গল্পের প্লট
গল্পের প্লট
হরিপদ টেবিলে বসে কলম চেবাচ্ছিল। কিছুতেই মাথায় প্লট আসছে না। প্রকাশক দুবার তাগাদা দিয়ে গেছে। হরিপদ যে খুব বড় সাহিত্যিক- এমন নয়, বরং তার জীবনে ব্যর্থতাই বেশি। প্রকাশকের দোরে দোরে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে পায়ে ঘুণ ধরে গেছিল হরিপদর। অবশেষে যখন তার শেষ গল্পটা বাংলার ভূত সাহিত্যে হইচই ফেলে দিল, তখন প্রকাশকরাই এসে হরিপদর বাড়িতে লাইন দিল। হরিপদ সবাইকে ফিরিয়ে দিয়েছে, ফেরাতে পারেনি শুধু দিবাকরবাবুকে, গত গল্পটা ছাপার আগে তিনটে গল্পের শর্তে সই করিয়ে নিয়েছিলেন দিবাকরবাবু।
কিন্তু হরিপদর এই রাতারাতি সাফল্যের রহস্যটা জানে শুধু হরিপদ। আর জানে নিতাই, নিতাইয়েরই যোগান প্লটটা। সাহিত্যে ব্যর্থ হয়ে হরিপদ সেদিন পুকুরপাড়ে বসে পুকুরটাকে বুজিয়ে একটা মুদির দোকান খোলার কথা ভাবছিল, হঠাৎই নিতাইয়ের আবির্ভাব। সিরিঙ্গে চেহারা, দেখে মনে হয় কতদিন যেন খেতে পায়নি লোকটা।
“দাদা, একটা বিড়ি হবে?”
উদাসীন হরিপদ একটা বিড়ি বাড়িয়ে দিয়েছিল।
বিড়িটা পকেটে রেখে নিতাই হরিপদকে একটু দেখে বলে উঠেছিল, “দাদা কি লেখালেখি করেন নাকি? একটা প্লট আছে, আরেকটা বিড়ি দিলে খুলে বলি।”
হারাবার কিছু নেই, তাই আরেকটা বিড়ি বাড়িয়ে দিয়েছিল হরিপদ। এই বিড়িটাও পকেটে ঢুকিয়ে শুরু করেছিল নিতাই। গল্পটা সদ্য প্রয়াত প্রখ্যাত সাহিত্যিক অমিতাভ চৌধুরীকে কে নিয়ে। “নিত্যানন্দ ,এই আমার মতই, অমিতাভ বাবুকে টাকার বদলে প্লটের যোগান দিত, আর সেই প্লট কাজে লাগিয়ে অমিতাভ বাবু হয়ে উঠেছিলেন বিখ্যাত। কিন্তু নিত্যানন্দ জুয়াড়ি- তাই তার পারিশ্রমিকের চাহিদা বাড়তেই থাকে। এরকমই একদিন, নিত্যানন্দের চাহিদা নিয়ে অমিতাভ বাবুর সাথে বচসা বাধে, এবং টা গড়ায় হাতাহাতিতে। অমিতাভ বাবুর বাড়ির ছাদে দেওয়াল নেই, হাতাহাতিতে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায় নিত্যানন্দ এবং প্রাণ হারায়। বিখ্যাত অমিতাভ বাবু পুলিশের ঝামেলা থেকে বেঁচে গেলেও নিত্যানন্দর প্রেতাত্মা…”
বাকিটা আর বলতে হয়নি নিতাইকে। সত্য আর কল্পনার মিশেল ভুতের গল্পটা বাংলা লেখক মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। এখন তো অনেকে অমিতাভ বাবুর উত্তরসুরি ও বলছে হরিপদকে। কিন্তু দ্বিতীয় গল্পটা কিছুতেই মাথায় আসছে না হরিপদর। আগে বাজে লেখা হলেও মাথায় কিছু আসত, এখন তাও নেই।
মগজে একটু হাওয়া লাগাবার জন্য পুরনো মোটরসাইকেলটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল হরিপদ। শহরের গণ্ডি ছাড়িয়ে হাইওয়ে উঠে অন্যমনস্ক হরিপদ হঠাৎ পিঠে কারুর হাতের ছোঁয়া অনুভব করল। পিছনে তাকিয়ে দেখে –নিতাই, মুখের একটা দিক অদ্ভুতভাবে থেঁতলানো, যেন অনেক উপর থেকে পড়ে গেছে। চোখ বোজার আগে হরিপদ শুনল নিতাইয়ের কণ্ঠস্বর, “দাদা, একটা বিড়ি হবে?”
পরদিন সকালে লিখতে বসার আগে খবরটা পেল মদন। বিখ্যাত সাহিত্যিক হরিপদ নিয়োগী পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন, তার মরদেহ আনা হচ্ছে একাদেমিতে, শেষ শ্রদ্ধা জানাবার জন্য। ভূত সাহিত্যের নতুন এই দিগন্তের আকস্মিক প্রয়াণের খবরে ভিড় কম হয়নি একাদেমিতে। ভিড়ের মাঝে এক কোণে একটা সাদা ফুলের মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল উঠতি লেখক মদন। হঠাৎ কাঁধে এক সিরিঙ্গে হাতের ছোঁয়া- “দাদা একটা বিড়ি হবে?”