Chandan Chattopadhyay

Horror Thriller Others

3  

Chandan Chattopadhyay

Horror Thriller Others

ঘন্টাকর্ণ

ঘন্টাকর্ণ

13 mins
190


তার আসল নাম ঘন্টেশ্বর দাস। কিন্তু লোকে তাকে ঘন্টাকর্ণ বলে বেশি জানে। মোটা গোলগাল চেহারা, গায়ের রঙ কাল, থাকে বাগবাজার এলাকায়। বাগবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাঠ শেষকরে, শ্যামবাজার এস. ভী. ইন্সটিটিউশন থেকে উচ্চমাধ্যমিক পড়েছে। তার বাবা ব্যাঙ্কশাল কোটের মুহুরী। আসলে কোটের সামনে ঢুকতে গেলে কিছু লোক আছে যারা চারদিক থেকে ঘিরে ধরে, এবং বিভিন্ন প্রশ্নের বাণে জর্জরিত করে, যেমন কি দরকার আছে এভীডেভীট করবেন ?, স্ট্যাম্প পেপার লাগবে?, নোটারি করার আছে?, তা হলে আমার সঙ্গে আসুন। 


ঘন্টেশ্বরের পিতা হচ্ছে এদের মধ্যে একজন। কাজেই তার যে রোজগার খুব একটা বেশি নয় সেটা বলাবাহুল্য বাড়িটা নিজেদের তাই কোনরকমে খাওয়া পরা চলে যায়। বাড়িতে ও তার বাবা-মা থাকে। স্কুল স্পোর্টসে সে প্রায় সব ইভেন্টে নাম দিতো। ১০০ মিটার রেসেতে সবাই যখন কমপ্লিট করত ও তখন অদ্ধেক রাস্তা পার করতে পারে না। এটা তার ভারী শরীর যেমন একটা কারণ তেমনি শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যাও একটা কারণ। ঘণ্টাকর্ণ কখনোই নিশ্বাস প্রশ্বাসকে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। একবার তো ওয়েট লিফটিংএর সময় পিছন থেকে তার প্যান্ট ছিড়ে যায় তাও সকলের সামনে সে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। অবশ্য তখন সে ক্লাস সিক্সে পড়তো। যদি কেউ ওকে বলতো তুই তো কোন বছর কোন স্পোর্টস ইভেন্টে কোন রেঙ্ক করতে পারিস না, তা হলে সব ইভেন্টে নাম দিস কেন। তখন সে একটা খুব সুন্দর জবাব দিত ইভেন্টে অংশ নেওয়াটাই বড় কথা, হারি জিতি সেটা বড়কথা নয়, আজ হারছি কিন্তু অন্যদিন হয়তো জিতবো। হ্যাঁ এটাকেই বলে স্পোর্টসম্যান স্প্রিরিট।


এত সবের মধ্যে তার অংকের মাথা ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার। 

ক্লাসের ছেলেরা যখন সাতের নামতা মুখস্ত বলতে হোঁচট খায় ও তখন সতেরও আঠারও এমনকি কুড়ি পর্যন্ত নামতা এক নাগাড়ে বলে যেতে পারত। এইজন্যে অংকের টিচার বাসুদেববাবুর খুব প্রিয় ছাত্র ছিল। ও যখন ক্লাস এইটে পড়ত তখন ক্লাস নাইনের অংক করতে পারত। ওর মনে হতো যেন অংকের বই দরকার আর অন্যসব বইয়ের কোন দরকারই নেই, বিশেষ করে ইতিহাস। ইতিহাস বইটা তার কাছেএকটা জঞ্জাল ছাড়া কিছু নয়। কে কোন খ্রিস্টাব্দে কি কাজ করেছে তার ফল কি হয়েছে সেইটা আজকে জেনে কি লাভ আছে। আমরা তো সামনের দিকে এগোছি। তাহলে ইতিহাস পড়ে পিছনের দিকে তাকাবার কি দরকার। এ বিষয়ে সে তো একবার ইতিহাস স্যারকে প্রশ্ন করেছিল। 


স্যার বলেছিলেন তোকে যদি নম্বর পেতে হয় তাহলে এটা তোকে জানতে হবে। তাছাড়া ইতিহাস পড়লে তুই পূর্বপুরুষদের কথা তাদের ধ্যানধারণা, চিন্তাধারা এগুলো জানতে পারবি। এটা না জানলে তুই ভবিষ্যতে চলবি কি করে। যাইহোক এইকথা তার কিন্তু মনে ধরে নি। 

অংক দিয়ে সে অনেক সময় অনেককে বোকা বানিয়ে দিয়েছে। তার দু একটা উদাহরণ বলতে পারি। একবার সায়েন্স টিচার আসার আগে সে ব্ল্যাকবোর্ডে দুটো সমীকরণ করে রেখে ছিল কতকটা এইরকমঃ


যদি   0 = 0                              বা, 1 = 1 X 4

বা,  1 X 0 = 1 X 0                          বা, 1 = 4

বা, 1 X (2-2) = 1 X (4-4)                এইটা কি ঠিক ?

বা, 1 X (2-2) = 1 X { (2)2 - (2)2}          আর একটা ছিল

বা, 1 X (2-2) = 1 X (2-2)(2+2)            যদি -2 > -3

         1 X (2-2)(2+2)                   বা, -2 X-2 > -3 X-2

বা,  1 = ---------------               বা, 4 >6

           (2-2)

বা, 1 = 1 X (2+2)               এইটা কি ঠিক ?

 

বিজ্ঞানের টিচার তো এটা দেখে প্রথমে রেগে গেলেন পরে ঘণ্টাকর্ণের বুদ্ধির তারিফ করে ছিলেন। 

 

আরেকবার একটা চায়ের দোকানে বসে,বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিছিল সে একটা প্রবলেম তৈরি করে সেটা সকলকে জানাল।

সেইটা এরকম কোন একটা রেস্টুরেন্টে খাবারের জন্য তিন বন্ধু ঢুকলো খাওয়ার শেষে ওয়েটার তাদের বিল দিল। তিরিশ টাকা হয়েছে। প্রত্যেকে দশ টাকা করে ওয়েটারকে দিল । ওয়েটার তিরিশ টাকা ম্যানেজারবাবুকে দিল। ম্যানেজারবাবু একটু দেখে বললেন আরে ভুল হয়ে গেছে এতে পঁচিশ টাকার বিল হবে। তখন তিনি পাঁচ টাকা ফেরত দিয়ে দিলেন ওয়েটারকে। ওয়েটার ভাবল পাঁচ টাকা কিভাবে তিন জনের মধ্যে কিভাবে ভাগ করব। তার থেকে আমি দুই টাকা নি, বাকি তিন টাকা ওদেরকে ফেরত দি। ওরা এক টাকা করে পাবে।

 এখন প্রশ্নটা হল তিনজন লোক এক টাকা করে ফেরত পেয়েছে। তাহলে তারা নয় (9) টাকা করে দিয়েছে। নয় গুনিতক তিন হল সাতাশ টাকা, তার কাছে আছে দুই টাকা তাহলে উনতিরিশ টাকা। কিন্তু বিল ছিল তিরিশ টাকার। তাহলে এক টাকা গেল কোথায়।

এটা যখন চায়ের দোকানে সবাইকে বলেছিল তখন অনেকেই মাথা চুলকে ছিল, লোকে বলেছিল অংকটা ভুল আর কেউ নানা রকমের উত্তর দিয়ে ছিল। এইরকম ছিল তার বুদ্ধি। 

কিন্তু বর্তমান যুগে কোন একটা সাবজেক্টে বেশি নাম্বার পেলে ফার্স্ট হওয়া যাবে না, অনান্য সাবজেক্ট গুলো সমানভাবে পড়তে হবে এবং ভালো নাম্বার তুলতে হবে। তবেই ফার্স্ট হতে পারবে। সেইজন্য সে কখনোই ফার্স্ট হতে পারে নি তবে প্রথম দশ জনের মধ্যে তার নাম থাকত। তার বাবার রোজগার ভালো নয় তাই সে মাধ্যমিক পরীক্ষার পর থেকেই প্রাইভেট টিউশনি করত। ছোট ছোট ছেলেদের অংক শেখাত। এইভাবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজে আর্টস নিয়ে ভর্তি হয়।


 কিন্তু সে গনিতকে স্পেশাল সাবজেক্টে রাখল। কারন যদি গণিতের কারনে সে কোনরকমে গ্রাজুয়েট পাশ হয়ে যায়। দু বছর পর সে গ্রাজুয়েট হয়ে, এদিক ওদিক চাকরির চেষ্টা করতে লাগলো। কারণ তার মনে হয়েছে চাকরিটা তার একান্ত জরুরী তাহলে সংসারের হাল কিছুটা এড়ানো সম্ভব। সৌভাগ্যক্রমে তার একটা চাকরি জুটে গেল। তার বাবার বন্ধু অ্যাডভোকেট হরনাথচক্রবর্তী কেল্ভিন জুট মিলের লিগ্যাল এডভাইসার। একদিন তিনি বাবাকে বললেন এই কোম্পানির টিটাগড় ফ্যাক্টরিতে একটা পদে চাকরি খালি আছে তোমার ছেলে যদি ইন্টারেস্টেড থাকে তাহলে চাকরিটা হতে পারে। আমি একটা সুপারিশ পত্র লিখে দিচ্ছি ওটা নিয়ে ওখানের ম্যানেজারবাবুকে দেখালে চাকরি হবে। ম্যানেজার বাবুকে আমি একটা ফোন করেও জানিয়ে দেব। বুধবার রাত্তিরে তার বাবা সেই চিঠিটা নিয়ে আসল।


আর বৃহস্পতিবার সকালে ঘন্টাকর্ণ টিটাগড়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

প্রথমেই বাগবাজার থেকে বাসে করে শিয়ালদা তারপর ট্রেনে করে টিটাগড়। শিয়ালদা থেকে প্রায় ২০-২৫ কিলোমিটার রাস্তা মাঝখানে ১০-১১ টি স্টেশন আছে। প্রায় আধঘন্টা ছাড়াই নানা লোকাল ট্রেনআছে। দমদম, বরানগর,পানিহাটি, খড়দহ হয়ে টিটাগড় যাওয়া যায়। স্টেশন থেকে ১০ মিনিট হাঁটা পথ, পার হলেই কেল্ভিন জুট মিলের বড় ফ্যাক্টরি গঙ্গার ধারে, সামনে বিরাট বড় গেট। ভেতরে ঢুকে ম্যানেজারবাবুকে এডভোকেট চক্রবর্তীর লেটারটা দেখাতেই চাকুরী হল। 


পাটশিল্প হল লেবার ইনটেনসিভ বিজনেস এখানে মেশিনের থেকে শ্রমিকের সংখ্যা অনেক বেশি। র’ জুট থেকে ফিনিশড প্রডাক্ট তৈরি করতে অনেক লম্বা প্রসেস। অনেক ধাপ পেরিয়ে তবেই তৈরি হয় চটের থলে, ব্যাগ, দড়ি ইত্যাদি। তাই বর্তমান যুগে কেউই আর নতুনকরে পাটশিল্প নিয়ে বিশেষ ভাবনা চিন্তা করছে না। পাটের পরিবর্তে অন্য অনেক কিছু বেরিয়ে গেছে সেইগুলোই বেশি ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া পাট শিল্পে প্রচুর জলের দরকার, তাইপ্রত্যেকটিকারখানাবড়কোননদীর ধারে হয়েথাকে। পশ্চিমবঙ্গে মূলত গঙ্গা নদীর ধারে পাটশিল্প বেশি দেখা যায়। 


এই কেল্ভিন জুট মিলে প্রায় সাড়ে তিন হাজার শ্রমিক আছে। ঘণ্টাকর্ণ জয়েন করাতে আরো একজন বাড়ল। এই কারখানাটি তিনটে শিফটে চলে। তার মানে ২৪ ঘণ্টা কারখানা চলে। এইশিল্পের আরেকটা অসুবিধা হল বছরের বেশ কয়েক মাস কাঁচামালের অভাব হয় তখন কারখানা বন্ধ রাখতে হয়। আমরা কাগজে প্রায়ই দেখি অমুক জুটমিল বন্ধ হয়ে গেছে। আসলে কাঁচামালের অভাবে তাদের ফ্যাক্টরি বন্ধ রাখতে হয়েছে। কারণ কোন কোম্পানি বসিয়ে বসিয়ে ৩ – ৪ হাজার শ্রমিককে মাইনে দেবে না। 


এই ফ্যাক্টরিতে জয়েন করার সময় সকাল সাড়ে ছ’টা। তাহলে ঘণ্টাকর্ণের পক্ষে বাগবাজার টু টিটাগড় রোজ ডেলি প্যাসেঞ্জারই করা সম্ভব নয়। তাই ওখানে একটা ঘর ভাড়া নিতে হল। সেখানে সে একাই থাকে, শনিবার অর্ধদিবস অফিস করে বাড়ি চলে যায়। আবার সোমবার ভোরবেলায় গিয়ে অফিসে জয়েন করে। সে বাড়িভাড়া নিয়েছে গঙ্গার ধারে প্রতিদিন ভোর বেলা উঠে সে গঙ্গা স্নান করে। তারপর ব্রেক ফাস্ট করে অফিস যায়। আর দুপুরে দেড় ঘণ্টা লাঞ্চ ব্রেক থাকে, তাই দুপুরে রান্না-বান্না করে খাওয়া-দাওয়া করে আবার অফিসে যায়, এবং বিকেল পাঁচটায় ছুটি হয়।


এইভাবে বেশ আনন্দেই দিন কাট ছিল তার। অফিসে সবার সাথে তার সৎভাব। 

মোটা বলে অনেক আড়ালে আবডালে কিছু বললেও, কিন্তু তার সামনে কেউ কিছু বলে না। ঘন্টাকর্ণ বসে লেবার ডিপার্টমেন্টে। ঠিক তার সামনের চেয়ারে বসে বিল্টূ । বিল্টূ (অর্থাৎ বীরেশ্বর ঘোষ) দুজনের বন্ধুত্ব খুব বেশী। জীবনের নানা কথা শেয়ার করে। ছুটির পর একসঙ্গে বেরিয়ে পচাদার দোকানে চা খেয়ে তবে যে যার বাড়ি যায়।

সম্প্রতি একটা অদ্ভুত জিনিস হচ্ছে ঘণ্টা কর্ণের সঙ্গে। রোজ ভোর বেলায় সে টিটাগড় ঘাটে গঙ্গা স্নান করে। সিঁড়িতে তোয়ালে সাবান রেখে শুধু একটা গামছা পড়ে সে নদীতে ডুব দেয়। ৫ সেকেন্ড পরে সে উঠে পরে এইভাবে পর পর তিনটি ডুব দেয়। 


সাধারণত কোন ব্যক্তি যখন জলে ডুব দেয় তখন চোখ নাক বন্ধ করে যাতে করে জল না ঢুকে যায়। আগে সে তাই করত সম্প্রতি তার এক নতুন দৃশ্য দেখার বাসনা হয়েছে। নদীর ভেতরে কি আছে তা দেখতে হবে। তাই সে নাক বন্ধ করলেও চোখ খোলা রাখে। প্রথমদিন সে কিছুই দেখতে পায় না। শুধুই ঘোলা জল। এইভাবে দুটো তিনটে দিন যাবার পর, একদিন সে দেখতে পেল একটা মুখের আকৃতি । যেহেতু সে নিঃশ্বাসকে বেশীক্ষণ ধরে রাখতে পারে না তাই ১০ সেকেন্ডের মধেই জলের বাহিরে এল।

প্রথম ডুবটাতে মুখের আকৃতিটি আবছা। দ্বিতীয় ডুবে সেটা আরও পরিস্কার হলো। আর তৃতীয় ডুবে সেই মূর্তি যেন চোখের ইশারায় তাকে ডাকছে জলের ভেতরে। মুখের আকৃতিটি কার সেটা সে বুঝতে পারল না। তিনটি ডুব দিয়ে সে গঙ্গা থেকে উঠে পরে। প্রথম প্রথম সে ভেবেছিল এটা মনের ভুল। তাই উড়িয়ে দিল। এরপর দ্বিতীয়দিন, তৃতীয়দিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। চতুর্থদিনে এক কাণ্ড হল, ডিপার্টমেন্টের বড়কর্তা একটা নতুন গাড়ি কিনেছেন তাই সবাইকে তিনি লাড্ডূ খাওয়াচ্ছেন। বিল্টূতাকে জিজ্ঞাসা করল কোথা থেকে কিনেছেন। তার উত্তরে তিনি আজকের খবরের কাগজটি এগিয়ে দিয়ে বললেন শেষের পাতা নিচের দিকে একটা বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে দেখ। ওখান থেকে কিনেছি, খুব কম কিস্তিতে। আমাদের টিটাগড়ে এই কোম্পানির একটা শোরুম আছে। কাগজটা নিয়ে বিল্টূ ঘণ্টাকর্ণকে দেখায়। ঘণ্টাকর্ণ পুরো কাগজটা খুলে হতবাক হয়ে গেল। আসলে গাড়ির শোরুমের বিজ্ঞাপনের পরিবর্তে অন্য একটা খবর তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গতকাল ভারতে একজন বিখ্যাত হকি খেলোয়াড় মারা গিয়েছেন। বিল্টূ কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারল না এই খবরটার প্রতি তার এত আকর্ষণ কেন। ছুটির পরে পচাদার চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে ঘণ্টাকর্ণ বিষয়টি খোলসা করল। আসলে ক’দিন ধরে গঙ্গায় ডুব দিয়ে সে একব্যক্তির মুখের আকৃতি প্রত্যক্ষ করছিল, এই সেই ব্যক্তি। 

এই কথা শুনে বিল্টূ হাসিতে ফেটে পরে বলল,” আরে পাগল লোকে চোখ নাক বন্ধ করে জলে ডুব দেয়, তুই কি চোখ খোলা রেখে জলে ডুব দিয়েছিল।

সেবলল,” আগে আমি তাই করতাম সম্প্রতি জলের ভেতরের পরিবেশটা দেখার ইচ্ছা হয় তাই চোখ খোলা রেখে জলে ডুব দি। গত তিন চার দিন ধরে আমি এই ব্যক্তির মুখের আকৃতি জলের ভেতরে দেখতে পাচ্ছি। ও আমাকে চোখের ইশারায় জলের ভেতরে ডাক ছিল”। বিল্টূ মজা করে বলল,“তাহলে এই ব্যক্তি নয় কোন জল পরী তোকে ডাকছে, সাবধান যাবি না কিন্তু”। 

বিল্টূ যতই হাসি ঠাট্টা করুক ঘণ্টাকর্ণের মন কিন্তু মানতে পারল না। পরেরদিন আবার চান করতে গেল কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। তারপর আবার দু চার দিন বেশ নিরুপদ্রেব কাটল। তারপর একদিন অন্য একটা মুখ দেখতে পেল। এটা ঘন্টাকর্ণের পরিচিত, এক চলচ্চিত্র অভিনেতা নাম করা। 

এই চলচ্চিত্র অভিনেতার অনেক সিনেমা ঘন্টাকর্ণ দেখেছে। কাজই অফিসে এসে তাড়াতাড়ি সে বিল্টূকে ঘটনাটি বলল। বিল্টূ বলল, “ চুপ কর এইরকম সন্দেহজনক ভিত্তিহীন কথাবার্তা ছড়ালে পুলিশ তোকে ধরবে”। সে চুপ করে গেল।

এর মধ্যে বিল্টূ একটা যুক্তি দিল তুই একটা কাজ কর তুই ঘরে স্রান কর, বা নদীতে যদি স্রান করতেই হয় তাহলে ঘটি করে জল তুলে মাথায় ঢাল। ডুব না দিলেই তো হল, তা হলে তুই কোন ছবি দেখতে পাবি না। কথাটা ঘণ্টাকর্ণের মনে ধরেছে, তাই সে ঘঠিতে করে জল তুলে মাথায় দিতে লাগলো। কাজেই সে কোন মূর্তি দেখতে পেল না। কিন্তু মনের মধ্যে একটা অজানা আশঙ্কা তার সবসময় কাজ করছে। এত বড় নামি অভিনেতার কি খুব শীঘ্রই মৃত্যু হবে। 

প্রতি শনিবার ঘণ্টাকর্ণ অফিস শেষ করে দুপুর সাড়ে বারো টার মধ্যে বেরিয়ে পরে, বাড়ি যাবার জন্য। তার বাবা মা এই দেড় দিনের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে। তাই শনিবার সে বাসা থেকে রেডি হয়ে, বড় ব্যাগ নিয়ে বের হয়। অফিস করে সোজা টিটাগড় স্টেশন তারপর ওখান থেকে ট্রেন ধরে শিয়ালদা। তারপর শিয়ালদা থেকে বাগবাজার। সোমবার বাড়ি থেকে সোজা অফিস তারপর বিকালে বাসায় যায়। তার রোজকার রুটিন এই ভাবে বাঁধা। আজ শনিবার তাই সে তাড়াতাড়ি তার হাতের কাজ গুছিয়ে টেবিল পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। কারণ সাড়ে বারোটার মধ্যে সে বের হবে। ইতিমধ্যে বিল্টূ এসে খবর দিল সেই অভিনেতা একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। রেডিওর খবরে এখুনি বলল, বিল্টূর কথা শুনে একে অপরের দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। 

খানিক্ষন পরে বিল্টূ বলল,” তাহলে তুই যা দেখ ছিস তা কাক তালীয় নয়, সত্যি”। 

ঘণ্টাকর্ণ, “ না আমার ও তো তাই মনে হচ্ছে”। এর পর ঘন্টাকর্ণ খুব মন মরা ভাবে আজকে বাড়িতে গেল। সে ভাবলো একবার কথাটা বাবা-মাকে শোনাবে তার পর ভাবলো না এই বয়সে উনাদের আর ফালতু চিন্তার মধ্যে জড়াতে চাই না।

রবিবার সকাল বেলা সে ঠনঠনিয়া কালী মন্দিরে গেল। যথা উপাচারে পূজাদিয়ে, মাকে ভালো ভাবে সব কথা জানাল এবং কিভাবে এটা দূর হয় সেটাও তাকে জানাতে বলল। ফের সোমবার আবার পুরানো রুটিন অনুযায়ী ভোরবেলা বেরিয়ে গেল, সকালবেলায় অফিসে পৌঁছালো। সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যেবেলায় আবার বাসায় ফিরে গেল। প্রায় দু সপ্তাহ এভাবে কেটে গেলো, ঘণ্টাকর্ণ আর জলের ভেতরে কাউকে দেখছে না। ইতিমধ্যে একদিন বিল্টূ জিজ্ঞাসা করল আর কোন জলপরী ডাকছে কিনা। 

সে উত্তরে জানিয়ে ছিল না। ঘন্টাকর্ণ অফিসে জয়েন করেছে আজ প্রায় ছ'মাস হতে চলল। এখন আষাঢ়ের শেষ রথযাত্রা হয়ে গেছে। টিটাগড়ের স্কুল মাঠে রথযাত্রা উপলক্ষে একটা বড়মেলা হয়। তারা দুজনে একদিন ছুটির পর মেলা দেখতে গিয়েছিল। সে দিন মঙ্গলবার বিল্টূ অফিসে বসে কাজ করছে, এমন সময় ঘন্টাকর্ণ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল,” ভাই আজ খুব গন্ডগোল হয়ে গেছে”। ইতিমধ্যে বিভিন্ন ধরনের কাজের মধ্যে বিল্টূ এই ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। তাই সে জিজ্ঞাসা করলো, “কি হয়েছে “

ঘন্টাকর্ণ একটু দম নিয়ে নিচু গলায় এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,” আমাদের বড়বাবুর মুখায়ব আজ আমি গঙ্গার মধ্যে দেখেছি”। বিল্টূ ও নিচু গলায় বলল,”এখন তো একদমই চুপ করে থাক বড়বাবু মৃত্যুর খবর তার জীবিত অবস্থায় তাকে জানালে তোকে এক্ষুনি চাকরি থেকে দূর করে দেবে”।

অগত্যা ঘণ্টাকর্ণ নিজের জায়গায় গিয়ে বসে কাজ করতে লাগল। কিন্তু মনটা ভীষন ছটফট করতে লাগলো। তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বিল্টূ বলল, “দাঁড়া আমি একটা কোন কাজ নিয়ে বড়বাবুর কাছে গিয়ে দেখি তার হালচাল কি রকম”। এই বলে ছুটির এপ্লিকেশনের ফাইলটা নিয়ে সে বড়বাবুর কাছে গেল, কাদের ক্যাজুয়াল লিভ দেয়া হবে আর কাদের উইথ আউট পে করা হবে সেইটা জানতে। বিল্টূ গিয়ে দেখল তিনি বেশ হাসি খুশি মেজাজে আছেন, মনে মনে গুনগুন করে গান করছেন। বিল্টূকে দেখে তিনি বললেন, “ এস বিল্টূ বাবু কি খবর”। বিল্টূ যে কাজ নিয়ে এসেছিল সেটা বলল। 

তার উত্তরে তিনি বললেন,” আজতো সবে মাসের কুড়ি তারিখ, মাস শেষ হতে আরো দিন দশেক বাকি। এরমধ্যে যদি কোন লিভ এপ্লিকেশন পরে সে গুলো দেখে নাও সামনের মাসের দু তারিখকে আমি বলে দেবো কাদের উইথ আউট পে হবে”। 

দুর্ভাগ্যক্রমে বড়বাবু এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া আর হয়ে ওঠে নি। সাতাশ তারিখে রাত্রে ঘুমের মধ্যে তিনি ইহলোক ত্যাগ করে পরলোকে যাত্রা করেছিলেন। আটাশ তারিখে সকাল দশটার সময় ম্যানেজারবাবুকে ফোন করে জানান বড়বাবুর ছেলে। অতএব সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাক্টরিতে সাইরেন বেজে গেল, এবং আজকের মত সমস্ত কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ম্যানেজারবাবুও অন্যান্য কিছু সিনিয়ার স্টাফ বড়বাবুর বাড়িতে গেলে তাকে শ্রদ্ধা জানাবার জন্য। বিল্টূ ও ঘন্টাকর্ণ দুজনেই গিয়েছিল। মৃতব্যক্তির মুখ দেখে ঘণ্টাকর্ণের মনে হয়েছিল যেন বড়বাবু তাকে বলছেন তুমি যদি আমাকে আগে থেকে সাবধান করতে তাহলে আমি এইবয়সে আর অতো গুলো লুচি খেতাম না। বড়বাবুর ছেলে ম্যানেজারবাবুকেবলে,” বাবা অফিস থেকে ফিরেছিলেন সুস্থভাবে, রাত্রিরে ডিনার করে শুতে যান, তখনও সুস্থ ছিলেন। কিন্তু রাত্তিরে বোধ হয় ঘুমের মধ্যেই হয়তো স্ট্রোক হয়ে গেছে, আমরা জানতে পারিনি”। খুবই মনমরা ভাবে তারা ফিরে আসল।

তারপর দিন পনের ঠিক ভাবে কাটলো। ইতিমধ্যে শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি হয়ে গেছে, যাকে বলে ভরা শ্রাবণ। গঙ্গা নদী এখন বৃষ্টির ও জোয়ারের জলেভর্তি। একুল ওকুল প্রায় দেখাই যায় না। 

কয়েক দিন ধরেই বিল্টূ লক্ষ্য করলো ঘণ্টাকর্ণের মধ্যে বেশ পরিবর্তন হয়েছে। অফিসে আসে লেট করে। রোজই প্রায় পনের বিশ মিনিট লেট হয়ে যায়। যেহেতু বড়বাবু নেই তাই বাঁচোয়া। নতুন বড়বাবু কবে নিয়োগ হবে তা জানা নেই। বিকালে আর পচাদার দোকানে চা খায় না। ছুটির পর সোজা বাড়ি চলে যায়। আজ শনিবার ঘণ্টাকর্ণের সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়ি যাবার দিন। কিন্তু আজ সে বড় ব্যাগ নিয়ে আসে নি। তাই দেখে বিল্টূ একটু আশ্চর্য হয়ে বলল,”কিরে আজ বাড়ি যাবি না” সে সংক্ষেপে উত্তর দিল, “না”।

যেহেতু শনিবার অর্ধদিবস তাই বেলা একটার মধ্যে ছুটি হয়। ছুটিরপর অফিসের বাইরে বেরিয়ে বিল্টূ বলল, ”চল চা খাবি”। সে বলল, “না বরঞ্চ চল একটু গঙ্গার ধার দিয়ে উত্তর দিকে খানিকটা বেরিয়ে আসি”। বিল্টূ বলল, “ ঠিক আছে চল”। প্রায় আধঘন্টা ধরে তারা হেঁটে গেছে গঙ্গার পাড় ধরে। এখন নদীতে ভরা জোয়ার, মাঝে মাঝে দু-একটা নৌকা বাইছে। টিটাগড়ের ঘাট পারিয়ে তারা প্রায় কাকীনাড়ার ঘাটে পৌঁছে গেছে। ওপারে চন্দননগর সেটাও, প্রায় আবছা হয়ে আসছে, কারণ মেঘ করেছে। এইরকম খানিকটা যেতে যেতে এক জায়গায় তারা দেখতে পেল বেশ কিছু লোকের জটলা।

বিল্টূ বলল,” চল দেখে আসি ওখানে কি হয়েছে” 

ঘণ্টাকর্ণ বলল, “তুই দেখে আয় আমি এই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি”। বিল্টূ গিয়ে দেখল গঙ্গার পারে একটা নৌকা দাঁড়িয়ে আছে। তার থেকে দুজন জেলে একটা মোটা ব্যক্তির লাশ নৌকা থেকে নাবাচ্ছে। লাশটাকে তারা গঙ্গার পাড়ে উপুড় করে শোয়ালো। একজন বললো জেলেদের জালে এই লাশটা উঠেছে। বডির মধ্যে অনেক জল ঢুকে গেছে তাই ফুলে উঠেছে। দেখে তো মনে হচ্ছে দু-তিনদিন আগে ব্যক্তিটা জলে ডুবে মারা গেছেন। 

বিল্টূ জিজ্ঞাসা করল,“ব্যক্তিটি কে সেটা জানা গেছে”। ভিড়ের ভেতর থেকে একজন বলল,”না তবে পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে, আসলে পরে হয়তো জানা যেতে পারে”। লাশের পরনে শুধু একটা গামছা শরীরের উপরের অংশখালি। একজন ব্যক্তি জেলেকে বলল বডিটা সোজা করুন মুখটা দেখলে হয়তো চেনা যেতে পারে। এই এলাকার ব্যক্তি কি অন্য কোথাকার। দুজন জেলে মিলে তাকে সোজা করলো। মুখটা দেখেই বিল্টূ চমকে উঠলো এবং আস্তে আস্তে পিছু হটতে হটতে ভিড়ের বাইরে চলে এলো। আরে এ যে ঘন্টাকর্ণ। তাড়াতাড়ি সে গাছ তলায় গেল, কিন্তু ঘন্টাকর্ণকে কোথাও দেখতে পেল না। এদিক ওদিক চারিদিকে খুঁজল শেষে বিষণ্ণমনে বাড়ী ফিরে এল। 

রাত্তিরে সে স্বপ্ন দেখল যেন ঘন্টাকর্ণ তাকে বলছে ভাই গত কয়েকদিন ধরে আমি গঙ্গার মধ্যে যে মুখটা দেখতে পেয়েছিলাম সেটা আমারই। তোকে কিছু বলিনি। দুদিন আগে চান করতে এসে হঠাৎ আমি পা পিছলে গভীর জলে পরে যাই। তখন ভরা জোয়ার, তাই আর নিজেকে বাঁচাতে পারি নি। কাল তোর অফিসের ড্রয়ারে একটা চাবি ও একটাচিঠি পাবি। চিঠিতে আমি তোকে অথোরাইজড করে দিয়েছি আমার সমস্ত পাওনা টাকা তুলে আমার বাড়িতে পৌঁছে দিবি। আর চাবিটা আমার বাসা বাড়ির, কালকে তুই আমার জিনিসপত্র গুলো বাড়িতে পৌঁছে দিবে এবং বাড়িওয়ালাকে ঘরটা খালি করে দিবি। 

পরেরদিন সকালে বিল্টূ প্রায় এক ঘণ্টা আগে অফিসে এসে হাজির। প্রথমে ড্রয়ার খুলে দেখল একটা চাবি একটা লেটার আছে। এই দুটো দেখে তার চোখ জলে ভরে গেল।

 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror