গানের সুর
গানের সুর


রমাপদবাবুর এ এক ভারী অদ্ভুত অভ্যেস। জীবনের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে তিনি মনে রাখেন গান দিয়ে। কিভাবে একটা গানের সাথে একটা মানুষ জুড়ে যায়, তার ফর্মুলা অনেক ভেবেও রমাপদবাবু বের করতে পারেন নি। অবিশ্যি আপাত ভুলো মন রমাপদবাবু নিজের এই অভ্যেসের কাছে খুশি মনেই বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন, অন্তত এই সুযোগে তো কিছু মনে পড়ে! নানা রকমের গান রমাপদবাবুর জীবনে তাই বহাল তবিয়তে বিরাজমান। যেমন “চিঙ্গারি কোই ভরকে” শুনলে মনে পড়ে যায় কলেজের বন্ধু সুমনের কথা, মদ খেতে খেতে সুমনের শেষ গান এইটা হত, তারপরই কাউকে কিছু না বলে ঘুমিয়ে পড়ত ছেলেটা। পরীনিতা ছবির “রাত হামারি তো” শুনলে রমাপদবাবুর মনে পড়ে স্ত্রী বিজেতার কথা। বিজেতা যখন রমাপদবাবুর অফিসের পুরনো বস সুদীপ্তর সাথে ঘর ছাড়ল, তখন বহু রাত্রে রমাপদবাবু এই গানটা বারবার শুনেছন। আবার সুদীপ্তর কথা মনে পড়ে “ঝুট বোলে কাউয়া কাটে” শুনলে, সেটা কেন, রমাপদবাবু জানেন না। আশার “মেরা কুছ সামান” শুনলে কলেজের চুমকির কথা মনে পড়ে, চুমকি রমাপদবাবুকে প্রেমের প্রতিবেদন দিয়েছিল, চিঠিতে। উচ্চাখাঙ্খী রমাপদবাবুর তখন প্রেমের সময় ছিল না, না করে দিয়েছিলেন চুমকি কে। চুমকিও আর কোনদিন যোগাযোগ করেনি। তবুও গানটা শুনলে চুমকিকে মনে পড়ে। তারপর কলেজ শেষ করে রমাপদবাবু সরকারি অফিসে চাকরি পেলেন, জীবনে বিজেতা এল, চলেও গেল, রমাপদবাবু যেমন পরাজিত ছিলেন, তেমনই রয়ে গেলেন।
ভালই ছিলেন রমাপদবাবু গান, সুর আর স্মৃতি নিয়ে। বাধ সাধল এক অতি চেনা অথচ ভুলে যাওয়া সুর! মাথার মধ্যে সুরটা গতরাত থেকে ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু রমাপদবাবু কিছুতেই মনে করতে পারছেন না গানটার কথাগুলো। অন্য কোন সুরও আর মাথায় আসছে না। অফিসে গিয়ে দেখলেন রিসেপশনিষ্ট শেফালির কাছে গেলে সুরটা তীব্র হয়ে ওঠে, মাথা ছাড়িয়ে যেন সারা শরীরে বাজতে থাকে। কয়েকবার শেফালির কাছে গিয়ে আবার দূরে গিয়ে পরীক্ষা করেও দেখলেন রমাপদবাবু। লাঞ্চ টাইমে আবার একবার শেফালির টেবিলের দিকে গেলেন, শেফালি নেই, খেতে গিয়েছে হয়তো। মাথার মধ্যে থেকে সেই সুর বেরচ্ছেই না। নিজের টেবিলে গিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলেন রমাপদবাবু। হঠাৎই সুরটা তীব্র হয়ে উঠল, মাথা উঠিয়ে দেখলেন সামনে শেফালি দাঁড়িয়ে হাতে একটা কার্ড – “রমাবাবু, আমার বিয়ে সামনের পঁচিশে, আসবেন কিন্তু”। শেফালি চলে গেল, সুরের তীব্রতা এবার কমল না, বরং বেড়েই চলল। আর সহ্য করতে পারছিলেন না রমাপদবাবু, মনে হচ্ছিল, তিনি পাগল হয়ে যাবেন। দু’হাতে মাথার চুল টানতে টানতে তিনি বের হয়ে গেলেন অফিস থেকে। কোথায় কোনদিকে চলেছেন খেয়ালও নেই রমাপদবাবুর, হঠাৎ মাথার সুর ছাপিয়ে শুনতে পেলেন গাড়ির হর্নের আওয়াজ আর হয়তো নিজেরই আর্তনাদ…
পানের পিক ফেলল সিভিক পুলিশ দুর্জয়, আরও একটা অ্যাকসিডেন্ট ! আজকেও চুমকি রাগ করবে দেরিতে বাড়ি যাওয়ার জন্য। ওদিকে ট্রাফিক সিগনালে বেজে চলেছে “আমার পরাণ যাহা চায়”…