Sayandipa সায়নদীপা

Drama Horror

3  

Sayandipa সায়নদীপা

Drama Horror

গণ্ডগ্রামে গন্ডগোল

গণ্ডগ্রামে গন্ডগোল

13 mins
2.3K


দুম… ফটাস….

“আরে রে রে…”

“কি হলো?”

“হেঁ হেঁ চাকাটা গেল মনে হচ্ছে।”

“উফফ কি কুক্ষনেই যে তোমাকে সাথে আনতে গেলাম! ভগবান!”

“প্লিজ সার,বলেছি না নো ফিয়ার হোয়েন ঝিঙ্কু দ্য গাইড ইজ হিয়ার।”

“নিকুচি করেছে গাইডের, তোমাকে আনার চেয়ে আমি যদি নিজেই নিজেকে গাইড করতাম তাহলে বোধহয় অনেক আগেই গন্তব্যে পৌঁছে যেতাম।”

“ এবার কিন্তু ইনসাল্ট হয়ে যাচ্ছে সার; আমি হলাম গিয়ে এখানকার বিখ্যাত শোভন দাশ ব্র্যাকেটে ঝিঙ্কু দ্য টুরিস্ট গাইড আর আপনি কিনা আমাকেই এভাবে গালমন্দ করছেন!”

“টুরিস্ট গাইড না আরও কিছু, বলি এই জায়গাটা ঘুরে দেখতে আবার গাইড লাগে নাকি! যত্ত সব পয়সা কমানোর ধান্দা তোমাদের।”

“সার, হতে পারে আপনি অনেক শিক্ষিত কিন্তু ঝিঙ্কু গাইডকে এভাবে ইনসাল্ট করবেন না বলে দিলাম।”

“ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোমাকে আমি কিচ্ছু বলবোনা যদি তুমি আমাকে ঠিকঠাক ওই গ্রামটায় পৌঁছে দিতে পারো।”

“কিন্তু সার গ্রামটা তো এখনো সাত আট কিলোমিটার হবে, সন্ধ্যে হয়ে এসেছে এমন সময় ওখানে কি করে যাবেন!”

“আমি তো তোমাকে আগেই বলেছিলাম ঝিঙ্কু সকালে চলো কিন্তু তুমিই শোনোনি, সারা সকাল জুড়ে নাকি খুব ব্যবস্থাপনা হচ্ছিল তা এখন কি ব্যবস্থাটা হবে শুনি?”

“আলবাত ব্যবস্থা করেছি সার, নয়তো ওই গ্রামে গিয়ে আপনার মত শহরের বাবু থাকতে পারতো না। হুহ... যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর! আপনি জোনাকি বৌদির ভাই বলেই আপনার জন্য এতো খাটলুম, আপনার থাকা খাওয়ার সব যথাসাধ্য ব্যবস্থা করে এসেছিলুম ওখানে কিন্তু এখন আমার বাইকটা বিগড়ে গেল বলে আপনি এমন করে বলছেন আমাকে!”

“আচ্ছা আচ্ছা আর সেন্টু খেতে হবে না। এখন বলো দেখি কি করা যায়, এই ধূ ধূ প্রান্তর থেকে কিভাবে যাবো আমরা!”

“একটা আইডিয়া আছে সার, বলব?”

“বলে ফেল।”

“বলছি যে আপনি একটু হাঁটতে পারেন যদি তাহলে এখান থেকে এই বাঁ দিকের রাস্তা ধরে এক কিলোমিটার মত গেলে একটা গ্রাম পড়বে, ওখানেই নাহয় আজ রাতটা থেকে যাওয়া যাবে। কাল সকালে হলে কারুর সাইকেল নিয়ে আমি মেকানিক খুঁজে আনবো।”

“গ্রামটাতে আগে গেছো কোনোদিনও?”

“আলবাত গেছি সার, এই তো গত বছরে টাউনের একটা কেলাব থেকে শীতের জামা কাপড় দিতে এসেছিল এই গ্রামে, তো তাদের একজন আমাকে চিনতো তো সে বললো ঝিঙ্কুদা আমাদের গাইড করো। তখন আমিও এলাম তাদের সঙ্গে নিয়ে, পুণ্যের কাজ করছে বলে ফ্রিতেই গাইড করেছিলাম।”

“বুঝলাম। তা এখন এক কিলোমিটার হাঁটতে হবে?”

“আর তো উপায় নেই সার।”

“ঠিক আছে, চলো।

“কিহে এবার কোনদিকে, রাস্তা তো এখানে এসে দুভাগ হয়ে গেল!”

“হেঁ হেঁ সার বলি কি যে আমার মনে হচ্ছে যে ডানদিকের রাস্তাটা নেওয়াই ভালো হবে।”

“মানে! তুমি যে বললে আগে এসেছো এখানে তাহলে এখন এসব মনে হচ্ছে টচ্ছে কি কথা?”

না মানে… আমি জানি ডানদিকের রাস্তাটাই ঠিক হবে।”

“চলো তাহলে, এরকম দোনামনা করছো কেন?”

“নাঃ দোনামনা নয়… চলুন।”

“সার…”

“বলে ফেলো।”

“বলছি যে আমার মনে হচ্ছে সেই গ্রামটা বাম দিকের রাস্তা দিয়ে যেতে হতো।”

“হোয়াট!

হে ঈশ্বর কেন এতো শাস্তি দিচ্ছ আমাকে! কেন এই লোকটার পাল্লায় পড়লাম আমি!”

“সার বলছি এখন কি করবেন, চাঁদও উঠে গেছে, বাইকও খারাপ…”

“এখন কি করবো জানো? তোমার গলাটা টিপে ধরবো, তোমাকে খুন করবো আমি!”

“সে সার আপনি করতেই পারেন, তাতে আমারই সুবিধা। বেঁচে থাকার বড় জ্বালা, মুক্তি পাবো সব থেকে।”

“চোপ, একদম চোপ। আমার মাথা খেওনা আর, আমি চললাম।”

“কোথায় যাচ্ছেন সার? আমার গলা টিপবেন না?”

“উফফ… প্লিজ শাট আপ। আর জ্বালিও না আমাকে, দোহাই তোমায়। অনেক গাইড করেছ, আর না। ওই যে দূরে মনে হচ্ছে একটা আলো দেখতে পাচ্ছি, হয়তো কোন গ্রাম আছে... আমি এখন যাচ্ছি ওখানে। তুমি আসতে চাইলে এসো নয়তো যেখানে খুশি যাও।”

“আরে সত্যিই তো সার, আপনার চোখ তো দারুণ। এতো দূর থেকে দেখতে পেয়ে গেলেন! চলুন যাওয়া যাক।”

“দাঁড়ান, চললেন কুথা?” সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে দেখে বিষম খেলো নিলোৎপল, তবে ঠিক লোকটাকে দেখে নয়, ওর চোখ দুটো দেখে। ছোটবেলায় দুধ খেতে না চাইলে মা আগুন চোখের ভয় দেখাতেন, আগুন চোখ কি তাহলে একেই বলে! ঝিঙ্কু আগেভাগেই গিয়ে লুকিয়েছে নীলের পেছনে, অগত্যা নীলকেই তাই আমতা আমতা করে বলতে হলো, “আজ্ঞে আমাদের ধুলান্ডি গ্রামে যাওয়ার কথা ছিল, মাঝপথে বাইকটা খারাপ হয়ে গেল তাই…”

“ধুলান্ডি ক্যান? আজকাল দেকি শহরের বাবুরা সব আমাদের গরিবী দেকতে আসে, যেন কোনো সিনিমা দেকাই আমরা।”

লোকটার কথা শুনে মাথা গরম হয়ে গেল নীলের, আগুন চোখ দেখে সেই প্রাথমিক ভয়ের ভাবটাও এখন কেটেছে খানিকটা তাই এবার দৃঢ় গলায় সে জবাব দিলো,

“দেখুন কে কি করে আমার জানা নেই তবে আমি একটি এনজিওতে কাজ করি এবং সেই এনজিওর তরফ থেকেই আমাকে পাঠানো হয়েছে ধুলান্ডি এবং ওর আশেপাশের কিছু গ্রামের মানুষদের শারীরিক অবস্থা, জীবনযাত্রা নিয়ে একটা রিপোর্ট তৈরি করতে যাতে তার ওপর ভিত্তি করে মানুষগুলোর দিকে আমরা প্রয়োজনীয় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারি।”

“ছার শুদু ধুলান্ডি ক্যান, আমরাও যে বড় দুখে আছি। একবার এসে দেকে যান।”

লোকটাকে প্রথম দেখে যতো না চমকেছিল এখন ওর এই আচমকা রূপ পরিবর্তনে তার থেকে অনেক গুণ বেশি চমকালো নীল, যার ফলে চট করে কোনো জবাব এলো না মাথায়। লোকটা এবার হঠাৎ করে মাথা ঝুঁকিয়ে হাত জড়ো করে বললো,

“ছার এসেই যকন পড়িচেন তখন এই গরিবের গাঁয়ে এগটা রাত কাটিয়ে দেই যান। ভালোমন্দ খেতে দিতে পারবনি কিন্তু গরিবের ঘরে যা আছে তাই দে আপনারে সেবার কোনো তুরুটি রাখবনি ছার, এই কতা দিলাম।”

নীল এবার বেশ কায়দা করে বললো,

“আমি এখানে ভালোমন্দ খেতে আসিনি মশাই, আমি আপনাদের মাঝে মিশে আপনাদেরই একজন হয়ে আপনাদের জন্য কাজ করতে এসেছি।”

“ওগো ছার গো চোকে জল এনে দিলেন।”

এই বলে লোকটা টপ করে একখানা প্রণাম করে ফেললো নীলকে, নীল চমকে উঠে দুপা পিছিয়ে গেল।

গ্রামের মধ্যে ঢুকেই লোকটা হাঁকডাক শুরু করলো, তার ডাকে ছোটো ছোটো কুঁড়ে গুলো থেকে বেশ কিছু নারী পুরুষ বাইরে বেরিয়ে এলো। তাদের উদ্দেশ্যে লোকটা বললো,

“এই যে শুনচিস সব এরা হল আমাদের অতিতি, ভালো করে খাতির করবি এনাদের। যা একন যা এদের খাবার বন্দোবস্ত কর গে।”

আজ পূর্ণিমা, আকাশে গোল হয়ে চাঁদ উঠেছে। গ্রামের বাইরে রাখা একটা খাটিয়ায় বসে চাঁদটার দিকে তাকালো নীল; একটা ন্যাড়া গাছের ডাল এসে চাঁদটার কিছু অংশকে আড়াল করছে। এমন দৃশ্য দেখেই ওর বুকটা আনচান করে উঠলো, আহ এমন দিনে নিজের বিছানায় শুয়ে ভুতের গল্প পড়ার মজাই আলাদা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে গীতশ্রী ম্যাডামের মুখটা মনে পড়তেই চোয়াল শক্ত হলো নীলের, দুষ্ট মহিলা একটা, নীলের ওপর তার এতো রাগ কেন কে জানে! শেষবার যে ডোনেশনটা এসেছিল তারও ঠিকঠাক ভাগ পায়নি নীল। সবই ওই ম্যাডামের চাল। আজ নীলকে যে এরকম একটা গ্রামে এসে ভুগতে হচ্ছে তাও ওনার প্ল্যানের অংশ নিশ্চয়, নীলকে অতিষ্ট করে মারতে চান উনি কিন্তু নিলোৎপল সেনকে জব্দ করা এতোটাও সোজা না। হুহু একটু আগে এই লোকটার সামনে কেমন চমৎকার অভিনয়টা করলো সে, কি সুন্দর ডায়লগ ঝাড়লো… আহ নীল সিনেমা না হোক একবার অন্তত সিরিয়ালে ট্রাই করে দেখতে পারতিস! একটা মেয়ে এসে ঠকাস করে ওদের সামনে দুটো ডিশ রাখতেই নীলের চিন্তার জাল ছিন্ন হলো। বাইরে কোনো আলোর ব্যবস্থা নেই, জ্যোৎস্না আলোয় ঠিক বোঝা গেলনা কি খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। হাত দিয়ে মনে হলো মাছ জাতীয় কিছু হবে, আরেকটা বাটিতে থকথকে কোনো জিনিস। মেয়েটা চলে যেতেই আগুন চোখ বুড়ো এসে হাজির, “খান খান ছার, গরিবের ঘরে এই সামান্য আয়োজন কত্তে পেরেছি। নিজ গুনে মাফ করে দিবেন।”

ঝিঙ্কু নীলের কানে কানে বললো, “সার এদের ঘরে মনে হয় চাল নেই, ভাতের আশা করবেননা, খেতে শুরু করুন।” ঝিঙ্কুর কথায় চমকে উঠলো নীল, এই প্রথমবার এখানের গরীব মানুষগুলোর জন্য সত্যিকারের বুকটা চিনচিন করে উঠলো ওর। ছোটো ছোটো করে কাটা অনেকগুলো মাছের পিস দিয়েছিল ওদের, খেতে গিয়ে নীল বা ঝিঙ্কু কেউই বুঝতে পারলোনা ওগুলো কি মাছ। তবে স্বাদ মন্দ ছিলো না। ওদের খাওয়া শেষ হওয়া মাত্রই বুড়ো এসে হাজির, “খাওয়া হলো ছার?”

“হ্যাঁ হলো। তা আপনার নামটা তো এখনো জানলাম না…” বললো নীল।

“আজ্ঞে আমার নাম হরিহরণ দাস।”

“আচ্ছা হরিবাবু আপনাদের গ্রামের নামটা কি?”

“আজ্ঞে গন্ডগ্রাম।”

নীল আর ঝিঙ্কু একসঙ্গে চমকে উঠলো, “কি?”

“হেঁ হেঁ ঠিকই শুনেছেন, এ গাঁয়ের নাম গন্ডগ্রাম।”

“অদ্ভুত!” বিড়বিড় করল নীল, “আচ্ছা হরি বাবু এদিকে আপনারা ধানের চাষ করেন না?”

“ধানের চাষ করে কি হবে ছার? ভাত মুড়ি তো আমরা খাইনা।”

“মানে! ভাত মুড়ি খাওনা তো কি খাও?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো ঝিঙ্কু।

“এই যে আপনাদের যা খেতে দিলাম।”

“মাছ! কিন্তু এখানে তো কোনো পুকুর নেই, মাছ কোথা থেকে পাও?”

“মাছ কি ছার! হাঃ হাঃ আপনারা বুজতি পারেননি ওগুলা তো হল গিয়া সাপ, সাপ ভাজা।”

“কি! সাপ...!” একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলো নীল আর ঝিঙ্কু। পেটটাও যেন গুলিয়ে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে, বমি বমি পাচ্ছে বোধহয়, মাথা ঘোরাচ্ছে, হাত পায়ের যন্ত্রনা করছে, চোখদুটো টনটন করছে, কান কটকট করছে…

ঝিঙ্কু নীলের কানে কানে বললো, “সার এবার মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি মরে যাব, আপনি গলা টিপবেন বলে টিপলেন না আর এরা খাতির করার নামে বিষ খাইয়ে দিল!”

লোকটা মনে হয় ঝিঙ্কুর কথা শুনতে পেয়েই মুলোর মত দাঁতগুলো বের করে বললো, “ভয় পাবেননি আপনারা, এ সাপের বিষ নাই। আমরা তো পেতিদিন খাই আমাদের কি কিছু হইচে?”

“হয়নি?” অদ্ভুত স্বরে জিজ্ঞেস করলো ঝিঙ্কু।

“আপনি নিজের চক্ষেই দেখুন।”

নীলের ভেতরটা আইঢাই করছে ভয়ঙ্কর ভাবে, যে কোনো মুহূর্তে বমি হয়ে যাবে, সে মিনমিন করে বললো, “বলছি যে টয়লেটটা কোথায়?”

“আজ্ঞে?”

বাম হাতের কড়ে আঙ্গুলটা মুড়ে নীল ইশারা করে দেখালো, লোকটা আবার মুলোর মত দাঁত গুলো বের করে বললো, “বুজিচি বুজিচি…

এই পাঁচু ছারকে একটু নে যা তো।” লোকটা ডাকা মাত্রই একটা ছেলে এসে হাজির হলো সেখানে, ছেলেটাকে দেখেই আঁতকে উঠলো নীল। গোলগাল চেহারার পাঁচুর শরীরের তুলনায় মাথাটা অসম্ভব ছোটো, ঠিক যেন মনে হচ্ছে একটা ফুটবলের ওপর একটা ক্রিকেট বল বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

পাঁচু নীলকে যেখানে নিয়ে এলো সেখানটা গ্রামের বাড়িগুলোর থেকে দূরে একটা ফাঁকা জায়গা মাত্র। এখানে এসেই আগে হড়হড় করে বমি হয়ে গেল নীলের। পাঁচু যেন ব্যাপারটা দেখেও দেখলো না, উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। সারা শরীরটায় অস্বস্তি করছে নীলের, এখানে তো জলও নেই, চোখে মুখে জল দিতে পারলে হয়তো ভালো হতো। দেখা যাক ফিরে গিয়ে একটু জল চেয়ে চোখে মুখে দেওয়া যাবে নাহয়।

“হয়ে গেছে।” হতাশ গলায় বলল নীল। পাঁচু একবার পেছন ফিরে ওকে দেখে নিয়েই হাঁটা লাগাল। এমন ভাবে হাঁটতে লাগলো সে যেন ভীষন তাড়া তার। বাড়ির গুলোর কাছাকাছি এসে নীলের মনে হলো কেমন যেন সাজো সাজো রব পড়ে গেছে সেখানে। খাটিয়া গুলো সরিয়ে রাখা হয়েছে একদিকে, তার একটার ওপর বসে আছে ঝিঙ্কু। নীল গিয়ে ঝিঙ্কুর পাশে বসতেই সে চাপা গলায় বললো, “সার এরা নাকি এখন ক্রিকেট খেলবে।”

“কি!”

“হাঁ সার তেমনই তো বললো…” ঝিঙ্কুর কথার মাঝেই ওরা শুনতে পেল হরিহরণ পাঁচুকে ধমকে বলছে, “এতক্ষণ কোথায় ছিলি হতভাগা? তুই না থাকলে খেলা শুরু করতে পারছিনা যে!”

হরিহরণের কথা শেষ হতেই ওর থেকে চোখ ফিরিয়ে ঝিঙ্কু আবার বললো, “সার আমার না কেমন যেন অস্বস্তি করছে, কিছু গন্ডগোল মনে হচ্ছে এই গণ্ডগ্রামে।” ঝিঙ্কুর কথার কোনো উত্তর দিলো না নীল, ঝিঙ্কু যে একেবারে ওর মনের কথাটাই বলে দিয়েছে।

হঠাৎ দুটো লোক বেরিয়ে এলো একটা ঘর থেকে, তাদের দেখে নীল আর ঝিঙ্কু দুজনেই চমকে উঠলো, এদের তো কোনো মতেই এই গ্রামের লোক বলে মনে হচ্ছে না! বেশভূষা সব অন্যরকম। লোক দুটো এসে যন্ত্রের মতন ওদের পাশের খাটিয়ায় বসে পড়ল। নীল আর ঝিঙ্কু অবাক হয়ে লোকদুটোর দিকে তাকিয়েছিল, এবার সামনে ঘুরতেই চমকে উঠল ওরা, হরিহরণ তার বিখ্যাত মুলোর মত দাঁতগুলো বের করে দাঁড়িয়ে সেখানে, “হেঁ হেঁ ছার ছওরের খেলা তো অনেক দেকেচেন এবার দেগবেন আমাদের গাঁয়ের খেলা কেমন হয়। এগবার দেগলে আর ভুলতে পারবেননি কিন্তু।”

“তাই?”

“হুঁ। আর ওই ভদ্দনোক দুজন হলেন গিয়ে আম্পার।”

“বলছি তোমাদের এখানে টিভি আছে!” জিজ্ঞেস করলো ঝিঙ্কু।

“না তো।”

“তাহলে ক্রিকেট খেলা শিখলে কোথায়?”

“হেঁ হেঁ ভালো পোন্ন কয়েচেন ছার। এহন টিভি নাই, আগে ছিল। ওই যে মধু খুড়াকে দেকচেন, ওর ব্যাটা অনেক নেকাপড়া ছিকেছিল মামাঘরে থিকে। সে চাগরি পেয়ে ছওর থিকে বাপকে একটা টিভি এনে দেয়। কায়েন্ট ছাড়াই বাতারি চলত ছার, তায়েই আমরা খেলা দেকতাম। খুব ভালো লাগতো ছার খেলা দেকতে।”

“তারপর সে টিভি গেল কোথায়?”

“আর বলবেননি ছার, এগবার রাত্তিরে এমন বিষ্টি বজ্জপাত হল যে টিভিটা তো পুড়লই সঙ্গে মধুখুড়ার ঘরেও আগুন লাগে গেল, সেই থিকা পুরা গাঁয়ে…”

“সে কি! তারপর?”

হরিহরণ আর কিছু বলার আগেই কে যেন ডাকলো তাকে। সে নীলদের বললো, “তারপরটা পরে বলবো ছার, এহন খেলা শুরু কত্তে হবে। টিভি যাওয়ার পর আমরা এহন নিজেরাই খেলি হেঁ হেঁ…”

“এক মিনিট, ছেলে মেয়ে সব একসঙ্গে খেলবে?”

“হাঁ ছার, সবাই মিলে খেলি।”

এই বলে হাসতে হাসতে হরিহরণ চলে গেল। নীল মনে মনে বললো,

“স্ট্রেঞ্জ! এরকম একটা গ্রামে এতো মডার্ন মেন্টালিটি যে ছেলে মেয়ে একসাথে খেলে!”

হরিহরণ ফাঁকা জায়গাটার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করার ভঙ্গিতে বললো, “এবার আমরা খেলা ছুরু করব। আজ আমাদের বড় আনন্দের দিন, বহুদিন পর আমাদের খেলা দেকতে ছওরের বাবুরা এইসচেন। সবাই হাততালি দে।” হরিহরণের কথা শেষ হওয়া মাত্রই সবাই নীলদের দিকে তাকিয়ে হাততালি দেওয়া শুরু করলো। এতক্ষণে নীলের একটু ভালো লাগছে, নিজেকে বেশ ভি.আই. পি বলে মনে হচ্ছে। হরিহরণ এবার হাঁক পড়লো, “এই ব্যাট আন রে।” তার কথা শেষ হওয়া মাত্রই একটা ডিগডিগে ছেলে চলে এলো আম্পায়ারদের সামনে। ঝিঙ্কু বিড়বিড় করে বললো, “লোকদুটো তো খালি হাতে বেরিয়েছিল, ওদের কাছে ব্যাট…”

ঝিঙ্কুর কথা শেষ হওয়ার আগেই আর্তনাদ করে উঠলো নীল। ওরা অবাক হয়ে দেখলো, সেই আম্পায়ার লোক দুটোর একজন হাতে করে নিজের পা দুটো খুলে দিয়ে দিলো ডিগডিগে ছেলেটার হাতে। ছেলেটা সেই দুটো হরিহরণকে দিয়ে এসে অপর আম্পায়ারের সরু সরু হাত দুটো খুলে ফেললো, তারপর এক কোণে দাঁড়ানো একজন রোগা মহিলার কাছে গিয়ে তার চারটে হাত পা সব নিয়ে উইকেটের মত করে পুঁতে ফেললো মাটিতে। এই টুকু দেখেই গোঁ গোঁ করে সংজ্ঞা হারালো ঝিঙ্কু। উইকেট মহিলার হাত পা বিহীন শরীরের ওপর বসানো মুন্ডুটা ঝিঙ্কুর অবস্থা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো। হরিহরণ এবার হাঁক পাড়লেন, “পাঁচু বল দে।” বিস্ময়ের শেষ সীমায় পৌঁছে নীল দেখলো অম্লান বদনে পাঁচু দু হাত দিয়ে নিজের মাথাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুলে ফেললো ধড় থেকে, তারপর বল ছোঁড়ার ভঙ্গিতে সেটা ছুঁড়ে দিলো একজনের দিকে, সেও নির্বিকার ভঙ্গিতে লুফে নিল ক্যাচ। এ দৃশ্য দেখার পর আর সহ্য করার ক্ষমতা নেই নীলের, মাথাটা বনবন করে ঘুরছে তার, সেও এবার উল্টে পড়ল ঝিঙ্কুর পাশে।

ক্রিকেট খেলা শেষ হয়ে গেছে বোধহয়, নীল দেখলো হরিহরণ দাঁত বের করে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে ওর দিকে, উফফ কোনো মানুষের হাসি এতো ক্রুর হতে পারে! না না এতো মানুষ নয়, এরা যে আদপে কি কে জানে! ঝিঙ্কু এখনো অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। হরিহরণ এসে দাঁড়ালো নীলের সামনে; ভয়ে ভয়ে নীল জিজ্ঞেস করলো, “ক্ক… কি চাই?”

“আজ্ঞে আপনার মাথাটা ছার।”

“ক্ক...কি?”

“হাঁ ছার, ওটা দেগলুম বেশ চমৎকার ঘুরতি পারে, তাই ভাবলুম লাট্টু বানায়ে খেলবো।” এই বলে হরিহরণ দু’হাতে ধরল নীলের মাথা।

“নাআআআআ…”

ধড়পড় করে উঠে বসলো নীল, গোটা শরীর ঘামে ভিজে গেছে তার। কিন্তু কোথায় হরিহরণ! সামনে তো পুরো ফাঁকা কেউ কোত্থাও নেই… তাহলে কি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল সে? পাশে ঝিঙ্কু অঘোরে ঘুমোচ্ছে। তার মৃদু ঠেললো নীল, কোনো লাভ হলোনা। এবার তাই একটু জোরে ঠেলতেই সে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার করে উঠে বসলো খাটে, তারপর আশেপাশে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললো, “ওরা কোথায় গেল সার? ভুত গুলো কোথায় গেল…?”

“জানিনা।”

“সব কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে সার!” প্রায় কেঁদে ফেলল ঝিঙ্কু। তার কথার কোনো প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে ওপরের দিকে তাকালো নীল, গোল চাঁদটা আলো ছড়াচ্ছে চারিদিকে।

“ওদের আশেপাশে এখন দেখা যাচ্ছেনা ঝিঙ্কু। এই সুযোগ, চলো পালাই।”

“কিন্তু আমার যে মাথা ঘোরাচ্ছে সার!”

“তাহলে শিগগির থামাও তাকে নয়তো কে জানে এরা হয়তো মাথা খুলে এবার লাট্টু বানিয়ে নেবে!”

“আঁ?”

“আঁ পরে করবে এখন ছুট লাগাও…”

এই বলে খাটিয়া থেকে নেমেই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করলো নীল, দেখা দেখি ঝিঙ্কুও ছুটল পেছন পেছন। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পরেই ইলাস্টিকের মত কি যেন এসে জড়িয়ে ধরল ওদের পা, টাল সামলাতে না পেরে দুজনেই আছাড় খেয়ে পড়ল মাটিতে। দেখলো, ওদের পা দুটো টেনে ধরেছে লম্বা ইলাস্টিকের মত দুটো হাত। ঝিঙ্কু আর নীল দুজনেই ভয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, আর তখনই ওদের সামনে এসে উপস্থিত হল হরিহরণ, ওদের পা দুটো ছেড়ে দিয়ে বললো,

“কোতায় যাচ্ছিলেন ছারেরা? আপনাদের তো আর কোতাও যেতে দেবনি আমরা, আপনাদের দেকে আমাদের পাঁচুর এগডা নতুন খেলার কতা মাথায় এইসচে… হেঁ হেঁ… কিরিকেট ছেড়ে এবার আমরা সেই খেলাটা খেলব রোজ… হেঁ হেঁ…”

ঝিঙ্কু ভয়ের চোটে জড়িয়ে ধরল নীলকে, আর নীল অবাক হয়ে দেখলো গোল চাঁদটা যেন ঝপ করে উধাও হলো আকাশ থেকে,

চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল নিশ্ছিদ্র অন্ধকার...

************************************************************************************

“ডিসগাস্টিং… আই হেট ইউ… আই হেট ইউ…”

“কাকে বলছেন ম্যাডাম?”

পাশে দাঁড়ানো নীতিশের কথা শুনে বড় বড় চোখে ওর দিকে তাকালো গীতশ্রী তারপর বিরক্তি ভরা গলায় বললো,

“মাইন্ড ইওর ওন বিজনেস।”

“দেখুন ম্যাডাম একদম মেজাজ দেখবেন না, আপনার জন্য আমাদের আজ এই অবস্থা।”

“তুমি আমাকে দোষ দিচ্ছ? তুমি জানো আমি তোমার কি করতে পারি?”

“কিচ্ছুনা, আপনার জালিয়াতি সব ধরা পড়ে গেছে এখন। নেহাত বসের আত্মীয়া বলে চাকরিটা যায়নি আপনার।”

“ইউ ইউ…”

“আমাকে মেজাজ পরে দেখবেন, আগে নিজের এই ভাঙা হিলটা ফেলুন দিয়ে বলুন কি করা যায় এখন। এই অন্ধকারে… আশেপাশে কোনো গ্রামও তো দেখা যাচ্ছে না।”

“তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছো! আমি কাউকে ছাড়বো না… কাউকে না। ওই নীল এখানে সার্ভে করার নাম করে কোথায় যে উধাও হলো কে জানে! উফফ তোমাকেও আমি ছাড়বো না নীতিশ।”

নীতিশ কোনো জবাব দিতে যাচ্ছিল কিন্তু ওর মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল যখন দেখলো একটা লোক এসে দাঁড়িয়েছে ওদের সামনে। লোকটার চোখগুলো আগুনের মত জ্বলছে যেন, গীতশ্রী ভয় পেয়ে নীতিশের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। লোকটা কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে থেকে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল,

“এদিগে কি মনে করে? পথ ভুলে নাকি?”

“না… মানে হ্যাঁ… মানে আপনি জানলেন কি করে?” ঢোঁক গিলে জিজ্ঞেস করলো নীতিশ।

“হেঁ হেঁ আমরা সব বুজতে পারি। আসুন আমার সঙ্গে, এই তো আমাদের গাঁ।”

নীতিশ আর গীতশ্রী দুজনেই অবাক হয়ে দেখলো একটু দূরেই আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে, আশ্চর্য এতক্ষণ তো চোখেই পড়েনি ওদের।

“আসুন ছার, আসুন দিদিমণি। গরিব লোক আমরা, ভালোমন্দ খেতে দিতে তো পারবনি, তবে একটা চমৎকার খেলা দেখাব আপনাদের, এগবার দেখলে আর ভুলতে পারবেননি।”

“খেলা!” একসাথে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ওরা।

“হাঁ খেলা। আসুন আমার সঙ্গে।”

লোকটার পেছন পেছন গ্রামে ঢুকলো নীতিশ আর গীতশ্রী। বেশ ভিড় এখানে, খেলা উপলক্ষে বোধহয় সব লোক জড়ো হয়েছে এক জায়গায়। ভিড় ঠেলে ওদের এনে লোকটা ওদের বসিয়ে দিল একটা খাটিয়ায়। ওরা দেখলো গাছের সরু সরু শেকড় দিয়ে ভলিবলের নেটের মত একটা জিনিস তৈরি করে টাঙানো হয়েছে, কিন্তু একি! নেটটার দুপ্রান্ত বাঁধা দুটো লোকের সঙ্গে, ওদের দেখে ঠিক যেন মানুষ বলে বোধ হয়না, মনে হচ্ছে যেন দুটো মূর্তি দাঁড়িয়ে! বামদিকের লোকটার মুখে চাঁদের আলোটা এসে পড়ছে সরাসরি, তারদিকে ভালো করে তাকাতেই চমকে উঠলো গীতশ্রী, “নীলল…!”

চিৎকার করে উঠে ওখানেই জ্ঞান হারাল সে।

শেষ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama