃত।

তন্ময়বাবু চিন্তান্বিত মুখে ওখান থেকে বেরিয়ে এলেন। ওই ভদ্রলোকটি কিছু একটা রিপোর্ট করতে ব্যস্ত। তিতাস গুটিগুটি তন্ময়বাবুর পিছনে এসে দাঁড়ালো,"আপনি সি.আই.ডির প্রখ্যাত ক্রিমিনলোজিস্ট রাজেশ বসাক?"

তন্ময়বাবু তিতাসের দিকে না তাকিয়েই বললেন, "তোমাদেরকে এর মধ্যে ঢুকতে বারণ করেছি।"

"আপনিই তো আমাদেরকে ঢুকিয়েছেন। আপনার দরকার আছে,আপনি আপনার পরিবারকে নিয়ে এখানে এলেই পারতেন। আমাদের ট্যুরটা নষ্ট করলেন কেন?"

টুবলু বললো, " ওসব ছাড় এখন! আচ্ছা, আপনিই সত্যি রাজেশ বসাক? কখনও একটাও কেসে ফেল করেননি? "

তন্ময়বাবু (কিংবা রাজেশবাবু) আর কি করেন? একটা সম্মতিসূচক দ্বীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন মাত্র। উনি বা টুবলু কেউই খেয়াল করেনি, ইতিমধ্যে কখন অখিলেশবাবু আর রমা দেবী ওদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন।


তিতাস বাবা মাকে আসতে দেখেই সরে গেছে করিডোরের অন্যপ্রান্তে,যেখানে একজন হোমড়াচোমড়া পুলিশ অফিসার  হোটেলের মালিক মি: সুন্দরম, রিসেপশনিস্ট মি: আইয়ার, এবং যে ছেলেটি খুনটা প্রথম আবিষ্কার করে, তার ইন্টারোগেশন করছেন। ওদের থেকে সামান্য দূরত্বে দাঁড়িয়ে তিতাস মোবাইলে ভয়েস রেকর্ডারটা অন করে দিল।

প্রথমে মি: সুন্দরম।

"আপনার নাম?"

"ত্রিলোক সুন্দরম।"

"আপনি আজকে দুপুর দুটো থেকে বিকেল সাড়ে চারটে পর্যন্ত কোথায় ছিলেন?"

মিঃ সুন্দরম করিডোরের শেষপ্রান্তে একটা ঘরের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বলেন, "ওই ঘরে দুপুর দুটো থেকে তিনটে পর্যন্ত আমাদের মিটিং ছিল।"

"কে কে ছিলেন?"

"আমি, আমার বিজনেস পার্টনার মিঃ বালারিয়া, আর মিঃ মূর্থীর সেক্রেটারি মিঃ যাদব।"

"মিঃ মূর্থীর সেক্রেটারি কি কোনো বিশেষ কারণে এসেছিলেন?"

"আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার হোটেলের নিচে একটা রেস্টুরেন্ট কাল সকাল থেকে খোলা হবে, তার ব্যানার দেখেছেন বোধহয়। ওইটা মিঃ মূর্থীর চেইনের লেটেস্ট রেস্টুরেন্ট। সেই বিষয়েই ফাইন্যাল মিটিং করতে এসেছিলেন ওনার সেক্রেটারি।"

"তাহলে মিঃ মূর্থী কি ওই কারণে এসেছিলেন?"

"উনি রিসেপশনে এসে আইয়ারজিকে বলেন যে উনি ওই বিষয়ে এসেছেন। কিন্তু আমাদের মিটিংয়ে উনি জয়েন করেননি।"

অফিসারটি মুহূর্তের জন্য আটকে যান। পরক্ষনেই বলেন, " উনি কখন আসেন?"

মিঃ সুন্দরম এবার যেন একটু বিরক্ত হয়েই বলেন, "এসব তথ্য আপনি মিঃ আইয়ারের কাছেই পাবেন। আমি জানি না।"

"তিনটেয় কি মিটিং শেষ হয়েছিল?"

"হ্যাঁ। বাকি দুজন তখন বেরিয়ে যান। আমি একটু কাজে বাইরে গিয়েছিলাম।"

"উনি এসেছেন জেনেও আপনি বেরিয়ে গেলেন?"

"বললাম না, উনি আমাদের মিটিংয়ে জয়েন করেননি। তাই উনি এসেছেন কিনা সেটাই আমি জানতাম না। এমনকি মিটিং শেষ হওয়ার পরে আমি আর আমার ঘরের দিকেও যাইনি। মি: বালারিয়া আর মিঃ যাদবের সঙ্গেই নিচে যাই, এবং ওনারা বেরিয়ে যাওয়ার পরে আমিও বেরিয়ে যাই।"

"আপনারা যখন ওই ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন মিঃ মূর্থী এখানে ছিলেন না?"

"না।"

"বেরিয়ে আপনি ঠিক কোথায় গিয়েছিলেন?"

" প্রথমে আমাদের অন্য আরেকটি হোটেলে যাই, তারপরে সবজি বাজারে যাই।"

"আপনাদের কটা হোটেল আছে?"

"চারটে।"

"কটার সময় ফেরেন বাজার থেকে?"

"সাড়ে চারটে।"

"তার মানে মিঃ মূর্থীর সঙ্গে আপনার কোনো সাক্ষাৎ হয়নি?"

"না।"

"আপনি আসতে পারেন।" মিঃ সুন্দরম দৌড়ে পালিয়ে গেলেন। বাবা আর মা তন্ময়বাবুকে জেরায় জেরবার করে দিচ্ছে। টুবলু সুযোগ বুঝে সুট করে ওখান থেকে কেটে পড়ে এদিকে, তিতাসের দিকে চলে এল। এরপরে রিসেপশনিস্ট মিঃ আইয়ারের পালা। মোটাসোটা ভদ্রলোকটি খুব নার্ভাস ভাবে এসে অফিসারের সামনের সোফায় বসলো।

"আপনার নাম?"

" শুভঙ্করম আইয়ার।"

"আপনার আজ কটা থেকে শিফট ছিল?"

"একটা থেকে ছটা পর্যন্ত।"

"আপনি শিফটে আসার পর থেকে কি হলো পরপর বলুন।"

মিঃ আইয়ার একটু থেমে মাথার মধ্যে ঘটনা গুলো পরপর সাজিয়ে বলতে শুরু করলেন, " দেড়টায় রুম নং ৩০২ এর বোর্ডাররা চেক আউট করে বেরিয়ে গেলেন।  তারপর দুটো পর্যন্ত কেউ আসা যাওয়া করেনি। দুটোর সময় প্রথমে এলেন মিঃ বালারিয়া, তার কিছু পরে মিঃ যাদব। তার অনেকটা পরে, প্রায় পৌনে তিনটে নাগাদ এলেন মিঃ মূর্থী। ওনাকে খুব উত্তেজিত এবং গম্ভীর দেখাচ্ছিল। এসে আমাকে বললেন যে ওঁর রেস্টুরেন্টের ব্যাপারে উনি মিঃ সুন্দরমের সঙ্গে দেখা করতে চান। আমি ওনাকে বললাম যে স্যার মিটিংয়ে আছেন। উনি সেই শুনে তখনই উপরে চলে গেলেন, লিফটও নিলেন না। "

" তারপর কি হলো?"

আইয়ার ভীত মুখে চুপ করে গেলেন। অফিসার প্রশ্ন পাল্টে বললেন, " ওই ঘরটা কি কনফারেন্স রুম?"

উনি সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন। "ওখানে কি মাঝেমধ্যেই মিটিং হয়?"

"আজ্ঞে হ্যাঁ। আজকে যে তিনজন ছিলেন, তাদেরই মিটিং হয় এক সপ্তাহের অল্টারনেট দিনে।"

অফিসার খুবই অবাক হলেন। তিতাস-টুবলুও। মিঃ যাদব তো মূর্থীর সেক্রেটারি। উনি এদের মিটিংয়ে রেগুলারলি কেন?

আইয়ার কথাগুলো বলেই চুপ করে গেছেন। ভয়ে আর কিছু বলতেই পারছেন না। কিছু একটা বলবার জন্যে উদ্যত হয়েও পরক্ষণেই মাথা নেড়ে সিদ্ধান্ত বদল করলেন। 

"মিঃ বালারিয়া আর যাদব কখন বেরোলেন?"

" তিনটেয়। স্যার মিঃ বালারিয়ার গাড়িতেই ওনাদের অন্য হোটেলটায় গেলেন।"

"ওনাদের কটা হোটেল?"

আইয়ার আবার কিছু একটা বলতে গিয়ে চেপে গেলেন। তারপরে বললেন, "চা… চারটে।"

অফিসার ক্রুর দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে বললেন, "আসতে পারেন।"

ভদ্রলোক উঠে কপালের ঘাম মুছলেন। যাওয়ার আগে তিতাসদের লক্ষ্য করে কেমন একটা দৃষ্টিতে ওদের দেখে বেরিয়ে গেলেন। অফিসার আড়চোখে তিতাস-টুবলু এবং ওদের পিছনে সদ্য জেরা থেকে মুক্তি পাওয়া তন্ময়বাবুকে দেখে পরেরজনকে ডাকলেন। খুনটা যে প্রথম দেখে, সেই চাকরটি এলো। এ আরো বেশি ভয় পেয়ে আছে। ওর কথা-কান্নাকাটির মধ্যে থেকে "আমি কিছু জানিনা স্যার" বাদ দিলে দাঁড়ায় যে ও চারটে পনেরো নাগাদ নিচে জল ভরতে এসে দেখে আইয়ারজি কাউন্টারে বসে দরদর করে ঘামছেন, এবং খুব অসুস্থ মনে হচ্ছিল ওনাকে। জিজ্ঞেস করাতে উনি কিছু বলার আগেই অজ্ঞান হয়ে যান। তখন ওপর থেকে হোটেলের আরেকজন স্টাফ, রামেশ্বর চিৎকার করে ওঠে। তড়িঘড়ি ওপরে গিয়ে দেখে ওই ব্যাপার। ওকে ছেড়ে দিয়ে অফিসার বোর্ডারদের নিয়ে পড়লেন। তিতাসরা পরে আসা সত্বেও বাদ গেল না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওদের নামঠিকানা জানলেন। বাবা নার্ভাসনেসে এত বেশি হোঁচট খাচ্ছিল যে শেষপর্যন্ত মা-ই নিজের আর বাবার প্রফেশন, এমনকি মায়ের কলেজ আর বাবার অফিসের লোকেশন পর্যন্ত বলে দিল। তন্ময়বাবুর ফুল ফ্যামিলি কিন্তু এবারে সত্যি কথাই বলল। কারণ তন্ময়বাবু একটা এমার্জেন্সিতে পড়ার ফলে এই খুনের তদন্তে থাকা সমস্ত পুলিশকে নিজের আসল পরিচয়ই বলেছেন। এমারজেন্সিটা কি সেটা একটু পরে জানা গেল ঠিকই, কিন্তু তিতাস টুবলু ছাড়া তা কেউ জানতে পারলো না। 



(৭)

তিতাসদের ঘরে সবার ডিনার দিয়ে গেছে। ঘটনার ঘনঘটায় সবার মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। বাবা একজন গোয়েন্দার সঙ্গে ইন্টারঅ্যাক্ট করতে পারছে, এই ভেবে পুলকিত, আর উল্টোদিকে গোয়েন্দাবিদ্বেষী মা এখনও রেগে আছে এই বেড়ানোটা নষ্ট হয়ে গেল বলে। তন্ময়বাবু খুব গম্ভীর হয়ে আছেন, এবং খানিকক্ষণ আগে তিতাস আর টুবলু ওনার সাথে একটা চুক্তি করেছে যেটার অনুযায়ী ওরা এখন ওনার 'সহ-গোয়েন্দা'; ('সহকারী' পরিচয়ে দুজনেরই প্রবল আপত্তি।) যার কারণে তন্ময়বাবু ওদেরকে ওনার এরকম হন্তদন্ত হয়ে গোকাক থেকে ফিরে আসার এমার্জেন্সি কারণটা বলতে বাধ্য হয়েছেন। আতা আর অঙ্ক গোয়া যাওয়া হয়নি বলে খুব ক্ষেপে আছে এখনও।

বাবা মায়ের খাওয়া হয়ে গেছে। তিতাসদের আরেকপ্রস্থ সাবধানবানী শুনিয়ে গুডনাইট বলে শুতে চলে গেলেন। তন্ময়বাবুর স্ত্রী-কন্যারাও গুডনাইট জানিয়ে একে একে ঘরে চলে গেল। সবাই চলে গেলে তন্ময়বাবু ঘটনাটা বললেন।

গোকাকে সোয়া পাঁচটায় তন্ময়বাবুকে ফোন করেন রজতের কাকা, ওনার কলিগ মিঃ সুবিমল মুখার্জি। সুবিমলবাবু তাঁর ট্রিপ থেকে হসপেটে ফেরেন তিনটে নাগাদ, এবং এসে দেখেন রজত নেই, আর ওর ফোনও সুইচড অফ। ইতিমধ্যে তাঁর সঙ্গে রজতের কোনো কথা হয়নি, কারণ দুজনেই কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাই ওনার খবরও নেওয়া হয়নি। ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করে সুবিমলবাবু প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এবং তাদের উত্তর রীতিমতো দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। ওনার প্রতিবেশীরা বলেন যে এক সপ্তাহ আগে যেদিন সুবিমলবাবু বেরিয়ে যান, সেদিন রজতের গাড়ি ওবাড়িতে অনেক রাতে ঢুকেছিলো, প্রায় সাড়ে এগারোটা নাগাদ। প্রত্যেকদিনই রজত এবং সুবিমলবাবু নটার মধ্যে বাড়ি ঢুকে যেতেন, তাই যারা এটা লক্ষ্য করেছে, তাদের প্রত্যেকেরই কৌতূহল হয়। এবং পরদিন খুব ভোরবেলায় ওখান থেকে আরেকটা গাড়ি বেরিয়ে যায়। এবং তার পর থেকে বাড়ির বাইরের দরজায় ঝুলছে তালা। এই খবর পাওয়া মাত্র উনি তন্ময়বাবুকে ফোন করেন।

সুবিমলবাবুর ধারণা, রজতকে কে বা কারা কিডন্যাপ করেছে।

"কিন্তু রজতকে কিডন্যাপ করেছে এটাই বা কেন ভাবলো সুবিমল, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।" তন্ময়বাবু চিন্তিত মুখে বলা শেষ করলেন। 

তিতাস আস্তে আস্তে বললো," রজত আসলে কে না জানলে উনি কোথায় গেছেন তা বলা অসম্ভব।"

তন্ময়বাবু কিছু একটা বলার জন্য হাঁ করেও চুপ করে গেলেন; এবং ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

শুয়ে পড়ার আগে তিতাস বলল," মিঃ মূর্থী আর ওনার সেক্রেটারি একই দিনে, একই সময়ে, একই বিষয়ে এবং একই লোকের সঙ্গে আলাদা আলাদা ভাবে কেন দেখা করতে এলেন বলতে পারবি দাদা?"

টুবলু সবেমাত্র লেপটা মুড়ি দিয়ে ঘুমের আশায় চোখটা বুজেছিল, এই অকস্মাৎ প্রশ্নে ঘুম-টুম উড়ে গেলে, একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "নাঃ।"


(৮)

পরেরদিন সাতটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে নীচে বেশ খানিক চেঁচামেচি শুনতে পেল তিতাস। দশ মিনিটের মধ্যে দুজনেই রেডি হয়ে নিচে নেমে দেখে লাউঞ্জে দুজন মাঝবয়সী, লম্বা এবং মূলত রোগা ভদ্রলোক বসে আছেন। এবং তাঁদের বসিয়ে রাখা হয়েছে বলে খুব চেঁচামেচি করছেন। তাঁদের উল্টো দিকের সোফায় ইংলিশ খবরের কাগজ হাতে বসে আছেন তন্ময়বাবু। তাদের দেখে বসতে বললেন পাশের সোফাটায়। ওরা বসলে উনি হাতের কাগজটা মুড়ে বললেন, "এই দুজন ভদ্রলোক থার্ড ফ্লোরের শেষ রুমটার বোর্ডার। সকাল সকাল পুলিশি নির্দেশ অমান্য করে পালানোর চেষ্টা করছিলেন। তাই অনিচ্ছা সত্বেও এনাদের বসিয়ে রাখতে হয়েছে কিছু আলাপ-পরিচয়ের জন্যে। সুবিমলকে খবর দিয়েছি। ও আসা পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।"

টুবলু বলল, "মিঃ বালারিয়া আর মিঃ যাদবের জিজ্ঞাসাবাদ হবে না? ওঁরা তো ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন।" তন্ময়বাবু চিন্তিত মুখে বললেন, "গতকাল মিটিংয়ের পরেই ওনারা ব্যাঙ্গালোর চলে যান। 

এবং বর্তমানে ব্যাঙ্গালোর থেকে হসপেটের ট্রেনে আছেন। দুপুরের দিকে পৌঁছবেন। কিন্তু…"

"কিন্তু?"

"ওনাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, এতে সুবিমলের প্রবল আপত্তি। কে জানে কেন!"

তিতাস এতক্ষণ চুপ করে ছিলো, হঠাৎ বলল, " খুনটা কটায় হয়েছে আপনি জানেন?"

তন্ময়বাবু একটু ভেবে বললেন, "পুলিশের ডাক্তার তো বলছে দুটো থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে।"

তিতাস আবার চুপ করে গেল। গেটের বাইরে থেকে "আইয়ে সাব" শোনা যেতে বোঝা গেল সুবিমলবাবু এসে গেছেন। 

মিনিট পনেরোর ইন্টারোগেশনের পরে সুবিমলবাবু উঠে রিসেপশনিস্টের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে গেলেন। এখন মিঃ আইয়ারই কাউন্টারে বসে ছিলেন। বোর্ডারদুজনকে তাদের ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হল। পুরো সময়টা ওরা সমানে বলে গেল যে ওদের কিছু আর্জেন্ট কাজ পড়ে গেছে, এবং এই পরিস্থিতিতে ওরা ভয় পেয়ে গিয়েছিল, তাই ওরা পালাচ্ছিল। কিন্তু কিছুতেই বলল না কোথায় যাচ্ছে, বা কি কাজ। সুবিমলবাবুর ধমকেও কোনো কাজ হলনা। ব্যর্থ হয়ে তিনি অন্যদিকে মন দিয়েছেন। 

কিছু পরেই বাকি সবাই নেমে এলে ব্রেকফাস্টের জন্য বেরিয়ে পড়া হল। কোথায় যাওয়া হবে, সে নিয়ে অনেক হিসেবনিকেশ করে রাস্তাটার ঠিক পরের মোড়ে নর্থস্টার বলে একটা হোটেলের নিচে  বেশ ভালো দেখতে একটা রেস্টুরেন্টে যাওয়া হল। প্রথমে মশলা ধোসা দিয়ে প্রাতরাশ সেরে সবার জন্য কফি অর্ডার করা হল। একজন ওয়েটার এসে এঁটো প্লেটগুলো না তুলেই তিতাসদের টেবিলে দুটো প্লেটে চারটে কফি, একটা বাটিতে চিনি, আর চারটে পাওডার্ড মিল্কের প্যাকেট নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। তিতাস কফির কাপে চিনি গুলে, গুঁড়ো দুধের প্যাকেটটা ছিঁড়তে গেল। কিন্তু প্যাকেটটা চিরপরিচিত রয়্যাল ব্লু রঙের নেসলে-র প্যাকেট, যেটা বাকি তিনজনের কাপের পাশে আছে, সেটা নয়। একটু তুঁতে ঘেঁষা নীল রঙের 'নেসলে' লেখা বর্গাকার প্যাকেট। কিন্তু 'নেসলে'-র 'e' এর মাথায় যে ছোট্ট ড্যাশটা থাকে, সেটা নেই। আর প্যাকেটটা আয়োতক্ষেত্রকার হওয়ার বদলে বর্গাকার। নামী কোম্পানির প্যাকেটে এত গড়বড় দেখে তিতাস আর ওটা নিতে ভরসা পেল না। কাপের পাশেই রেখে দিল। এই সময় আরেকজন ওয়েটার এসে পাশে বাবারা যে টেবিলে বসেছে, সেখানে একই ভাবে কফি দিয়ে আগের এঁটো প্লেটগুলো তুলে নিল। তিতাসদের টেবিল থেকে প্লেটগুলো তুলতে গিয়ে তার চোখে পড়ল তিতাসের কাপের পাশে পাওডার্ড মিল্কের প্যাকেটটা। মুহূর্তে গতানুগতিকতা বদলে গেল সতর্কতায়। ওটা দেখেই তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে যাওয়া খেয়াল করেছে তন্ময়বাবুও। ওয়েটারটি প্লেটগুলো নিয়ে দৌড়ে সিঙ্কের দিকে যাওয়ার বদলে কাউন্টারে গিয়ে ম্যানেজারকে কিছু বলতেই সেও ভীত চোখে তিতাসের দিকে তাকাল। তিতাস চট করে প্যাকেটটা সোয়েটারের পকেটে ঢুকিয়ে নিল। হঠাৎ যেন কাউন্টারের কাছে একটা শোরগোল উঠল। ম্যানেজার নিজেই দৌড়াদৌড়ি করছে। এমনকি কাউন্টার ছেড়ে একসময় দৌড়ে বেরিয়ে গিয়ে মিনিটখানেকের মধ্যেই ফিরে এসে কাউকে একটা ফোন করে ডাকল। তিন মিনিটের মধ্যেই আপাদমস্তক গরম পোশাকে মোড়া একজনের আবির্ভাব ঘটল। ম্যানেজার তার কানে কানে কিছু একটা বলতেই সে উল্কার গতিতে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। এবং একইসঙ্গে কফিটা একঢোকে শেষ করে কাউন্টারে গিয়ে বিল মিটিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন তন্ময়বাবু। লোকটা রেস্টুরেন্টের সামনে থেকে বাইক বের করে স্টার্ট দিয়েছে, এবং ঝড়ের বেগে ছুটছে। তন্ময়বাবু সামনে যে অটোটা পেলেন, তাতে চড়ে বসে বললেন, "ফলো হিম।"


তন্ময়বাবুর এরকম আকস্মিক প্রস্থানে হতচকিত সবাই। রিভলভিং ডোর ঠেলে বাইরে বেরোতে বেরোতে সুমনা ওনাকে ফোন করলেন, আর দশ সেকেন্ডের মধ্যে একবার '"হুঁ" আর একবার "হ্যাঁ" বলে ফোন কেটে দিলেন। উনি বললেন, "ওর হঠাৎ খেয়াল হয়েছে সকালের আলোয় বিট্ঠা-"

"আউফ!" তিতাস হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। এবং ওর পাশ দিয়ে মিউমিউ করে সরি বলতে বলতে একজন ওয়েটার ভেতরে ঢুকে গেল। সুমনা তিতাসের ধাতস্থ হওয়ার জন্যে একটু অপেক্ষা করে বললেন, " হ্যাঁ, তো ও এখন সকালের আলোয় বিট্ঠাল মন্দির দেখতে গেছে। হঠাৎ মাথার পোকাটা নড়ে উঠেছে, আরকি! আপনারা ওই নিয়ে ব্যস্ত হবেন না। আমাদের আজকের প্ল্যান মার্কেটে যাওয়া ছিল তো, তাতে কোনো ব্যাঘাত ঘটছে না। চলুন, আমরা আগে লোকাল মার্কেটেই যাই।" বলে উনি ট্যাক্সি ধরার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। মা তিতাসের পড়ে যাওয়াটাকে "অত্যধিক ব্যালেন্স" হিসেবে চিহ্নিত করে বেশ নিশ্চিন্তে মনে সুমনা আর আতা-অঙ্কর পাশে উঠে বসলেন। কিন্তু বাবা এবারে আর কোনো রিস্ক না নিয়ে তিতাস আর টুবলুর সাথে আরেকটা ট্যাক্সিতে উঠলেন। 

তিতাস পড়েছে মহাবিপদে। বাজারে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার বা দাদার নেই, কিন্তু পাশে বাবা। চূড়ান্ত অনিচ্ছা সত্বেও একটা দোকানের সামনে গাড়িটা থামতে নামতেই হল। মা তাদের জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। তিতাস অতিকষ্টে সাহস সঞ্চয় করে মাকে বলল, "ইয়ে, মা, বলছিলাম কি যে আমার আর দাদার তো এখানে কোনো কাজ নেই, তাই আমরা একটু হাম্পি মিউজিয়ামটা ঘুরে আসি আরেকবার? " মা  চুপ করে অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকে দেখছেন। তিনি বললেন, "তোমরা একা? না, তা হবে না। বাবা যদি সঙ্গে যায় তবে ছাড়ব।"

বাবা গেলেই তো হয়েছে! তিতাস করুন চোখে দাদার দিকে তাকাল আর দাদা বাবার দিকে। অখিলেশবাবু মাথা নেড়ে বললেন, "বেশ তো, আমি ওদের সাথে যাচ্ছি, তুমি তাহলে বাকিদের সাথে বাজারটা ঘোর।"

গাড়িতে বসে টুবলু বাবাকে বলতে শুরু করলো, "দেখো..মানে, তুমিও তো গোয়েন্দা গল্প ভালোবাসো-" তাকে থামিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে অখিলেশবাবু বললেন, "কিচ্ছু বোঝাতে হবে না। তোরা যে মিউজিয়ামে যাবি না, তা আমি ভালো করেই জানি। বল কোথায় যাচ্ছিস?"

"শ্যাম রেসিডেন্সিতে। সকালের ওই দুই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে হবে।"

"বেশ।"


(৯)

সকাল দশটা বাজে। হোটেলের লাউঞ্জ খাঁ খাঁ করছে। রিসেপশনে এখনও আইয়ারজি বসে আছেন। তিতাসদের ঢুকতে দেখে একবার মুখ তুলে দেখলেন, তারপরে আবার হাতের বইটার মধ্যে ঢুকে গেলেন। টুবলু ফিসফিস করে বলল, "লোকটা নিঃসন্দেহে সন্দেহজনক। একেও একটু পুছতাছ করা দরকার।" তিতাস সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল। বাবা ওদের নামিয়ে দিয়ে বিট্ঠাল মন্দিরে গেছেন। তন্ময়বাবুকে যে ওখানে পাবেন না তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু উনি গেলেন কোথায়?

থার্ড ফ্লোরে এখন চারটি মাত্র ঘর অকুপায়েড। তিনটে তিতাসদের, আর একটি ওই দুই ভদ্রলোকের। কিন্তু ওদের রুম নাম্বার না জানায় সবকটা ঘরের দরজাটা চেক করতে হল। ওনাদের যেহেতু এখন আর হোটেল থেকে বেরোতে দেওয়া হচ্ছে না, তাই যে ঘরটায় তালা নেই, সেটাই ওনাদের ঘর হবে। দেখা গেল, করিডোরের শেষের ঘরটাই ওনাদের। টুবলু দরজায় টোকা মারতে যাবে, এমন সময় তিতাস সন্দেহপ্রকাশ করলো যে ওনারা ওদের প্রশ্নের উত্তর দেবেন কেন। এর সদুত্তর কারোর কাছেই ছিল না, তাই যা হয় হবে ভেবে দরজায় নক করা হল। মিনিট তিনেক কোনো সাড়াশব্দ নেই। তারপর একটা ধরা ধরা গলায় ইংলিশে ভেসে এলো, "কে?" এর কি উত্তর দেওয়া যায় ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলে গেল। যিনি খুললেন, তিনি যে আগন্তুকের দেখে মোটেই খুশি হলেন না, সেটা তাঁর অভিব্যক্তিতেই বোঝা গেল। কিন্তু তিনি ওদের ভেতরে আসতে দিলেন। 

ঘরের আয়তন তিতাসদের ঘরটার মতনই। বেশ অগোছালো করে রাখা। দুটো সিঙ্গেল বেডেই ছড়িয়ে আছে জামাকাপড়, মোবাইল চার্জার, শেভিং কিট, ইত্যাদি। বোঝাই যাচ্ছে, সুটকেস্টা সদ্য আনপ্যাক করা হয়েছে। তিতাস কোনোরকম ভণিতা না করে সোজা কাজের কথায় এল। 

"আপনারা পালাচ্ছিলেন কেন?"

যিনি দরজা খুলেছিলেন, তিনি অত্যন্ত রুক্ষ ভাবে জবাব দিলেন যে এ প্রশ্নের উত্তর তাদেরকে দিতে তাঁরা বাধ্য নন। তিনি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু অন্য ভদ্রলোকটি তাঁকে থামালেন, এবং তামিলে কিছু বললেন যা শুনে এই ভদ্রলোক গজগজ করতে করতে একটা খাটে গিয়ে গোঁজ হয়ে বসে পড়লেন। 

এবার ইনি বললেন, "আমার নাম পি.কে. রেড্ডি। আর আমার বন্ধুর নাম এ.এন. পিল্লাই। আমরা পালাচ্ছিলাম কেন, সে বিষয়ে আমরা মিথ্যে বলেছি, " এতটা বলে মিঃ রেড্ডি ঢোক গিললেন। উনি যে ভয় পাচ্ছেন, সেটা স্পষ্ট। আবার বলতে শুরু করলেন, " কোনো আর্জেন্ট কাজে নয়, আমরা খুব ভয় পেয়ে পালানোর চেষ্টা করছিলাম। তোমরা সকালে ওই ক্রিমিনলোজিস্ট ভদ্রলোকের সঙ্গে ছিলে, দেখেছি। তাই আর বোধহয় লুকিয়ে লাভ নেই। 

গতকাল সন্ধেয় যখন খুনটা আবিষ্কৃত হয়, তখন অন্য সবার সঙ্গে আমরাও উপরে যাই। পুলিশ আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে চলে যাওয়ার পর যখন নেমে আসতে যাই, তখন পিল্লাই বলে যে ও ওর ফোনটা আসার সময় নিয়ে এসেছিল, এখন খুঁজে পাচ্ছে না। তালগোলে ওটা কোথাও পরে গেছে ভেবে আমরা করিডোরের কোনা, সোফার তলাগুলো খুঁজে দেখি। যে অফিসার ইন্টারোগেশন করছিলেন, তিনি যেটাতে বসেছিলেন, সেই সোফাটার তলাতেই ফোনটা পড়ে ছিল। কিন্তু ওটা উদ্ধার করতে গিয়ে আমরা আরেকটা জিনিস পাই।" মিঃ রেড্ডি ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা ছোট্ট কালো, চ্যাপ্টা আর চৌকোনা জিনিস বের করলেন। "এটা একটা মিনি ভয়েস রেকর্ডার। আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ। কিন্তু এতে যে কথাগুলো রেকর্ড হয়ে আছে, সেগুলো সাংঘাতিক। সেজন্যই আমরা ভয় পেয়ে যাই।" রেড্ডি তিতাসকে জিনিসটা দিলেন। "এটা চালালেই বুঝতে পারবে আমরা কেন ভয় পেয়েছিলাম। যেহেতু গতকাল সারাদিনই আমরা এখানে ছিলাম না, সেটা আমরা পুলিশের কাছে প্রমাণ দিয়েছি, তখন এটা দেখার পর আশা করছি সন্দেহের লিস্টে আমরা অনেক নীচে নেমে যেতে পারব।" রেড্ডি গম্ভীর মুখে শেষ করলেন। ধন্যবাদ জানিয়ে তিতাস-টুবলু বেরিয়ে এল। "তাহলে তো এটা এবার চালিয়ে দেখতে হয়।" টুবলু বলল। তিতাস ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, "উঁহু, এখন না। ওটাকে আগে মোবাইলে কপি করে খালি করে দে। তারপরে আইয়ার। চল।"


মিঃ আইয়ার রিসেপশনে বসে বই হাতে ঢুলছিলেন। পায়ের শব্দ পেয়েও উঠলেন না। টুবলু ওঁর সামনে গিয়ে আস্তে করে ওনাকে ডাকল। আইয়ারজি চোখ খুলে ওদেরকে দেখেই আঁতকে উঠলেন। পুলিশের কাছে যখন ইনি জবানবন্দি দিচ্ছিলেন, তখনও তিতাসরা সেখানে ছিল। তাই পুলিশের সাথে তাদের যোগস্থাপন করলে ভয় পাওয়ারই কথা। 

"তো-তোমরা?"

টুবলু বলল, "ভয় পাবেন না। আমরা পুলিশের কেউ নই। গতকাল আপনার কয়েকটা কথা শুনে আমাদের একটু খটকা লেগেছে। তাই সেগুলো ক্ল্যারিফাই করে নিতে এসেছি।" এই কথায় যেরকম প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত ছিল, সেরকম হলো না। উনি কোনো প্রতিবাদ করলেন না। নার্ভাস স্বরে বললেন, "কি জানতে চাও? আমি কিন্তু খুনের ব্যাপারে কিছু জানি না। পুরো সময়টা আমি এখানেই ছিলাম, আমা-"

টুবলু তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলল, "আমাদের প্রশ্নটা একটু অন্য। এতবার মিটিং হয় কি নিয়ে? রেস্টুরেন্টটা তো রিসেন্ট ব্যাপার। সেটা নিয়েই প্রত্যেকদিন নিশ্চয়ই হয় না?"

আইয়ার ঘাড় নাড়লেন। উনি জানেন না, কিংবা বলতে চাইছেন না।

"মিঃ সুন্দরমের ঠিক কটা হোটেল?"

"চার- না, না! আমি বলতে পারবো না, ছেড়ে দাও।" আর্তনাদ করে উঠলেন উনি। 

"আপনি নির্ভয়ে বলুন। এখানে কেউ আপনার কথা শুনতে পাবে না।"

অনেকক্ষণ দোনোমনো করে উনি বললেন, "দুটো। শ্যাম রেসিডেন্সি আর নর্থস্টার।" নর্থস্টার শুনেই চমকে উঠলো দুজনে। ওরা তো নর্থস্টারের রেস্টুরেন্টেই সকালে গিয়েছিল না?

"এখানকার সবজি বাজার দুপুরে কটায় খোলে?"

"সাড়ে তিনটে।"

"কালকে ইন্টারোগেশন শেষে চলে যাওয়ার সময় আপনি আমাদের দিকে, বিশেষ করে তন্ময়বাবুর দিকে ওভাবে তাকালেন কেন?"

মিঃ আইয়ারের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল। পরপর তিনবার ঢোক গিললেন। অতিকষ্টে হাঁ করলেন কিছু বলবার জন্যে, কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত পায়ের আওয়াজে থেমে গেল। মিঃ সুন্দরম নেমে আসছেন। ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে কাউন্টারে আইয়ারের সঙ্গে তিতাসদের দেখেই তাঁর মুখে বিরক্তি এবং সন্দেহ ফুটে উঠল। কিন্তু সেটাকে মুখোশ পরিয়ে তিনি গটগট করে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শোনা গেল, "আসুন, আসুন মিঃ বালারিয়া। চলুন।"  

সুন্দরম বালারিয়ার সাথে লিফটে উঠলেন। একটুক্ষণ অপেক্ষা করে তিতাস বলল, "দাদা, চল।"

কোথায় যাবে জিজ্ঞেস করতে করতেই তিতাস সিঁড়ি দিয়ে দৌড় লাগিয়েছে। অতঃপর!

ফোর্থ ফ্লোর পর্যন্ত দৌড়ে এসে টুবলু সিঁড়িতেই বসে পড়ল। তিতাস করিডোরে পৌঁছনোর ঠিক আগের বাঁকটায় বসে আছে। রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে করিডোরের বড় হলটা দেখা যাচ্ছে। সেখানে যে দুজন বসে আছে, এটুকুই বোঝা যাচ্ছে, কথাটা কিছু শোনা যাচ্ছে না। তিতাস হঠাৎ করে খুব ডেসপারেট হয়ে গেল। যেন তার বুদ্ধিকে এরা চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। দাদাকে তার জায়গাটা ছেড়ে দিলো, আর মোবাইলে রেকর্ডারটা অন করে দিতে বলল। বলে যে স্পিডে এসেছিল, তার দ্বিগুন স্পিডে নীচে নেমে গেল। লাউঞ্জে আইয়ার ভীত মুখে বসে আছেন। তিতাস দৌড়ে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করল, "হোটেলের পিছন দিকে ফোর্থ ফ্লোরের করিডোরে যাওয়ার একটা সিঁড়ি আছে না?" আইয়ার সাংঘাতিক শক পেলেন এই কথাটা শুনে। কোনোক্রমে অস্ফুটে হ্যাঁ বলতেই তিতাস ছিটকে বেরিয়ে গেল। এক সেকেন্ডও নষ্ট করা যাবে না। হোটেলের পিছন দিকে বিশ্রী কাঁটাগাছের জঙ্গলের মধ্যে একটা মোরামের রাস্তা। সেখান থেকে উঠে গেছে একটা খুব খাড়াই লোহার সিঁড়ি। দৌড়লে পড়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। পা টিপে টিপে ওপরে উঠল তিতাস। কিন্তু সে যে দরজাটা খেয়াল করেছে, সেটা কি খোলা থাকবে? ভাগ্যদেবী তিতাসের ওপর সদয় বলতে হবে। দরজাটা খোলা নেই বটে, কিন্তু চাবিটা লোহার ল্যান্ডিংয়ে পড়ে আছে। খুউউব সাবধানে চাবিটা ঘুরিয়ে দরজাটা একটু ফাঁক করল তিতাস। দরজার দিকে পিছন করে একটা সোফায় বসে আছেন মিঃ সুন্দরম আর মিঃ বালারিয়া। মিঃ মূর্থীকে যে সোফাটায় পাওয়া গিয়েছিল, এটা তার উল্টো দিকে। দরজা থেকে সোফার দূরত্ব খুব বেশি হলে দেড় হাত হবে। তিতাস দরজার তলা দিয়ে অন করা মিনি রেকর্ডারটা টোকা মেরে সোফার তলায় পাঠিয়ে দিল। যদি ওটা একজনেরও চোখে পড়ে যায়, তাহলে ওটার উদ্ধারকার্য বিশেষ জটিল হবে মনে হচ্ছে। ভেতরের সিঁড়ি থেকে দরজাটা দেখা যায়, কিন্তু এখান থেকে সিঁড়িটা দেখা যায় না। ওনারা এত ফিসফিস করে কথা বলছেন, এখান থেকেও কিছু শোনা যাচ্ছে না। তিতাস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছে, এমন সময় যেন তার ওপরে কৃপা করেই বালারিয়া উঠে পড়লেন। দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে কিছু বলছেন। হঠাৎ তাঁর চোখ সরু হয়ে গেল। ওর মুখ দেখেই তিতাসের হাত পা উত্তেজনায় ঠান্ডা হয়ে গেছে। দেওয়াল আর দরজার মধ্যে এক সেন্টিমিটার ফাঁক, আর তার মধ্যে থেকে উঁকি মারা তুঁতে রঙের স্নিকারটা লক্ষ্য করে মিঃ বালারিয়া গোঁফের ফাঁকে একটু হাসলেন। তারপরে মিঃ সুন্দরমকে ডেকে নীচে নেমে গেলেন। ল্যান্ডিংয়ের বড় বুদ্ধের মূর্তিটার পিছন থেকে বেরিয়ে থাকা নীল হলুদ স্নিকারটাও তাঁর নজর এড়ালো না। তিনি আবার মুচকি হেসে নেমে গেলেন। ওনারা নেমে যেতেই তিতাস একলাফে ঘরে ঢুকে রেকর্ডারটা তুলে নিল। দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে তালা দিয়ে চাবিটা পকেটস্থ করে নেমে গেল। এদিকে টুবলুও মূর্তির পিছন থেকে বেরিয়ে থার্ড ফ্লোরে নেমে ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিতাস ঢুকে এল। মোবাইলে ইয়ারফোন গুঁজে একটা ওর, আর একটা দাদার কানে দিয়ে, মিনি রেকর্ডারটা থেকে কপি করা রেকর্ডিংটা চালিয়ে দিল। প্রথমে খানিকটা গোঁ গোঁ আওয়াজ। তারপরে আস্তে আস্তে কথাগুলো স্পষ্ট হল।

একটা মোলায়েম গলা বলল,"নমস্কার মিঃ মূর্থী। আপনার কথা মতো ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আমাদের ক্লায়েন্ট আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে যাবেন। "

"বেশ। তাহলে আমরা আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। তারপরে এই ডিলটা করে আমরা আজ রাতের ট্রেনেই বেরিয়ে যাবো। ঠিক?"

"হ্যাঁ। সেই রকম ব্যবস্থাই করেছি। আমরা যতক্ষণ অপেক্ষা করবো, ততক্ষণ একটু ঠান্ডা হয়ে যাক, নাকি?"

"বেশ।"

কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তারপরে অস্পষ্ট নড়াচড়ার শব্দ। তারপরে কাঁচের টেবিলে প্লেট নামিয়ে রাখার শব্দ। 

"নিন, খান। এই চা টা নতুন আনিয়েছি। অসাধারণ খেতে।"

কোনো প্রত্যুত্তর বা নড়ার শব্দ এলো না। একটু পরে একটা গম্ভীর গলা বলল, "উঁহু। আগে আপনি নিন।"

"সন্দেহ করছেন আমাকে? বেশ, তাহলে আমিই আগে নিচ্ছি।"

কাপে চা ঢালার শব্দ হল। তারপরে চামচের ঠনঠন, এবং সঙ্গে সঙ্গেই চুমুক দেওয়ার শব্দ।

"আঃ! এই নিন।" আরেকবার চুমুক দেওয়ার শব্দ হল।

"আমারটায় চিনি কম হয়েছে। তেতো লাগছে।"

"এই যে চিনি।"

আবার চামচের শব্দ হল।

মোলায়েম গলা বলল, "এবার তাহলে কাজের কথায় আসি। আপনার প্ল্যান ছিল, আজকে আমাদের এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট ক্লায়েন্টের সাথে ডিলটা ফাইন্যাল করে, আজকেই মাল ডেলিভারি দিয়ে, এবং অবশ্যই পেমেন্ট নিয়ে, আজকের রাতের ট্রেনে আমরা সোজা মুম্বাই চলে যাব। সেখান থেকে প্লেনে দুবাই? তাই তো?"

"ঠিক তাই।" আবার জোরে চুমুক দেওয়ার শব্দ হল।

মোলায়েম গলায় এবার একটা হাসির রেশ দেখা দিল, "বেশ বেশ। কিন্তু আপনার এই প্ল্যানের এক্সিকিউশনে একটা ছোট্ট গোলমাল করে ফেলেছি। "

কাপ-প্লেট টেবিলে নেমে এল। গম্ভীর গলা আরও গম্ভীর হয়ে বলল, "কী?"

"ক্লায়েন্টকে যে পরশু আসতে বলে দিয়েছি। আজকে যে ডিল করে টাকা নিয়ে পালানো হচ্ছে না মিঃ ত্রিভুবন মূর্থী!"

মূর্থী চিৎকার করে উঠলেন, "কী বলছেন আপনি জানেন? আপনাকে আমি বুঝিয়ে বলিনি মাথার ওপর খাঁড়াটার কথা? আমাদের খুব তাড়াতাড়িই পালানো দরকার ছিল। ওঃ!"

"কি হলো মিঃ মূর্থী? ওকি, পড়ে গেলেন কেন? বুকে লাগছে? প্রেশার বেড়ে গেল বুঝি? তা অবশ্য হওয়ারই কথা। আসলে কি বলুন তো, আপনি ছিলেন মালিক! পেমেন্টের অর্ধেক আপনার ভাগে যেত, আর বাকি অর্ধেক থেকে ওয়ার্কারদের মাইনে, মাল জোগাড় করা...তারপরে আমাদের ভাগে যা পড়ত, তা অতি নগণ্য। এবার আপনিই বলুন,মাথা খাটাব আমরা, পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে কারবার চালাবো আমরা, আর আপনি শুধু অর্ডার দেবেন আর পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকবেন? তা কি করে হয়?"

"আমি...আপনাকে বিশ্বাস…করে.."

"আর বাকিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন, তাই না? আপনি মাস্টারমাইন্ড, আপনার অনেক টাকা। এত টাকা, যে আপনি বাকি জীবনটা কোনো কাজ না করেই চালিয়ে দিতেন। আমাদের কিন্তু তত লাভ করতে দেননি আপনি। তাই যে আপনাকে এইভাবে মরতে হচ্ছে।"

" আপনাদের...প্ৰত্যেকের...মাইনে...কয়েক লাখ-...আঃ"

"বিশ্বাসঘাতকতার কোনো ক্ষমা নেই, মিঃ মূর্থী। বাই!"

এবার পিছনে আরেকটা গলা শোনা গেল। এই গলাটা ভাঙা ভাঙা, সর্দি বসা। "কাজ হয়ে গেছে? "

মোলায়েম গলা দূরে সরে গেছে, "হ্যাঁ। পালস নেই, স্বাসও পড়ছে না। ওর কাজটা মনে আছে তো? আপনার বয়ানটা মনে আছে?"

"হুঁ। বিজনেস রাইভালরি।"

"চলুন, কনফারেন্স রুমে গিয়ে বাকি কথাটা সেরে ফেলি।" দু জোড়া পায়ের শব্দ ফিকে হয়ে এল।

কান থেকে ইয়ারফোন খুলে ফেলল দুজনে। যা শুনলো, সেগুলো হজম করতে বেশ কসরত করতে হবে মনে হচ্ছে। 

টুবলু মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, "কি বুঝলি?"

"ব্যাপার গুরুচরণ।"

"সঠিক উত্তর। কটা বাজে?"

"সাড়ে বারোটা। বাবা মায়ের এখনও দেখা নেই কেন বলতো?"

টুবলু নড়ে বসল, "কোনো বিপদ-টিপদ, মানে সকালে যা হলো…"

"আশ্চর্য কিছু নয়। চল, দেখি গিয়ে।"

"হ্যাঁ, আচ্ছা, ভালো কথা, ওই ওয়েটারটা তোর পকেট থেকে প্যাকেটটা সরাতে পারেনি তো?"

"না। ওদের অমন দৌড়াদৌড়ি দেখে এ পকেটে রেখে দিয়েছিলাম।"

নিচে নামতেই মোলাকাত হল, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, উত্তেজিত তন্ময়বাবুর সঙ্গে। আইয়ারের সঙ্গে কথা বলছেন। তিতাসদের নামতে দেখে উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন, এবং যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।

"তোমরা ঠিক আছ?"

"পনেরো মিনিট ধরে একটানা মশার কামড় খাওয়া বাদে, পারফেক্ট।"

ওনার একটা ভুরু ওপরে উঠে গেল। "বাবা মা কই?"

"মা সুমনাআন্টি আর আতা-অঙ্কর সাথে বাজারে, বাবা বিট্ঠাল মন্দিরে।"

আরেকটা ভুরু ওপরে উঠে গেল। "তার মানে তোমরা একা?" দুজনেই ঘাড় নাড়ল। তন্ময়বাবু ওদের আবার ওপরে নিয়ে গেলেন, দিয়ে ওদের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। 

" তোমরা এতক্ষন নিশ্চয়ই ইয়ার্কি মারছিলে না? "

তিতাস ওদের তদন্তের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিল তন্ময়বাবুকে। কিন্তু মোলায়েম গলা, আর মূর্থীর কথোপকথনটা পুরোপুরি বলল না। সব শুনে তন্ময়বাবু খুব মন দিয়ে তাঁর অবশিষ্ট দাঁড়িগুলো চুলকাতে লাগলেন। 

" তোমরা শিওর, ওই গলাটা…"

তিতাস বলল যে ওরা দুজনেই একশো ভাগ নিশ্চিত ওই মোলায়েম গলাটা কার।

"আপনি কিন্তু এখনও আপনার কেসটা খোলসা করেননি। রজত কোথায় আপনি জানেন?"

তন্ময়বাবু এবার মাথা চুলকাচ্ছেন। "না, তিতাস, বিশ্বাস কর, ওর প্ল্যানের পুরোটা ও আমাকে বলেনি।"

"তার মানে আপনাদের একটা প্ল্যান আছে?" 

"হ্যাঁ, মানে, একটা কেস...মানে একটা ড্রাগ পাচারকারী চক্র গোটা দেশে ছেয়ে গেছে। তার অন্যতম নোডাল পয়েন্ট হচ্ছে হসপেট, মানে রজত সেরকমই ইনফরমেশন দিয়েছিল আমাকে। সেইজন্যই এখানে এসেছিলাম আমি। কিন্তু কি ড্রাগ, সেটা আমরা জানি না। কারণ এরা সব ধরনের ড্রাগের বিজনেস করে। হেরোইন, কোকেইন, মরফিন...এখানে কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না।"

"আপনার সমস্যার একটা সম্ভাবক উত্তর বোধহয় আমরা দিতে পারব। একটা ক্লু পেয়েছি। আরএই খুনের কেসটার মিসিং লিঙ্কটাকে ধরতে হলে পোস্টমর্টেম রিপোর্টটার আশু প্রয়োজন। সেটা কবে আসবে?"

তন্ময়বাবু বিরস মুখে বললেন, "আর বোলো না! সুবিমল যে কি করছে! ওর কোনো গা নেই এই খুনটা নিয়ে, কালকে খুন হয়েছে, আজকে একটু আগে পোস্টমর্টেমে পাঠিয়েছে। কি বলি বলতো!" তিতাস খুবই অবাক হল। সুবিমলবাবু এই তদন্তের দায়িত্বে আছেন, আর উনি এরকম অবহেলা করছেন কেন? দুজন প্রধান সাস্পেক্টকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আপত্তি, এত দেরিতে পোস্টমর্টেম, বিষটা হয়তো ধরাই পড়বে না!

"বিষ?"

"হ্যাঁ, বিষ। মিঃ মূর্থীর বিষে মারা গেছেন, গুলিতে নয়। এর প্রমাণ ওই রেকর্ডিংটা। আর আমাদের কপাল ভালো হলে,পোস্টমর্টেমেও তাই বলবে। "

"কিন্তু তুমি যা বলছো, একই কেটলি থেকে দুজনেই চা নিয়েছে, তাহলে চায়ে বিষ নেই নিশ্চয়ই?"

"ওটাই তো। বিষটা দিলো কি করে? ওটাই তো বুঝছি না। আপনি তাড়াতাড়ি পোস্টমর্টেম করানোর জন্য আবার বলুন, নাহলে কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই।"

"আর তুমি রজতের ব্যাপারে কি জানো? কি ক্লু পেয়েছ?"

তিতাস গম্ভীর মুখে বলল, "রজতই হলেন মিঃ বালারিয়া।"


(১০)

মিঃ বালারিয়া বলে আদৌ কেউ আছেন কিনা এবার সেটাই সন্দেহ হচ্ছিল তিতাসের। কারণ, এই মুহূর্তে দুজন পুলিশ অফিসার আর দুজন কনস্টেবলের সামনের সোফায় বড়লোকি মেজাজে যে ভুঁড়িওলা, কালো, গোঁফহীন, রোদচশমা পরা ভদ্রলোক বসে আছেন, তিনি কিছুতেই মেকআপ-নেওয়া রজত হতে পারেন না।অন্য কারও মেকআপ নিয়ে পুলিশের সামনে এলে, সবারই কনফিডেন্স কমে যাওয়ার কথা, তা সে যত পাকা ক্রিমিন্যালই হোক না কেন! কিন্তু যিনি বসে আছেন, তিনি সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসী, এবং খুব গুছিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে তিনি খুনের ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গ জানেন না। তাঁর এবং মিঃ সুন্দরমের এতবার মিটিং হয় কেন, আর সেখানে মিঃ যাদবই বা থাকেন কেন, এসবের উত্তরে তিনি কিছুতেই মুখ খুলেছেন না। সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর কথা হল, সুবিমলবাবু খুব যত্নসহকারে অনুপস্থিত খুন সংক্রান্ত প্রতিটি বিষয়ে। এবং তন্ময়বাবু মিঃ সুন্দরম আর মিঃ বালারিয়ার ছদ্মবেশে রজতের কথোপকথন শোনার পর, যখন জানতে পারলেন যে আজ রাতেই ডিল ফাইন্যাল করার জন্যে মিঃ বালারিয়া আর মিঃ সুন্দরম ক্লায়েন্টের সঙ্গে দেখা করবেন, সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্তি একটিও শব্দ ব্যয় না করে বেরিয়ে গেলেন কথোপকথনে উক্ত হোটেল নর্থস্টারে রুম ভাড়া নিতে। সামনে বসে থাকা ভদ্রলোকটি এবং ওনার প্রতিটি কথা এতটাই গা জ্বালানো যে তিতাস আর থাকতে না পেরে উঠে পড়ে বাইরের লনে বেরিয়ে গেল।


"অ্যাই অ্যাই দাঁড়া!" দাদা বেরিয়ে এসেছে। তিতাস নিস্পৃহ মুখে ঘাসের ওপর বসে পড়ল। "তন্ময়বাবুকে বললি যে তুই কি ড্রাগ পাচার হচ্ছে তার ক্লু পেয়েছিস? কি পেয়েছিস?" টুবলু বলে।

"রহুং ধৈর্যং।" 

"বাংলা বল। কি জানিস তুই?" 

তিতাস গতকাল হসপেট স্টেশনে শোনা রজতের সঙ্গে ওই লোকটির কথোপকথনটা দাদাকে বলল। "এবার, আমাদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী রজত হচ্ছেন বালারিয়া। রজত তন্ময়বাবুকে ড্রাগ পাচারের কথাটা বলেছেন। আবার রজতই বলছেন, সাচ্চারাম তিনকিলো গয়া হ্যায়। কিরকম হল ব্যাপারটা? তার মানে রজত এদিকেও আছেন, ওদিকেও আছেন। বালারিয়ার হোটেল নর্থস্টারে গুঁড়ো দুধের প্যাকেটে গড়বড় হচ্ছে। সেটা আবার সুন্দরমের পার্টনার বিজনেস। এদিকে সুন্দরম এবং 'আমরা'- র বাকিরা পুলিশকে এড়িয়ে কারবার করছে। মূর্থী ছিলেন তাদের মাস্টারমাইন্ড। তাহলে কি দাঁড়ালো?"

"মূর্থীর খুন আর ড্রাগ বিজনেস আন্তঃসম্পর্কিত। "

"কারেক্ট। কটা প্রশ্নের উত্তর পেলাম?"

"ঠিক যেগুলোর উত্তর ওই পুলিশ অফিসার বালারিয়ার কাছ থেকে পেলেন না।"

তিতাসের পরিতুষ্ট ভাবটা মিলিয়ে গিয়ে গম্ভীর হয়ে যায়। "কিন্তু এগুলোর প্রমাণ কোথায়? ওরা নিজেরা স্বীকার না করলে কিচ্ছু হবে না।"

"তন্ময়বাবু বোধহয় ওদের আজকে রাতেই হাতে নাতে ধরে ফেলবেন।"

"আর খুনটা? এখনও পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসেনি। আর এই নতুন বালারিয়াই বা কে?"

"ঐটা একটা ভাববার মতো কথা বটে।"

নিজেদের মধ্যে কথা বললেও দুজনের কানই ছিলো ভেতরে চলতে থাকা কথাবার্তার দিকে। সেখানে একটা নতুন গলার আবির্ভাব শুনে দুজনেই উঠে পড়ল। মিঃ সুন্দরম এসেছেন। অফিসারটি তাঁকে বললেন, "আপনার হোটেলে ঘটা এই ঘটনায় এই হোটেল সম্পর্কে অনেক সন্দেহজনক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সেসবের বিষয়ে আপনার পার্টনার কোনো আলোকপাত করতে পারলেন না। আপনি?"

সুন্দরম একগাদা বিরক্তিমাখা স্বরে বললেন, " বিজনেসের কিছু প্রাইভেট বিষয় থাকে স্যার। একজন বাইরের লোক আমাদের হোটেলে এসে খুন হন, এবং সেই সময় আমরা সেখানে উপস্থিতও ছিলাম না! এ বিষয়ে আমাদের ব্যবসার অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ডকে ধরে টানাটানি করে কি লাভ হবে?"

পুলিশটার মুখে একটা ক্রুর হাসি দেখা দিল, "আপনি যদি মুখার্জি স্যারের কথা ধরে বসে থাকেন যে, এ নিয়ে কোনো জলঘোলা হবে না, আপনি ভুল করছেন। রেস্টুরেন্টের ব্যবসায় মিঃ মূর্থীর নাম যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত। তাই ওনার এরকম মৃত্যু যে একটা ইস্যু তৈরি করবে, সেটা আপনার অন্তত বোঝা উচিত। যাই হোক, এখন আসি। মিঃ যাদব এসে পৌঁছলে আবার আসব।"


"এই তিতাস, কি হচ্ছে বলতো? সুবিমলবাবু তো রীতিমতো খুনটাকে চাপা দিতে চাইছেন!"

তিতাস কোনো জবাব দিলো না। তার দৃষ্টি ফলো করে টুবলু দেখলো, গেটের পাশে একটা কালো ইনোভা এসে দাঁড়িয়েছে, আর সেটা থেকে নেমে আসছেন রিতেশ। এসে তিতাসদের বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে উঠে গেলেন ভেতরে। পুলিশ অফিসারটি বেরোনোর উদ্যোগ করছিলেন, রিতেশকে উঠতে দেখে "আরে মিঃ যাদব" বলে সম্বোধন করে আবার ঢুকে গেলেন। 


"তিতাস? অ্যাই!" তিতাস চমকে দাদার দিকে তাকালো। টুবলু রাগী গলায় বলল, "তুই রিতেশের কথা কিছু শুনছিস আদৌ? কোথায় তাকিয়ে আছিস?"

"হ্যাঁ, কি বলছিস?"তিতাস অন্যমনস্ক ভাবে বলে। টুবলু অবাক গলায় বলল, "এদিকে একজন প্রাইম সাস্পেকটের ইন্টারোগেশন হচ্ছে, আর তুই উল্টোদিকে মন দিচ্ছিস কেন?"

" সবার প্রতিক্রিয়া দেখছি। বালারিয়াকে দেখ, যেন প্রতিটা কথা কোনো স্ক্রিপ্টের সাথে মেলাচ্ছেন। উঁহু, না, কেমন একটা…"

রিতেশের কথার মাঝখানেই উঠে মালিকের সাথে পাশে আর একটা লনে বেরিয়ে গেলেন বালারিয়া। দাদাকে লাউঞ্জে বসিয়ে রেখে তিতাস বালারিয়াকে ফলো করে সেখানে গিয়ে ওনাদের থেকে সামান্য দূরত্বে ফুলগাছগুলোর ছবি তুলতে লাগলো।

সুন্দরম বললেন, "যা কথা হয়েছিল মনে আছে তো? এখানে কিন্তু কোনো কারসাজি করা যাবে না!"

"কথা? কি, কখন কথা হয়েছিল?" বালারিয়া খুবই বিস্মিত হলেন। 

সুন্দরমও অবাক হয়েছেন। "আজ এগারোটায় তো আমাদের কথা হল, ফোর্থ ফ্লোরের লবিতে বসে আমি আর আপনি ডিল করা নিয়ে ডিসকাশন করলাম, আর আপনি বলছেন.."

বালারিয়ার মুখ সাদা হয়ে গেল। "এগারোটায় আমি এসেছিলাম? কি বলছেন আপনি? আমি তো পৌনে তিনটের আগে পৌঁছইনি। স্টেশনে নেমে তো এখানে এসে দেখলাম পুলিশ আমার জন্য অপেক্ষা করছে!"

তিতাসের হাত পা উত্তেজনায় অবশ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে রজত বালারিয়া সেজে কেন এসেছিলেন? আর এই বালারিয়াই বা কে, যার সাথে রজতের চেহারার এত মিল?

সুন্দরম ভীষণ শক পেয়েছেন। "তার মানে কেউ এসেছিল আজকের ডিলের সব খবর জানতে, তাহলে...তো সব সিক্রেট বেরিয়ে গেল! এবার.."

বালারিয়া টেনশনে মাথার চুল খামচে ধরলেন। হতবাক হয়ে মাথা ঝাঁকাচ্ছেন। এত প্ল্যানিং, এত কিছু, এমনকি দলের লিডারকে খুন করা...সব তো বিফলে যাবে! সুন্দরম একটা বেঞ্চে ধপাস করে বসে পড়লেন। সন্ধে হয়ে এসেছে। বালারিয়া চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুললেন। মাথা ঝাঁকানোর ফলে উইগটা খুলে গিয়ে টাক বেরিয়ে পড়েছে।এই শীতেও দরদর করে ঘামছেন। সন্ধের অস্ত যাওয়া সূর্যের ঢিমে আলোয় তিতাস বালারিয়ার টাকওলা,চশমা ছাড়া, কাঁচুমাচু, অপ্রস্তুত মুখটা দেখতে পেল। এতক্ষন ধরে মাথার মধ্যে ছারপোকার মতো সবচেয়ে অস্বস্তিকর প্রশ্নটার উত্তর এখন তিতাসের চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। এই সহজ উত্তরটা এতক্ষন কেন পায়নি সে?


সকালে ওভাবে বেরিয়ে গিয়ে তন্ময়বাবু সকলকে খুব অপ্রস্তুতে ফেলেছিলেন। সন্ধেবেলায় আর সেটা করলেন না। সন্ধে ছটা নাগাদ সবাই মিলে কাছেই ধারওয়াড় বলে একটা জায়গায় লাইট এন্ড সাউন্ড শো দেখতে যাওয়া হল। শো শেষে ওখান থেকে বেরিয়ে একটা আইসক্রিম পার্লারে ঢোকা হল। এসবকিছু করার উদ্যোক্তা তন্ময়বাবুই। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, তিনি এসব খুন-টুনের ব্যাপারটা সবার মাথা থেকে সরাতে চাইছেন। আইসক্রিম নিয়ে তন্ময়বাবু তিতাস আর টুবলুকে পার্লারের ছোট্ট ব্যালকনিটায় ডাকলেন।

"অনেক তাগাদা দেওয়ার পরে পোস্টমর্টেম হয়েছে অবশেষে। একটু আগে রিপোর্টটা থানায় এসেছে। ওখানকার ওসি আমাকে সেটা ফরোয়ার্ড করেছেন। মিঃ ত্রিভুবন মূর্থীর মৃত্যু হয়েছে স্ট্রিকনিন নামক একটি বিষে, তিনটে পনের নাগাদ। গুলির ক্ষতটা ডাক্তার আসার মাত্র চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগে হয়েছিল। মানে-"

"মানে চারটে নাগাদ।"

"একদম তাই। তোমার কথাটা মিলে গেছে। কিন্তু, গুরুত্বপূর্ণ এই যে, খুনটা করল কে? আর...আর ওখানে রেকর্ডারটাই বা রাখলো কে? বাই দ্য ওয়ে, তোমরা আজকে বালারিয়া আর রিতেশ যাদবের কথাগুলো শুনলে?"

"দুজনেই মুখস্ত বুলি আউড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আইয়ার একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু চেপে যাচ্ছেন।"

"আইয়ারকে চেপে ধর। ও কিছু একটা জানে। আর রিতেশ যাদব…"

"কী?"

"ছেলেটার রেকর্ড ক্লিন। কিন্তু এই সুন্দরম আর বালারিয়া, দুজনেরই পুলিশের খাতায় হাল্কা নাম আসতে আসতেও আসেনি। তোমরা ওর ব্যাপারে শিওর?"

"ও মূর্থীর সেক্রেটারি ছিল!"

"হ্যাঁ, কিন্তু মাত্র ছমাস আগে কাজে ঢুকেছে!"

"আর রজত আপনার সাথে যোগাযোগ কবে থেকে করছে?"

"সেও তো ওই পাঁচ-ছ মাসই হবে। কেন বলতো? তুমি কি রজত আর রিতেশের.."

তিতাস কোনো জবাব দিলো না। মায়েদের খাওয়া হয়ে গেছে, এখন ডাকাডাকি করছে। সবাই নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো দোকানটা থেকে। 


ডিনার করে সাড়ে আটটার মধ্যে সবাই হোটেলে ঢুকে গেল। তন্ময়বাবু নর্থস্টারে চলে গেলেন। আজকেই ওদের এখানে শেষ দিন। যেহেতু খুন হওয়ার সময় ওরা এখানে ছিল না, তার প্রমাণও তন্ময়বাবু দেখিয়েছেন, তাই ওরা কাল বিকেলেই কলকাতা ফেরার ট্রেনে চাপবে। কিন্তু রহস্যটা যে এখনও উদঘাটন হলো না?

টুবলু ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে 'সাচ্চারাম' নিয়ে পড়লো। তিতাস ভেবেই যাচ্ছে। রজত যদি তন্ময়বাবুকে সাহায্যই করেন, তাহলে ওদের গোকাকে পাঠালেন কেন? তিনি বালারিয়া সেজে এলেন, কেউ ধরতে পারলো না। তিনি সব ইনফরমেশন পেয়ে গেলেন ডিল সম্পর্কে, এবং তারপরে আবার গায়েব হয়ে গেলেন। পাঁচ ছমাসে রিতেশ বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠলেন। তারপর? খুনের সময় তিনি কি করছিলেন? কোথায় ছিলেন? 'ও' টা কে? রেকর্ডারটা ওখানে কে রাখলো? বিষটা কি করে দেওয়া হল? 

দাদা ভীষণ ব্যস্ত। আপনমনে বারবার 'সাচ্চারাম' আউড়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, আবার নিভে যাচ্ছে। রাত বেশি হয়নি। তিতাস ঘর থেকে বেরিয়ে রিসেপশনে এলো। খুনের পর থেকে শিফট চেঞ্জ হয়নি। মাঝেমধ্যে কাউন্টার ফাঁকা থাকছে, আর তা নাহলে আইয়ার বসে আছেন, যেমন এখন। তিতাসকে আসতে দেখে বিধ্বস্ত, ক্লান্ত চোখে তাকালেন ওর দিকে। যেন শেষবারের মতো অনুরোধ করছেন, তাঁকে রেহাই দিতে। তিতাসের খুব খারাপ লাগলো ওনাকে দেখে। কিন্তু কিছু করার নেই। 

আইয়ার বললেন, "আর বোধহয় সব চেপে রেখে কোনো লাভ নেই, না?"

"যেখানে রক্ষকই ভক্ষক, সেখানে তার শেখানো মিথ্যে বললে নিজের প্রাণের ঝুঁকি নেই বটে। কিন্তু যখন রক্ষকেরও রক্ষক সেখানে অবতীর্ণ হয়, তখন পুলিশকে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার অপরাধে হাতে হাতকড়া পড়ার সম্ভাবনা আছে। এবার আপনার ইচ্ছে।"

আইয়ার শূন্য দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বললেন, "যাদের পয়সায় খাই, তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলে আমার পাপ হবে। কিন্তু জেলে গেলে আমার সম্মান যাবে। বেশ, বলছি তবে। মিঃ বালারিয়া আর মিঃ যাদব আসেন দুপুর দুটোয়। মিঃ মূর্থী আসেন দুপুর তিনটেয়। তাঁর আসার একটু আগেই, দুটো পঞ্চান্নয় বেরিয়ে যান শুধু মিঃ সুন্দরম। তারপরে আমি ওপরে আমার ঘরে যাই চারটের সময়, গিয়ে দেখি…"

"কি দেখেন?" তিতাস সোজা হয়ে বসে।

"করিডোরের পিছন দিকের সিঁড়ির দরজাটা, যেটা তৈরি হওয়ার পর থেকে খুব বেশি হলে দুবার ব্যবহার হয়েছে, সেটা খুলে গেল, এবং দেখলাম ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন মিঃ সুন্দরম। হাতে পিস্তল। ঠিক উল্টোদিকের সোফায় বসেছিলেন মিঃ মূর্থী। একা। বাকিরা পৌনে চারটে নাগাদ বেরিয়ে যান । তারপর.." আইয়ার কেঁপে উঠলেন, " এদিকের সিঁড়ির কাছে আমার উপস্থিতি লক্ষ্য করার আগেই তিনি কপালে তাক করে গুলি করলেন মিঃ মূর্থীকে..খুন করলেন ওনাকে। আমাকে মিঃ বালারিয়া বলেছিলেন যদি কোনোভাবে পুলিশ আসে, এবং আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করে, আমি যেন বলি সকলেই তিনটের সময় বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এবং মিঃ মূর্থী দুটোর কিছু পরে এসেছিলেন। কোনোভাবেই যেন কারও আসা বা যাওয়ার সঠিক সময় না বলি।" ভয়ে চোখ বুজে ফেললেন আইয়ার। প্রথমে গুলিয়ে গেলেও একটু পরেই বুঝতে পারলো তিতাস। আইয়ার বিষের কথাটা জানেন না। এবং যেহেতু মূর্থীকে বিষ খাইয়ে মারা হয়েছে, তাই আইয়ারের কথা ঠিক হলে সুন্দরম কোনোভাবেই মোলায়েম গলা হতে পারেন না, তাহলে তার আর দাদার প্রথম ডিডাকশনটা ভুল। 

"আপনার এখান থেকে হোটেলের পিছন দিকে কেউ যেতে গেলে তাকে দেখা যায়?"

"হ্যাঁ। লনের ধার দিয়েই একমাত্র রাস্তা আছে। পিছন দিকে যাওয়ার আর কোনো রাস্তা নেই।" তিতাস ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে পড়ল। সিঁড়ির পাশেই একটা ছোট ঘেরা কিউবিকলের মতো জায়গায় তিনটে কুলার, আর দুটো বড় বড় ব্যারেল বসানো আছে জল ভরার জন্য। সিঁড়িতে উঠতে গিয়ে সেদিকে চোখ পড়ে গেল তিতাসের। প্রথম কুলারের সামনে কোনো জলের পাত্র ছাড়াই দাঁড়িয়ে আছেন সুন্দরম। জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে।


(১১)

থার্ড ফ্লোরে নিজেদের ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে গেল তিতাস। দরজার সামনে একটা মাঝারি সাইজের কার্ডবোর্ডের বাক্স রাখা। দরজা ভেজানো ছিল। তিতাস সন্তর্পণে বাক্সটা টপকে ঘরে ঢুকল। দাদা মুখ কালো করে বসে আছে খাটে। তিতাসকে দেখে বলল, "তন্ময়বাবু ফোন করেছিলেন। ডিল হওয়ার জন্য সকলের মিট করার কথা ছিল আটটা পঁয়তাল্লিশে। আধঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, এখনও কেউ আসেনি। অতএব এটা স্পষ্ট যে, নর্থস্টারের কথাটা যে জানাজানি হয়ে গেছে, সেটা এরা জানতে পেরে গেছে। তাই ডিল ওখানে হচ্ছে না।"

"ওটা তন্ময়বাবুর মাথাব্যথা। আমরা কেন ভাবতে যাব? দরজার বাইরে বাক্সটা দেখেছিস?"

টুবলু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল, আর বলল যে ও তিতাসের জন্য অপেক্ষা করছিল। হোটেলের দেওয়া পাতলা তোয়ালেগুলো হাতে জড়িয়ে বাক্সটা এনে টেবিলে রেখে সাবধানে সেটাকে খোলা হল। ভেতরে একটা কেটলি জাতীয় জিনিস। তফাৎ একটাই, যে নলটা দিয়ে ভেতরের পানীয়টা ঢালা হয়, সেখানে দুটো মুখ। জিনিসটা আর পাঁচটা টি-পটের মতো সাদামাটা নয়। বেশ ঘন পোর্সিলিনের নকশা করা আছে গায়ে। 

"এটা কি রে?" তিতাস অবাক মুখে জিজ্ঞেস করে।

"অ্যাসসিন'স টি-পট।" টুবলু গম্ভীর হয়ে গেছে। সেটা কি জিজ্ঞেস করতে টুবলু বলল, "এই যে দুটো ফুটো দেখছিস, এদুটো দুটো টি-পটের ভেতরে দুটো আলাদা চেম্বারের। একই সাথে দুটো ফুটো দিয়ে ঢালা যায়, কিংবা একটা কর্ক দিয়ে বন্ধ করে অন্যটা দিয়ে ঢালা যায়। কিন্তু এটা এখানে কে এবং কেন দিয়ে গেল?"

"সেটা সময়ের সাথেই উত্তর পাওয়া যাবে। স্ট্রিকনিনের কোনো গন্ধ আছে?"

"না। তুই যা সন্দেহ করছিস,  তার জন্যে টেস্ট করতে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।"

তিতাস  "হুঁ" বলে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। তারপরে টুবলুকে সাচ্চারাম রহস্যের কথা জিজ্ঞেস করল। টুবলু বলল যে উত্তর পেয়ে গেছে, এবং সেটা তিতাসকে বুঝিয়েও দিল। আজকের মত রহস্যে ইতি টেনে দুজনে শোয়ার তোড়জোড় করছে, এমন সময় দরজা থেকে একটু দূরে একসাথে অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ, কারও চাপা গর্জন, একটা গোঙানি, আর এই ফ্লোরেই একটা দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা গেল। সেটা শুনে তিতাস মোবাইলটা জ্যাকেটের পকেটে নিয়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। পিছনে টুবলুও। 

বাইরে বেরিয়ে দেখে সব শুনশান। যেন একটু আগে শোনা শব্দকল্পদ্রুমটা একটা হ্যালুসিনেশন মাত্র। কিন্তু ঘটনা যে বেশ গভীর তা বোঝা গেল বাবা-মা, তন্ময়বাবু, এবং মিঃ রেড্ডি আর মিঃ পিল্লাইয়ের ঘরের দরজায় তালা দেখে। বাবা মায়ের ঘরের কাছে গেলে জোরালো নাক ডাকার আওয়াজ শুনে নিশ্চিন্ত হল তিতাস। তন্ময়বাবুদের ঘরের দরজার আই-হোল দিয়ে নীলচে নাইট ল্যাম্পের আলোয় বিছানায় তিনটে মূর্তির আবছা অবয়ব দেখা গেল। কিন্তু একটা তালারও চাবি তাদের কাছে নেই। ঘটনা যখন এবার তাদের পরিবারের ওপর এসে পড়েছে, তখন বুঝতে হবে যে তারা রহস্যের ক্লাইম্যাক্স-এ চলে এসেছে। 

তাদের ঠিক ওপরতলা থেকে এখনও চাপা কথাবার্তা এবং থেকে থেকে ধমক, মারধরেরও আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। শয়তানের ডেরায় পা দিচ্ছে জেনেও রহস্যভেদ করার দূর্দম্য আকর্ষণে তিতাস আর টুবলু ওপরে গেল। 


ফোর্থ ফ্লোরের করিডোরে আগের দিনই যে নাটকের মঞ্চ সাজানো হয়েছিল, সেই সাজ আজ আর নেই। আজ সবার মুখোশ খুলে গেছে। বেরিয়ে গেছে বিশ্বাসঘাতকতা, লোভ এবং শয়তানির ক্রুর স্বপরিচয়। সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে তিতাস-টুবলু দাঁড়িয়ে পড়ল। মেঝেতে অসহায়ভাবে আইয়ার বসে আছেন। তাঁর ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে। নাক দিয়েও রক্ত পড়ছে। আর সামনে গুলি খাওয়া বাঘের মতো দাঁড়িয়ে আছেন ত্রিলোক সুন্দরম। বর্তমান রঙ্গমঞ্চ থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন মিঃ বালারিয়া এবং রিতেশ। তিতাসরা দাঁড়িয়ে পড়তেই সবকটা চোখ ঘুরে তাদের ওপর ফোকাস হল। আইয়ার হতাশ, সুন্দরম ক্রুদ্ধ,বালারিয়া ক্রুর এবং রিতেশ নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাদের দেখছে। 

বালারিয়া মুচকি হেসে বললেন, "বাবামায়ের ঘরে তালা লাগানোটা কি সুন্দর কাজ দিল, তাই না? আমি জানতাম তোমরা আসবে।"

সবাই চুপ করে ঝড়ের প্রতীক্ষা করছে।

তিতাস আর টুবলু উঠে পড়ল করিডোরে। এখন তারা বালারিয়ার তিনহাতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। টুবলু আড়চোখে দেখলো, তিতাসের মোবাইলের ঠিক ক্যামেরার অংশটাই জ্যাকেটের বাইরে বেরিয়ে আছে এবং এই মুহূর্তে যে ভিডিও রেকর্ডার অন আছে, সেটা বলাই বাহুল্য।

বালারিয়া বললেন, "আমার মনে হয় তন্ময় তোমাদের বারণ করেছিল এসবের মধ্যে জড়াতে? মনে হয় কেন বলছি, আমি শিওর। আসলে কি মুশকিল বলতো, তোমরা ভাব তোমরা সব ভালো জানো, ভালো বোঝো। বড়দের থেকেও বেশি বুদ্ধি ধরো। কিন্তু তোমরা তোমাদের ডিফেক্টগুলো দেখতে পাও না বা হয়তো চাও না।" বালারিয়ার মুখের হাসি মুছে গেছে। আক্রোশে, ঘৃণায় মুখটা এখন বীভৎস লাগছে। একজন শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত মানুষ যে এতটা ঘৃণ্য আচরণ করতে পারে, ভেবে অবাক লাগল তিতাসের।

"তোমরা ভেবেছিলে রেড্ডির একটা ছোট্ট কাজের জন্য, আর আইয়ারের কনফেশনের জন্য আমাদেরকে হারিয়ে তোমরা জিতে যাবে?" সুন্দরম এগিয়ে এসেছেন। "তন্ময়বাবু হার মেনে নিল, কালকে এখান থেকে তোমরা পত্রপাঠ বিদেয় হবে, এখনও এত জেদ তোমাদের? এতটাই অবাধ্য তোমরা,যে এই শেষ মুহূর্তেও তুমি", তিতাসের দিকে আঙ্গুল তুললেন সুন্দরম, "আইয়ারের কাছে খবর নিতে চলে এলে? এমনকি, রেড্ডির কাছ থেকে ওই রেকর্ডারটাও আদায় করে নিলে? এত সাহস তোমাদের?"

তিতাস এই বিপদেও খুব শান্ত ভাবে বলল, "আপনারা যেভাবে বলছিলেন না, সব প্রশ্নের জবাব দিতে আপনারা বাধ্য নন, ঠিক সেভাবেই আমি বলছি, তালাগুলোর চাবিটা দিন। আমাদেরকে আপনাদের যা বলার বলতে পারেন, কিন্তু কোন সাহসে আমার বাবা মা এবং তন্ময়বাবুর পরিবারের সাথে ঝামেলা করেন?"

সুন্দরম আর থাকতে পারলেন না। এক পা এগিয়ে তিতাসের গালে সপাটে একটা চড় মারলেন। বালারিয়া তার শয়তানি হাসিটা মেখে বললেন, "এখন কি হবে বলতো? তোমাদের দুজনের কপালে দুটো ছোট্ট বুলেট ঢুকে যাবে। কেন জান? কারণ তোমরা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি জানার চেষ্টা করেছ এবং জেনেও গেছ। মিঃ মূর্থী আমাদের সাথে চালাকি করার চেষ্টা করেছিল, তাকেও সরিয়ে দিয়েছি। আর তোমরা বেঁচে থাকলে খুনের রহস্য ফাঁস হয়ে যাবে, তাই তোমাদেরও সরিয়ে দেব।"

চড়ের জোরে তিতাসের ঠোঁট কেটে গিয়ে রক্তের ফোঁটা দেখা দিচ্ছে। তিতাস ভয় পেয়ে গেছে, কিন্তু তাও স্বরে আত্মবিশ্বাস দেখিয়ে বলল, " আপনাদের থেকে আমার বুদ্ধি সত্যিই বেশি। কিচ্ছু করতে পারবেন না। তন্ময়বাবু সব বুঝে গেছেন। উনি খুব তাড়াতাড়ি পুলিশ নিয়ে এখানে এসে যাবেন।" একথা শুনে বালারিয়া অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন। হাসতে হাসতে বললেন, "কে বাঁচাবে? তন্ময়? কিন্তু তার আগে ওকে কে বাঁচাবে? ও তো এখন নর্থস্টারে একটা ছোট্ট খুপরিতে বন্দি। যতক্ষন না আমরা এখান থেকে পালাচ্ছি, ও মুক্তি পাবে না। খুব এসেছিল আমাদের এত নিখুঁত ভাবে লুকানো ড্রাগ চক্র ধরতে। এবার বুঝবে ঠ্যালা!"

সুন্দরম তিতাস আর টুবলুর হাঁটুতে দুটো লাথি মারলেন। টুবলু রেলিং ধরে খাড়া রইলেও তিতাস টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল।

সুন্দরম পকেট থেকে রিভলভার বার করে তিতাসের কপালে চেপে ধরলেন। রিতেশ এগিয়ে এসে টুবলুকে দেওয়ালের সঙ্গে ঠেসে ধরে ওর কপালেও রিভলভার তাক করল। বালারিয়া হেসে বললেন, "আগে তোমরা যাবে, তারপরে এই আমাদের বিশ্বস্ত কর্মচারী মিঃ রঘুনাথ আইয়ারকে আমি নিজে হাতে শেষ করব। তোমাদের প্রতি ওর দরদ একেবারে উথলে উঠেছিল, এখন নিজের বাড়াবাড়ির জন্য তোমাদের মরতে দেখবে। কি দরকার ছিল, আমাকে অমান্য করার, আইয়ার?" উনি আইয়ারের সামনে ঝুঁকে পড়লেন। তারপরে তিতাসদের উদ্দেশ্যে হাসিমুখে বললেন, "গুডবাই!"

সুন্দরম সেফটি ক্যাচ খুলতেই তিতাস তার গোড়ালিতে সজোরে একটা লাথি মেরে উঠে দাঁড়ালো। বুদ্ধিমান ক্রিমিন্যালরা প্রতিপক্ষের আসল দুর্বলতা খোঁজে। লোভীরা বাকিদের আন্ডারেস্টিমেট করে। ইনিও তিতাসকে অসহায় ভাবছিলেন। এটা বোঝেননি, যে তিতাস কেবলমাত্র বালারিয়ার পুরোটা বলার অপেক্ষায় ছিল। একই সঙ্গে, রিতেশ টুবলুর কপাল থেকে রিভলভার তুলে নিয়ে সুন্দরমের পায়ে গুলি চালাল। ঘটনার আকস্মিক মোড়ে হতভম্ব বালারিয়া তাড়াতাড়ি নিজের পিস্তল বার করে আইয়ারকে গুলি করতে গেলেন।

"ভুলেও ওই ভুলটা করবেন না, মিঃ-", পিছনের দরজার কাছ থেকে একটি পরিচিত গলা বলল।

তিতাস রজতের কথাটা শেষ করলো, "মিঃ সুবিমল মুখার্জি, ওরফে মিঃ বালারিয়া!"


ফোর্থ ফ্লোরের করিডোরের লবি এখন জমজমাট। বাবা মা, সুমনাদেবী, আতা-অঙ্ক, মিঃ রেড্ডি, মিঃ পিল্লাই, রজত, রিতেশ, তন্ময়বাবু (ওদেরকে আটকে রেখেই ওনাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়েছে), এবং মিঃ আইয়ার সোফাগুলোতে বসে আছেন, আর উল্টোদিকে দুটো চেয়ারে দুজন কনস্টেবলের পাহারায় বসে আছেন মিঃ সুন্দরম এবং সুবিমলবাবু। তিতাস আর টুবলু এদিকে দেওয়ালের দিকে দুটো সোফায় বসে আছে। 

রজতের ইঙ্গিতে তিতাস বড় একটা স্বাস নিয়ে শুরু করল,"এসবকিছুর মূলে আছেন তন্ময়বাবু।" তন্ময়বাবু নার্ভাস ভাবে হাসলেন।

" সাঁতরাগাছি-চেন্নাই এক্সপ্রেসে প্রথম দিন থেকে ওনার আচার-আচরণ খুব অস্বস্তিকর ছিল। কিন্তু বাঙালির সহজাত প্রবৃত্তির উদাহরণ হিসেবে উনি আমাদের সঙ্গে আলাপ করেন, এবং আমাদের ওনাদের ভ্রমণসূচিতে অংশগ্রহণ করান। তারপরে এখানকার পুলিশের নারকোটিক্স ডিপার্টমেন্টের রজতের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করান একজন বড় আখ ব্যবসায়ী হিসেবে। গোকাক যাওয়ার দিনে স্টেশনে ওনার আর রজতের কথোপকথনের কিছু অংশ দাদা শুনতে পায়। সেগুলো ছিল "কমলাপুর" আর "কলোনি"। তার মানে অবশ্য পরে বুঝেছিলাম। তারপরে, গোকাকে উনি আমাদের বলেন ওনার মিথ্যে পরিচয় নিয়ে আমরা যেন মাথা না ঘামাই। এর পরে, হঠাৎই বলা নেই, কওয়া নেই, উনি দুম করে গোয়ার প্ল্যান চেঞ্জ করে আমাদের সবাইকে নিয়ে হসপেটে এলেন। কারণ ছিল খুন এবং আপাতদৃষ্টিতে রজতের নিরুদ্দেশ হওয়া। 

আসলে কিন্তু এখানে কোনো প্ল্যান চেঞ্জ হয়নি। 

পরে বোঝা যায়, যে রজত আমাদের গোকাক পাঠিয়েছিলেন সঠিক সময়ে ফেরত আনবেন বলেই। গোয়ার গল্পটা স্রেফ ঢপ। কিন্তু যে জন্যে আমাদের ফেরত আসতে হল, সেটা তন্ময়বাবুর হিসেবে ছিল না। রজত খবর পেয়েছিলেন যে সেদিন সন্ধেয় এদের একটা বড় ডিল হবে, এবং ওদের হাতেনাতে ধরার জন্যেই তিনি তন্ময়বাবুকে গোকাক থেকে ডেকে আনবেন। 

কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। হাতেনাতে ধরার জন্য সেই মুহূর্তে স্পটে উপস্থিত থাকার চেয়ে সুবিধাজনক আর কি হতে পারে? গোকাক থেকে হসপেট যথেষ্ট দূরও বটে। তাহলে?

এখানেই আসে রজতের মাস্টারপ্ল্যান। উনি ওনার কাকার সাথে এই ড্রাগ ব্যবসার অন্তর্গত, এটার মূল খুঁজে উপড়ে ফেলবেন বলে। এদের বিশ্বাসে থাকার জন্যে তিনি সবার কাছে তন্ময়বাবুর আসল পরিচয় বলে ওনাকে এখান থেকে সরিয়ে দেন, কিছুক্ষণ পরে ফিরিয়ে আনবেন বলেই, যাতে এই মোক্ষম দাঁওটা মারতে এদিকে কোনো অসুবিধা না হয়। অবশ্য এই পুরোটাই আমার অনুমান।

কিন্তু উনি মিঃ মূর্থীকে খুন করার পরিকল্পনা সম্পর্কে কোনোভাবেই অবগত ছিলেন না। তাই খবর পাওয়ামাত্র উনি তন্ময়বাবুকে খবর দেন, এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা এখানে ফিরে আসি। সুবিমলবাবু তন্ময়বাবুকে দেখে খুবই বিস্মিত হন, এবং পুরোটা ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন রজত নিরুদ্দেশ হয়েছেন বলে। রজত হয়ত হসপেট ছেড়ে এক পা-ও নড়েননি। 

এবার আসি খুনের বৃত্যান্তে।

প্রথমে পুলিশের প্রশ্নে মিঃ সুন্দরম বলেন যে উনি, মিঃ বালারিয়া, এবং মিঃ মূর্থীর সেক্রেটারি মিঃ যাদব ঘটনার সময়ে ঘটনাস্থল থেকে সামান্য দূরত্বে একটি ঘরে দুটো থেকে তিনটে পর্যন্ত মিটিং করছিলেন, এবং তিনটের সময় সকলেই হোটেল থেকে বেরিয়ে যান। মিটিংয়ের বিষয় ছিল মিঃ মূর্থীর লেটেস্ট রেস্টুরেন্ট, যেটা হোটেলের নীচে খোলা হবে, এবং অদ্ভুতভাবে, মিঃ মূর্থী এবং ওনার বিশ্বস্ত সেক্রেটারি একই বিষয়ে, একই সময়ে, একই লোকের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে দেখা করতে এসেছিলেন। তাহলে কি মাত্র ছমাস আগে জয়েন করা সেক্রেটারি অতটাও বিশ্বস্ত ছিল না? মিঃ সুন্দরম এও বলেন যে ওনাদের চারটে হোটেল, কিন্তু আদপে ওনাদের দুটো হোটেল। এত অহেতুক মিথ্যে কথা কেন? 

মিলিয়ে দেখলে দেখা যাচ্ছে, মিঃ সুন্দরম আর মিঃ বালারিয়া, ওরফে সুবিমলবাবু, একই মিথ্যে বলে একে অপরের জন্য অ্যালিবাই দিচ্ছে। কিন্তু মিথ্যেটার মধ্যে অসঙ্গতি অজস্র। ওনাদের বিজনেস মিটিংয়ে মিঃ মূর্থীর সেক্রেটারি কি করেন? আর একই ফ্লোরে একটা মানুষ খুন হয়ে গেল, ওনারা তার বিন্দুবিসর্গও জানেন না?

এই সময় আকস্মিকভাবে আমাদের হাতে আসে একটি মিনি ভয়েস রেকর্ডার। জিনিসটা একটা শ্যাম্পুর শ্যাসের থেকে বড় নয়। সেটা আমাদের দেন এই কেসের একমাত্র ইনোসেন্ট লোক, মিঃ রেড্ডি।" একথা শুনে মিঃ পিল্লাই একটু নড়েচড়ে বসলেন।

"ওটাতে কিছু চাঞ্চল্যকর কথোপকথনের রেকর্ডিং আছে, যেটা পরিষ্কার ভাবে প্রমাণ করে মিঃ মূর্থীর মৃত্যু রিভলভারের গুলিতে নয়, বিষের কারণে হয়েছে। যেটা অবশ্যই পরে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে প্রমাণিত হয়, এবং যে কারণে সুবিমলবাবু এরকম একজন প্রতিষ্ঠিত বিজনেসম্যানের রহস্য মৃত্যুর পোস্টমর্টেম করাতে চূড়ান্ত অনিচ্ছুক ছিলেন। 

এর মধ্যে শ্যাম রেসিডেন্সির পার্টনার বিজনেস হোটেল নর্থস্টারের রেস্টুরেন্টে আমার সাথে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। কফি খাওয়ার সময় আমার কাছে আসে ওনাদের বিজনেসের অন্যতম অস্ত্রটি, যে জাল গুঁড়ো দুধের প্যাকেটে ড্রাগ পাচার করা হত, তার একটি স্যাম্পেল। ওটাতে যে ড্রাগ আছে, সেটা তখনও বুঝতে পারিনি। তবে কিছু গড়বড় যে আছে, সেটা বোঝা গেল, আমার হাতে ওই প্যাকেটটা একজন ওয়েটারের চোখে পড়ার পরে গোটা জায়গাটা জুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হওয়ার কারণে। 

এদিকে, রেকর্ডিং থেকে আমরা জানতে পারি, একজন মোলায়েম গলার অধিকারী মানুষ মিঃ মূর্থীর চায়ে বিষ দিয়েছে। খুব সহজেই আমরা সন্দেহ করি মিঃ সুন্দরমকে। আবার, এই সময় রজত বালারিয়া সেজে মিঃ সুন্দরমের কাছে আসেন আজকের ডিল সম্পর্কে সমস্ত তথ্য আদায় করতে। তখন আমরা বিশ্বাস করেনি রজতই হলেন মিঃ বালারিয়া। কিন্তু সেটাও ভুল প্রমাণিত হয় বিকেলে, সুবিমলবাবু আর সুন্দরমের একটা কথোপকথনে। তখনই আমি ওনাকে চিনে ফেলি। 

তারপরে, দৈবক্রমে আমরা আইয়ারের কাছ থেকে জানতে পারি, যে তিনটের সময় কেবল মাত্র সুন্দরমই বেরিয়ে যান, এবং ফেরেন চারটের সময়, দিয়ে মিঃ মূর্থীর ডেডবডিকে গুলি করেন, আর সেটা আইয়ার দেখে ফেলেন। 

তাহলে কি দাঁড়ালো? মিঃ মূর্থীর চায়ে বিষ দিয়েছেন মোলায়েম গলা, আর তারপরে সিনে আসেন সর্দি বসা ভাঙা গলা। যখন আসল বালারিয়ার জিজ্ঞাসাবাদ হচ্ছিল, তখন উনি দুবার পকেট থেকে ভিক্স লজেন্স বার করে খেয়েছেন। এমনকি, তার পরে সুন্দরমের সাথে কথা বলার সময়েও খাচ্ছিলেন। এখন থেকে আমরা বুঝতে পারছি, রেকর্ডিংয়ে মোলায়েম গলা ও মিঃ মূর্থী বাদে তৃতীয় গলাটা ছিল মিঃ বালারিয়ার, ওরফে সুবিমলবাবুর।

মোলায়েম গলার সাথে বালারিয়া, রজত, রিতেশ, মিঃ রেড্ডি,আইয়ার কারোরই কোনো মিল নেই।  যখন সুন্দরমও বাদ পড়ে গেলেন, তখন গোলমালটা ধরা পড়ল। সুন্দরমের পরে হোটেল থেকে বেরিয়েছেন বালারিয়া আর রিতেশ, যাদের মোলায়েম গলার সঙ্গে মিল নেই। তাহলে? তাহলে খুনি তখন হোটেলেই ছিল। আমরা তখন ছিলাম না। ছিলেন শুধু মিঃ রেড্ডি, আর মিঃ পিল্লাই। 

যখন আমরা মিঃ রেড্ডি আর মিঃ পিল্লাইকে সকালে ওনাদের অমন অদ্ভুত আচরণের কারণ জিজ্ঞেস করতে গেলাম, আমরা হিন্দিতে কথা বললেও মিঃ পিল্লাই আমাদেরকে অত্যন্ত রুক্ষ ও কর্কশ ভাবে তামিলে কিছু বললেন। বোধহয় ওখান থেকে চলে যেতেই বলেছিলেন। পরক্ষণেই, তাঁর এই আচরণের একেবারে বিপরীত আচরণ করেন মিঃ রেড্ডি। তিনি ভদ্রভাবে আমাদের রেকর্ডারটা দেন, এবং বলেন যে ওটা শুনলেই আমরা বুঝতে পারব কেন ওনারা অত ভয় পেয়ে পালাচ্ছিলেন। তাহলে কি দাঁড়ালো? মিঃ পিল্লাই রেকর্ডিং শুনে ভয় পেয়েছিলেন, পালানোর চেষ্টা করেছিলেন, ওনার স্বাভাবিক গলা আমাদের শুনতে দেননি,ইচ্ছে করে আমাদেরকে ওনার তামিল পরিচয়, এবং হিন্দি বলতে পারেন না, নিজের এরকম একটা ইমেজ আমাদের সামনে খাড়া করার চেষ্টা করেছেন। মোলায়েম গলার সাথে মিঃ রেড্ডির গলা কোনোমতেই মেলে না। আর, যার সাথে মেলে, এমন কোনো গলা আমরা শুনিনি। কিন্তু খুনি হোটেলেই ছিল। তাহলে, সব তথ্য মিঃ পিল্লাইকেই খুনি হিসেবে চিহ্নিত করছে। যদিও মিঃ রেড্ডি ওটা শুনেছেন, আমার মনে হয় উনি স্বপ্নেও ওনার বন্ধুর এরকম একটা কানেকশনের কথা ভাবতে পারেননি। অতএব, উপসংহার হল, ড্রাগ বিজনেসের বর্তমান মাথা হল সুবিমল মুখার্জি এবং ত্রিলোক সুন্দরম, আর খুন করেছেন মিঃ পিল্লাই।" 

পিল্লাই সোফা থেকে লাফিয়ে উঠলেন, "মিথ্যে! এদের মতো দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে যা বলছে, সেটাকে আমরা এতক্ষন ধরে শুনছি এবং বিশ্বাস করছি কেন? এরা কি পুলিশের থেকেও ভালো জানে নাকি? আমি আর রেড্ডি সম্পূর্ণ নির্দোষ! আমাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই। শুধুমাত্র কয়েকটা ধারণা এবং অনুমানের ওপর বেস করে এরা এত বড় অপবাদ আনছে আমার ওপর। আপনারা কেউ প্রতিবাদ করছেন না কেন?"

টুবলু হেসে বলল, "ঘটনাচক্রে আমাদের কাছে খুব সলিড প্রমাণ আছে আপনার বিরুদ্ধে। যে অ্যাসসিন্স টি-পট দিয়ে আপনি খুন করেছিলেন, সেটা আমাদের হাতে এসে গেছে, এবং তাতে স্ট্রিকনিনের ট্রেস এবং আপনার হাতের ছাপ পাওয়া গেছে।"

পিল্লাই ভীষণ উত্তেজিত হয়ে তড়বড় করে বলে উঠলেন, " হতেই পারে না ! এরকম হতে পারে না! ওটা থেকে আমি সব হাতের ছাপ মুছে দিয়েছিলাম, আর… রিতেশকে দিয়ে দিয়েছিলাম ওটা ডেস্ট্রয় করে দেওয়ার জন্যে। আমি-" বলেই নিজের ভুলটা খেয়াল হল পিল্লাইয়ের। দু হাতে মুখ ঢেকে সোফায় ধসে পড়লেন তিনি।

রেড্ডি বললেন, "বাট হু ইজ রিতেশ? ও তো এদের বিজনেসে ছিল! ও কেন এই খুনটা ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো?"

এর উত্তর রিতেশ নিজেই দিলো, "আমি নারকটিক্স ডিপার্টমেন্টে মুখার্জিস্যারের আন্ডারে চাকরি করি। আমরা প্ল্যান করে একসাথে আলাদা আলাদা পরিচয়ে এদেরকে খুঁজে বের করে এদের বিজনেসে ঢুকে এদের বিশ্বাসযোগ্য হয়ে এদের ভেতরের খবর জোগাড় করার চেষ্টা করি। কিন্তু, কমলাপুরের হিপি কলোনি এদের মূল খদ্দের, এটুকু বাদে আর কিছুই পাইনি। তারপর স্যার নিজেই ফিল্ডে নামলেন। তখন আস্তে আস্তে খবর বেরোতে লাগলো। আর, সোফার তলায় ওই রেকর্ডারটা আমিই সেদিন রেখেছিলাম। কারণ ক্লায়েন্টের সাথে কথাবার্তা ওখানেই হওয়ার কথা ছিল। আর আজকে তিতাসদের ঘরের সামনে ওই টি-পট টাও আমিই রেখে এসেছিলাম। বাক্সে আমার হাতের ছাপ পাওয়া যাবে।"

রেড্ডি বললেন, "কিন্তু ওদের কাছে যখন ইনফরমেশন ছিলই, তাহলে ওরাই তো এদেরকে ধরিয়ে দিতে পারত। আর, টাইমিংটা নিয়ে এরকম গোলমাল করলো কেন?" 

তিতাস মাথা নেড়ে বলল," তা হতো না। কারণ দুটো। এক, এরা তো ওনাদের আসল পরিচয় জানতো না। তাই এদেরকে ধরিয়ে দিলে, এরা ওদেরকে নিয়েই ডুবত। তখন রজত আর রিতেশের যে এই ব্যবসার সঙ্গে যোগ নেই, সেটা কে বলতো? দুই, কি ড্রাগ পাচার হচ্ছে সেটা ওনারা জানতেন না। শুধু ড্রাগের কোডনেমটা জানতেন। সেটা থেকে কিছু উদ্ধার করা একরকম অসম্ভব।তাই ড্রাগই যে পাচার হচ্ছে এটা প্রমান করা শক্ত হত। আর আসছে টাইমিংয়ের ব্যাপারটা। আমার ধারণা, ওটা করা হয়েছিল পুলিশকে গুলিয়ে দেওয়ার জন্য। কারণ সবাই যদি একসাথে একটা জায়গা থেকে প্রেজেন্ট এবং অ্যাবসেন্ট থাকে, তাহলে নির্দিষ্ট কাউকে চিহ্নিত করা খুব কঠিন।"

"কিন্তু কি ড্রাগ পাচার হচ্ছে সেটা তো আমরা এখনও জানি না", তন্ময়বাবু বললেন।

এবার টুবলুর পালা। সে বলল, "সেটা জানা গেছে। গোকাকে যাওয়ার দিন হসপেট স্টেশনে ঘটনাক্রমে তিতাস রজত এবং সম্ভবত বিজনেসের কোনো কর্মচারীর কথোপকথন শুনতে পায়। তা ছিল, সাচ্চারাম তিন কিলো পৌঁছে গেছে। এবারে, যদি সাচ্চারাম মানুষ হয়ে থাকে, তাহলে কোনোমতেই সে তিন কিলো পৌঁছতে পারেনা। তাহলে সাচ্চারাম কোনো দ্রব্য। আমরা আজ রাত পর্যন্ত জানতাম রজত আখ ব্যবসায়ী। তাহলে কি সাচ্চারাম আখ? দেখা যাচ্ছে, সেটা মিলে যাচ্ছে, কারণ আখের সায়েন্টিফিক নেম হলো Saccharum officinarum, যেটা পাতি হিন্দিতে উচ্চারণ করলে Saccharum টাকে 'সাচ্চারাম' ও বলা যায়। কিন্তু, এখানেও গড়বড়। এক, আখ ব্যবসায়ী খামোখা আখের সায়েন্টিফিক নেম দিয়ে কাজ করবে কেন? আর দুই, যদি আখ ক্ষেত থেকে ফ্যাক্টরিতে যায়, বা অন্য কোন প্রসেসিং ইউনিটে যায়, সেটা তো কুইন্টালে যাবে। তিন কিলো যাবে কোন দুঃখে? তাহলে তো সাচ্চারাম আখ নয়।

আখের ইংলিশে নাম হল Sugarcane। এবং দ্রব্যটা যেহেতু আখ নয়, এবং কোনোমতেই চিনির ফ্যাক্টরিতে যাচ্ছে না, তাই আমরা 'Sugar' টা বাদ দিচ্ছি। তাহলে পড়ে রইল 'cane'। সেটা কোনো গোপনভাবে পাচার হওয়ার জিনিস নয়। আর যেহেতু ততক্ষনে তন্ময়বাবুর কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে এরা ড্রাগ পাচার করে, এবং রজতের সঙ্গে এদের সম্ভাব্য একটা যোগাযোগ ও জানতে পেরেছি, তাই 'cane' টা 'caine' খুব তাড়াতাড়িই cocaine এ পৌঁছে গেলাম। এরা কোকেইন পাচার করে।"

ডিডাকশন শুনে তন্ময়বাবু, রজত, রেড্ডি আর বাবা হাততালি দিয়ে উঠলেন। তন্ময়বাবু বললেন, "কিন্তু একটা জিনিস এখনও আমার মাথায় ঢুকছে না। পিল্লাই যদি মূর্থীকে খুন করবে বলেই এসে থাকে, তাহলে রেড্ডিকে নিয়ে এল কেন?"

তিতাস একটু ভেবে বলল, "আমার ধারণা, সেটা শুধুমাত্র কভারের জন্য। আসল কারণটা অবশ্য উনিই বলতে পারবেন। এই প্ল্যানটা অনেকদিন আগে থেকেই হচ্ছিল, কারণ এরমধ্যে এক বা একাধিক 'ইম্পরট্যান্ট ক্লায়েন্টের'ও গল্প আছে। সে সব ব্যবস্থাপনা কয়েকদিনের মধ্যে হওয়ার নয়। সুবিমলবাবু আর সুন্দরম শুধু হসপেটের কারবারটাই সামলাতেন। পিল্লাই মোস্ট প্রব্যাবলি বাইরের নোড গুলোতে গিয়ে কাজ করতেন। এবং, ওনার আর মূর্থীর কথাবার্তা শুনে মনে হয় ওরা একে অপরের খুবই ক্লোজ এবং বিশ্বাসভাজন ছিলেন।"

রজত উঠে পড়েছেন। অপরাধীদের নিয়ে বেরিয়ে যেতে গিয়েও থমকে গেলেন। তিতাসকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "কিন্তু খুনটা করলো কিকরে?"

"অ্যাসসিনস টি-পট। একটা কেটলির ভেতরে দুটো চেম্বার আছে। যে নলটা দিয়ে পানীয় ঢালা হবে, সেখানেও দুটো গলি আছে। একবারে একটা বন্ধ করে শুধু অন্যটা দিয়ে ঢালা যায়, কিংবা একসাথে দুটো দিয়েই ঢালা যায়। চা ঢালার সময় যে রেকর্ডিংটা হয়েছে, সেটা শুনলে মনে হয় আগে পিল্লাই নিজের চাটা ঢেলেছেন, তারপরে মিঃ মূর্থীর টা। কিন্তু এর মধ্যে যদি কোনো নল বন্ধ করা হতো, তাহলে সেটা মূর্থী লক্ষ্য করতেন। সেরকম কোনো উল্লেখ নেই। তাহলে দুটো ফুটো দিয়েই চা ঢালা হয়েছে। কিন্তু যদি নিচের চেম্বারে বিষাক্ত চা থাকে, তাহলে সেটা পিল্লাইয়ের কাপে পড়লো না কেন? এটা আমি সুস্পষ্ট ভাবে জানি না, কিন্তু যখন আমরা ওটা পেলাম, তখন দেখার পর মনে হলো, যে নিচের চেম্বারে যদি কাপের এক চতুর্থাংশ মতো বিষাক্ত চা থাকে, তাহলে জিনিসটা একটা নির্দিষ্ট অ্যাঙ্গেলে ধরলে তবেই দুটো নল দিয়ে একসাথে চা পড়বে। সেটা পিল্লাই আগেই ঠিক করেছিলেন, যাতে কোনো পরিস্থিতিতেই মিঃ মূর্থী বেঁচে না বেরোতে পারেন। তাই যেহেতু উনি আগে নিজের চা টা ঢেলে উপরের চেম্বারে চা কমিয়ে দিলেন, তারপরে ওটা অনেকটা বেঁকিয়ে চা ঢাললেও সন্দেহ হয়নি। আর, যেহেতু দুটোতেই চা ছিল, তাই খটকার প্রশ্ন আসে না।"

সব শুনে রজত হেসে তন্ময়বাবুকে বলল, "এত ছোট ছোট ছেলেমমেয়েদের মাথায় এত বুদ্ধি খেললে আমাদের চাকরি আর বেশিদিন নেই।"

বিষণ্ন বদনে তন্ময়বাবু মাথা নেড়ে সায় দিলেন।


(১২)

আজকেই বিকেলে তিতাসরা হসপেট থেকে বিদায় নেবে। 'এক সপ্তাহের ছিমছাম শান্তিপূর্ণ ভ্রমণ' সম্পূর্ণ অন্যভাবে কেটেছে। 'শান্তিপূর্ণ'-র থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল ওরা। প্রথমে মিথ্যে পরিচয়ের সহযাত্রী, তারপরে খুন, ড্রাগ পাচার, এবং শেষমেষ অপরাধীদের সাথে ওরকম একটা কনফ্রন্টেশন। মা প্রথমে রেগে গেলেও এখন তিতাস-টুবলুর বুদ্ধি ও সাহসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বাবাতো ভীষণই খুশি। খুশি নয় শুধু আতা আর অঙ্ক। বেড়ানোটা প্রথমে মাটি, তারপরে কাদা হয়ে গেল! সে আর কি করা যাবে! তার বদলে যে দুদিনের টানটান রহস্য, উত্তেজনা, সেগুলো দিয়ে ওই দুঃখ কাটাকুটি হয়ে গেছে! 

অ্যাসাসিনস টি-পটটা আর তিতাসের মিল্ক পাউডারের প্যাকেটটা কাল রাতেই ফরেন্সিকে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট এসে গেলে ওটা স্টেরিলাইজ করে পুরস্কার এবং স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে তিতাসদের পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ওই যে ক্লায়েন্ট আসার কথা ছিল, তার জন্য ওনারা ফাঁদ পেতেছিলেন। যেই না উনি সুন্দরমের দেওয়া সাত কিলো কোকেইনের প্যাকেটটা স্যুটকেসে ভরেছেন, অমনি করিডোরে লুকিয়ে থাকা পুলিশরা ওনাকে ঘিরে ধরে এবং ক্যাচ কট কট। এরকম একটা কেসে এভাবে সাহায্য করার জন্যে রজত যাওয়ার আগে প্রচুরবার ওদের ধন্যবাদ জানিছেন। সুবিমলবাবু, সুন্দরম আর পিল্লাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দুটো হোটেলেই জাল দুধের প্যাকেটে প্রচুর কোকেইনের স্টক পাওয়া গেছে। সকাল সাতটায় নর্থস্টারের সামনে দিয়ে আজকে সত্যি সত্যি বিট্ঠাল মন্দিরে যেতে যেতে তিতাসের একটা কথা মনে পড়ে গেল। ও তন্ময়বাবুকে বলল, "আপনি যে কালকে সকালে এই রেস্টুরেন্টে ওই গুঁড়ো দুধের প্যাকেটটা নিয়ে ঝামেলা হওয়ার পর ছিটকে বেরিয়ে গেলেন, কোথায় গিয়েছিলেন?"

তন্ময়বাবু গাড়ির জানলা দিয়ে সকালের প্রকৃতি দেখছিলেন। তিতাসের প্রশ্নে একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "ওই শীতপোশাকে মোড়া লোকটাকে ফলো করছিলাম। রয়্যাল এনক্লোসারের জঙ্গলের মধ্যে জৈন মন্দিরের পিছনে ওদের যে ঘাঁটিটা পাওয়া গেছে, সেটা হয়তো কালকেই পেয়ে যেতাম। কিন্তু ওখানে ঢোকার আগে শহরের বাইরের রাস্তাতেই লোকটা আমার অটোটা, আর আমাকেও দেখে ফেলে এবং ফোন করে বোধহয় ঘাঁটির সকলকে ওখান থেকে ক্লিয়ার করে ফেলার নির্দেশ দেয়। তারপর আরও নির্জনে, রয়্যাল এনক্লোসারের পিছন দিকে, যেখানে কেউ যায় না, সেখানে ঢোকার ঠিক মুখে ও হঠাৎ করে ডানদিকে চলে এসে দ্বিগুন স্পিডে বেরিয়ে যায়। টাল সামলাতে না পেরে আমার অটোর ড্রাইভার স্কিড করে গিয়ে পড়ে রাস্তার ওপর অনাহুত অতিথিদের জন্যে ছড়ানো কাঁচের টুকরো। ব্যাস! টায়ার ফেঁসে সব উল্টে পড়ে গেল। ওই অবস্থা থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায়। আমার সামনে দিয়ে জঙ্গলের ভেতর থেকে দুটো ছোটো ট্রাক উল্কার বেগে বেরিয়ে গেল। সেগুলোতে বোঝাই করা প্যাকিংবক্স। আমি কোনোরকমে ফোন করে রজতকে বললাম সমস্ত রাস্তায় ওই গাড়িদুটোর জন্য চেক করতে। ধরা পড়ল বটে, কিন্তু ব্যাটাদের মারধর করে, বাবা-বাছা করে কিছুতেই একটা টুঁ শব্দও বার করা গেল না। একটা বাক্স থেকে নেসলে-র একটা প্যাকেট চেকিংয়ের জন্যে পাঠানো হল, কিন্তু সেতো গিয়ে সুবিমলের পাল্লায় পড়ল। "

তন্ময়বাবু চুপ করে গেলেন। ততক্ষনে বিট্ঠাল মন্দির এসে গেছে। সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে তার চূড়ো। গাড়ি থেকে নেমে সবাই ভেতরে ঢুকল। ভেতরে ঢুকে তিতাস আর টুবলু পাথরের রথটার সামনের পাথরের বেঞ্চটায় বসল। 

তিতাস বলল, "দুনিয়াটাই লোভী আর বিশ্বাসঘাতকে ভরে গেছে।"

টুবলু দার্শনিকের মতো বলল, "কিন্তু কিছু লোক ভালো কাজের জন্যেও মিথ্যে বলে, যেমন তন্ময়বাবু, রজত আর রিতেশ। যাকগে, ওসব ছাড়। এখন বলতো, তুই নিশ্চয়ই এই অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে একটা গল্প লিখবি! কি নাম দিবি? 'একটা শান্তিপূর্ণ ভ্রমণ', নাকি ধর…'রহস্যময় হসপেট', নাহলে… 'হসপেটে খুনখারাপি', কিংবা ধর.."

তিতাস মুচকি হেসে বলল, "হাম্পিতে হইচই।"




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy